Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঘুমাতে ভয়! আপনি কি হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত?

ঘুমাতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ বা প্রাণীকূল খুঁজে পাওয়া দুর্লভ বটে, কিন্তু এমন অনেক দুর্ভাগ্যবান ব্যক্তি আছেন যারা কিনা ঘুমাতেই অত্যাধিক মাত্রায় ভয় পান। হ্যাঁ, এটা একধরনের রোগ। ঘুমের অনেক অসুখের মাঝে এই রোগটির নাম অন্তর্ভূক্ত। মেডিকেল টার্মে এই অসুখটি ‘হিপনোফোবিয়া’ নামেই পরিচিত। এছাড়াও এই রোগটিকে কোথাও কোথাও ক্লিনোফোবিয়া বা ওম্নিফোবিয়া নামেও নামকরণ করা হয়েছে।

নামকরণ বা উৎপত্তি

হিপনোফোবিয়া (Hypnophobia) নামটি এসেছে গ্রিক শব্দ হাপনোস (Hupnos) এবং ফোবোস (Phobos) থেকে। গ্রিক ভাষায় হিপনোস শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘ঘুম’ এবং ফোবোস বা ফোবিয়া (Phobia) শব্দের অর্থ  ‘ভয়’। গ্রিকদের ঘুমের দেবতাকে ডাকা হয় হিপনোস (Hypnos) নামে।

হিপনোফোবিয়া কেন হয়ে থাকে?

ঠিক কী কারণে অযাচিতভাবে মানুষ ঘুমাতে আতঙ্কগ্রস্ত হয় তা বলা কঠিন। তবে ধারণা করা হয়, আত্মরক্ষার প্রস্তুতি থেকেই মনের অগোচরে বাসা বাঁধে এই রোগ। অনেকের ক্ষেত্রে আবার সিনেমায় ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য (বিশেষত ভুতুড়ে সিনেমার দৃশ্য) মনে গেঁথে গেলে অথবা ঘনিষ্ঠজনের সাথে ঘটে যাওয়া কোনো দুঃখজনক স্মৃতির সাক্ষী হয়ে থাকলে বা শৈশব (বিশেষত শৈশবের কোনো শারীরিক নিপীড়নের ঘটনা) অথবা জীবনের যেকোনো মুহূর্তে কোনো কারণে ভয় পাওয়ার নিদারূণ ঘটনা মনে গেঁথে থাকলে এসব ঘটনা আড়ালে-আবডালে ঘুমের সংশ্লিষ্টতায় ব্যাঘাত ঘটার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হিপনোফোবিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি নিদ্রাহীন রাত কাটাতে বাধ্য হন; Source: Live Science

অবচেতন মন তখন সব কিছুতেই তৈরি করে নেয় একধরনের আতংক বা ফোবিয়া, যা থেকে হিপনোফোবিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। অনেকক্ষেত্রে আবার এই রোগের উৎপত্তিগত কারণ হিসেবে বংশানুক্রমিক বা জেনেটিক কারণকেও নির্দেশ করা হয়ে থাকে।

হিপনোফোবিয়া আক্রান্তের লক্ষণ

হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের লক্ষণসমূহ চলুন জেনে নেয়া যাক-

১) অত্যাধিক মাত্রায় দুশ্চিন্তা এবং ভয়
২) শ্বাসের স্বল্পতা বা শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
৩) দ্রুত শ্বাস টানা
৪) হৃদযন্ত্রের অতিরিক্ত স্পন্দন
৫) মাত্রাতিরিক্ত ঘাম
৬) বিতৃষ্ণাবোধ
৭) মুখ শুকিয়ে যাওয়া
৮) মনোযোগের অভাব
৯) বাকযন্ত্রের আড়ষ্টতা
১০) মানসিক অস্থিরতা
১১) খিঁচুনি
১২) শরীর শক্তিশূন্য মনে হওয়া
১৩) সর্বদা আতঙ্কগ্রস্ততা
১৪) অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা
১৫) মাথাব্যথা
১৬) সবকিছুতে বিরক্তি ভাব
১৭) ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রা
১৮) ঘুমের মাঝে হাঁটা
১৯) অবচেতন মনে বিছানা ভিজিয়ে ফেলা

তবে ব্যক্তিবিশেষে রোগের লক্ষণ পাল্টে যেতে পারে। যেহেতু এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি, সে কারণে এই রোগের সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে কিছুটা দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। চলুন জেনে আসি কী কী উপায়ে এই রোগ থেকে মুক্তি ঘটতে পারে।

