Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সিকিম: পাহাড়ে, বরফে অনন্য এক রাজ্য

বাগডোগরা বলতে অনেকেই হয়তো মনে করবে আমরা দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং যাচ্ছি। কিন্তু না, আমরা যাচ্ছি সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকে।

ফেলুদাভক্তদের কাছে লাইন দুটি হয়তো পরিচিত ঠেকবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের এ রাজ্যের সাথে অনেকেরই প্রথম পরিচিত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজ ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’-এর মাধ্যমে। রহস্যের পেছনে ধাওয়া করতে করতে গ্যাংটকের অপরূপ সৌন্দর্য সত্যজিৎ রায় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তাঁর আশ্চর্য কলমের জাদুতে।

ছেলেবেলায় যতবারই উপন্যাসটি পড়েছি, ততবারই যেন গ্যাংটক তার সমস্ত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে আমাদের কল্পনায়। আর সেই কল্পনার সাথে বাস্তবকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেলে আর ছাড়ে কে! তাই সুযোগ পাওয়া-মাত্রই তিন বন্ধু চেপে বসলাম গাড়িতে, কল্পনার রাজ্যের সন্ধানে।

ভীড়ের ঠেলায়!

সিকিমে বেশ অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই যখন সিকিমের ভিসা দেয়া শুরু হলো, তখন অনেক ভ্রমণপিপাসু মানুষই সিকিমের পথে পাড়ি জমাল। ব্যাপারটা মাথায় নিয়েই আমরা রওনা দিয়েছিলাম।

বাংলাবান্ধায় অবস্থিত ফুলবাড়ি বর্ডারে পৌঁছলাম সকাল ১১টার দিকে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল বর্ডার পার হয়ে জিপে করে গ্যাংটক রওনা দেব। বাংলাবান্ধা থেকে গ্যাংটক মোটামুটি সাড়ে চার ঘন্টার রাস্তা। রওনা দেবার আধঘণ্টা পরই শিলিগুড়ি পড়বে, দুপুরের খাবার পর্বটা ওখানেই সেরে নেয়া যাবে।

দুই দেশের কাস্টমসের ঝামেলা শেষ হতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা না। কিন্তু বিধি বাম, বর্ডারে পৌঁছে আমাদের চোখ কপালে উঠল। ট্যুরিস্ট আর ট্যুরিস্ট। ভীড় হবে জানতাম, তাই বলে এত! মনে হচ্ছে ফার্মগেট নাহয় গাবতলী এসে পড়েছি!

দুজন বিজিবি সদস্য বলল, সকাল থেকে নাকি অন্তত দু’হাজার মানুষ বর্ডার ক্রস করেছে। অন্যান্য দিন একশ মানুষও নাকি হয় না। যা-ই হোক, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন ঘড়ির দিকে তাকালাম, বিকেল ৫টা পার হয়ে গেছে।

ভারতীয় হলে তখনও রওনা দেওয়া যেত, কিন্তু বাংলাদেশী বা বিদেশী হবার আলাদা হ্যাপা আছে! গ্যাংটক ঢোকার আগে রাংপো আর্মি চেকপোস্টে  নাম এন্ট্রি করাতে হয়, ফেরার সময়ও পাসপোর্টে এক্সিট সীল নিতে হয়; আর রাত ৮টার পর চেকপোস্ট বন্ধ।

আর পাঁচটার সময় রওনা দিলে ৮টার আগে চেকপোস্ট পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব, কারণ বাংলাবান্ধা থেকে রাংপো অন্তত তিনঘণ্টার রাস্তা। অগত্যা, ঠিক করলাম, একটা অটো নিয়ে শিলিগুড়ি চলে যাই; রাতটা ওখানেই কাটাই। পরদিন খুব ভোরে উঠে নাহয় গ্যাংটক রওনা দেব।

শিলিগুড়ির রাত: ডিনার যখন স্ট্রীট ফুড

প্রথাগত ভ্রমণকাহিনী থেকে আমার এই পুরো অভিজ্ঞতার বর্ণনা একটু আলাদা। ভ্রমণকাহিনী লেখকেরা সাধারণত কোনো জায়গার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার সম্পর্কে অনেক তথ্য তুলে ধরেন, জায়গাটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলেন।

তবে আমি চেষ্টা করব এসব কঠিন বিষয় দূরে সরিয়ে রেখে সহজভাবে আমি যা অনুভব করেছি, সেটাই বর্ণনা করতে। সেজন্য আমার ভালো লাগার বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাবে এখানে। যেমন ধরা যাক, খাবারের ব্যাপারটা।

শিলিগুড়ি রাত কাটাতে হচ্ছে বলে সবারই মন খারাপ ছিল, একটা রাত নষ্ট হলো ট্যুরের। মন ভালো করার জন্য খাবার অতি উত্তম প্রভাবক। আর আমাদের মত ভোজনরসিকদের মন ভালো করতে ভালো খাবারের বিকল্প আর কী হতে পারে!

আমাদের হোটেল ছিল শিলিগুড়ি জংশনের পাশে, হিলকার্ট রোডে। চেক-ইন করে ব্যাগপ্যাক রেখে ফ্রেশ হয়ে নামলাম খাবারের সন্ধানে। রাস্তায় এতরকম খাবার-দাবার দেখে মাথা খারাপ হবার যোগাড়!

সবার আগে ভাবলাম সিঙাড়া চেখে দেখা যাক। দেশের সিঙাড়ার সাথে তুলনা করলে বলা যেতে পারে, এই সিঙাড়ায় মালমশলা কিছুটা বেশি আর অনেক বেশিই সুস্বাদু। তবে এরপরের আইটেম আমাদের মন এতটাই ভালো করে দিল যে, আমরা ভাবতে বাধ্য হলাম, পাকে চক্রে শিলিগুড়িতে রাতটা না কাটালে আফসোস হতো! সেটা হল মোমো।

পাহাড়িদের এই খাবারটি এখন বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু শিলিগুড়ির এই মোমোর স্বাদের জুড়ি মেলা ভার। দামও অনেক কম। ভেজ-ননভেজ দু’ধরনের মোমোই অসাধারণ। এক প্লেট এক প্লেট করে বেশ ক’প্লেট সাবাড় করার পর জোর করেই নিজেদের সংযত করলাম- মোমো দিয়েই পেট ভরিয়ে ফেললে বাকি খাবার চেখে দেখব কখন!

তাই কিছুদূর এগিয়ে গেলাম চৌধুরী পাও-ভাজির দিকে। এটা হিলকার্ট রোডের মোটামুটি বিখ্যাত দোকান। পাও-ভাজি খাবারটার অনেক নাম শুনেছি, তবে খাওয়ার পর খুব একটা যুতসই লাগল না। এর চেয়ে চিকেন ফ্রাই আর লিভার ফ্রাই বরং বেশ চমৎকার!

