সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্যাজোট্রনে রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি করতেন অ্যাডলফ তোলকাচেভ। কিন্তু সোভিয়েত সরকারের নিপীড়নের শিকার হয়ে স্ত্রী নাতাশার বাবা-মায়ের পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান নিজের কর্মস্থল ও রাষ্ট্রের প্রতি। বনে যান সিআইএ-এর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট; যার কাছে থেকে সিআইএ পেয়েছিল সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ সব নথিপত্র। তোলকাচেভের সাধারণ প্রকৌশলী থেকে অসাধারণ এক গোয়েন্দা হওয়ার সত্য ঘটনার চার পর্বের সিরিজের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
তোলকাচেভের সাথে সিআইএ’র যোগাযোগ
১৯৭৮ সালের ৫ মার্চ, রাত ১০টা। কেস অফিসার জন গুলিশার প্রথমে দেখে নিলেন তার ওপর কেউ নজরদারি করছে কিনা। এরপর তিনি বলশোই থিয়েটারের পাশে এক পাবলিক টেলিফোন থেকে তোলকাচেভকে ফোন দিলেন। প্রথমবারের মতো তার সাথে কোনো সিআইএ সদস্যের কথা হয়।
ফোনে গুলিশার নিজেকে নিকোলায় নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। সিআইএ এই ফোনের মাধ্যমে তোলকাচেভকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল, তারা তার নিরাপত্তার বিষয়টি অটুট রাখছে এবং তারা তোলকাচেভ ও তার কাজ সম্পর্কে আরো জানতে আগ্রহী। গুলিশার তাকে সেদিন জানান, আবার ফোন করে তাকে পরবর্তী দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।
কিন্তু এরপর আগস্টের আগে তার সাথে আর যোগাযোগ করা হয়নি। তোলকাচেভকে দিয়ে কীভাবে কাজ করা হবে, সেই কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে কয়েকমাস সময় লেগে যায়। মস্কোর সিআইএ প্রধান হ্যাথাওয়ে চাইছিলেন, তোলকাচেভের সাথে তাদের ব্যক্তিগত বৈঠকটি সোভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতেই হোক। তবে হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ ছিল, তা যেন সবচেয়ে নিরাপদ কোনো স্থানে হয়।
তখন সিআইএ সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা তোলকাচেভের কাছে ডেডড্রপ পদ্ধতিতে বিভিন্ন সরঞ্জাম ও তথ্য সরবরাহ করবে। ডেডড্রপ হচ্ছে গোয়েন্দাদের তথ্য আদান-প্রদানের বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি বেছে নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে বৈঠকের আগেই তোলকাচেভ আরো কিছু চিঠি তৈরি করে তাতে তার কাজ সম্পর্কে এবং কোন কোন তথ্যে তার প্রবেশাধিকার আছে- সেসবের বিস্তারিত জানাতে পারবে।
তবে চিঠিগুলো লেখা হবে সিক্রেট রাইটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। এরপর সেগুলো ডেডড্রপ পদ্ধতি বিশেষ কিছু জায়গায় পৌঁছে যাবে। এরজন্য হ্যাথাওয়ে একটি ওয়ান টাইম প্যাড (ওটিপি) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ওটিপি হচ্ছে এক ধরনের নাম্বারের সিরিজ, যেগুলো এলেমেলোভাবে থাকে। এরপর চিঠির ওপর সেটির ছাপ দিয়ে দেওয়া হয়। ওটিপির নাম্বারগুলো অর্থ শুধু দুই পক্ষের কাছে থাকে। ফলে অন্যদের সেসব অর্থ বের করা বেশ কঠিন।
