২০২০ সালের রসায়নের নোবেল পুরষ্কারটি নিয়ে সারা বিশ্বজুড়েই অনেক আলোচনা সমালোচনা। এবারের পুরষ্কারটি একটু হলেও রসায়ন থেকে সরে প্রাণরসায়ন আর জীবপ্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে গিয়েছে। ‘ক্রিসপার ক্যাস-৯’ প্রযুক্তি দিয়ে প্রাণীর জিনোমকে খুব সহজেই কাটছাঁট করা যাবে, চাইলে প্রত্যাশিত পরিবর্তনও করা যাবে জিনোমে। এই প্রযুক্তির আবিষ্কার আর বিকাশে অবদান রাখার কারণে পুরষ্কারটি পেয়েছেন জেনিফার ডাউডনা, এমানুয়েল শারপ্যান্টিয়ে নামের দুই বিজ্ঞানী।
নোবেলের বাইরেও এ প্রযুক্তি নিয়ে তর্ক বিতর্কের শেষ নেই। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিনোম কাটছাঁট করা সহজ হওয়ার ফলে ক্যান্সার, এইডসের মতো রোগের চিকিৎসায় ভালো ফলাফল পাওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে গবেষকরা। সবচেয়ে বড় আশার বাণী শোনা যাচ্ছে জিনঘটিত জটিলতা যেমন, ‘ডাউন সিন্ড্রোম’, ‘হান্টিংটনস ডিজিজ’, ‘সিকল সেল এনেমিয়া’ ইত্যাদির ভালো প্রতিকার পাওয়া যাবে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বিজ্ঞানীরা সম্ভাবনা দেখছেন ম্যালেরিয়া ছড়াতে পারে এমন মশাকে ক্রিসপার ব্যবহার করে বন্ধ্যা করে দেওয়া যাবে। অনেকেই সম্ভাবনা দেখছেন এই প্রযুক্তির ব্যবহার করে ফিরিয়ে আনা যাবে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতি।
ভিডিও: ক্রিসপার ব্যবহার করে প্রতিরোধ করা যাবে ম্যালেরিয়া
তবে চীনের গবেষণাগারে মানুষের ভ্রূণে ক্রিসপার ব্যবহার করে জিন কাটছাট-সংশোধন নিয়ে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। ক্রিসপারের ফলে আমরা কি এমন পৃথিবীর দিকে হাঁটছি যেখানে ভ্রূণ থাকা অবস্থাতেই অর্থের বিনিময়ে অনাগত শিশুর বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক শক্তি কিংবা অন্য সক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়া যাবে? মানুষের ভেদাভেদ কি বাড়িয়ে দেবে এই প্রযুক্তি? এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে ক্রিসপার ক্যাস-৯। দিন যত গড়াচ্ছে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্র আর সম্ভাবনাও বাড়ছে, এই আবিষ্কারের কিছু মেধাসত্ত্ব নিয়ে বিবাদ গড়িয়েছে আদালতের বারান্দায়।
ক্রিসপার ক্যাস-৯ প্রযুক্তি কী?
শুরুতেই বলে নেওয়া যাক আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা, আমাদের দেহে কোনো জীবাণু যদি একবার আক্রমণ করে এবং সেই আক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠি আমরা, তবে আমাদের দেহে ঐ আক্রমণের একটি স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার যদি একই জীবাণু আক্রমণ করে, আমাদের দেহ অনায়াসেই আগের স্মৃতি ব্যবহার করে তাকে ধ্বংস করে ফেলে। দ্বিতীয়বার আক্রমণের ব্যাপারটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা টেরও পাই না।
ব্যাকটেরিয়াও অহরহ এমন আক্রমণের শিকার হয় ভাইরাসের দ্বারা, ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণকারী ভাইরাসদের বলা হয়ে থাকে ‘ফেইজ ভাইরাস’ (Bacteriophage), এই আক্রমণকারী ভাইরাসদের ঠেকাতেও ব্যাকটেরিয়ার একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে।
