আজকের গল্পটা এমন এক বাজারের যার সম্পর্কে প্রচলিত আছে, এখানে থেকে কেউ স্বর্ণ ছাড়া ফিরে যায় না। প্রায় রূপকথার মতো শোনালেও এর মধ্যে একেবারেই যে সত্যতা নেই তা নয়। যা রটে তার কিছু তো বটে!
বলছিলাম তুরস্কের গ্র্যান্ড বাজারের কথা। যাকে তুর্কিতে বলা হয় কেপালসার্সি, আরবিতে আস-সুক আল-মাসকুফ আর ইংরেজিতে গ্র্যান্ড বাজার। এটি সম্পদে যেমন ধনাঢ্য, তেমনি এর ইতিহাসের জেল্লাও কম নয়। ১৪৫৫ সালের শীতে যখন এর প্রথম ইটটি গাঁথা হচ্ছে ততদিনে সদ্য রোমানদের পতন ঘটেছে। কনস্ট্যান্টিনোপলের মসনদে বসেছেন ইতিহাসের বিস্ময়পুরুষ মুহাম্মাদ আল ফাতিহ (মেহমেত দ্য কনকোয়ারার)। তার হাতেই এই বাজারের প্রতিষ্ঠা। শুরুতে প্রধানত কাপড় আর অলংকার ব্যবসায়ীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই বাজারের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি।
মাত্র দুটি পেশার মানুষদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই বাজারের প্রাক্তন নাম ছিল বেদেস্তান— কাপড়ের বাজার। সুলাইমান আল কানুনীর সময় এর পাশাপাশি আরেকটি বাজার নির্মিত হলো, যার নাম সান্দাল বেদেস্তান। অধুনা এই দুটি বাজারের সমন্বয়েই বিশ্বব্যাপী এর পরিচিতি গ্র্যান্ড বাজার নামে। এই বাজারের আরবি নামটির মধ্যে এর পরিচয়ের একটি বড় উপাদান লুকিয়ে আছে। আরবিতে একে ডাকা হয় আস-সুক আল-মাসকুফ বলে, যার অর্থ হচ্ছে ছাদওয়ালা বাজার। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, পৃথিবীর আর সব বাজারের থেকে বিরল ব্যতিক্রম এই বাজার সম্পূর্ণ ছাদে ঢাকা। শুরুর দিকে যা ছিল কাঠের, উপর্যুপরি আগুন লাগার প্রবণতা থেকে পরে এর ছাদকে ঢেকে দেয়া হয়েছে টাইলস দ্বারা।
প্রাচীনকাল থেকেই চিত্রকলা ও ভ্রমণকাহিনীতে এই বাজারের অস্তিত্ব ছিল। ছিলো দুনিয়াব্যাপী ব্যবসায়ীদের কাছে আলাদা পরিচিতি। এর কারণও পরিস্কার, তিন মহাদেশ ব্যাপী বিস্তৃত উসমানী খেলাফতের কেন্দ্র ইস্তাম্বুলে অবস্থিত এই ব্যবসায়িক কেন্দ্র শুরু থেকেই ছিল ক্যারাভান রাখা, মুসাফিরদের আস্তাবল, পানির ফোয়ারা ইত্যাদি সুবিধায় সমৃদ্ধ।
কাপড়ের ব্যবসায়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় এর ছিল আলাদা কদর। অবশ্য ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর এর খ্যাতির জেল্লায় খানিকটা ভাটা পড়ে, কিন্তু কার্পেটের খ্যাতি ছিল বহাল তবিয়তে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় স্বর্ণ ও রত্নের ব্যবসায়। যার চমক যে এখনো রয়ে গেছে সেটা বোঝা যায় সারাবছর এর স্বর্ণ বিক্রি ও স্বর্ণকারের পরিমাণ দেখলে। প্রতিদিন এখানে আমদানী হয় দুই টন নিখাঁদ সোনা, আর বছরে বিক্রি হয় তিনশ ষাট টন স্বর্ণালংকার। একেকজন স্বর্ণ বিক্রেতাদের দৈনিক বিক্রি হওয়া স্বর্ণের পরিমাণ দশ কিলোগ্রাম থেকে ত্রিশ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। ২০১৩ সালের ডলারের হিসেবে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার ডলার থেকে দেড় লাখ ডলার পর্যন্ত। এখানে আছে চারশ জন স্বর্ণকার ও আড়াইশো জন স্বর্ণকারিগর। তুর্কি ভাষায় যাদের নাম ‘সাদাকার’।