চিকেন ফ্রাই © Writer

খাদ্যপর্ব শেষে আমরা মনোনিবেশ করলাম চা পানে। চায়ের মাধ্যমেই নাকি এলাকার পরিচয় ফুটে ওঠে! সেদিক দিয়ে অবশ্য শিলিগুড়ি পুরোপুরি ফেল। গ্রেস মার্ক দিয়েও পাশ করানোর উপায় নেই।

এই চা দার্জিলিং থেকেই আসে। সেক্ষেত্রে অবশ্য ‘দার্জিলিং চা’ এর উপর থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস উঠে যেতে বাধ্য। বাংলাদেশের চায়ের আশেপাশেও এই চায়ের আসার সম্ভাবনা নেই। (এখানে চুপি চুপি বলে রাখি, চা খেয়ে মুখের স্বাদ যে নষ্ট হয়েছিল, সেটা ফেরাতে আবার এক প্লেট মোমো খেয়েছি!)

পাও ভাজি © Writer

খুব বেশি সময় কাটাইনি বলে শিলিগুড়ি শহরটাকে তেমন ভালোভাবে দেখা হয়নি। হিলকার্ট রোডটাই হেঁটে দেখেছি কেবল। জায়গাটা প্রধানত ট্যুরিস্টদের জন্যই। তাই রাস্তার দু’পাশেই অসংখ্য হোটেল, ছোট ছোট খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ এবং বার। তবে বেশ ছিমছাম আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল এলাকাটা।

গ্যাংটকের পথে

পরদিন বেশ ভোরে উঠে নাশতা করে রওনা দিলাম গ্যাংটক। বাস, জিপ দুটোতেই যাওয়া যায়। আমরা চড়ে বসলাম জিপেই। ভোরের আলোয় বেশ লাগছিল ছিমছাম শিলিগুড়ি শহরটাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে সেবক রোড ধরে চলল। দু’পাশে বন, ড্রাইভার জানালো- এটা শিলিগুড়ি সাফারি পার্ক। কেতাবি নাম ‘মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি’। দেখে ইচ্ছে হচ্ছিল, এখনই ঘুরে আসি বনের ভেতরে! সুন্দর ঘন গাছের সারি, কিছুদূর পর পর আর্মি ক্যাম্প।

একটু পরই গাড়ি চলল তিস্তা নদীর ধার ঘেঁষে। নীলচে পানির সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। নদীর মতই এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে, সে রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি ছুটছে। মসৃণ সড়ক, খানাখন্দ খুবই কম। আশেপাশের দৃশ্য বদলাচ্ছিল একটু পরপরই। কখনো পাহাড়ের সারির পাশ দিয়ে ছুটছি, সাথে ঘন গাছপালা। আবার কখনো পাহাড়গুলো দূরে সরে যাচ্ছিল, সামনে চলে আসছিল পাতলা গাছের সারি আর ঘন ঘাসের জমি।

ঘণ্টা দুয়েক এভাবে চলার পর আমরা থামলাম একটু বিশ্রামের জন্য। জায়গাটা তিস্তা বাজারের কিছু আগে। ডানদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে কালিম্পং এর দিকে। রাস্তার দু’পাশে গুটিকয়েক খাবারের দোকান, দোকানের পেছনে খাদ, নিচে বয়ে গেছে সবুজাভ নীলচে তিস্তা নদী, আর তার সাথে পাহাড়গুলো একের পর এক দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এখানে এক দোকানে তাওয়া ছাড়াই সরাসরি আগুনে রুটি সেঁকার এক অভিনব পদ্ধতি দেখলাম। হালকা খাওয়া দাওয়া আর ফটোসেশন করে আমরা আবার ছুটলাম রাংপোর উদ্দেশ্যে।

অন্যভাবে রুটি সেঁকা © Writer

রাংপোতে আমাদের অভ্যর্থনা হল বিশাল এক ঐতিহ্যবাহী গেটের মধ্য দিয়ে। ওপরে সবুজ চৌচালা, দু’পাশে কলাম, কলামের গায়ে রংবেরঙের নকশাকাটা প্যাটার্ন, যা সিকিমের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তবে আমাদের মাথায় তখন ঘুরছে এন্ট্রি সীলের চিন্তা। গাড়ি থেকে নেমেই তড়িঘড়ি পাসপোর্ট আর কাগজপত্র হাতে ছুটলাম নগর পঞ্চায়েতের অফিস।

আবার আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! সেই এক ভীড়! আমাদের মতোই অনেক অভাগা ট্যুরিস্ট (নাকি ভাগ্যবান?) যারা এক রাত শিলিগুড়ি কাটিয়ে পরের দিন রওনা দিয়েছে গ্যাংটক- সবাই তখন লাইনে দাঁড়িয়ে। দশ মিনিটের কাজ লাগল পাক্কা এক ঘণ্টা।

এই ফাঁকে রাংপো ঘুরে দেখার সুযোগ ছাড়লাম না। ছোট্ট চক্রাকার একটা এলাকা। চারপাশে হোটেল আর দোকানপাট। প্রচুর জীপ আর ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। দেখে বুঝলাম, অনেক ট্যুরিস্ট এখান থেকেই গ্যাংটক, কালিম্পং, শিলিগুড়ি আর দার্জিলিং যায়।

রাংপোর প্রবেশপথ © Writer

যাই হোক, কাজ সেরে দ্রুত রওনা দিলাম। এবার আর বেশিক্ষণ লাগার কথা না। সবার মাথায়ই তখন খালি একটাই চিন্তা ঘুরছিল, আর কতক্ষণ?

অবশেষে, স্বপ্নের শহরে!

গ্যাংটক! দূর থেকেই যখন শহরটা চোখে পড়ল, মনের মধ্যে তখন অদ্ভূত এক অনুভূতি। ছোটবেলায় বই পড়ে যে ছবি এঁকেছি মনের মধ্যে, আজ সে ছবি বাস্তব হয়ে চোখের সামনে!

হিমালয়ের পূর্ব সীমার অন্তর্গত বিশাল এক পাহাড়, তারই বাঁকে বাঁকে অজস্র বাড়িঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে সিকিমের রাজধানী আর সবচাইতে বড় শহর। প্রায় ৫,০০০-৭,৫০০ ফুট পর্যন্ত গ্যাংটক শহরের বিস্তার। পাহাড় ঘিরে এঁকেবেঁকে রাস্তা উঠে গেছে চূড়া পর্যন্ত, তারই বাঁকে বাঁকে সব দালানকোঠা। বেশিরভাগই হোটেল, তার সাথে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি।

বাড়িগুলোর চেহারা মোটামুটি একইরকম। মাথার ওপরে দোচালা, চৌচালা আর সারি সারি জানালা, সাথে বারান্দা। তবে মনোমুগ্ধকর হল তাদের রঙ। এত রঙের বাহারি বাড়ি যে, চোখ ফেরানো যায় না!

