নিজের ঘরেই হোক কিংবা বনে-জঙ্গলে, মাকড়সা দেখে আঁতকে ওঠেন না বা এই প্রাণীকে এড়িয়ে চলে না এমন মানুষ খুব কমই আছে। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আট পা এবং ষোলো হাঁটুর এই প্রাণীটির প্রজাতির সংখ্যা প্রায় চল্লিশ হাজার। কাজেই এত সব প্রজাতির মধ্যে থেকে খুঁজে-বেছে সঠিক করে বলা মুশকিল যে, কোন মাকড়সাগুলো সবথেকে বেশি মারাত্মক। আবার বিভিন্ন মানুষের শরীরে একই মাকড়সার প্রভাব ভিন্নভাবে পড়তে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মাকড়সা বিষের প্রতি সংবেদনশীলতার উপরে।
আর্থ্রোপোডা (Arthropoda) পর্বভূক্ত এই প্রাণীটির প্রতি মানুষের মনে একপ্রকার ভীতি জন্ম নেয়। মাকড়সার প্রতি এই ভীতিকে বলা হয় আরাকনোফোবিয়া (Arachnophobia)। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫% এই মাকড়সাভীতিতে ভুগে থাকেন। জাস্টিন টিম্বারলেক কিংবা জে. কে. রাওলিং এর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এই তলিকার বাইরে নন। যদিও মাকড়সার চল্লিশ হাজার প্রজাতির মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক প্রজাতি আছে, যাদের নিয়ে মানুষের সত্যিকারের ভয় পাওয়ার কারণ আছে।
মাকড়সার সকল প্রজাতিরই দুটি বিষদাঁত থাকে। এই বিষদাঁতের মাধ্যমে মাকড়সা এর জালে আটক শিকারের শরীরে বিষ প্রয়োগ করে। এই বিষের প্রভাবে শিকার পতঙ্গের অভ্যন্তরের সবকিছু তরল হয়ে যায়। মাকড়সা এই তরল শুষে নিজের ক্ষুধা নিবৃত্ত করে। উল্লেখ্য, মাকড়সার বিষ মাকড়সার কোনো ক্ষতি করে না।
এখন জানা যাক সামগ্রিকভাবে বিষাক্ত কিছু মাকড়সা সম্বন্ধে যাদের নিয়ে মানুষের চিন্তার কারণ আছে।
ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারিং স্পাইডার
এই তালিকার প্রথমেই আছে ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারিং স্পাইডার (Brazilian wandering spider)। অনেকটা দক্ষিণ আমেরিকার উলফ স্পাইডারের মতো দেখতে হলেও ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারিং স্পাইডার আকারে বড় এবং এর বিষের শক্তিমাত্রা বেশি। এই ধরনের মাকড়সার বিষ স্নায়বিকভাবে খুবই সক্রিয়। একে মাকড়সাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষধর এবং বিপদজনক বলে মনে করা হয়ে থাকে।
সাধারণত শিকারী প্রজাতির এই মাকড়সা প্রচুর ভ্রমণ করে থাকে। দিনের বেলায় এদের চলাচল কম হলেও রাতে এরা যথেষ্ট চলাচল করে। এরা যদি কখনো বিপদের আভাস পায় বা কোনো প্রাণীর স্পর্শ পায় সেক্ষেত্রে এরা নিজেকে বাঁচানোর জন্য কামড় বসাতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে এই কামড়ের মাধ্যমে কোনো বিষ প্রয়োগ করে না। এরা বিষ প্রয়োগ করে তখনই যখন এরা আঘাতপ্রাপ্ত হয় বা এদেরকে কোনোভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত এই প্রজাতির মাকড়সা প্রতিটি কামড়ের সাথে শক্তিশালী সেরোটনিন (Serotonin) সমৃদ্ধ বিষ প্রয়োগ করে যা মাংসপেশীতে তীব্র চোটের (Muscle shock) সৃষ্টি করে। এরপর আস্তে আস্তে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় যা একপর্যায়ে পক্ষাঘাতের সৃষ্টি করে।
এদের বিষকে কতিপয় বিপদজনক সাপের বিষের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। মাকড়সা জগতের দ্বিতীয় ভয়ংকর প্রজাতি ব্ল্যাক উইডোর বিষের থেকে এদের বিষ প্রায় বিশগুণ শক্তিশালী। বিষের শক্তিমাত্রা এতটাই বেশি যে, কামড়ের পর বিষের এন্টিডট অর্থাৎ এন্টিভেনম দেয়ার পরেও কামড়ের এক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুর রেকর্ড আছে। শিশু এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরো বেশি। কারণ তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে কম।
ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার
মাকড়সা জগতে ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডারিং স্পাইডারের পরেই ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারকে (Black widow spider) স্থান দেয়া হয়। এই কুখ্যাত প্রজাতির মাকড়সাকে এদের পেটে রঙিন বালিঘড়ির চিহ্ন দেখে শনাক্ত করা যায়। এই প্রজাতির মাকড়সা সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে বসবাস করে থাকে। পুরোনো ধাঁচের বাড়ি, কাঠের বাড়ি অথবা কাঠের স্তূপ এদের জন্য উপযুক্ত বসবাসের জায়গা। মজার ব্যাপার হলো, এই প্রজাতির স্ত্রী মাকড়সাই বেশি দেখা যায়, কারণ পুরুষ মাকড়সার সাথে মিলনের পরেই স্ত্রী মাকড়সা এদের খেয়ে ফেলে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই প্রজাতির নাম হয়েছে উইডো অর্থাৎ বিধবা।
ব্ল্যাক উইডো প্রজাতির মাকড়সার বিষ র্যাটলস্নেকের বিষের থেকে প্রায় ১৫ গুণ বেশি শক্তিশালী। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এই মাকড়সার কামড়ের জন্য প্রায় ৬৩ জনের মৃত্যুর রেকর্ড আছে। একই সাথে জানা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বিষ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে (Poison Control Center) প্রায় ২,৫০০ জন ভর্তি হয় শুধুমাত্র এই প্রজাতির মাকড়সার কামড়ের কারণে। তবে এখন ভবন নির্মাণ কৌশলের আধুনিকতার কারণে এবং এন্টিভেনম আবিষ্কারের কারণে এই মৃত্যু নেই বললেই চলে।
এরা সাধারণত উগ্র প্রজাতির নয়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কামড়ের সাথে বিষ প্রয়োগ করে না। কিন্তু কোনো কারণে বিষ প্রয়োগ করলে সেটি মাংসপেশীতে ব্যথার সৃষ্টি করে। এরপর আস্তে আস্তে ডায়াফ্রাম প্যারালাইজড হয়ে যায়, যার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে কেউ কেউ দাবী করেন, তারা এই অবস্থা থেকে সেরে উঠেছেন কয়েকদিন পরেই। এদের বিষের ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে বলা হয় ল্যাট্রোডেকটিজম (Latrodectism)। উল্লেখ্য, ব্ল্যাক ঊইডো স্পাইডার, রেড ব্যাক স্পাইডার এবং ব্রাউন উইডো স্পাইডারের প্রকৃতি ও বিষক্রিয়া প্রায় একই রকম।
সিডনি ফানেল ওয়েব স্পাইডার
অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী এই প্রকার মাকড়সাকে প্রথম শ্রেণীর বিষাক্ত মাকড়সাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এদেরকে সাধারণত কোনোভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলে এরা বেশ উগ্ররূপ ধারণ করে। অর্থাৎ এই মাকড়সা অনেকটা বদমেজাজি ধরনের হয়ে থাকে। স্ত্রী মাকড়সা অধিকাংশ সময় এদের জালেই জীবন কাটায়। পুরুষ মাকড়সা গ্রীষ্মকালে মিলনের জন্য ঘোরাঘুরি করে থাকে।
সিডনি ফানেল ওয়েব (Sydney Funnel Web) মাকড়সার বিষদাঁত মাকড়সা জগতের মধ্যে সবথেকে বেশী নিখুঁত। এদের বিষদাঁত কতিপয় প্রজাতির সাপের থেকে উন্নত। তীক্ষ্ণ, সূচালো এই দাঁতের সাহায্যেই এই মাকড়সা এদের শিকারকে বা উত্যক্তকারীকে কামড় দেয় এবং বিষ প্রয়োগ করে। এদের দাঁত এতটাই তীক্ষ্ণ যে, চামড়ার জুতার ভেতর দিয়ে, এমনকি নখের উপর দিয়ে এরা কামড়াতে পারে।
