ড্যানিয়েল ট্যামমেটের নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। তিনি মাত্র ৫ ঘন্টায় পাই (π) এর ২২,৫১৪ ডিজিটের মান মুখস্থ করে বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন। নিকোলা টেসলা যেকোনো বইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে পুরো বই মনে রাখতে পারতেন। অনেকে ছোটবেলায় গোয়েন্দা কাহিনী শার্লক হোমস পড়ে থাকবেন। কি সুন্দর করেই না শার্লক সবকিছুর খুটিনাটি তথ্য গড়গড় করে মনে করে ফেলতেন, তাই না? এত আগেকার ঘটনার দিকেই বা কেন আমাদের নজর দিতে হবে, প্রতিবছর যে ওয়ার্ল্ড মেমোরি চ্যাম্পিয়নশিপ হয় সেখানেও দেখা যায় এমন অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তিদের কর্তৃত্ত্ব। তাদের সামনে দিয়ে দেওয়া হয় ১০০ ডিজিটের কোনো সংখ্যা। বলে দেওয়া হয় যে ১৫ মিনিটের ভেতরে সব মুখস্থ করে বলে দিতে হবে। আর তারাও গড়গড় করে সব মুখস্থ করে ফেলে এত তাড়াতাড়ি।
এসব শুনে আপনি হয়তো ভাবছেন কেন আপনার স্মৃতিশক্তি এমন হলো না? আপনি হয়তো সারারাত ধরে পরীক্ষার পড়া পড়ে পরের দিন সকালে পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখেন প্রায় অনেক কিছুই মনে করতে পারছেন না। তখন আপনার স্মৃতিশক্তি নিয়ে খুব হতাশ হয়ে যান। আমরা এসব নিয়ে অনেক ভাবতে থাকি। কীভাবে স্মৃতিশক্তি বাড়ানো যায়, কী খাবার খেলে বাড়ে এসব নিয়ে জানতে খুব আগ্রহ বোধ করি আমরা। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে, কীভাবে কোনোকিছু অনেকদিন ধরে মনে রাখা যায়, সেটা নিয়ে আমরা তেমন একটা ভাবি না। এখানে সে বিষয়টি নিয়েই কিছু আলোচনা করব। ঘুরে আসবো আমাদের পূর্বপুরুদের কাছ থেকে। কীভাবে তারা কোনো কিছু সহজে মনে রাখতেন আর কী উপায়ে আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে আমাদের জীবনে তা প্রয়োগ করব।
প্রাচীন গ্রিক আর রোমান পূর্বপুরুষদেরকেও তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য মনে রাখতে হতো অনেক কিছু। তখনকার সময়ে যেহেতু আজকের মতো ইন্টারনেটের প্রচলন ছিল না, তাই তাদেরকে তাদের স্মরণশক্তির উপরেই নির্ভর করতে হতো। তাদের অবস্থা অনুসারে তারা তৈরি করেন মনে রাখার এক অভিনব পদ্ধতি, যাকে বলা হয় ‘মেথড অব লকি’।
মেথড অব লকিকে অনেকে মেমোরি প্যালেস বলে অভিহিত করে থাকেন। আমাদের স্মৃতিশক্তি সাধারণত মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলে প্রসেসিং হয়। এ অংশটি শুধু যে কোনো কিছু মনে করার ক্ষেত্রেই কাজে লাগে তা নয়। কোনো কিছুর অবস্থান যাচাই করতেও সাহায্য করে। এ প্রক্রিয়াকে আমরা বলি নেভিগেশন প্রসেস। মস্তিষ্কের একই জায়গা একাধিক কাজ করছে। এ বিষয়টিই কাজে লাগানো হয় মেথড অব লকিতে।
ধরুন, আপনাকে এখন কোনোকিছু মনে রাখতে হবে। যে জিনিসটি আপনাকে মনে রাখতে হবে সেটি যদি কোনো স্থানে রাখেন তাহলে তা বেশিদিন মনে থাকবে। সেই স্থানটি যেকোনো জায়গা হতে পারে। আপনি যে বাসায় থাকেন সে বাসাটিকেও আপনি বেছে নিতে পারেন আপনার মনে রাখার সুবিধার্থে। এমনকি আপনি কল্পনায় আপনার মনের মতো একটি প্রাসাদ তৈরি করে নিতে পারেন।
সেই প্রাসাদের ভেতরের প্রত্যেকটি জিনিসকে খুব ভাল করে দেখুন। আপনার রুমের ভেতরে কোথায় আসবাবপত্র আছে, কোথায় পড়ার টেবিল, বিছানা, আয়না আছে এসব প্রত্যেকটি জিনিসই আপনার কাজে লাগবে। আপনি শুধু যে তথ্যটি মনে রাখতে হবে সেটিকে কল্পনায় নিজের মতো করে দেখতে থাকুন। পরে সেই জিনিসটিকে আপনার পছন্দমত ঘরের যেকোনো এক জায়গায় রেখে দিন। আপনার কল্পনায় আপনি তথ্যটিকে যত আকর্ষণীয় করে তুলবেন সেই তথ্যটি আরো বেশিদিন আপনার মনে থাকবে। আপনি চাইলে সেখানে যোগ করতে পারেন কৌতুকতা অথবা আবেগঘন কোনো চিত্র। আর সেই চিত্রটি যতটা অদ্ভূত হবে, সেটা মনেও থাকবে আপনার বেশিদিন পর্যন্ত।