গ্যাংটক © Writer

ভিউ পয়েন্টস

গ্যাংটকের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোকে একত্রে নাম দেওয়া হয়েছে ভিউপয়েন্টস। সেভেন ভিউপয়েন্টস, টেন ভিউপয়েন্টস এইরকম। সময়ানুযায়ী যে যতটা দেখতে পারে আরকি।

মানুষের ভীড় আর ট্র্যাফিক জ্যাম আমাদের অনেকটা সময়ই খেয়ে নিয়েছিল, তাই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড নেমে আগে ট্যাক্সি ভাড়া করলাম ভিউপয়েন্টস দেখার জন্য। করিৎকর্মা চালক সাহেব বেশ সাহায্য করলেন। প্রথমেই আমাদের চাহিদামত একখানা হোটেলে নিয়ে গেলেন।

চালক সাহেব সময় দিলেন মাত্র পনের মিনিট, কারণ তখন প্রায় একটা বাজে। চারঘণ্টার বেশি আলো থাকবে না। এরই মধ্যে সব দেখে শেষ করতে হবে। তাই তড়িঘড়ি মালপত্র রেখে কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। শুরু হল আমাদের গ্যাংটক ভ্রমণ।

বানঝাকরি ফলস

বানঝাকরি ফলস হল প্রাকৃতিক এক ঝরনাকে ঘিরে তৈরি করা পার্ক। গ্যাংটকের নিচের দিকে, ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩১-এর ওপরে এটির অবস্থান। বানঝাকরি এক মিথোলজিক্যাল চরিত্র। তারই নামে নামকরণ এ পার্কের।

পার্কে ঢোকার জায়গা থেকে ঝরনা পর্যন্ত পুরোটাই শানবাঁধানো ইটের রাস্তা। কখনো উঁচু, কখনো নিচু, কখনো-বা সিঁড়ি; একটু পরপর রয়েছে বসার জায়গা। ঝরনা থেকে পানি পাথরের খাঁজে খাঁজে চলে গেছে রাস্তার পাশ দিয়ে, অনেক নিচে। একটু পর সুন্দর সাজানো এক পুল, চৌচালা নকশাকাটা ছাদসমেত।

পুল পেরিয়ে ঝরনার কাছে পৌঁছে দেখলাম প্রচুর ট্যুরিস্ট। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। রোপওয়ে আর অ্যাডভেঞ্চার ট্রেইলেরও দেখা মিলল, যদিও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী কাউকে দেখা গেল না।

একপাশে ছোট একটা বোটিং এরিয়া, তার মাঝখানে ড্রাগনের মূর্তি। কতরকম ফুল যে দেখলাম, তার ইয়ত্তা নেই! পুরো জায়গাটাই বেশ সাজানো গোছানো, তবে কৃত্রিমতার ছাপটাই বেশি।

বানঝাকরি ফলস © Writer

গোনজাং মনাস্ট্রি

বানঝাকরি যাওয়ার জন্য নিচের দিকে নামতে হয়েছিল, এবার গাড়ি নিয়ে চূড়ার দিকে ওঠা শুরু হলো। এই পথে যাওয়ার সময় পূর্ব হিমালয়ান রেঞ্জের প্রায় পুরোটাই চোখে পড়ে। আঁকাবাঁকা পথে আধঘণ্টাখানেক চলার পর গোনজাং মনাস্ট্রির সামনে এসে আমরা থামলাম।

এখানে মনাস্ট্রি সম্বন্ধে কিছু কথা না বললেই নয়। গ্যাংটকে যতগুলো মনাস্ট্রি রয়েছে, তার সবই মোটামুটি বৌদ্ধ মনাস্ট্রি। ‘মঙ্ক’ থেকে ‘মনাস্ট্রি’ বা ‘মনাস্টেরি’ শব্দের উৎপত্তি। ‘মঙ্ক’ অর্থ একলা। সোজা ভাষায় প্রচলিত জীবন থেকে আলাদা হয়ে ধর্মের পথে আত্মনিবেশ করাই মনাস্ট্রি যাপনের উদ্দেশ্য

মনাস্ট্রির প্রাণকেন্দ্রে থাকে মন্দির। তার সাথে থাকার জায়গা, খাওয়ার জায়গা, পড়াশোনার জায়গা- সব মিলিয়ে বিশাল এক কমপ্লেক্স। বড় বড় মনাস্ট্রিতে স্কুল-কলেজ এমনকি ইউনিভার্সিটিও থাকে, আর সেখানে পড়াশোনার মূল বিষয়ই হলো ধর্মীয় শিক্ষা।

গোনজাং মনাস্ট্রি © Writer

যাকগে, আসল কথায় ফেরত আসি। গোনজাং মনাস্ট্রির প্রবেশপথেই বামপাশে আছে ছয়তলা হোস্টেল, টানা বারান্দাসমেত। প্রতিটি তলা দেখতে একইরকম, তবে একঘেয়ে নয়। তার প্রধান কারণ রঙের আধিক্য। বারান্দার রেলিং, দরজায় ঝোলানো রঙিন পর্দা, কাঠের ফ্রেম করা জানালা; সব মিলিয়ে পুরো বিল্ডিংটাই যেন একটা আর্টওয়ার্ক।

ডানপাশের রেস্টুরেন্টটা বরং কিছুটা আধুনিক। একটা যেন ব্রিটিশ ছাপ রয়েছে পুরোটাতে। সামান্য এগিয়ে পড়ল মন্দির, প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু মন্দির দশ ফুট উঁচু এক বেদীর পর বসানো। মন্দিরের সামনে বিশাল চত্বর, তার একপাশে ইটের বেষ্টনী; যেখানে দাঁড়িয়ে পুরো গ্যাংটক শহর একবারেই দেখে নেয়া যায়।

চত্বরে বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম শহরটাকে। বাতাস তখন আমাদের প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায় আরকি! তাপমাত্রা যদিও ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু শীতে কাঁপন ধরছিল যেন আরও বেশি।

মন্দিরে ঢোকার মুখে সিঁড়ির ধাপ উঠে গেছে দশ ফুট পর্যন্ত। মন্দিরের দেয়ালটা সাদা, জানালাগুলো হলুদ কাঠের ফ্রেমে বানানো, আর তার চারপাশে কালো বর্ডার দেওয়া। থামগুলো লাল, আর তার কোণায় রঙ-বেরঙের নকশা। সিকিমের যেখানেই গেছি, মোটামুটি সব জায়গাতেই এই নকশার প্যাটার্ন দেখতে পেয়েছি।

দরজার ওপর থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরো জায়গাটা যে কতরকম রঙের বাহার- তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ভেতরেও একইরকম রঙিন। পেছনের দেয়ালে রয়েছে প্রায় দশ ফুট উঁচু এক বুদ্ধমূর্তি, তার সামনে প্রার্থনা করার জায়গা, অনেকটা গীর্জাঘরের মতো। একপাশে লাইব্রেরী। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ, জুতো খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, বেশ ক’জন সন্যাসী প্রার্থনারত, তাই খুব বেশী সময় না নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

তাশি ভিউপয়েন্ট ও রক ক্লাইম্বিং

তাশি ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, তবে আকাশ মেঘলা থাকায় আমরা তা দেখতে পেলাম না। তাই সেখানে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট না করে আমরা এগিয়ে গেলাম রক ক্লাইম্বিং এর দিকে। জায়গাটা আর কিছুই না, রাস্তার পাশে বড় বড় পাথরে ভরা একটি জায়গা, যেখানে রক ক্লাইম্বিং করা যায়।

এখানে দড়ি দিয়ে বাঁধা অসংখ্য কাপড়ের টুকরো দেখলাম, যার মধ্যে ছবি আঁকা আর নেপালি ভাষায় মন্ত্র লেখা রয়েছে। জিজ্ঞেস করাতে জানলাম, পাহাড়ে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের আত্মার শান্তির জন্য তাদের পরিবার টুকরোগুলা টাঙায়। ব্যাপারটা একই সাথে মনোমুগ্ধকর এবং ভীতিকর!