২৪ আগস্ট, গুলিশার আবারো তোলকাচেভকে ফোন করেন। তাদের নির্ধারণ করা ডেডড্রপের স্থান ছিল তোলকাচেভের অ্যাপার্টমেন্টের পাশের এক টেলিফোন বুথ। নির্মাণ শ্রমিকদের ব্যবহার করা একটি ময়লা ব্যাগে তোলকাচেভকে একটি সিক্রেট রাইটিংয়ের কার্বন ও তার ব্যবহার বিধি, তিনটি আগে থেকেই লেখা কাভার লেটার, একটি ওটিপি, অভিযানের একটি বার্তা ও গোয়েন্দা কাজের আরো কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রেখে আসা হয়। পরে তোলকাচেভ সেসব কোনো ঝামেলা ছাড়াই সংগ্রহ করেন।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে তোলকাচেভের কাছে থেকে তিনটি কাভার লেটারই ফেরত আসে। যার পেছনে সিক্রেট রাইটিংয়ে তিনি সোভিয়েত রাডার ও সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, পরীক্ষা করার সময় সেগুলোর কার্যকারিতা এবং বিভিন্ন যুদ্ধবিমানের উড্ডয়ন সম্পর্কে তথ্য দেন। সেই সাথে তার কাছে হাতে লেখা ৯১ পৃষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে এবং সেগুলো তিনি সিআইএকে দিতে চান বলেও ইঙ্গিত দেন।
তোলকাচেভের এই অল্প কয়েকটি কাজ সিআইএকে সন্তুষ্ট করেছিল এবং একই সাথে তার প্রতি বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। হ্যাথাওয়ে তখন তোলকাচেভের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি সাক্ষাতের আয়োজন করার আদেশ দেন। ১৯৭৯ সালের নববর্ষের দিন সিআইএ ও তোলকাচেভ দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন রাশিয়ায় ছুটির দিন।
গুলিশার আগে থেকেই ফোনে যোগাযোগ করে দেখা করার স্থান বলে দেন এবং তাকে সেই ৯১ পৃষ্ঠার নথিপত্র সঙ্গে করে নিয়ে আসার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মস্কোর রাস্তায় তীব্র শীতের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে গুলিশার ও তোলকাচেভ তাদের মধ্যে ৪০ মিনিটের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎ সম্পন্ন করেন।
তোলকাচেভ বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। তিনি অনেক কাগজপত্র সিআইএ-এর হাতে তুলে দেন। যার মধ্যে কিছু কাগজপত্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনীর জন্য খুবই সংবেদনশীল। তিনি বিভিন্ন অস্ত্র তৈরির সূত্র, ডায়াগ্রাম, ড্রয়িং, ইলেকট্রনিকস স্পেসিফিকেশন, চার্ট ও মন্তব্যের বিস্তারিত হস্তান্তর করেন। এরপর তোলকাচেভের হাতে আরো কিছু তথ্যের চাহিদা ও কাজের পুরস্কার হিসেবে মোটা অঙ্কের অর্থ ধরিয়ে দেওয়া হয়।
তোলকাচেভের দেওয়া তথ্যগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে সিআইএ এর বিশেষ কিছু কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়৷ তথ্যগুলো হাতে পাওয়ার পর তারা অভিভূত হয়ে যান। তারা কোনোদিন কল্পনা করতে পারেননি যে, তারা সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর এত সব গোপন তথ্য পাবেন!
১৯৭৯ সালের মে মাসে, তোলকাচেভের দেওয়া তথ্যের উপর তিনদিনের একটি সেমিনার আয়োজন করে সিআইএ। সেখানে অংশ নেওয়া সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা একবাক্যে স্বীকার করেন যে, তারা যে তথ্য পেয়েছেন, তা এক কথায় অসাধারণ। আর এর মাধ্যমেই তোলকাচেভ সিআইএ ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী এজেন্টে রূপ নেন।
নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন
তোলকাচেভের অপারেশন পরিচালনার জন্য যোগাযোগ করার নির্দিষ্ট একটি সময়সূচি প্রয়োজন ছিল। তাকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আগে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার সুযোগ হয়নি৷ ফলে গোয়েন্দাদের মাঝে গোপনে যেসব পদ্ধতিতে যোগাযোগ স্থাপন করা হয় তার অনেকগুলো তোলকাচেভের ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছিল না।