এদের বিষে অ্যাট্রাকোটক্সিন (Atracotoxin) নামক একপ্রকার যৌগ থাকে, যা স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলে। এদের বিষ পূর্বে বর্ণিত মাকড়সাদের থেকে খুব শক্তিশালী নয়। তবে এরা যখন কামড় দেয় তখন আক্রান্ত প্রাণীর সঙ্গে লেগে থেকে একের পর এক কামড় দিতে থাকে এবং প্রতি কামড়েই বিষ প্রয়োগ করতে থাকে। এভাবে যতক্ষণ না বিষের পুরো ডোজ প্রয়োগ করা না হয় ততক্ষণ কামড় চলেতে থাকে।
১৯২৭ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে এই প্রকার মাকড়সার কামড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর রেকর্ড আছে ১৩ জনের এবং এদের কামড়ের পনেরো মিনিটের মধ্যে একটি বাচ্চার মৃত্যুর কথাও জানা যায়। তবে ১৯৮০ সালে এদের এন্টিভেনম আবিষ্কারের পর আর কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
রিক্লজ স্পাইডার
রিক্লজ স্পাইডারের (Recluse spider) মধ্যে দুই ধরনের মাকড়সার উল্লেখ পাওয়া যায় যারা বিষাক্ত। এরা হলো ব্রাউন রিক্লজ স্পাইডার এবং চিলিয়ান (Chilean) রিক্লজ স্পাইডার। মাথায় বেহালার মতো চিহ্ন থাকায় ব্রাউন রিক্লজ স্পাইডার ‘ভায়োলিন স্পাইডার’ বা ‘ফিডলার’ নামেও পরিচিত। অলস প্রকৃতির এই মাকড়সা সাধারণত জুতার মধ্যে বা কাপড়চোপড়ের মধ্যে বাসা বাধে। এর ফলে এরা সহজেই মানুষের সংস্পর্শে আসে এবং যদি কোনোভাবে এরা চাপ অনুভব করে তখন কামড় দেয়।
ব্রাউন রিক্লজ স্পাইডারের কামড় বিষাক্ত হয়ে থাকে। যদিও এদের কামড়ের ফলে কোনো মৃত্যুর রেকর্ড পাওয়া যায় না। এদের বিষ সাধারণত ক্ষয়কারী। এদের কামড়ের ফলে অত্যধিক টিস্যুক্ষয় এবং সংক্রমণ দেখা দেয়। এই অবস্থাকে বলা হয় লক্সোসেলিজম (Loxoscelism)। এদের বিষের কোনো সঠিক প্রতিষেধক না থাকায় সম্পূর্ণ সারতে প্রায় এক মাস সময় লেগে যায়। কখনো কখনো টিস্যু অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্থ হলে গ্রাফটিং করার প্রয়োজন পড়ে।
এরপর আসে চিলিয়ান রিক্লজ স্পাইডার। এরাও ব্রাউন রিক্লজের মতো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এদের বিষক্রিয়াও মাংসপেশী ও টিস্যুর ক্ষয় করে থাকে।
সিক্স আইড স্যান্ড স্পাইডার
এই প্রকার মাকড়সা সাধারণত আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চলে পাওয়া যায়। এদের রিক্লজ মাকড়সাদের নিকটাত্মীয়ও বলা যেতে পারে। আকারে খানিকটা কাকড়ার মতো চ্যাপ্টা হওয়ার কারণে এদের ‘ক্র্যাব স্পাইডার’ও বলা হয়ে থাকে। মরুভূমির বালির মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা এই মাকড়সা যেকোনো প্রাণীর জন্যেই আততায়ীর মতো ভূমিকা পালন করে।
মানুষের ক্ষেত্রে এদের কামড়ের ক্ষেত্রে কোনো সঠিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না। ফলে এরা মানুষের জন্য কতটা বিষধর তা জানার উপায় নেই। তবে এখন পর্যন্ত দুজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এদের কামড়ের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা হয়। একজনের ক্ষেত্রে নেক্রোসিস অর্থাৎ মাংসপেশীর ক্ষয়ের ফলে একটি হাত পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে। অন্যজনের ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যুর কথা জানা যায়। তবে খরগোশের ক্ষেত্রে এদের বিষের প্রভাব থেকে জানা যায় যে, ৫-১২ ঘন্টার মধ্যে খরগোশের মৃত্যু হতে পারে। এদের বিষে সাইটোটক্সিন (Cytotoxin) নামক যৌগের উল্লেখ পাওয়া যায় যা ক্ষয়কারী।
মাকড়সাভীতির বাইরেই অধিকাংশ মানুষের কাছেই মাকড়সা একটি ছোটখাট পতঙ্গ ছাড়া আর কিছুই না। এটা হতে পারে এই কারণে যে, আমাদের আশেপাশে যেসব মাকড়সা আছে তারা নিরীহ প্রকৃতির বা অতটা বিষাক্ত নয়। কিন্তু অবশ্যই সাবধান থাকা উচিত, কারণ কখন কোন মাকড়সার কামড়ে কী ক্ষতি হয়ে যায়!