রক ক্লাইম্বিং © Writer

গণেশ টক ও হনুমান টক

‘টক’ মানে মন্দির। কাজেই গণেশ টক আর হনুমান টক হলো গণেশ মন্দির আর হনুমান মন্দির। দুটো মন্দিরই মোটামুটি একই রকম, রঙের মধ্যে হলুদটাই চোখে পড়ে বেশি। গণেশটক প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে, আর হনুমান টক এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে সাত হাজার ফুট।

মন্দিরগুলো বিভিন্ন ঘরে বিভক্ত। একেকটা ঘর একেক রকম কাজের জন্য তৈরি। বিগ্রহের ঘর তো সহজেই চেনা যায়, এছাড়া খালি ঘরও ছিল দুটো মন্দিরেই। দেখে মনে হলো ঘরের মধ্যে ছোট কোনো আচার-অনুষ্ঠান বা মেডিটেশন করা হয়।

হনুমান টকে ষড়ভুজাকৃতির একখানা ঘর দেখলাম, যার দেওয়ালে ফ্রেম করে ছবির আদলে রাম, লক্ষণ, সীতা, হনুমান প্রমুখ রামায়ণের চরিত্রের মূর্তি আছে। একেকটা ছবি রামায়ণের একেকটা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বানানো (আঁকাও বলা যায়, পেছনের পাহাড়-জঙ্গল কিন্তু রং-তুলিতেই করা)।

বানানোর কেরামতিটাও বেশ। দেওয়ালের প্লাস্টার একটা নির্দিষ্ট পরিমাপে কেটে তার মধ্যে রঙ-তুলি দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড আঁকা, সেই ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর গল্প অনুযায়ী বিভিন্ন ভঙ্গীমায় মূর্তিগুলো বানানো। সবশেষে ছবির সামনের অংশটুকু কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে দেওয়া যাতে ছবিগুলো রক্ষা পায়।

হনুমান টকের একাংশ © Writer

মোট জায়গার পরিমাণের দিক দিয়ে হনুমান টক কিছু্টা বড়। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, হনুমান যখন লক্ষণের জন্য সঞ্জীবনী গাছ আনতে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে এই পাহাড়ের চূড়ায় বসেই দিক ঠিক করেন। পুরো মন্দির কমপ্লক্সের মেঝে লাল ইট বাঁধানো। মজার জিনিস ছিল- একপাশে সংরক্ষিত সঞ্জীবনী গাছের চারা। কে জানে! এখনও কাজ করে কিনা!

এম.জি.মার্গ

ভিউ পয়েন্টস দেখা শেষে যখন হোটেলে ফিরলাম, সন্ধ্যে পার হয় হয় অবস্থা। বিশ্রাম করে রাতের খাবারের উদ্দেশ্যে নামলাম এম.জি.মার্গ। নামলাম বলার কারণ আমাদের হোটেল এম.জি.মার্গ থেকে বেশ খানিকটা ওপরে।

একে বলা যায় গ্যাংটক শহরের প্রাণকেন্দ্র। জিনিসটা আর কিছুই না, একটি পায়ে হাঁটা রাস্তা, সোজা কথায় শপিং স্ট্রীট। রাস্তাটা খুব বেশি বড় না, হেঁটে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে বড়জোর আট-দশ মিনিট লাগবে।

রাস্তার দু’মাথায় রয়েছে গান্ধীজির দু’টো ভাস্কর্য। গ্যাংটকের ল্যান্ডমার্ক, পর্যটকদের জন্য প্রধান মার্কেটিং এরিয়া বলা যায় এ রাস্তাটাকে। চওড়ায় প্রায় ষাট ফুট; দু’পাশে অসংখ্য সারি সারি দোকান, আর দোকানের ওপর হোটেল। প্রতিটা বিল্ডিং গায়ে গায়ে লাগানো, উচ্চতায় চার বা পাঁচতলা।

রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ড, সারি সারি বসার জায়গা, ল্যাম্পপোস্ট আর ডাস্টবিন। অসম্ভব পরিষ্কার ইট বাঁধানো একটা রাস্তা। রাতের বেলা এম.জি.মার্গের আলোতেই বোঝা যায়, গ্যাংটকের প্রধান এরিয়াতে আছি।

রাতের আলোয় এম.জি.মার্গ. © Writer

খাবার এম.জি.মার্গের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। উল্লেখযোগ্য দোকানের মধ্যে বলা যেতে পারে রোল হাউস, আগারওয়াল সুইটস, আর অবশ্যই ‘খান আঙ্কেল’স বিরিয়ানির’ কথা। রোল হাউস পুরোপুরি ভেজ ফুড হাউস। এখানে স্টীম মোমো, বাটার মোমো, চীজ মোমো, ফ্রাইড মোমো এরকম আরও অনেক ধরনের মোমো পাওয়া যায়। যদিও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে ট্র্যাডিশনাল স্টীম মোমোই বেশি উপাদেয়, তবে বাকিগুলোও কিন্তু ফেলনা নয়। 

‘আগারওয়াল সুইটস’-এ মিষ্টির সাথে সাথে বিভিন্ন স্ন্যাক্সও পাওয়া যায়। যেমন দইবড়া, ছোলা বাটোরা, ধোকলা, সেই সাথে মোমো তো আছেই। মিষ্টির মধ্যে সবচাইতে ভালো লেগেছিল সোহন হালুয়া আর গুলাবজামুন। ‘খান আঙ্কেল’স-এর বিরিয়ানি আর চিকেন চীজ রোলকে বলা যায় ‘লা-জওয়াব’। দেশে কত জায়গাতেই তো বিরিয়ানি খেয়েছি, কিন্তু খান আঙ্কেল’স-এর বিরিয়ানীর স্বাদ একেবারেই ভিন্ন।

এছাড়াও বিভিন্ন ছোটখাটো দোকানে আরও অসংখ্য সুস্বাদু স্ন্যাক্স রয়েছে, যেমন- জিলাপি, সিঙাড়া, চিকেন পপ। এগুলো আমাদের পরিচিত হলেও ফ্লেভারটা একদমই আলাদা, যা গ্যাংটকের নিজস্ব। নতুন জায়গায় গিয়ে লোকাল খাবার না চাখলে আসলে ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না।

আগারওয়াল সুইটস এর দইবড়া © Writer

যাই হোক, রাত দশটা পর্যন্ত আমাদের ‘শপিং অভিযান’ আর ‘খাদ্যাভিযান’ শেষ করে আমরা, যাকে বললে ’ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’; হোটেলে ফিরে গেলাম। কাল সকালে চলে যাবো নর্থ সিকিম। পাহাড়! বরফ! যার টানে এতদূর আসা। একবুক উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম সকালের আশায়।