আক্রমণকারী ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি করার জন্য তার জেনোমিক ম্যাটেরিয়ালই (ডিএনএ কিংবা আরএনএ) যথেষ্ট। তাই ভাইরাস প্রথমবার যখন তার ডিএনএটি ব্যাকটেরিয়ার মাঝে প্রবেশ করিয়ে দেয়, কিছু ব্যাকটেরিয়া এই ডিএনএটি সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করে রাখে। এই ডিএনএ থেকে প্রথমে তৈরি করে ক্রিসপার-আরএনএ, পরে সেখান থেকে তৈরি হয় ট্রেসার-আরআএনএ (tracrRNA)। ক্যাস প্রোটিনের সাথে এই ট্রেসার-আরএনএ যুক্ত হয়ে ব্যাকটেরিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। আবার যদি একই ভাইরাস তার ডিএনএ ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ করিয়ে দেয় তাহলে ‘ক্যাস প্রোটিন-আরএনএ যুগলবন্দী’ তাকে শনাক্ত করে এবং ধ্বংস করে দেয়।
যাত্রা শুরু
১৯৮৯ সালে স্পেনের এলিকান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল থিসিসে কাজ করার সময়ে ফ্রান্সিসকো মজিকা তার গবেষণাগারে ‘Haloferax mediterranei’ নামের এক অণুজীব (আর্কিয়া নামের এই অণুজীবের ব্যাকটেরিয়ার সাথে সামঞ্জস্য থাকলেও সাধারণত চরম পরিবেশে পাওয়া যায়। যেমন উচ্চ চাপ, উচ্চ তাপমাত্রা, উচ্চ লবণাক্ততা আছে এমন জায়গায়) নিয়ে কাজ শুরু করেন, এই অণুজীব অত্যন্ত লবণাক্ত পরিবেশেও বেঁচে থাকতে সক্ষম।
এর ডিএনএ নিয়ে কাজ করার সময় মজিকা দেখতে পান, ডিএনএর একটা অংশে বিশেষ একধরনের প্যালিন্ড্রোমিক সিকোয়েন্স (সামনে এবং পিছন থেকে পড়লে একই রকম থাকবে এমন শব্দকে প্যালিন্ড্রোম বলা যায়, যেমন ইংরেজি ‘madam’ শব্দটি একটি প্যালিন্ড্রোম) পাওয়া যাচ্ছে। এই প্যালিন্ড্রোমিক সিকোয়েন্সগুলো আবার একা নয়, একটি প্যালিন্ড্রোমিক সিকোয়েন্স মাঝে কিছু অন্য সিকোয়েন্স আবার আরেকটি। এভাবে এই আর্কিয়ার সম্পূর্ণ জিনোমের বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে এই ঘটনা দেখা যায়। গবেষণাপত্র খুঁজে দেখা যায়, জাপানের ইয়ুশিজুমি ইশিনো নামের এক গবেষকও তা অন্য একটি ব্যাকটেরিয়াতে খুঁজে পেয়েছেন।
ফ্রান্সিসকো মজিকা এই অদ্ভুত ব্যাপারটি নিয়ে লেগে থাকেন, তবে তার গবেষণাগারে ছিল অর্থের টানাপোড়েন। তাই মজিকা বায়োইনফোরমেটিক্স ব্যবহারে বেশি মনযোগী হয়েছিলেন। বায়োইনফোরমেটিক্স ব্যবহার করেই ২০০০ সাল নাগাদ বিশটি ব্যাক্টেরিয়াতে প্রায় একই ধরনের ঘটনার দেখতে পান। মজিকা প্রথমে এই সিকোয়েন্সগুলোর নাম দেন ‘Short Regularly Spaced Repeats (SRSR)’, যা তিনি ও তার সহগবেষকরা পরবর্তীতে বদলে রাখেন ‘Clustered Regularly Interspaced Palindromic Repeats (CRISPR)’।
তবে ক্রিসপারের কাজ কী তা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা ছিল। কেউ বলছেন এটি ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ সংশোধনের কাজে লাগে। তবে এটি যে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সেই ব্যাপারে তখনো কোনো ধারণা ছিল না।
২০০৩ সালে মজিকা ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার CRISPR-কে বায়োইনফোরমেটিক্স দিয়ে বিশ্লেষণ করার সময় লক্ষ্য করেন যে, এর সাথে একটি ‘ফেইজ ভাইরাস’ এর সিকোয়েন্সের মিল আছে। এখান থেকে শুরু করে তিনি অন্য ব্যাকটেরিয়ার ক্রিসপার সিকোয়েন্সগুলোও খুঁজতে শুরু করেন, দেখতে থাকেন ভাইরাসের সাথে কোথাও মিল পাওয়া যায় কিনা। শেষ পর্যন্ত অনেক ভাইরাসের সাথে এই ক্রিসপারের সিকোয়েন্সের মিল পাওয়া গেল, এবং এরা সবাই ফেইজ ভাইরাস। অর্থাৎ এরা ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে।
গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কারটি প্রকাশের জন্য তিনি খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘নেচার’ এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। নেচার তার গবেষণাপত্রটি প্রত্যাখান করে, আরো কয়েকটি খ্যাতনামা প্রকাশনাও তার এই যুগান্তকারী গবেষণাটি প্রকাশ করতে অপারগতা দেখায়। বলাই বাহুল্য যে, বায়োইনফোরমেটিক্স তখন মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছে, জীববিজ্ঞানের অনেক মহলেই এই প্রযুক্তি নিয়ে তখন ধারণা কম, ক্রিসপারও বেশ নতুন একটি জিনিস। তাই ফ্রান্সিসকো মজিকা হতাশ হয়েছেন বারবার। তবে শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে তার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ‘জার্নাল অফ মলিকুলার ইভুলিউশন’ এ।
তবে ভাইরাসের সিকোয়েন্সের সাথে ক্রিসপারের মিল পাওয়া গেলেও এটি যে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা প্রমাণিত হয় আরো দুই ফরাসী গবেষকের গবেষণা থেকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এদের গবেষণাপত্রগুলোও খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাখাত হয় শুরুতে। আরেক গবেষক ভ্যান ডার ওস্ট কাজ শুরু করেন ক্রিসপার সংক্রান্ত প্রোটিন নিয়ে, পাঁচটি প্রোটিনের একটি সমন্বিত সিস্টেম (Cascade) আবিষ্কার করেন তার গবেষক দল।
এমানুয়েল শারপ্যান্টিয়ে এবং জেনিফার ডাউডনা
ইতোমধ্যেই এমানুয়েল শারপ্যান্টিয়ে কাজ শুরু করেছেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, Streptococcus pyogenes নামের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। এই ব্যাকটেরিয়ার জিন নিয়ে গবেষণার সময় ক্রিসপার নিয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠেন তিনি। প্রায় একই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে জেনিফার ডাউডনাও সবেমাত্র কাজ শুরু করেছেন ক্রিসপার নিয়ে।
ক্রিসপার-ক্যাস সিস্টেম মূলত দুই ধরনের, প্রথমটি একটু জটিল এবং এই প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো ক্যাস প্রোটিনের দরকার। যেগুলো একটার পর একটা কাজ করে অনুপ্রবেশকারী ভাইরাসের ডিএনএকে কেটে দেয়। কিন্তু দ্বিতীয়টি বেশ সোজা, এই প্রক্রিয়ার দরকার একটি মাত্র ক্যাস প্রোটিন। ডাউডনা কাজ করছিলেন প্রথমটি নিয়ে আর শারপ্যান্টিয়ে দ্বিতীয়টি নিয়ে। দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটিই এখন পরিচিত ‘ক্রিসপার ক্যাস-৯’ নামে।
শারপ্যান্টিয়ে তার দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে ক্রিসপার-ক্যাস সিস্টেমের মধ্যে থাকা ‘ট্রান্স-এক্টিভেটিং ক্রিসপার আরএনএ (TracrTNA)’ কে খুঁজে বের করেন, আগে যে আরএনএ-প্রোটিন যুগলবন্দীর কথা বলা হয়েছিল, এই আরএনএ প্রোটিন যুগলবন্দীর আরএনএ-টি হলো এই ট্রান্স এক্টিভেটিং আরএনএ (tracrRNA), আর প্রোটিনটি হলো ক্যাস-৯ প্রোটিন। এই যুগলবন্দীই মূলত বাইরে থেকে আগত ভাইরাসের ডিএনএকে কাটে, এবং ভাইরাসের আক্রমণ থেকে ব্যাকটেরিয়াকে নিরাপদ রাখে।
পুয়ের্তে রিকোতে সাক্ষাৎ
২০১১ সালে পুয়ের্তে রিকোতে এক কনফারেন্সে প্রথম দেখা হয় জেনিফার ডাউডনা আর এমানুয়েল শারপ্যান্টিয়ের। সেখানেই তারা প্রথম একই সাথে কাজ করা শুরু করেন, এখান থেকে মূলত নতুন করে সূচনা হয় এই প্রযুক্তির। ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে একটু অদল বদল করে চাইলে একে দিয়ে আমাদের প্রত্যাশিত জিন বা ডিএনএর অংশ কাঁটা যাবে কিনা, তা নিয়ে শুরু হয় গবেষণা।
