রাজশাহীর বাসিন্দা অপু সরকারের দুই হাতের আঙুলের দিকে তাকালে আর দশজন মানুষের হাতের আঙুলের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়বে না। কিন্তু হাতের আঙ্গুলকেন্দ্রিক একটি সমস্যাই অপু ও তার পরিবারের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। খুবই বিরল জিনগত এক রোগের কারণে অপুর দুই হাতের আঙুলের কোনো প্রিন্ট বা ছাপ নেই। একমাত্র অপুই নয়, তার পরিবারের সর্বমোট ছয়জন সদস্য এই সমস্যায় ভুগছেন।
এই বিরলতম রোগের সন্ধান সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ২০০৭ সালে। সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল বাসেলের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ পিটার ইটিন এক সুইস মহিলার সন্ধান পান যিনি আঙুলের ছাপ না থাকার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছিলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ তার থেকে আঙুলের ছাপ চাচ্ছিল, কিন্তু জন্মগতভাবেই তার কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই!
পিটার ইটিন এই অদ্ভুত রোগ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তিনি দেখলেন, এই মহিলার পরিবারের আরো নয় সদস্য একইভাবে জন্মগতভাবেই ছাপবিহীন। প্রফেসর ইটিন ইসরায়েলি চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এলি স্প্রিচার এবং অন্যান্য সহকর্মীর সাথে একযোগে কাজ করে এমন আরো তিনটি পরিবারের সন্ধান পান, এবং রোগের নামকরণ করলেন ‘অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া’, অর্থাৎ এটা এমন এক বিরলতম শারীরিক অবস্থা যাতে রোগীর হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল, হাতের পাতা এবং পায়ের পাতায় কোনো ছাপ তৈরি হয় না। একে ‘ইমিগ্রেশন ডিলে ডিজিজ’ নামেও অভিহিত করা হয়, কারণ এই রোগের ভুক্তভোগীদের অন্য দেশে যেতে গেলে ইমিগ্রেশনে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়।
প্রফেসর ইটিন, তেল আবিব সোরাস্কি মেডিকেল সেন্টারের চর্মরোগবিদ এলি স্প্রিচার এবং তাদের সহকর্মীবৃন্দ মিলে সন্দেহ করলেন, রোগটি জিনগত হতে পারে। সুতরাং তারা পরিবারের ষোলজন সদস্যের ডিএনএ সংগ্রহ করে সিকোয়েন্স করলেন। এদের মধ্যে নয়জন অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ার রোগী ছিলেন, বাকি সাতজন সুস্থ। তাদের ধারণা সঠিক প্রমাণিত হলো। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যাদের অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া আছে, তাদের প্রত্যেকের ডিএনএ-র বিশেষ অঞ্চলে পরিবর্তন ঘটেছে যেটা মূলত SMARCAD1 প্রোটিন তৈরির জন্য দায়ী। সুস্থ সাতজন সদস্যে যেটা ঠিকমতোই কাজ করছিল।
SMARCAD1 নামের প্রোটিন তৈরিতে SMARCAD1 জিন সাহায্য করে। এই প্রোটিনের আবার দুটি ধরন আছে। একটিকে বলা হয় Full length isoform এবং আরেকটি Skin specific isoform। এই Skin specific isoform-ই ত্বকের কোষে প্রকাশিত হয়। এটা সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ‘ডার্মাটোগ্লিফস’ তথা হাতের রেখা তৈরিতে এর ভূমিকা আছে যা প্রত্যেক মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ছাপ তৈরিতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র SMARCAD1 প্রোটিনই যে ছাপ তৈরিতে ভূমিকা রাখে সেটা না, বরং ছাপ তৈরিতে ভূমিকা রাখা প্রোটিনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা ছাপ তৈরির ব্যাপারটি ঘটে মায়ের পেটে থাকতেই। কিন্তু কীভাবে এই প্রোটিনগুলো দায়ী সেই ব্যাপারে তেমন কিছু জানা যায়নি। সিকোয়েন্স করার পর গবেষকগণ নিশ্চিত হলেন, এই জিনই পরিবারের আক্রান্ত সদস্যদের মাঝে মিউটেটেড/পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ২০১১ সালে পিটার ইটিন, এলি স্প্রিচার এবং তাদের সহকর্মীবৃন্দ জার্নাল অব দ্য আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজিতে ‘অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়া’ বিষয়ে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
এই বিরলতম রোগের রোগীরা এমনিতে স্বাস্থ্যবানই থাকেন, তবে কিছু ঘর্মগ্রন্থির ঘাটতি থাকে। ফলে সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের ত্বক অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে থাকে। NFJS (Naegeli Franceschetti Jadassohn Syndrome) এবং ডার্মাটোপ্যাথিয়া পিগমেন্টোসা রেটিকুলারিস রোগেও ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরি হয় না। তবে এসবের সাথে কিছু গুরুতর শারীরিক সমস্যাও তৈরি হয়। যেমন- পাতলা ও ভঙ্গুর চুল, দাঁত, চামড়া, ঘর্মগ্রন্থিতে সমস্যা ইত্যাদি।
লেখার সূচনা হয়েছিল অপু সরকারের একটি সমস্যা তুলে ধরার মাধ্যমে। তার বাবা অমল সরকারেরও একই সমস্যা আছে। অপুর দাদা এবং ভাইদেরও এই সমস্যা আছে। দাদা আগের যুগের মানুষ হবার কারণে তেমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি না হতে হলেও অপুদের প্রতিনিয়ত সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, সিমকার্ড তোলার জন্য দরকার হাতের ছাপ। সেটা নেই বলেই যত বিড়ম্বনা। সিমকার্ড কিনতে অপু সরকাররা ব্যবহার করে থাকেন তাদের মায়ের হাতের ছাপ।
মেডিকেল বোর্ড তাদের এই রোগকে ‘কনজেনিটাল পালমোপ্লান্টার কেরাটোডার্মা’ নামে অভিহিত করেছে এবং সার্টিফিকেটও ইস্যু করেছে। পিটার ইটিনের মতে, পরিবারটির বংশগত কেরাটোডার্মাই ‘সেকেন্ডারি অ্যাডার্মাটোগ্লিফিয়ায়’ রূপ নিচ্ছে। যেহেতু তারা হাতের ছাপ দিতে অক্ষম তাই চোখের রেটিনা স্ক্যান বা ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র, সিমকার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে। খুবই বিরল রোগ হবার কারণে এই রোগের তেমন কোনো চিকিৎসাও নেই। রোগটির কারণে শারীরিক অন্য কোনো সমস্যা (যেমন- ত্বক অধিক শুষ্ক থাকা) দেখা দিলে সেটার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে আশাব্যাঞ্জক ব্যাপার হলো বর্তমানে জেনেটিক্সের অগ্রগতির কারণে সামনের দিনগুলোতে জিন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন গবেষকগণ।