লাচুং যাত্রা

সকাল দশটার দিকে আমরা রওনা হলাম নর্থ সিকিমের ছোট্ট শহর লাচুং এর দিকে। প্রায় ১২৫ কিলোমিটার পথ, যেতে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা তো লাগবেই। তবে পথে অনেক দেখার মতো জায়গা পড়বে, তাই ধরেই নিলাম মোটামুটি সাত-আট ঘন্টার ধাক্কা। রওনা দেওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যেই গাড়ি ছুটল নর্থ সিকিম হাইওয়ে ধরে।

আমাদের প্রথম স্পটে অবশ্য বেশ তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে ছোট্ট একটা মনাস্ট্রি, নাম যোগচেন তেনজাং। চারপাশে পাহাড় আর ঘন গাছপালায় ঘেরা এক মনাস্ট্রি। অন্যান্য মনাস্ট্রি থেকে প্রধান পার্থক্য হলো এর আকৃতি। তুলনামূলকভাবে এটি যথেষ্ট ছোট। তবে গঠনগত দিক থেকে গতানুগতিক মনাস্ট্রির মতোই।

যোগচেন তেনজাং মনাস্ট্রি © Writer

চারপাশটা চট করে দেখে নিয়ে আমরা রওনা করলাম আবার। দু’পাশে সবুজরঙা পাহাড় আর তার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের জীপ। কখনও ওপরে উঠছি তো কখনও নিচে নামছি। এভাবে চলতে চলতে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর এসে পৌঁছুলাম একটা ছোট্ট ঝরনার পাশে। ফলকে নাম লেখা, বাকথাং ওয়াটারফলস।

ঝরনার পাশে ছোট ছোট কয়েকটা ঝুপড়ি। সবাই গাড়ি থেকে নেমে চিপস, বিস্কুট আর চা খেলাম। বরাবরের মতোই জঘন্য চা, তবে শরীরটাকে চাঙা করতে জিনিসটা তখন খুব প্রয়োজন ছিল। এখানে বলে রাখি, সিকিমে যত ঝরনা দেখেছি, সবগুলোর সামনেই বেশ সুন্দর করে বিভিন্ন উচ্চতায় টেরাসের মত করে স্ল্যাব দাঁড় করানো, সিঁড়ি বেয়ে সেগুলোতে উঠে দাঁড়ানো যায়।

বিভিন্ন উচ্চতা থেকে ঝরনা দেখাটাও যে বেশ উপভোগ্য ব্যাপার- তা এখানকার ঝরনাগুলো না দেখলে বুঝতাম না। যাই হোক, বাকথাং হয়ে আমাদের যাত্রা আবার শুরু হলো। এবার বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, চক্রাকার পাহাড়ি রাস্তাটা আমাদেরকে নিচে নিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম চমৎকার একটা নদী। কিছুক্ষণ দেখা দিচ্ছিল, আবার গাড়ি ঘোরার সাথে সাথে নদীটাও যেন পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। এভাবে প্রায় আধঘন্টা মতন লুকোচুরি খেলার পর যখন পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছুলাম, বিশাল নদীটা তখন আমাদের সামনে। জিজ্ঞেস করাতে জানলাম নদীটার নাম দিক চ্যু। তিস্তার শাখা নদী। এমন সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না!

আমাদের দেশের পাহাড়ি নদীর পানি সাধারণত সবুজাভ হয়। তবে এই পানির রঙ একদমই আলাদা। নীল-সবুজের মাঝামাঝি, অনেকটা টার্কিশরঙা। নদীর ওপর ব্রীজ, বোঝাই যাচ্ছে ব্রীজ পেরিয়ে এবার আমাদের পাশের পাহাড়ে উঠতে হবে। কিন্তু এত সুন্দর নদীর পাশে দাঁড়িয়ে একটু বুক ভরে শ্বাস নেব না, ক’টা ছবি তুলবো না, তা তো আর হয় না! তাই সই! প্রায় আধঘন্টা কাটালাম নদীপানে তাকিয়ে।

দিক চ্যু নদী © Writer

গাড়ির চালক তাড়া দিতে লাগল। সামনে আরও অনেক ‘স্টপেজ’ আছে। তাছাড়া দুপুরের খাবারও বাকি। বেশি দেরি হলে সন্ধ্যের আগে লাচুং পৌঁছানো যাবে না। আর পাহাড়ি রাস্তায় নেহাত বাধ্য না হলে রাতে গাড়ি চালানো একেবারেই অনুচিত। অগত্যা আবার উঠে বসলাম গাড়িতে।

এবার বৈপরীত্য। এতক্ষণ চক্রাকার রাস্তা দিয়ে নিচে নেমেছি, এখন চড়াই উঠতে হবে। জীপ চলতে লাগল উঁচু পথ ধরে। নদীটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসতে আসতে একসময় মিলিয়ে গেল। আমরা ছুটে চললাম এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে।

কী এক আশ্চর্য পাহাড়ের রাজ্যে যেন এসে পড়েছি আমরা! আশেপাশে যেদিকে তাকাই, চোখে পড়ে খালি একটার পর একটা সবুজ পাহাড়ের চূড়া। সার বেঁধে যেন থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে। কোনোটার চূড়া মেঘ ফুঁড়ে ওপরে উঠে গেছে, শেষ নেই যেন।

দৃশ্যপটের খুব একটা পরিবর্তন না হলেও একঘেয়েমি নেই মোটেই। মাঝেমাঝে ছোট কিছু ঘরবাড়ি, ব্যাস এটুকুই। নিচে তাকালে যখন দেখি, বহুদূরে একফালি সরু রাস্তা- বিশ্বাসই হতে চায় না, ঐ পথটুকু আমরা পেরিয়ে এসেছি! এঁকেবেঁকে চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমরা এসে পৌঁছুলাম হোটেল সুবেদার। ঘড়ি তখন বলছে তিনটা বাজে।

যাত্রাপথে ঝরনা? নাকি ঝরনাপথে যাত্রা?

পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধ্যে নামে বেশ তাড়াতাড়ি। হাতে একদমই সময় নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব লাঞ্চ সারতে হল। আমাদের পুরো যাত্রাপথেই অসংখ্য ছোট বড় ঝরনা দেখতে দেখতে এসেছি। সবগুলো নেমে দেখতে গেলে লাচুং পৌঁছতে অন্তত দু’দিন লাগবে। তাই ঠিক করলাম, লাচুং পর্যন্ত আর কেবল দুটো ঝরনায় থামব। ঝরনা দুটো হল নাগা ফলস আর ভেওমা ফলস।

নাগা ফলস © Writer

নাগা ফলস নামটা যদি সাপের রাজা, নাগরাজ এরকম কোনো কিছু ভেবে রাখা হয় তাহলে বলা যায় নামকরণ যথার্থ। সাপের মতই এঁকেবেঁকে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ঝরনাটা। পাহাড়ের নিচে এসে বড় বড় পাথরের খাঁজ দিয়ে রাস্তার পাশ ধরে দূরে সরে গেছে।

ঝরনাটা যেখানে সমতলে এসে পড়েছে, তার ওপর দিয়ে চলে গেছে নড়বড়ে এক লোহার ব্রীজ। উঠলেই মনে হয় এই বুঝি ধ্বসে গেল! ঝরনাটার ঠিক উল্টো পাশেই বিশাল এক পাথুরে পাহাড়; রুক্ষ, চকচকে। দেখলে কেমন যেন একটু নিরানন্দ ভাব হয়।

আমাদের গাড়ির সাথে আরও প্রচুর ট্যুরিস্ট জীপ একসাথেই গ্যাংটক ছেড়ে এসেছিল। পথে যেখানেই থেমেছি, সব জায়গায় ট্যুরিস্টের জটলা ছিল। তবে অতিরিক্ত ভীড় ছিল না, এই রক্ষে! ব্রীজ পেরিয়ে বেশ কিছু ঝুপড়ি, সেখান থেকে আরেক দফা বিস্বাদ চা খেয়ে আমরা জীপে চেপে বসলাম।

নাগা ফলস থেকে মোটামুটি মিনিট বিশেক দূরত্বে চাংথাং। এখান থেকে নর্থ সিকিমের প্রধান দুটো শহর, লাচুং আর লাচেন এর দিকে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। শহর দুটোর পাশে ছোট দুটো নদীও আছে। নদীর নামেই শহরের নাম।

ব্রীজের ওপর আমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ থামল। পায়ের অনেক নিচে এসে মিশেছে লাচুং আর লাচেন নদী। ওখানেই বাঁধ দিয়ে তৈরি চাংথাং হাইড্রোলিক পাওয়ার প্ল্যান্ট। ততক্ষণে খুব ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। মেঘ এসে ঘিরে ফেলেছে চারিদিক। টিপটিপ করে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও আরম্ভ হয়েছে। পথ আর বেশি বাকি নেই।

দেরি না করে জীপে উঠে ভালমত গলায়, নাকে, মুখে কাপড় পেঁচিয়ে নিলাম। আমরা তখন প্রায় সাড়ে নয় হাজার ফুট উঁচুতে। শীত বাড়ছিল দ্রুত। চাংথাং থেকে লাচুং এর পথটা বেশ ভালোই আঁকাবাঁকা। তাই গাড়ি খুব বেশি জোরেও চলছিল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেওমা ফলস এসে পড়লাম। অন্ধকার বলে ঝরনাটা আমরা পরদিন ফেরার পথে দেখেছিলাম। ভেওমা অর্থ লালসাপ। কিন্তু ভেওমা ফলস নামে এটাকে কেউ চেনে না। সবাই চেনে ‘অমিতাভ বচ্চন ফলস’ নামে। কারণ একটাই, ঝরনাটা বড্ড উঁচু!

অমিতাভ বচ্চন ফলস © Writer

লাচুং এ আমাদের হোটেলে এসে যখন গাড়ি থামল, ঘড়ি তখন বলছে ৭ টা বাজে। তবে পরিবেশ বলছে নিশুতি রাত। কোথাও কোনো আলো নেই, শব্দ নেই। হঠাৎ মনে হয়, এ কেমন নিস্তব্ধতার জগতে এসে পড়লাম!

হোটেলের নিচে ছোট্ট দোকানটায় শুধু আলো জ্বলছে। হোটেল না বলে ধর্মশালা বলাটাই ভালো। সরু একটা সিঁড়ি চলে গেছে দোতলা পর্যন্ত। ওখানেই সব রুম, মেঝে পুরোটাই কাঠের। গাড়ি থেকে নেমে মনে হলো, শরীরের হাড়গোড় বোধহয় জমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা তখন শূন্যের আশেপাশে।

দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে রুমে গেলাম, ভাবলাম গরম পানিতে একটু হাতমুখ ধোব, সে আশা গুড়ে বালি। ধর্মশালায় কোন গিজারই নেই। হাতে পানির ছিটে লাগলেও মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি ছ্যাঁকা দিল। অতঃপর পানির সংস্পর্শে না আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। ডিনারের আগে পরে স্টাফরা হাত ধোয়ার জন্য গরম পানির ব্যবস্থা করে দিল, ঐটুকুই যা।

বরফের রাজ্যে: কাটাও আর ইয়ামথাং ভ্যালি

খুব ভোরে ওঠার তাড়া ছিল বলে আগের রাতে সবাই বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাছাড়া এই শীতের মধ্যে রাতে কিছু করারও ছিল না। ভোরবেলা উঠে যখন বারান্দায় গেলাম, আপনা থেকেই কথা বন্ধ হয়ে গেল। পাহাড় যেন ঘিরে রেখেছে আমাদের।

রাতের বেলা আশেপাশে দেখতে পাইনি, এখন ভোরের প্রথম আলোয় দেখলাম আশেপাশে প্রচুর ঘরবাড়ি। নিচে একটা উপত্যকা, সেখানেও অসংখ্য বাসস্থান। আর তার পিছনেই তিনটে বিশাল পাহাড়। শেষ পাহাড়টা যতটুকু দেখা যায় পুরোটাই বরফে ঢাকা!

পাহাড়ের পেছনে আকাশে ধীরে ধীরে সূর্যের লাল-হলুদ আভা ফুটে উঠছে। আকাশের অন্য কোণে ছোট্ট হয়ে থাকা চাঁদটাও উঁকি মারছে। যেন আস্তে আস্তে রাতের চাদরখানা কেউ সরিয়ে নিচ্ছে, আর লাচুং এর বুকে নেমে আসছে ভোর! সে এক অপরূপ দৃশ্য।

লাচুং এ ভোর © Writer

আমাদের প্রথম গন্তব্য কাটাও। আর পরবর্তী গন্তব্য ইয়ামথাং ভ্যালি। দুটোর মাঝখানে আমাদের হোটেল হওয়াতে ঠিক হলো, কাটাও দেখে ফেরার পথে ব্রেকফাস্ট করে ইয়ামথাং ভ্যালি যাব। কোথাও খুব বেশি সময় নেয়া যাবে না, কারণ ১২ টার দিকে আবার গ্যাংটক রওনা হওয়া লাগবে। কাজেই সবাই দ্রুত বরফের উপযুক্ত জামাকাপড়ে নিজেদের প্যাকেট করে জীপে চড়লাম।

কাটাও আর ইয়ামথাং ভ্যালি দুটোই হোটেল থেকে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের রাস্তা। ইয়ামথাং ভ্যালি উত্তর দিকে, আর আমরা যাচ্ছিলাম পূর্বদিকে। রাস্তার কথা আর কী বলব! পেটের মধ্যে যেভাবে নাড়িভূড়ি প্যাঁচানো থাকে, ঠিক সেরকম প্যাঁচানো রাস্তা। একটার পর একটা বাঁক নিচ্ছে তো নিচ্ছেই।

মিনিট দশেক পরেই বরফের দেখা মিলল। লালমোহনবাবুর ভাষায় বলতে গেলে, “গাছে বরফ, রাস্তায় বরফ, পাহাড়ে বরফ, চারিদিকে তুষার তুষারময়!” বাস্তবিকই তাই, কেবল রাস্তার মাঝখানটা বাদ দিয়ে চারপাশ পুরোটা সাদা হয়ে রয়েছে।