পৃথিবীর প্রথম শপিংমল হিসেবে খ্যাত এই গ্র্যান্ড বাজার পর্যটনকেন্দ্রও বটে। প্রায় পৌনে ছয় শতাব্দীর কালের দাগ লেগে রয়েছে যে স্থাপনায় তার প্রতি আকর্ষণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ইট আর পাথরে নির্মিত এই স্থাপনা দেখতে গড়ে প্রতিদিন এখানে আসেন আড়াই থেকে চার লাখ দর্শনার্থী। গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে যা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ পর্যন্ত। এই বিপুল কর্মযজ্ঞ সামাল দিতে আছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পুলিশ। তা ছাড়াও এমনিতে এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা চমৎকার। স্বচ্ছন্দে চলাচলের জন্য আছে ৬৪টি রাস্তা। চুয়াল্লিশ হাজার বর্গ মিটার আয়তনের এই বাজারে প্রবেশপথ রয়েছে বাইশটি। বারোটি বাড়িতে থাকা ৩,৬০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেখাশোনা ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য আছে ৪৩ জন বিশেষ পাহারাদার।
দীর্ঘ পৌনে ছয়শো শতাব্দীর পুরোনো এই বাজার তার দীর্ঘ জীবনে বেশ কয়েকবার আংশিক ও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। এর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আছে আগুনে পোড়ার দাগ। সাধারণ হিসেবের বাইরেই স্মরণীয় ইতিহাসে প্রায় চৌদ্দবার আগুন লাগবার কথা জানা যায়। ১৬১৮ সালের আগুনে বিত পাজারী (সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেট) ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আর ১৬৬০ এ এমনকি পুরো গ্র্যান্ড বাজারই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। বারবার আগুন লাগার ফলে এর কাঠের ছাদ পাল্টে টাইলস লাগানো হয়, আর বাজারের ভেতরে ধূমপান করা হয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গ্র্যান্ড বাজারের সবশেষে আগুন লাগার ঘটনা জানা যায় ১৯৫৪ সালে।
এছাড়া ভূমিকম্পের আঘাতেও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৮৯৪ সালের ভূমিকম্পে যখন পুরো ইস্তাম্বুল ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন গ্র্যান্ড বাজারও বিধ্বস্ত হয়েছিল। যার পরে পুরো এলাকা পুনর্নির্মাণ করা হয়। সেসময় এর কয়েকটি বাড়ি সীমানার বাইরে রয়ে গিয়ে গ্র্যান্ড বাজারের আকার প্রাচীন আকৃতির চেয়ে ছোট হয়ে যায়। বারবার আঘাতে আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েও বহু পুরাতন এই বাজার আবার সজাগ হয়ে উঠেছে। মুসাফিরের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে এর গলি, আস্তাবল, দোকানপাট। পুনরায় গড়ে উঠছে এর ঐশ্বর্য।
সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এই বাজার যখন প্রতিষ্ঠা করেন তখন এর দোকান ছিল মোটে ১১৮টি, কাজ করত দু-চার পেশার লোক। বর্তমানের গ্র্যান্ড বাজারে প্রায় চার হাজার দোকানে আছে শখানেক ভিন্ন ভিন্ন পেশার লোক। গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল স্বর্ণ ও রত্ন পাথরের দোকান। বলা হয়, এর সম্পদের পরিমাণ ইহুদী ধনকুবের রসথচাইল্ড পরিবারের কয়েকগুন। বিশাল সম্পত্তির সম্ভার সাজিয়ে বসে থাকা এসব দোকান আকারে অবশ্য খুবই ছোট, উচ্চতায় ৬-৮ ফুট আর প্রস্থে ১০ বর্গ মিটারের কম। এই ক্ষুদ্র দোকানের সামনে ঝোলানো থাকে রং-বেরঙের কাপড়, আর দোকানের ভেতরে ভল্টে থাকে দামী পণ্য। সামনের তাকিয়ায় হেলান দেওয়া দোকানীর হাতে থাকে চায়ের কাপ, আর তার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের বহু দেশের খদ্দের।
এসব দোকানির কারো কারো পেশার বয়স অর্ধশতাব্দীরও বেশি। দীর্ঘ দিনের এই অভ্যস্ত জীবন ছেড়ে তারা আর কোথাও যেতেও চান না। প্রায় চল্লিশ বছর অলংকারে মুক্তা বসানোর কাজ করা মাইক যুনকিক বলেন, “কেউ যদি বলে তোমার প্রিয় জিনিস কী, আমার জবাব হলো, এই ছাদওয়ালা বাজার, আমার স্ত্রী, আর প্রিয় ফুটবল ক্লাব।” সারা জীবন এক স্বর্ণকারের পেশায় কাটিয়ে দেওয়া ওস্তাদ ফেদায়ী বলেন, “লোকে যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়েছি, তখন বলি, আমি ডিগ্রি নিয়েছি এই ছাদওয়ালা বাজারের জীবন থেকে।” যৌবনের শুরুতে এক স্বর্ণকারের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে আসা মোহাম্মদ কংকোর এখানে পার করেছেন দীর্ঘ ছয়টি দশক। পেরিয়ে আসা জীবনের দিকে ফিরে তার জীবনের মূল্যায়ন হলো, “আমি আল্লাহর কাছে সন্তুষ্ট যে এখানে বেহেশতের প্রশস্ততায় থাকছি, এটি পৃথিবীর আর সব জায়গার মতো নয়।”
ফিরে যাওয়া যাক শুরুর বিন্দুতে। আসলেই কি যারা গ্র্যান্ড বাজারে যায় তারা স্বর্ণ ছাড়া ফিরে আসে না? কথাটা আতিশয্য করে বলা হলেও কিঞ্চিত সত্যের ছোঁয়া আছে বৈকি। এর শত শত স্বর্ণ ও স্বর্ণকারের দোকানে অনবরত গলানো হচ্ছে সোনা, আগুনের তাপে গনগনে হয়ে নেমে আসছে পাত আকারে, রেতের ঘষায়, হাতুড়ির আঘাতে বিন্দু বিন্দু হয়ে স্বর্ণ ছড়িয়ে পড়ছে বাজারের পথেঘাটে। লেগে থাকছে জামা কাপড়ে। প্রতিটি স্বর্ণকারের সামনে লাগানো আছে চামড়ার থলে, যেখানে কাজ করার সময় জমা হওয়া স্বর্ণের গুড়ো জমা হয়। দোকানে জমা হওয়া ধুলো ঝাড়ু দিয়ে জমিয়ে রাখা হয়, সেখানেও থাকে বিন্দু বিন্দু স্বর্ণ। বছর শেষে সেই ধুলোও দাম দিয়ে বিক্রি হয়। এমনকি বাজারের ফেলে দেয়া কাগজের ঠোঙাও অন্য সবকিছুর সাথে ফেলে দেয়া হয় না। প্রতিটা প্যাকেট আলাদা আলাদা করে দেখার পরই তা ফেলা হয়। কারণ ভুলে যদি একটি মুক্তার দানা, এক টুকরো স্বর্ণ রয়ে যায়, তবে সেটাই ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সহায়ক হবে। মিললেও মিলতে পারে অমূল্য রতন!
গ্র্যান্ড বাজারের সাতকাহন তো শোনা হলো, এবারে ইস্তাম্বুল ঘুরতে গেলে একপাক ঘুরে আসুন বিখ্যাত ছাদওয়ালা বাজারে। যেখানে শতাব্দী প্রাচীন ঐশ্বর্যের সম্ভার সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে এক বণিক। যার দেয়ালে লেগে আছে এক বিগত সাম্রাজ্যের পায়ের ছাপ। সম্পদের মূল্য যা-ই থাক, এসব ইতিহাসের দাম নিশ্চয়ই কোনো অংশে কম নয়।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে