ধরুন, একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলেন আর প্রস্তুত হচ্ছিলেন অফিসে যাওয়ার জন্য। মনের অজান্তেই হয়তো ভাবছিলেন, আমার মতো কেউ যদি এখন থাকত, তাহলে কেমন হত যারা আমার হয়ে সবগুলো কাজ করে দিত, আর আমার অফিস যেতে হত না! কিছুদিন পর হঠাৎ খুব ভোরে উঠলেন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে। খুলে দেখলেন, হুবহু আপনার মতো দেখতে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে! কী! ভয় পেয়ে গেলেন? আধুনিক বিজ্ঞানে এসবই সম্ভব ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে। জমজ না হয়েও জিনগতভাবে দেখতে একই রকম মানুষ বা প্রাণীর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকেই ক্লোনিং বলে।
শুরুর কথা
উদ্ভিদ শারীরবিজ্ঞানী হারবার্ট. জে. উইবারের মতে ‘ক্লোন’ শব্দটির উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিক শব্দ ‘টুইগ’ থেকে, যার অর্থ মগ বা ডাল, প্রধানত যে প্রক্রিয়ায় নতুন গাছের জন্ম হয় একটি গাছের মগ/ডাল থেকে। ১৯৩৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্স স্পারম্যান এক উদ্ভট পরীক্ষার প্রস্তাব দিলেন, যা ছিল একটি কোষের নিউক্লিয়াসকে নিউক্লিয়াসহীন ডিম্বানুতে রূপান্তরিত করা। একেই ক্লোনিংয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক অসওয়াল্ড এভারি জানান, জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো নিউক্লিয়িক এসিডের মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়।
ক্লোনিং প্রক্রিয়া
ক্লোনিংয়ের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে বেশ কিছু জটিল ধাপ পার করতে হয়। প্রথমত ডিম্বাণু সংগ্রহ করতে হয় এক স্ত্রী প্রজাতির দাতা থেকে। তারপর খুব সাবধানতার সাথে নিউক্লিয়াসটি কোষ থেকে সরাতে হয়। এর সাথে আরও একটি কোষও সংগ্রহ করতে হয় চামড়া থেকে। এরপর একই প্রজাতির অন্য এক স্ত্রী/পুরুষ প্রাণীর শরীর থেকে দুগ্ধগ্রন্থি অথবা অন্য কোনো টিস্যু সংগ্রহ করতে হবে ।
এই দ্বিতীয় প্রাণীকেই ক্লোনিং করা হবে। এই প্রাণীর কোষ থেকেও একই প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস সংগ্রহ করতে হবে এবং প্রথম প্রাণী থেকে সংগৃহীত ফাঁকা ডিম্বাণুতে বসাতে হবে। পরবর্তীতে ডিম্বাণুটি ভাগ হবে এবং বহুকোষী ভ্রূণে পরিণত হবে। এ পর্যায়ে ভ্রূণটিকে সঠিকভাবে সারোগেট মায়ের জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে। অতঃপর যদি সঠিকভাবে গর্ভধারণ সম্পন্ন হয় তখনই ক্লোন প্রাণীর জন্ম হবে।
ইতিহাস
বর্তমান বিশ্বে ক্লোনিং সম্পর্কে ধারণা আছে অনেকেরই। এর রয়েছে ১০০ বছরেরও বেশি সমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক ইতিহাস। ১৮৮৫ সালে বিজ্ঞানী হ্যান্স এডওয়ার্ড এক পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান প্রতিটি কোষে তার ভ্রূণীয় অবস্থার প্রাথমিক দিকে নিজস্ব জিনগত বৈশিষ্ট্য থাকে এবং একটি পরিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। পরবর্তীতে যথাক্রমে ১৯০২ এবং ১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী হ্যান্স স্পারম্যান ভ্রূণের মাধ্যমে একই রকম প্রাণী সৃষ্টির দুটি পরীক্ষা করেন। তবে কোনোটিই আশার আলো দেখেনি। ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞানী জে ডেরেক তার পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন নিউক্লিয়াস আদান-প্রদানের মাধ্যমে স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভ্রূণ সৃষ্টি সম্ভব। অবশেষে ১৯৯৬ সালে বিজ্ঞানী ল্যান উইলমুট এবং কেইট ক্যাম্পবেল ২৭৭ বার চেষ্টার পর প্রথমবারের মতো সফলভাবে একটি ভেড়ার ক্লোন করতে সক্ষম হন।
এই ভেড়াটিই বিশ্বের সর্বপ্রথম স্তন্যপায়ী ক্লোন করা প্রাণী যা আমাদের কাছে ‘ডলি’ নামে পরিচিত। এই সাফল্যের পর বিজ্ঞানীরা ১৯৯৮ সালে একটি ইঁদুর, ২টি গরু; ২০০০ সালে যথাক্রমে একটি বানর ও একটি শূকর; ২০০১ সালে একটি গরু, একটি মহিষ, এবং পরবর্তীতে আরও বিভিন্ন প্রাণীর ক্লোন করেন।
মানুষের ক্লোন করাও কি সম্ভব
একের পর এক প্রাণীর ক্লোন সফলতার সাথে সম্পন্ন করার পর বিজ্ঞানীরা ভাবলেন মানুষের ক্লোন করার ব্যাপারে। ১৯৯৬ সালে ‘ডলি’ নামের ভেড়াটির ক্লোন সফলতার মুখ দেখার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা মানুষের ক্লোন নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তবে আজও মানুষের ক্লোন সফল হয়নি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও ন্যাশনাল একাডেমির যৌথ প্রয়াসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্লোনিং প্রযুক্তি খুবই অনিরাপদ এবং গবেষণার জন্যও নিষিদ্ধ করতে হবে এটি।
বিগত ১৫ বছরে জীনতত্ত্ব গবেষণা এতটাই উন্নত হয়েছে যে মানুষের ক্লোন করা অসম্ভব কিছু না। গবেষকদের মতে, ১০০টির মতো ক্লোন করা ভ্রূণ থেকে মাত্র একটি সফল গর্ভধাণের ফলে ‘ডলি’র জন্ম হয়েছে, এবং বাকি ভ্রূণগুলোর মারাত্মক জন্মগত ত্রুটির ফলে মৃত্যু হয়েছে। এই জন্মগত ত্রুটির প্রধান কারণ কিছু বাধাপ্রাপ্ত জিন। তবে জীববিজ্ঞানী ইয়ি জাওং এসব বাধাপ্রাপ্ত জিনগত সমস্যার সমাধান উদ্ভাবন করেছেন।
এত সফলতার পরও মানুষের ক্লোন করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সেন্টার অব জেনেটিক ও সোসাইটির মতে, বিশ্বের প্রায় ৪৬টি দেশে যেকোনো ধরনের ক্লোনিং সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, এবং প্রায় ৩২টি দেশে প্রজননশীল ক্লোনিং নিষিদ্ধ। এছাড়াও আমেরিকার ১৫টি অঙ্গরাজ্যে সম্পূর্ণভাবে ও ৩টি অঙ্গরাজ্যে নাগরিক তহবিল থেকে ক্লোনিংয়ের গবেষণার খাতে ব্যয় করা নিষিদ্ধ। মানুষের ক্লোন করার ফলে যে নৈতিক অবমূল্যায়ন ঘটবে, তা ব্যাপক আকার ধারণ করবে বলে অনেকে ধারণা করেন। তবে চীন কখনোই মানুষের ক্লোনিংকে নিষিদ্ধ করেনি। সমালোচকরা ধারণা করছেন সফলভাবে বানরের ক্লোন সম্পন্নকারী চীনা বিজ্ঞানীরা শীঘ্রই মানুষের ক্লোনিংয়েও সফল হবেন।