হিপনোফোবিয়া আক্রান্ত হওয়ার ক্ষতিকর দিকসমূহ

যেহেতু হিপনোফোবিয়া একটি মানসিক সমস্যা, তাই এক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সময়মতো এই রোগ না সারালে সারাজীবন ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করাই ভবিতব্য বলে ধরে নেওয়া যায়। এই রোগের ক্ষতিকারক দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় যে, এতে পারিবারিক অশান্তি ও সম্পর্কহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। সর্বোপরি, এক অসুখী জীবন, স্বাস্থ্যহানী, মনোসংযোগের অভাবও দেখা দেয়।

তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে ৭০-৯০ ভাগ রোগী পুরোপুরিভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে খুব দ্রুত চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। চিকিৎসার বিলম্ব যতই ঘটবে, ততই নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার আশংকা বেড়ে যেতে থাকে। সাধারণত নবযৌবন বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরই এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নানা সমীক্ষায় প্রমাণ মেলে, মহিলাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার পুরুষদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

হিপনোফোবিয়া রোগটি কারো কারো কাছে ক্লিনোফোবিয়া, আবার কারো কারো কাছ ওম্নিফোবিয়া নামে পরিচিত; Source: SleepHub

সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে রোগের উপসর্গের মাঝে পার্থক্য থাকতেই পারে। ভয় রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সব সময় সিটিয়ে থাকে। বিশেষ করে কোনো কারণ ছাড়াই উদ্ভ্রান্তের মতো একের পর এক ভয় তাকে আক্রমণ করতে পারে এই ভেবেই মানুষ চিন্তামগ্ন দিনযাপন করে। এই ভয় পাওয়ার অনুভূতি মানুষের মধ্যে অধিকাংশ সময়ই অবস্থান করে ও তার জীবনকে নষ্ট করে দেয়। অতীতে কোনো এক পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে থাকলে সেই পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে স্বাভাবিকভাবেই কমবেশি সকলের গায়েই কাঁটা দিতেই পারে। কিন্তু এ ধরনের ভয় থেকে মনের অগোচরে তৈরি হয় একধরনের আতংক।

মহিলাদের হিপনোফোবিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি; Source: curemysleepapnea.com

যাদের মধ্যে আতঙ্ক বা ভয়-রোগ রয়েছে তারা যে ধরনের পরিস্থিতিতে ভয় পায় সেসব পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি প্রায়ই এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। ফলে তাদের জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় এ থেকে নানা সামাজিক বিপত্তিও ঘটে যেতে পারে। শুধুমাত্র ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ততার কারণে অনেকে কর্মস্থলেও পিছিয়ে থাকে, ফলে ভালো কর্মীও হতে পারে না। মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও অবচেতন মনে অস্বাভাবিক ধরনের হয়ে থাকে। ভয়ের কারণে মানুষের ঘুমের সমস্যা তো এক প্রধান সমস্যা হয় বটেই, তাই রাতে জেগে থাকতে বাধ্য হতে হতে একসময় তৈরি হয় নানা মানসিক সমস্যা।

হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি রাতে ঘুমাতে যেতেই ভয় পান; Source: bloggedd.com

ভয়সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত অনেকেই তাদের রোগের উপসর্গ নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন। এমনকি ডাক্তার যদি আশ্বস্ত করে যে, এসব উপসর্গ মারাত্মক কিছু নয় তবুও তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ততায় দিন কাটান। অনেক ক্ষেত্রে অকারণে নিজেদের হার্টের রোগী, নিউরোলজিক্যাল রোগী বা কোনো মারাত্মক খারাপ অসুখের রোগী মনে করে ভয় পায় এবং প্রায়ই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান। অনেকে আবার বারবার ডাক্তার পাল্টিয়ে যাচাই করার মানসিকতা দেখিয়ে থাকেন এবং রোগ নির্ণয়ের জন্য কতগুলো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বারবার করাতেই থাকেন। আসলে এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই, তবে এতে করে রোগী সাময়িকভাবে মানসিক সান্ত্বনা খুঁজে পেতেও পারেন।

ভয়ের কারণে ঘুমাতে না পারার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি অস্থিরতা, পাগলাটে আচরণ এবং ও খিটেখিটে স্বভাবের হয়ে থাকেন; Source: SleepHub

ভয় বা আতংক থেকে মানুষ তার বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বা নিজের প্রতি আস্থা এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ভয়ের উপসর্গগুলো সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। উপসর্গগুলো আস্তে আস্তে বিলীন হওয়ার জন্য ঘণ্টাখানেক বা বছরের পর বছর সময়ও লাগতে পারে। যারা ভয়ের কারণে ঘুমাতে পারেন না তারা সবসময় তাদের ভেতরের অসহ্য অস্থিরতার কথা প্রকাশ করে থাকে। অনেক সময় তারা পাগলাটে ধরনের আচরণ করে থাকে।