ঠান্ডা যেন মিনিটে মিনিটে বাড়ছিল। এভাবে বড়জোর দশ-পনের মিনিট এগিয়ে গাড়ি থামল খাণ্ডা ওয়াটার ফলস-এর সামনে।  সামনে একটা ছোট লোহার পুল পেরিয়ে রাস্তাটা পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই পথে কিছুদূর গেলেই আর্মি চেকপোস্ট পড়ে, তারপরেই ভারত-চীন বর্ডার। অতদূর আমাদের যাওয়ার অনুমতি নেই, কাজেই এখানেই নেমে পড়তে হলো।

নামার পর দেখলাম হাঁটাই মুশকিল। একে তো ভয়ানক ঠাণ্ডা, তাপমাত্রা মাইনাস ছয় ডিগ্রি, তার ওপর পায়ে বুট আর গায়ে বিশাল একখানা জ্যাকেট। এসব নিয়ে বরফের ওপর হাঁটা চাট্টিখানি কথা নয়। পিছলে পড়ার ভয়ও রয়েছে। তাই ছোট ছোট পায়ে, যাকে বলে ‘বেবি স্টেপ’ নিয়ে আমরা ঝরনার কাছে গেলাম। মাইনাস তাপমাত্রায়ও পানির বেগ ঝরনাটাকে জমাট বাঁধতে দেয়নি।

তুষারময় কাটাও © Writer

ঝরনার উল্টো দিকে তাকাতেই আমাদের যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। খানিক দূরেই বিশাল এক পাথুরে পাহাড়, সূর্যের আলো এসে পড়েছে সে পাহাড়ের চূড়ায়। বরফঢাকা চূড়াটা ঝকঝক করছে! যেন একরাশ সোনা কেউ রেখে এসেছে তার মাথায়।

আমাদের পাহাড় আর ঐ সোনার পাহাড়ের মাঝে এক উপত্যকা, সূর্য বেশিদূর ওঠেনি, কাজেই সামনের পাহাড় ছাড়া আমাদের আশেপাশে সবই ছায়াময়। কেমন একটা অপার্থিব সৌন্দর্য এই আলো-ছায়ার খেলায়, যা প্রতিটা মূহুর্তেই আমাদের আরও বেশি মুগ্ধ করছিল!

খান্ডা ওয়াটারফলস © Writer

মুগ্ধতা সামান্য কাটতেই খেয়াল হলো, শীতে আমাদের অবস্থা বেশ খারাপ। হাঁটুর পর আর কিছু আছে বলে অনুভব করতে পারছি না। ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গিয়ে বুটটা চেপে বসেছে পায়ে। ‘কাটাও’ মনে হয় পা দু’খানা কেটেই রেখে দেবে। প্রায় আধঘন্টা দাঁতে দাঁত চেপে শীতের কামড় সহ্য করার পর বুঝলাম, আর সম্ভব না!

রোদের জন্য আমরা তখন হন্যে হয়ে উঠেছি। আমরা আছি পাহাড়ের আড়ালে, কাজেই এখানে রোদ উঠতে সময় লাগবে। খানিকটা পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেখানে রোদ উঠেছে সেখানে নাহয় নামব। যেই ভাবা সেই কাজ, পড়িমরি সবাই গাড়িতে উঠে কিলোমিটারখানেক পিছিয়ে গেলাম।

ততক্ষণে বেশ সুন্দর রোদ উঠল, গাড়ি থেকে নেমে এবার আমরা বরফ ছোঁড়াছুঁড়ি করছি। রোদ প্রবল শীতের অনুভূতিটুকু কাটিয়ে দিতেই সবাই বরফের আনন্দ নিতে লেগে পড়ল। মিনিট বিশেক এভাবে ‘বরফকেলি’ (জলে আনন্দ করাকে যদি জলকেলি বলা হয়, বরফে তো তাহলে আমরা বরফকেলিই করছিলাম, নাকি?) করার পর আমরা হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম।

ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য ইয়ামথাং ভ্যালি। এবার শীতটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল, কারণ ন’টা বেজে গেছে। সূর্য বেশ অনেকখানিই উঠে পড়েছে। বিশ মিনিটের রাস্তা, সবাই হালকা ন্যাপ নিয়ে নিলাম।

যখন চোখের পাতা আলাদা হলো, হতভম্ব হয়ে পড়লাম। চারপাশে দানবাকৃতির সব পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকা। চূড়াগুলো যেন মেঘের দেশে গিয়ে ঠেকেছে। একটার পর একটা পাহাড় এমনভাবে আমাদের ঘিরে রয়েছে, মনে হয় তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে, এই বুঝি নড়ে উঠল!

ইয়ামথাং ভ্যালী © Writer

গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম অসংখ্য ট্যুরিস্ট, ভ্যালির বুকে। তবে ভ্যালির বিশালতা মানুষের সংখ্যাকে ধর্তব্যের মধ্যে আসতে দিল না। এ সৌন্দর্যের কী বর্ণনা দেব!

বরফে ঢাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম ধীরে ধীরে, আর মুগ্ধতা বাড়ছিল। কালো পাথুরে রাস্তা আর পাহাড়। বরফের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল তাদের আসল রঙটা। সাদা কালো মিশে যেন অন্যরকম এক রঙের খেলা। তার সাথে সূর্যের সোনালী আভা আর গাছপালায় সুপ্ত সবুজ রঙ তো আছেই। সব মিলিয়ে পুরোই অন্য এক জগতের অনুভূতি!

প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো কাটালাম এখানে। কতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম পাহাড়গুলোর দিকে, কতক্ষণ বরফের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করলাম, বরফের পুতুল বানালাম, আমরা যেন আমাদের মধ্যে নেই। কী করছি না করছি- কিছুই যেন ঠিকমত বুঝতে পারছি না, খালি একরাশ মুগ্ধতা আর সামান্য অবিশ্বাস নিয়েই কাটল পুরো সময়টা।

প্রতিটা সেকেন্ড যেন জীবনের জ্বালানী যোগাচ্ছিল, শেখাচ্ছিল বেঁচে থাকার আসল অর্থ। তাই যখন ফেরার জন্য রওনা দিলাম, কারোর মনেই আফসোস ছিল না। কারণ ভয়াবহ সৌন্দর্যের কাছে বেশিক্ষণ থাকতে নেই!