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি জুড়ে সিআইএ হেডকোয়ার্টারের সাথে পরামর্শ করে তোলকাচেভকে একটি ছোট স্পাই ক্যামেরা, একটি লাইট মিটার, ক্যামেরা চালানোর দিকনির্দেশনা ও অভিযান সম্পর্কিত একটি চিরকুট দিয়ে সেসব আবারো একটু নোংরা ব্যাগে ভরে ডেডড্রপ পদ্ধতিতে হস্তান্তর করা হয়। ক্যামেরাটি দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন কাগজপত্রের ছবি তোলার জন্য। ক্যামেরার আকার ছিল ছোট এক ম্যাচবক্সের সমান।
প্রতিমাসে একবার করে তোলকাচেভের বাসায় ফোন করে যোগাযোগ করা হতো। তবে ফোন করার দিন তারিখ নির্ধারণ করার বিষয়টি খুবই অভিনব ছিল। যেমন-জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ফোন করা হলে পরেরবার ফোন করা হতো ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে। এভাবে পরেরবার ফোন করা হতো মার্চের ৩ তারিখে। আবার কোনো মাসের ১৫ তারিখে ফোন করা হলে, পরেরবার ফোন করা হতো পরের মাসের ১৬ তারিখে।
প্রতি তিন মাসে একবার করে মাসের শেষ সপ্তাহে তোলকাচেভ বিভিন্ন তথ্য সিআইএ-কে প্রদান করতেন। তবে তার সবই হতো ডেডড্রপ পদ্ধতিতে। প্রথমে তাকে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখার জন্য সংকেত পাঠানো হতো। এরপর সেখান থেকে তা সংগ্রহ করে সিআইএ তাকে আরেকটি সংকেত পাঠাত; যাতে করে তিনি বুঝতে পারেন, তার দেওয়া ডকুমেন্টসগুলো সঠিক লোকের কাছেই পৌঁছেছে।
এসব সংকেত প্রদানের জন্য অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে রাখা হতো। যেমন সোমবারে যদি সিআইএ তোলকাচেভের দেওয়া ডকুমেন্টস পায়, তাহলে মঙ্গলবারে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্কিং করে রাখা হতো। সেটি দেখেই তোলকাচেভ বার্তা পেয়ে যেতেন।
কিন্তু তোলকাচেভের কাছে ডেডড্রপ পদ্ধতিতে তথ্য আদানপ্রদান ভালো লাগত না। তিনি এর চেয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে স্বস্তিবোধ করতেন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে, সিআইএ-কে এই পদ্ধতি পরিহার করার পরামর্শ দেন। কারণ তার ভয় ছিল যদি কোনোভাবে এসব কারো হাতে পড়ে যায়, তাহলে তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
তখন হ্যাথাওয়ে সিআইএ এর হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়ার পর ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় ভাগে বেশ কয়েকবার তারা তোলকাচেভের সাথে বৈঠক করেন। পরবর্তী পাঁচ বছরে সিআইএ ও তাদের সোভিয়েত এজেন্ট ২০ বারের বেশি বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে তোলকাচেভ শতাধিক ক্যামেরা ফিল্ম ও শত শত হাতে লেখা ডকুমেন্টস সিআইএ এর হাতে তুলে দেন।
কেজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে তোলকাচেভের সাথে যোগাযোগ
সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির বিশেষ একটি দলই ছিল, যারা বিভিন্ন বিদেশী নাগরিকের ওপর নজরদারি করতো। তবে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা অনেক হলেও, তাদের পক্ষে সবার ওপর নজরদারি চালানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু এরপরও একজন কেস অফিসারকে সতর্কভাবে চলাচল করতে হতো, যাতে তিনি নজরদারির বাইরে থেকে এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