ইতোমধ্যেই যেহেতু বিজ্ঞানীরা আরএনএ, প্রোটিনগুলোর কাজ আলাদা করে জানেন তারা একটি সিস্টেম ডিজাইন করেন। যেখানে ক্রিসপার আমাদের প্রত্যাশিত জায়গায় কাটবে, অর্থাৎ এই প্রযুক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। জেনিফার ডাউডনার নেতৃত্বে তার গবেষণাগারে এই কাজটি করা হয়, একটি গাইড আরএনএ তৈরি করা এবং সেটিকে ক্যাস-৯ প্রোটিনের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। গাইড আরএনএ-তে দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী এই প্রোটিন-আরআএনএ যুগলবন্দী তাদের প্রত্যাশিত জায়গাটিতে গিয়ে কাটছাঁট শুরু করে।
সাধারণত আমাদের ডিএনএ যদি কোনো কারণে কেটে যায়, তাহলে সে নিজেই তা ঠিক করার কাজটি শুরু করে। তবে সেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সুতরাং ক্রিসপার ক্যাস-৯ সিস্টেমে চাইলে একটি ‘টেম্পলেট ডিএনএ’ যুক্ত করে দেওয়া সম্ভব। ফলে ক্রিসপার ক্যাস-৯ দিয়ে কাটার ফলে কীভাবে পুনরায় তা জোড়া লাগবে তাও নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
২০১২ সালে জেনিফার ডাউডনা আর এমানুয়েল শারপ্যান্টিয়ের এই গবেষণা প্রকাশের পর জীববিজ্ঞানে তুলকালাম পড়ে যায়। জীববিজ্ঞানের গবেষণাগারে জিন কাটছাঁট করার অনেকগুলো প্রযুক্তি সেই সত্তরের দশক থেকেই ছিল। তবে সবগুলোই ছিল সময় এবং অর্থসাপেক্ষ। ক্রিসপার ক্যাস-৯ প্রযুক্তি আসার পর খুব দ্রুত সময়ের মাঝেই প্রত্যাশিত জায়গায় নির্ভুলভাবে এই জিন কাটছাঁট করা শুরু হয়েছে।
চিকিৎসা ও গবেষণায়
ক্রিসপারের মাধ্যমে জিনকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার সবচেয়ে বড় সুফল পাওয়া যাচ্ছে চিকিৎসা এবং গবেষণায়। আমাদের ডিএনএর একটি জেনেটিক কোডে পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট রোগ ‘সিকল সেল এনেমিয়া’, বিজ্ঞানীরা আশা করছেন খুব দ্রুতই সিকল সেল এনেমিয়া সারিয়ে তোলা যাবে ক্রিসপার ব্যবহার করে।
তবে এই রোগ ছাড়াও মানুষের জিনঘটিত যেসব রোগ আছে যেমন ‘ডাউন সিন্ড্রোম’, ‘হান্টিংটনস ডিজিজ’, ‘মাস্কুলার ডিস্ট্রফি’ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে আশাবাদী। কল্পবিজ্ঞানকে সত্যি করে কোনো কোনো গবেষণাগারে কাজ চলছে এমন ভাইরাস নির্মাণের যে ভাইরাসের মাঝে ক্রিসপার ক্যাস-৯ সিস্টেমকে ঢুকিয়ে আমাদের রোগাক্রান্ত কোষে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। ফলে রোগাক্রান্ত কোষটিতে যদি ক্যান্সার আক্রান্ত হয় তাকে ধ্বংস করা সম্ভব হবে। তাই ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে ক্রিসপারের ব্যবহার ইতোমধ্যেই আশা জাগিয়েছে, চেষ্টা শুরু হয়েছে। এইডসের চিকিৎসায়ও ব্যবহার শুরু হয়েছে ক্রিসপারের।
কোভিড-১৯ শনাক্তে পৃথিবীজুড়ে অনেকগুলো ক্রিসপার ক্যাস-৯ ভিত্তিক টেস্ট কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো ব্যবহার করে খুব কম খরচে কোভিড শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ক্রিসপার ব্যবহার করে ‘ফেলুদা’ নামের টেস্টের ব্যবহার শুরু হয়েছে।
আইনি লড়াই
জেনিফার ডাউডনা, এমানুয়েল শারপ্যান্টিয়ে যখন ক্রিসপার ক্যাস-৯ নিয়ে আজ করছিলেন ঠিক প্রায় একই সময়ে আরেক চাইনিজ-আমেরিকান গবেষক ফেং ঝ্যাংও কাজ করছিলেন। বিশেষ করে মানবদেহের ডিএনএতে ক্রিসপার ব্যবহারে তিনি গবেষণার দৌড়ে বেশ এগিয়েও ছিলেন। গবেষণাপত্র প্রকাশের আগেই ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির নিউরোসায়েন্টিস্ট ফেং ঝ্যাং এবং তার দল বুঝতে পেরেছিলেন যে এই প্রযুক্তির আছে অসীম সম্ভাবনা, তাই প্যাটেন্ট করা উচিত। তবে গবেষণাপত্র আগে প্রকাশের সুবাদে ডাউডনার পক্ষে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলে) এমআইটির সাত মাস আগেই প্যাটেন্ট দাখিল করেন। ফেং ঝ্যাং, তার গবেষণা প্রতিষ্ঠা ব্রড ইন্সটিটিউট, এমআইটিও পাল্টা প্যাটেন্টের আবেদন করে। তবে ডাউডনার প্যাটেন্ট ঝুলন্ত থাকা অবস্থায় থাকাকালীন ব্রড ইন্সটিটিউট এর আইনজীবীরা অতিরিক্ত ফি পরিশোধ করে তাদেরটিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