প্রচন্ড মানসিক চাপের দরূণ ভয় সৃষ্টি হওয়া বা কোনো মারাত্মক দুর্ঘটনা, অসুস্থতা প্রভৃতি কারণেও অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাছাড়া অতিরিক্ত চা-কফি খাওয়া, কোকেন বা অন্য কোনো উত্তেজক ওষুধ অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলেও ভয়ের সৃষ্টি হতে পারে। ভয় মানুষকে হতভম্ব করে দেয়।

অতিরিক্ত চা-কফি খাওয়া বা কোনো উত্তেজক ওষুধ অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলেও হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন; Source: Reader’s Digest

এর ক্ষতিকর প্রভাব কী বা কতটুকু তা আগে থেকে বলা কঠিন। যারা এই রোগে আক্রান্ত হয়নি তারা অনেক সময় মনে করে যে, ভয় হচ্ছে কোনো বিষয়ে নার্ভাস বা উদ্বিগ্ন হওয়া, যা কম-বেশি সবার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। অনেক সময় কেউ ভয় পেলে তার মনের ভেতরে যেসব অস্থিরতা দেখা দেয় বাইরে থেকে তা বোঝা কঠিন।

হিপনোফোবিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মেডিটেশনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে; Source: illawarramercury.com.au

সাধারণত যারা খুব অল্প সময় ভয়ে আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত তাদের জীবনে এর মারাত্মক কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু যারা বারবার ভয়ে আক্রান্ত হয় এবং এ থেকে ঘুমাতে পর্যন্ত পারে না তাদের জীবনে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। পরিবারের কোনো এক সদস্যও যদি হিপনোফোবিয়া আক্রান্ত হয়ে থাকে তবে পরিবারের অন্যদের জন্যও এটি দুঃখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রোগীর চিকিৎসার জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের সদয় দৃষ্টি দেওয়া খুব প্রয়োজন এবং সময়মতো রোগীকে একবার অন্তত মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।

মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে কাউন্সিলিংয়ের সাহায্য নিয়ে ভয়রোগে আক্রান্ত রোগীকে পুরোপুরিভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়; Source: thejournal.ie

তাছাড়া অনেক সময় সাময়িক চিকিৎসা এবং থেরাপিস্টের পরামর্শেও উপকার পাওয়া যায় বৈকি, তবে এক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক রোগীকে তার নিকটজনের সময় দেয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভয়রোগের উত্তম চিকিৎসা হলো রোগী যেসব অবস্থা বা পরিস্থিতিকে ভয় পায় তার সঠিক অনুসন্ধান করে সেসব পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে যাওয়া এবং তার ভুল ভাঙ্গানোর চেষ্টা করা। পরিবারের কাছের মানুষেরাই এ কাজটি করতে পারে। একমাত্র রোগীর কাছের মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টাই পারে এমন ভয়রোগে আক্রান্ত রোগীকে পুরোপুরিভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।

হিপনোফোবিয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই থেরাপির সাহায্য নিয়ে থাকেন; Source: getholistichealth.com

 চিকিৎসা পদ্ধতি

হিপনোফোবিয়া থেকে মুক্তি পেতে কাউন্সেলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সমাধান। তবে সমস্যা হলো এই পদ্ধতি সময় সাপেক্ষ হওয়াতে রোগীকে দীর্ঘদিন যাবত আতঙ্কে সময় কাটাতে হওয়ার ভোগান্তিতে ভুগতে হয়। বেশিরভাগ থেরাপি বলতে গেলে সময়সাপেক্ষ। তাই বলে চিকিৎসা পদ্ধতির অবদান কিন্তু থেমে নেই। পদ্ধতিগুলোর মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে-

১) কগনিটিভ থেরাপি (Cognitive Therapy or CT)
২) কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (Cognitive Behavior Therapy)
৩) হ্যাবিট স্ট্রাটিজিস টু রিল্যাক্স (Habit Strategies to Relax)
৪) ইন ভিভো এক্সপোজার (In Vivo Exposure)
৫) রেস্পন্স প্রিভেনশান (Response Prevention)
৬) হিপনোথেরাপি
৭) গ্রুপ থেরাপি
৮) সাইকো থেরাপি
৯) এনার্জি সাইকোলজি
১০) পথ্য (Medication) এবং
১১) মেডিটেশান বা ধ্যান

ফিচার ইমেজ: smulderstextiel.nl

Related Articles