পাহাড় গিয়ে ঠেকেছে মেঘে © Writer

শেষদিন, মনাস্ট্রিতে

নর্থ সিকিম থেকে গ্যাংটক ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। রাতটা এম.জি.মার্গে ঘোরাঘুরি করেই কাটালাম। পরদিন সকালে উঠে মনে হল, আজই শেষ দিন, আগামীকাল সকালেই ফেরার পথ ধরতে হবে।

শেষ দিন পুরোটাই আমরা কাটালাম দুটো মনাস্ট্রিতে, একটা গ্যাংটকের বিখ্যাত রুমটেক মনাস্ট্রি, আরেকটা রাংকা মনাস্ট্রি। সারাদিনের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে আমরা রওনা দিলাম রাংকা মনাস্ট্রির দিকে। গ্যাংটক থেকে রাংকা বিশ কিলোমিটার। এটাকে লিংদুম মনাস্ট্রিও বলে, তবে রাংকা নামেই বেশি পরিচিত।

রাংকা মনাস্ট্রির প্রবেশপথ © Writer

ঢোকার মুখে দেখলাম লাল-হলুদ দোচালা একটা স্ট্রাকচার, যার সাথে অনেক জপযন্ত্র বা প্রেয়ার হুইল লাগানো আছে। প্রার্থনা করতে যারা আসেন, তারা হাঁটতে হাঁটতে চাকাগুলো ঘোরাতে থাকেন। চাকার গায়ে মন্ত্র লেখা আছে। একবার ঘোরালে মন্ত্রটা একবার পড়া হয়ে যায়। যাই হোক, গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমরা মনাস্ট্রির বিশাল চত্বরের অভ্যর্থনা পেলাম।

ডানপাশে জপযন্ত্রের তৈরি স্ট্রাকচার সাপের মত লম্বা হয়ে চলে গেছে প্রায় দুশ’ ফুট পর্যন্ত। এরপর রাস্তাটা বেঁকে বামদিকে চলে গেছে ইউনিভার্সিটির দিকে। ঢোকার বামপাশেই পার্কিং, সুন্দর একখানা রেস্তোরাঁ আর স্যুভেনিয়র শপ, এরপর আছে ‘গোল্ডেন স্তূপা’। আর কমপ্লেক্সের মাঝে ‘গ্রেট অ্যাসেম্বলি হল’ অর্থাৎ মূল মন্দির, তার চারপাশ ঘিরে দোতলা হোস্টেল আর স্কুল, মাঝখানটায় উঠোন।

পুরো কমপ্লেক্সটাই খুব সুন্দর করে ডিজাইন করা। আশেপাশে আর কোনো ঘরবাড়ি না থাকায় কমপ্লেক্সের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল শুধু পাহাড় আর গাছপালা। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল বোধহয় ভুল করে কোন ছবির জগতে ঢুকে পড়েছি!

গ্রেট এসেম্বলী হল © Writer

ঢোকার রাস্তাটা গোল হয়ে মূল মন্দিরটাকে পেঁচিয়ে পুরো কমপ্লেক্স ঘুরে আবার ঢোকার মুখে এসে মিশেছে। কাজেই আমরা সে রাস্তা ধরেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবার আগে সিঁড়ি বেয়ে ঢুকলাম অ্যাসেম্বলি হলে। করিডোর আর উঠোন পেরিয়ে দু’পাশে দুটো সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর মূল মন্দিরের সামনে ছোট আরেকটা উঠোন, তারপরে ফয়ার পেরিয়ে মন্দিরে ঢোকার লাল দরজা।

ফয়ারের দিকে তাকালে চোখ যেন ধাঁধিঁয়ে যায়। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই রঙিন নকশায় ভরপুর। মূল মন্দিরের ভেতর প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু এক বুদ্ধমূর্তি। মূর্তির দুপাশে কাঠের আলমারি উঠে গেছে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত, তার সাথে ছোট ছোট কাচের পাল্লা।

প্রতিটা পাল্লার পেছনে একটি করে ছোট বুদ্ধমূর্তি। সব মিলিয়ে অন্তত সাত-আট হাজার মূর্তি রয়েছে আলমারিতে। বড় বুদ্ধমূর্তির সামনে, আশেপাশে টেবিলের ওপর শত শত জিনিসপত্র- ফুল, প্রদীপ ইত্যাদি। এত এত জিনিসের ভীড়ে কোনটা যে কী, তাই বোঝার উপায় নেই। তবে সবই যে পূজার জন্য- তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল।

গোল্ডেন স্তূপা © Writer

মন্দিরের পেছন দিকে প্রধান পুরোহিতের বাড়ি। বাড়ির সামনে খুব সুন্দর বাগান করা। একপাশে ইউনিভার্সিটি, আর এক পাশে স্তূপা। স্তূপাটা তিনভাগে ভাগ করা। দু’পাশে দুটো চোঙাকৃতি স্থাপনা আর মাঝখানে মূল মন্দিরের আদলে তৈরি একখানা ঘর, তবে আকারে ছোট।

ভেতরে বিশাল এক জপযন্ত্র টাঙানো। চারটে কাপড় বাঁধা দেখে বুঝলাম, চারজন ঐ কাপড় কোমরে বেঁধে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে আর সেই সাথে জপযন্ত্রটাও ঘোরে।

রঙিন রুমটেক মনাস্ট্রি © Writer

পুরো মনাস্ট্রি দেখে শেষ করতে দুপুর হয়ে গেল। রাংকার রেস্তোরাঁতেই নুডুলস আর মোমো দিয়ে লাঞ্চ সারলাম, এরপর রওনা দিলাম রুমটেক। রাংকা থেকে রুমটেকও বিশ কিলোমিটারের মতোই দূরত্ব। রুমটেকে ঢোকার মুখে বেশ কড়া সিকিউরিটি চেকিং হয়। সম্ভবত এর খ্যাতি আর পরিচিতির জন্যই।

যদিও রুমটেক এতটা জমকালো নয়, যতটা রাংকা। সেটাই স্বাভাবিক কারণ রুমটেক মনাস্ট্রি রাংকার অন্তত তিরিশ বছর আগে তৈরি। জমকালো কম হলেও রুমটেক যেন অনেক বেশি জীবন্ত! সবসময়ই কোনো না কোনো কাজকর্ম চলছে। করিডোরে যেমন প্রচুর লামা পড়াশোনা করছিল, তাদের গলার স্বরে চারদিক গমগম করছিল।

মন্দিরের গঠনে রাংকা আর রুমটেকের তেমন পার্থক্য নেই, কেবল রুমটেকের আকার বেশ ছোট। এছাড়া রঙ, নকশা দুটো মন্দিরেই প্রায় একইরকম। রুমটেকের মূল মন্দিরের পেছনে আছে নালন্দা ইনস্টিটিউট আর গোল্ডেন স্তূপা। দুটোই বেশ ওপরে, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। গোল্ডেন স্তূপায় যাওয়ার যে সিঁড়ি, তার পাশের দেওয়ালে বুদ্ধের অনেকগুলো বাণী ঝোলানো আছে, বেশ চমৎকার লাগল ব্যাপারটা!

গৌতম বুদ্ধের বাণী © Writer

ছয় দিনের সফর অবশেষে তার শেষ দিনটাও পার করে ফেলল। পরদিন সকালে জীপ নিয়ে রওনা দিলাম বাংলাবান্ধা। পেছনে রেখে গেলাম, আশ্চর্য সুন্দর মায়াভরা এক রাজ্য। যেন হাতছানি দিয়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল; আর বলছিল, আবার দেখা হবে!

This is a bangla travel article on sikkim. It is regarded as one of the most famous places in India.

Feature Image © Writer

Related Articles