তবে দ্রুতই প্যাটেন্ট যুদ্ধ রূপ নেয় আইনি লড়াইয়ে। আমেরিকা এবং ইউরোপে প্যাটেন্ট নিয়ে সেই লড়াই চলছে আলাদা আলাদাভাবে। কিছু লড়াইয়ে বিশেষ করে আমেরিকাতে ফ্যাং এবং তার প্রতিষ্ঠান এমআইটি এগিয়ে আছে। ইউরোপের আদালতগুলোতে এগিয়ে আছেন জেনিফার ডাউডনা এবং তার সহযোগীরা। এই নোবেল প্রাইজের ব্যাপারটি জেনিফার ডাউডনার অবস্থানকে আইনিভাবে শক্ত করবে কি? আইনজীবীরা বলছেন, পুরষ্কারের চেয়ে তথ্য প্রমাণই আদালতে বেশি কার্যকর। তবে গবেষণাগারগুলোতে যাতে এই প্যাটেন্টের প্রভাব না পড়ে সেক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি উন্মুক্ত আছে। তবে এইডস, ম্যালেরিয়া, ক্যান্সার কিংবা সিকল সেল এনেমিয়ার চিকিৎসায় যদি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হয়, সেখানেই কার্যকর হবে প্যাটেন্ট। তাই প্যাটেন্টজনিত জটিলতার মীমাংসা না হলে এই প্রযুক্তিতে বড় বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনাও কম।
ভয় এবং শঙ্কা
ক্রিসপার দিয়ে মানবভ্রূণেরও পরিমার্জন সম্ভব, তবে এই ব্যাপারটি নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ২০১৫ সালে চীনের গবেষকরা দাবি করেন তারা পরীক্ষাগারে মানবভ্রুণের জিন পরিবর্তনে সফল, ঠিক তখন থেকেই বিশ্বজুড়ে গবেষকদের মাঝে সাড়া পড়ে গেছে। আমরা কি এমন এক ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে যেখানে অনাগত একটি মানুষের মাঝে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকবে তা ঠিক করে দেওয়া যাবে। এতে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা চলছে। যদিও চীনা গবেষকরা বলছেন এই জিন পরিমার্জনের মাধ্যমে তারা ‘CCR5’ নামে একটি জিনকে সরিয়ে দিয়েছেন, ফলে শিশুটি এইডস, কলেরা, গুটিবসন্তের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবে।
আবার অনেক গবেষক বলছেন এই জিনের অনেক অজানা কাজ থাকতে পারে, এই জিন সরিয়ে দিলে হয়তো পরিণতি ভয়াবহও হতে পারে। চীনের প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক মহলে ক্রিসপারের এমন ব্যবহার বেশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকে বলা হয়েছে ক্রিসপার প্রযুক্তি এখনো বেশ নতুন, এই প্রযুক্তি এখনই মানবভ্রূণে পরীক্ষা নিরীক্ষার সমীচীন নয়। বিভিন্ন দেশে আইন করে মানভভ্রূণে ক্রিসপার ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে দাবি উঠেছে।
এই প্রযুক্তির অন্যতম আবিষ্কারক এবং ২০২০ সালে রসায়নে নোবেলজয়ী জেনিফার ডাউডনা দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে সরব। তিনি প্রায়ই গবেষকদের সতর্ক করে যাচ্ছেন এই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে। ২০১৭ সালে তার লেখা বই ‘A Crack in Creation: The New Power to Control Evolution’-এ তিনি তার আবিষ্কারের যাত্রার পাশাপাশি মানুষকে এই প্রযুক্তির ব্যাপারে সতর্কবাণীও দিয়েছেন। কিন্তু গবেষকরা কি মানবে এই সতর্কবাণী? আইন করে কি থামানো যাবে এই প্রযুক্তির যাত্রা? ভ্রূণের জিনকে যদি পরিমার্জন করা ব্যাপক আকারে শুরু হয়ে যায় তবে এই আবিষ্কার কি মানুষের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে সক্ষম? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো সময়ই ভালো দিতে পারবে।