ক্লোনিংয়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি এমন সার্ভিস দিচ্ছে যা ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে। যেমন- সোয়ান বায়োটেক, ভেগান পেটস প্রভৃতি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পোষা প্রাণীর ক্লোন করে দিচ্ছে। বিশ্বখ্যাত চলচিত্র জুরাসিক পার্ক মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে একটাই প্রশ্ন জাগায়, “আদৌ কি কখনো বিলুপ্ত প্রাণীকে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে জীবিত রূপে ফেরানো সম্ভব?’’। এই প্রশ্নকেই ২০০৩ সালের ৩০ জুলাই উত্তর স্পেনের একদল বিজ্ঞানী বাস্তবে রূপ দিলেন। তারা বিলুপ্ত প্রজাতির এক ছাগলকে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে পুনর্জীবিত করলেন। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতে, ‘বুকারডো’ নামের ছাগলটি মাত্র ১০ মিনিটের জন্য বেঁচে ছিলো। তবে এখানেই গবেষকরা হাল ছেড়ে দেননি। আমেরিকান রসায়নবিদ ড. জর্জ চার্চের নেতৃত্বে হার্ভার্ডের গবেষক দল বিলুপ্ত প্রাণী ম্যামথের ক্লোনিং করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তারা আশা করছেন আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পুরো পৃথিবী ১০,০০০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত প্রাণী ম্যামথকে জীবিতাবস্থায় দেখতে পাবে।
ভবিষ্যতে জৈবপ্রযুক্তিতে কেমন হবে ক্লোনিংয়ের অবদান
বিভিন্ন গবেষক ও জীববিজ্ঞানী ধারণা করছেন, সামনের বছরগুলোতে জৈবপ্রযুক্তিতে ক্লোনিং বেশ বড় রকমের পরিবর্তন আনবে। যদিও বর্তমানে রোগী ও রোগভিত্তিক থেরাপির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ক্লোনিং ব্যবহার করা হচ্ছে, তবে ভবিষ্যতে রোগীর শরীরে টিস্যু প্রতিস্থাপনেও ক্লোনিং ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি এমন সময় আসে যখন মানুষের ক্লোনিং সফলভাবে সম্পন্ন হবে, তখন মানুষ সহজেই বিভিন্ন কৃত্রিম প্রাণীর মতো নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে ধারণা করা হয়, রোগীর শরীরে টিস্যু প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটি সফল করতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে।
ক্লোনিং নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
ক্লোনিং নিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল ধারণাটি হচ্ছে, অনেকেই মনে করেন ক্লোনিং একটি নতুন প্রযুক্তি। আমরা হরহামেশা যেসব ফল খাচ্ছি, এগুলো যুগ যুগ ধরে ক্লোনিংয়ের মাধ্যমেই উৎপন্ন হচ্ছে। যেমন- কলা গাছের বীজ থেকে একটি কলা গাছ পরিপূর্ণভাবে বড় হতে প্রায় ৩০ বছর লেগে যায়, সুতরাং ক্লোনিংয়ের মাধ্যমেই কলা, আপেল, আলু, আঙুর, পিচসহ বিভিন্ন ফলের উৎপাদন দ্রুতভাবে করা হয়।
ক্লোনিং নিয়ে আরেকটি ভুল ধারণা হচ্ছে, ক্লোন করা প্রাণীটির ব্যক্তিত্ব ও মেজাজ হুবহু যে প্রাণী থেকে ক্লোন করা হয়েছে তার মতোই হবে। কোনো প্রাণীর মেজাজ কেমন হবে তা একমাত্র সেই প্রাণীর পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিচর্চার উপর নির্ভর করে। ধরুন, আপনার পোষা বিড়ালটিকে আপনি ক্লোন করতে চাচ্ছেন এর শান্ত ও মিষ্টি স্বভাবের জন্য। যদিও আপনি সহজেই বিড়ালটির ক্লোন করাতে পারবেন, কিন্তু ক্লোন করা বিড়ালটির স্বভাব আপনার প্রথম বিড়ালটির মতো করতে চাইলে আপনাকে ক্লোন করা বিড়ালকেও প্রথম বিড়ালটির মতো ছোটবেলা থেকে একই পরিবেশ ও পরিচর্চা দিতে হবে।