সিআইএ-এর কেস অফিসাররা কেজিবি সদস্যদের বিরক্ত করে তোলার জন্য রুটিন মাফিক বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। কখনো তারা কেনাকাটা করতেন, কখনো পার্কে দৌড়াতেন, কখনো বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতেন, আবার কখনো নিজের পোষা কুকুর নিয়ে হাঁটতেন। এর মধ্যেই তারা যদি হঠাৎ করে কোনো সুযোগ পেতেন, সাথে সাথে তা কাজে লাগাতেন।
তবে এর বাইরেও কেস অফিসারকে এজেন্টদের সাথে যোগাযোগের একাধিক পরিকল্পনা তৈরি করতে হতো। কারণ তিনি জানতেন না কখন তিনি নজরদারির বাইরে থাকবেন। ১৯৮০ সালের জুন থেকে তোলকাচেভের সাথে যোগাযোগের একটি ভিন্ন পদ্ধতি বের করেন জন গুলিশার। তিনি মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে দূতাবাসে থাকা কর্মীর বাসায় দাওয়াতের কথা বলে আসতেন৷
কিন্তু তিনি আসতেন যে গাড়িতে, সেই গাড়িতে কখনোই যেতেন না। অন্য কোনো গাড়িতে করে বের হয়ে যেতেন, যার প্রতি কেজিবির সন্দেহ কম থাকতো। গাড়ির ভেতরেই পশ্চিমা পোশাক ছেড়ে সাধারণ রাশিয়ানদের মতো বেশ ধরতেন। এরপর তোলকাচেভের সাথে দেখা করে ফিরে আসার পথে পোশাক পরিবর্তন করে মার্কিনী বেশ ধরতেন।
তোলকাচেভের বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক দাবি
এ ধরনের কাজে প্রত্যেক এজেন্টই বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে থাকেন। তবে শুরুতে তোলকাচেভের তেমন কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারলেন, তার দেওয়া তথ্যের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি, তখন তিনি নিজেকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে চাইলেন। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে, তোলকাচেভ যখন দ্বিতীয়বারের মতো সরাসরি সাক্ষাৎ করেন, তখন তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন।
সেদিনের ১৫ মিনিটের সাক্ষাতে তোলকাচেভ মোট ৫টি ফিল্ম তুলে দেন, যেগুলোতে তিনি স্পাই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছিলেন। এর সাথে ৫০ পৃষ্ঠার বেশি নিজ হাতে লেখা বাস্তব ও প্রায়োগিক তথ্য দেন। তার দেওয়া নোটগুলোতে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ এক যুগের সকল গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য সিআইএ-কে দেওয়ার প্রস্তাব দেন৷ সব তথ্য তিনি মোট সাত ধাপে দেবেন এবং প্রতিটি ধাপের জন্য তাকে আলাদাভাবে অর্থ দিতে হবে।
এর আগে জানুয়ারিতে যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেটিকে তিনি প্রথম ধাপ হিসেবে ধরেন। সেসময় সিআইএ তাকে ১০ হাজার রুবল দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তা যথেষ্ট মনে করেন না। প্রতিটি ধাপের জন্য তিনি ছয় অঙ্কের পারিশ্রমিক দাবি করেন, যে পরিমাণ অর্থ এর আগে ভিক্টর বেলেনকো পেয়েছেন। যদি সিআইএ এই পরিমাণ অর্থ দিতে রাজি না থাকে, তাহলে তিনি নতুন তথ্য বাদ দিয়ে পুরনো সব তথ্য দেবেন।
তোলকাচেভ তখন এ-ও বলেন যে, তিনি শুধু অর্থের জন্য এমন কাজ করছেন না। বরং তার লক্ষ্যই হচ্ছে অল্প সময়ের মধ্যে যথাসম্ভব তথ্য পাচার করা। যেহেতু তিনি তার কাজ শুরু করেছেন। তাই তিনি আর মাঝপথে থেমে যেতে চান না।
অক্টোবরে আবারো তোলকাচেভের সাথে সিআইএ সাক্ষাত করে। এপ্রিলে তাদের এজেন্ট যে পারিশ্রমিক চেয়েছিলেন, সেটি পরিশোধে সিআইএ কোনো কার্পণ্য করেনি। তাকে মোট এক লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ রুশ মুদ্রায় প্রদান করা হয়।