চলুন, আপনার সুবিধার জন্য আমরা এই পদ্ধতিটিকে বাস্তবে কাজে লাগিয়ে দেখি এটা কতটা কার্যকর। আমরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দশজন প্রেসিডেন্টের নাম মনে রাখার চেষ্টা করবো মেথড অব লকিকে কাজে লাগিয়ে। পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে পুরো ব্যাপারটিকেই কল্পনায় নিজেদের মতো করে চিত্রায়িত করে নিতে। আগে আমরা জেনে নিই সিরিয়ালি আমেরিকার প্রথম দশজন প্রেসিডেন্টের নাম। তারা হলেনঃ
১) জর্জ ওয়াশিংটন
২) জন এডাম
৩) থমাস জেফারসন
৪) জেমস ম্যাডিসন
৫) জেমস মনরো
৬) জন কুইন্সি এডাম
৭) অ্যান্ড্রু জ্যাকসন
৮) মার্টিন ভ্যান বুরেন
৯) হ্যানরি হ্যারিসন
১০) জন টাইলর
এবার প্রেসিডেন্টদের নাম ক্রমানুসারে মনে রাখবো। কল্পনা করুন আপনি আপনার বাসার ভেতরে ঢুকলেন। তারপর রুমের কিনারায় ওয়াশিং মেশিনের (ওয়াশিংটন) ঢাকনাটি খুললেন। খোলার পর আপনি দেখলেন যে কাপড় ধোয়ার সেই মেশিনে এটম বোমা (এডাম)। আপনি তাড়াতাড়ি করে সেই বোমা নিয়ে ছুটতে লাগলেন। ভেবে পেলেন না যে এখন আপনি কি করবেন। টেবিলে বসে থাকা আপনার ছেলে বা সন (son) (জ্যাফারসন) আপনাকে দেখে বলে বসলো “Are you mad” (ম্যাডিসন)।
অবশ্য বেচারা কী করবে আর! ছেলে যদি তার বাবার হাতে এটম বোমা নিয়ে তাকে ঘুরতে দেখে তাহলে বাবাকে পাগল বলাটাই স্বাভাবিক। এমন সময় আপনার বাসার রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো আপনার স্ত্রী হলিউডের মেরিলিন মনরো। কি অবাক হচ্ছেন? আরে ভেবেই নিন না যে কিছুক্ষণের জন্য হলিউডের এই নায়িকাই আপনার স্ত্রী! তো মনরো আপনাকে বলছে যে কুইকলি এটম বোমা (কুইন্সি এডাম) নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে, নয়তো সবাই বাসাতেই মারা যাবে।
তো আপনিও বোমা নিয়ে দৌড়ে আপনার বেডরুমের ভেতরে ঢুকলেন। অবাক হয়ে দেখলেন আপনার রুমে বসে আছে মাইকেল জ্যাকসন (অ্যান্ড্রু জ্যাকসন)। মাইকেল জ্যাকসন আপনাকে দেখেই বলছেন, বাসার পাশেই একটি ভ্যান (মার্টিন ভ্যান) দাঁড়িয়ে আছে। ঐ ভ্যানের চালকটিকে তাড়াতাড়ি (Hurry) এটম বোমাটি দিয়ে আসতে, তাহলে সে তাড়াতাড়ি করে বোমাটি শহরের বাইরে নিয়ে যেতে পারবে। আপনিও তাড়াহুড়ো করে দৌড় দিতে গিয়ে বাসার টাইলসে (জন টাইলর) পিছলে পরে গিয়ে কোমর ভেঙে ফেললেন।
এবার পুরো ঘটনাটি আবার প্রথম থেকে ভাবুন। আপনার বাসায় প্রবেশ করুন। আগের ঘটনাটি মনে করুন। আপনি খুব অবাক হয়েই এখন আবিষ্কার করবেন যে, আপনি আসলেই আমেরিকার প্রথম দশজন প্রেসিডেন্টের নাম ক্রমানুসারে বলতে পারবেন। আর কখনো সহজে এটি ভুলবেনও না। মজার না ব্যাপারটি?
খেয়াল করুন, আমি আমার উদাহরণে টেনে এনেছি এটম বোমা, হলিউডের বিখ্যাত নায়িকা এবং মাইকেল জ্যাকসনকেও। আপনি আপনার তথ্যকে যতটা অদ্ভুত আর রোমান্টিক করে তুলবেন, সেই তথ্যগুলো তত বেশিদিন মনে থাকবে। মেথড অব লকি প্রয়োগ করে ওয়ার্ল্ড মেমোরি চ্যাম্পিয়নশিপের প্রতিযোগীরা তাদের তথ্যগুলো মনে রাখে। তাদের মাঝে কেউ কেউ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নও হচ্ছে। আপনিও চাইলে প্রাচীন এই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিটি প্রয়োগ করে আপনার স্মৃতিশক্তিকে ঝালিয়ে নিতে পারেন। পারেন যেকোনো জিনিসকে আপনার নিজের মতো করে অনেকদিন মনে রাখতে।