কিন্তু এর জবাবে তোলকাচেভ বলেন, ছয় অঙ্কের বলতে তিনি ছয়টি শূন্য বুঝিয়েছিলেন৷ কারণ তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় এক মার্কিন বিশেষজ্ঞের মুখে শুনেছিলেন সোভিয়েত সরকার মিগ-২৫ পুনর্সংস্কারের জন্য প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। সেই হিসেবে তিনি মিগ-২৫ এর তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে তার বিনিময়ে যে অর্থ পাচ্ছেন, তা অতি সামান্যই বলা যায়।
তবে তোলকাচেভ বুঝতে পেরেছিলে্ তিনি যে পারিশ্রমিক দাবি করছেন- তা অনেক বেশি। মূলত তার অর্থের প্রতি তেমন লোভ ছিল না। কিন্তু সিআইএ তার কাজকে মূল্যায়ন করছে, তা বোঝার জন্য তার বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক প্রয়োজন ছিল। পরবর্তীতে ডিসেম্বরে আবারো তার সাথে সিআইএ-এর কেস অফিসার সাক্ষাত করে৷ তখন তাকে মাসে এক লাখ রুবল করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়৷ এতে তোলকাচেভ সন্তুষ্ট ছিলেন।
তবে এরপরও পারিশ্রমিক নিয়ে তোলকাচেভ ও সিআইএ-এর মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল। অবশেষে ১৯৮০ সালের মে মাসে তা দূর হয়। সিআইএ তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বার্ষিক বেতনের সমপরিমাণ অর্থ তাকে প্রদানের আশ্বাস দেয়। পাশাপাশি কাজের ওপর ভিত্তি করে তার পারিশ্রমিক বাড়বে বলেও জানানো হয়।
তবে তোলকাচেভকে যে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, তা বন্ড আকারে থাকবে। তিনি যখন তার পরিবার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন তিনি সেখানে তা নগদ অর্থে পরিণত করতে পারবেন। এর ওপর তাকে ৮.৫ হারে মুনাফা দেওয়ার কথাও বলে সিআইএ।
তবে তোলকাচেভ তার কিছু অর্থ সোভিয়েত সরকার বিরোধী আন্দোলনে ব্যয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিআইএ এর সাথে নিজেদের জড়াতে ইচ্ছুক ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তোলকাচেভ দিয়ে সামরিক তথ্যগুলো হাতিয়ে নেওয়া।
ক্যামেরা নিয়ে যত সমস্যা
১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তোলকাচেভকে প্রথম মিনিয়েচার ক্যামেরা দেওয়া হয়। কিন্তু এই ক্যামেরা দিয়ে তার কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিল। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, এই ক্যামেরার প্রতি রোলে ৭০-৮০টি এক্সপোজার থাকে। অফিসে ছবি তোলার জন্য বেশি আলোরও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই ক্যামেরায় তা সম্ভব হতো না। তাছাড়া ছোট আকারের জন্য ক্যামেরা ধরে রাখা কঠিন ছিল। ফলে অধিকাংশ ছবি ঝাপসা হতো। এছাড়া ছবি তোলার সময় শব্দও হতো বেশি।
এ কারণে তোলকাচেভ একটি সাধারণ ৩৫ মিলিমিটারের ক্যামেরা দিতে বলেন। যার মাধ্যমে তিনি আরো ভালো ছবি তুলতে পারবেন। তবে এই ক্যামেরা দিয়ে তিনি যেহেতু অফিসে ছবি তুলতে পারবেন না। তাই তিনি বিভিন্ন নথিপত্র নিরাপত্তার ফাঁক গলে বাসায় নিয়ে ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নেন।
দুপুরের খাবারের জন্য যখন তাদের বিরতি দেওয়া হয়, তখন তার স্ত্রী অফিসে থাকেন, আর ছেলে স্কুলে। ফলে ফাঁকা বাড়িতে তার কাজ সারতে বেশি সময় লাগবে না। তোলকাচেভ তার গোপনে গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে পরিবারের কাউকে জানাননি। কারণ তিনি চাননি তার জন্য তাদের কোনো সমস্যা হোক।
পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের অক্টোবরে তাকে পেন্টাক্স ক্যামেরা দেওয়া হয়। এরপর থেকে দুপুরে ২০ মিনিটের জন্য বাসায় গিয়ে বিভিন্ন নথিপত্রের ছবি তুলে সেসব আবার অফিসে রেখে দিতেন তোলকাচেভ। এর পরবর্তী সাক্ষাতে তিনি ১৫০টি ফিল্ম ভর্তি ছবি দেন, যার সবগুলোই ছিল একদম পরিষ্কার। কিন্তু এর আগে যেসব ছবি দিয়েছিলে্ তার অধিকাংশই বোঝা যায়নি।
কিন্তু সিআইএ চেয়েছিল শুধু বাসায় না, তোলকাচেভকে এমন কিছু ক্যামেরা দিতে, যা দিয়ে তিনি অফিসেও ছবি তুলতে পারেন। একই বছরের অক্টোবরে তাকে প্রথমে দুইটি এবং পরে আরো চারটি নতুন মডেলের স্পাই ক্যামেরা দেওয়া হয়। তবে এসব ক্যামেরার ফিল্ম শেষ হয়ে যাবার পর তাকে পুরো ক্যামেরাই ফেরত দিতে হতো। এ কারণেই তাকে একসাথে একাধিক ক্যামেরা সরবরাহ করা হয়েছিল।
তোলকাচেভের অফিসের নিরাপত্তা জোরদার
তোলকাচেভের অফিসের নিয়ম ছিল, সেখানে কর্মরত প্রকৌশলীরা যেকোনো প্রয়োজনে যত ইচ্ছে নথিপত্র দেখতে পারবেন এবং সেগুলো অফিসের সময় শেষ হওয়ার আগে ফেরত দিলেই চলবে। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে এই নিয়ম বাতিল করা হয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী পাস জমা দেওয়া ছাড়া কোনো নথি গ্রন্থাগার থেকে নেওয়া যাবে না। যখনই কেউ গ্রন্থাগার থেকে কোনো নথি নেবেন, সেখানে তাকে তার পাস জমা দিতে হবে। এরপর তিনি যখন অফিস থেকে বাইরে যাবেন, তাকে ডকুমেন্টস জমা দিয়ে পাস ফেরত নিতে হবে।
এই নিয়মের কারণে তোলকাচেভের ছবি তোলার পরিমাণ কমে যায়। কারণ নথিপত্র বাসায় নিয়ে যাওয়ার কোনো পাস তার কাছে ছিল না। এ কারণে তিনি ঝুঁকি নিয়ে টয়লেটের মধ্যে মিনিয়েচার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতেন। কিন্তু এতে তিনি স্বস্তিবোধ করতেন না। কারণ অল্প আলোতে ছবিগুলো ভালো আসত না।
তখন তিনি সিআইএ-কে নকল পাস তৈরি করে দিতে বলেন, যাতে তিনি সেটি প্রদর্শন করে বিভিন্ন নথিপত্র দুপুরের খাবার সময়ে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। তোলকাচেভের পরিকল্পনা ছিল আসল পাস দিয়ে তিনি অফিসে প্রবেশ করবেন এবং বের হবেন। আর নকল পাস দিয়ে গ্রন্থাগার থেকে নথি নেবেন।
সিআইএ তার জন্য নকল পাস তৈরি করার জন্য তার কাছে থেকে পাসের রঙিন ছবি ও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তোলকাচেভকে সেই পাস দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি কাজে লাগেনি। এর আগেই নতুন নিয়ম বাতিল করে দেওয়া হয়।
১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারী কর্মীরা অভিযোগ করেন যে, তাদের বিভিন্ন সময় অফিসের বাইরে যেতে হয়। বিশেষ করে দুপুরে। কিন্তু তখন গ্রন্থাগার বন্ধ থাকে। এতে তাদের সমস্যা হচ্ছে। তখন নতুন নিয়ম বাতিল হয়ে যায়৷
তোলকাচেভও আবার পুরোদমে তার কাজ শুরু করেন। জুনে তিনি সিআইএ-কে মোট ২০০টি ফিল্ম সরবরাহ করেন, যা ছিল তার একবারে সরবরাহ করা সর্বোচ্চ সংখ্যক ফিল্ম। তোলকাচেভের সরবরাহ করা এত বিপুল সংখ্যক ছবি যুক্তরাষ্ট্রকে কতটুকু উপকার করেছিল? জানতে হলে পড়ুন পরের কিস্তি।
একুশে বইমেলা ‘২০ উপলক্ষে রোর বাংলা থেকে প্রকাশিত বইগুলো কিনতে এখনই ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
১) ইহুদী জাতির ইতিহাস
২) সাচিকো – নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক শিশুর সত্য ঘটনা
৩) অতিপ্রাকৃতের সন্ধানে