স্পেশাল ফোর্স বা বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা যেকোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি এক নিমিষেই পাল্টে দিতে পারেন। যুদ্ধের বিশেষ মুহুর্তে তাদের আগমনে পাল্টে যায় যুদ্ধের গতি এবং এ কাজেই তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।
এই বাহিনীর সদস্যদের যুদ্ধের সময় এনিমি লাইনের পেছনে প্যারাস্যুটের মাধ্যমে অবতরণ করিয়ে ব্লকিং পজিশন তৈরি করা হয়। সেসময় নিয়মিত বাহিনী যখন সম্মুখ দিক থেকে শত্রুদের প্রবল আক্রমণ করে, স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা তখন শত্রু বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করে।
দু’দিকের এই তীব্র আক্রমণ সামলাতে না পেরে শত্রুবাহিনী পরাজয় বরণে বাধ্য হয়। যেমনটি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নরম্যান্ডিতে মিত্রবাহিনীর প্যারাড্রপের ফলে। ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল একাত্তরেও; যৌথ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যৌথ বাহিনীর টাঙ্গাইলে প্যারাড্রপের ঘটনাটি ত্বরাণ্বিত করেছিল পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ।
যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ বাহিনীর কার্যক্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের এই কাজের জন্য পারদর্শী করে তুলতে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, সাধারণ বাহিনীর যেখান থেকে শেষ, বিশেষ বাহিনীর সেখান থেকে শুরু!
পেছনের কথা
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ জুড়ে চলছে মানুষ নিধন। পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ যোগ দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি গড়ে উঠছে গেরিলা বাহিনী। আর এ সকল গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (ইবিআর) সদস্যরা। এমনই এক পরিস্থিতিতে নিয়মিত বাহিনীর আক্রমণকে আরও বেগবান করার জন্য এবং সরাসরি এনিমি লাইনের ভেতর আক্রমণ করার জন্য একটি স্বতন্ত্র কমান্ডো বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
তখনই এই অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এলেন মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের অপারেশনাল অফিসার মেজর এটিএম হায়দার, যিনি ছিলেন পাকিস্তান আর্মির স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি)-এর প্রশিক্ষিত প্যারাকমান্ডো এবং সরাসরি জেনারেল মিঠ্ঠার হাতে গড়া। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর হায়দার তৎকালীন কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন।
কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করার এই প্রয়োজনীয় মুহুর্তে ঢাকা শহরের কিছু ছেলে আসে মেলাঘর মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য। দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এঁদের সরাসরি এনে দাঁড় করান মেজর হায়দারের সামনে।
মেজর হায়দার তাঁদের সুদীর্ঘ সময় রেইড, অ্যাম্বুশ, হামলা, প্রতিরক্ষা, সারভাইভাল, বুবিট্র্যাপসহ বিভিন্ন কষ্টকর আর দুঃসাধ্য কমান্ডো প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এই কঠোর প্রশিক্ষণ আর দেশপ্রেমকে পুঁজি করে গড়ে ৫৩ জনকে নিয়ে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম বিশেষ বাহিনী।
তারা একে একে ঢাকায় বিরাশিটি আক্রমণ চালান। একদিক দিয়ে মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখেও যখন পাকিস্তানিরা ঢাকা সেনানিবাসের মাটি কামড়ে পড়েছিল, তখনই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা এক অভিনব কায়দায় পাকিস্তানিদের ওপর একের পর এক রেইড চালায়। ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতির এই সকল রেইডের ফলে পাকিস্তানিরা লোকবল এবং মনোবলে দুর্বল হয়ে পড়ে।
আক্রমণ সামলাতে দিশেহারা হতে হতে একসময় ঢাকা শহরে পাকিস্তানিরা ‘অন্ধ ও বধির’-এ পরিণত হয়! থেমে যায় ঢাকা শহরে পাকিস্তানিদের রাত্রিকালীন টহল। দিবা টহলেও থাকে ভয় আর উত্তেজনা। ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলোতেও তখন সমানে চলছে কমান্ডোদের আক্রমণ।
এই অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অনেক সৈন্য ও রসদ হারিয়ে নিরাপদ আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত বাহিনী, গেরিলা বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর সম্মিলিত অগ্রাভিযানের মুখে অবশেষে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের এক পড়ন্ত বিকেলে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাঙালির কাঙ্ক্ষিত বিজয়।
স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইং
১৯৭৬ সাল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম বিশেষ বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে প্রাক্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত কমান্ডোদের দিয়ে গঠন করা হয় ‘কমান্ডো – স্পেশাল ওয়ারফেয়ার স্কুল’। এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সেনানিবাস, যথাক্রমে- চট্টগ্রাম, সাভার, রাজবাড়ী, জয়দে
‘মেকার অফ লিডার্স’- এই স্লোগান নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান ‘স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাক্টিক্স’, সংক্ষেপে ‘এস আই অ্যান্ড টি’।
১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লা সেনানিবাসে এই স্কুলের যাত্রা শুরু। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে এর নাম এবং কার্যপরিধি পরিবর্ধিত হয়। এরপর এই বিশেষায়িত যুদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে কুমিল্লা থেকে সিলেটে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮১ সালে তদানীন্তন স্পেশাল ওয়ারফেয়ার স্কুল এই প্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত হয়ে ‘স্পেশাল ওয়ারফেয়ার উইং’-এ রুপ নেয়। আর এই প্রতিষ্ঠানেই হয়ে থাকে কঠোরতম ‘প্যারা কমান্ডো’ প্রশিক্ষণ।
প্যারা কমান্ডো কোর্স বা আর্মি কমান্ডো কোর্স
প্যারা কমান্ডো কোর্স বা আর্মি কমান্ডো কোর্স বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কষ্টকর একটি প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর সকল আর্মস এবং সার্ভিস থেকে কেবলমাত্র স্বেচ্ছাসেবী অফিসার এবং সৈনিকরাই এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণ অত্যন্ত কঠোর এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
প্যারা কমান্ডো প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তিকাল ছয় মাস। এই ছয় মাসে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী কমান্ডোকে যেতে হয় শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি দিন যেন নরকের আগুনের মতো হয়ে ওঠে প্রশিক্ষণার্থী কমান্ডোর জন্য।
কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, অমানুষিক পরিশ্রম আর অবর্ণনীয় শারিরীক নির্যাতন সহ্যের পর তৈরি হন একজন কমান্ডো। কখনো নামতে হয় উত্তাল সাগরের অতল গহ্বরে, কখনো অসীম নীলাকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় নিচে, কখনো বা হাড় কাঁপানো শীতের রাতে লড়তে হয় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। ক্ষুধার তাড়নায় খেতে হয় অনেক অখাদ্য, সার্ভাইভাল ট্রেনিংয়ে গিয়ে লড়তে হয় নিজের ক্ষুধার্থ শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণুর সাথে।
এই ছয় মাসের নির্ঘুম রাত-দিনের হিসেব কমান্ডোদের থাকে না। ভয়ানক সব সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে আরও এক মাস প্যারাট্রুপিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণের পর প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী কমান্ডো অর্জন করেন সেই দুর্লভ কমান্ডো ব্যাজ। অপ্রচলিত এবং প্রচলিত যুদ্ধের যত ধরন আছে, তার সবই নখদর্পনে থাকে বিশেষ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত এই সকল যোদ্ধাদের।
প্যারা কমান্ডো প্রশিক্ষণ সবার জন্য নয়। এটি এক আদিম সত্য। তাই কমান্ডো অরিয়েন্টেশনের প্রথম রাত থেকেই শুরু হয় ঝরে পড়া। প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত যারা টিকে থাকে, তাদের শ্রেষ্ঠত্বটাও হয় একদম নিরেট!
কখনো কখনো এই ঝরে যাওয়াদের সংখ্যাই এসে দাঁড়ায় মোট প্রশিক্ষণার্থীর পঁচাশি শতাংশে। অর্থাৎ, মাত্র পনের শতাংশ প্রশিক্ষণার্থী পুরো কমান্ডো কোর্স সম্পন্ন করে বুকের বাম দিকে চকচকে সোনালি রঙের কমান্ডো ব্যাজ পরিধান করতে পারেন।
প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড
১৯৯৩ সালের জুলাই। বিশেষ বাহিনীর প্রথম ব্যাটালিয়নের পতাকা উত্তোলন করা হয় পূণ্যভূমি সিলেটে। ‘১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন’ নামক স্বতন্ত্র এই ব্যাটালিয়নের প্রতিটি সদস্য দেশ এবং দেশের বাইরে সর্বোচ্চ শ্রমের মাধ্যমে দেশের পতাকার মান সমুন্নত রাখতে সদা প্রস্তুত। তার স্বীকৃতিও মিলেছে একের পর এক। সম্প্রতি ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে ‘জাতীয় পতাকা’ প্রদান করা হয়, যা কোনো একটি ব্যাটালিয়নের জন্য সর্বোচ্চ সার্ভিসের স্বীকৃতি।
প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ২০১৬ সালে সেনা সদরের তত্ত্বাবধানে স্বতন্ত্র একটি বিশেষ অপারেশন ব্রিগেডে রূপ নিয়েছে, যেটি ‘প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড’ নামে পরিচিত। এর সদর দপ্তর সিলেটে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। ঠিক একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই এদেশের বিশেষ বাহিনীর যাত্রা। তবে এই বিশেষ বাহিনী প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায় ১৯৭৬ সালে। এরপর থেকে এই বাহিনী যেসব অপারেশনে অংশ নিয়েছে, তার প্রতিটিতেই অর্জন করেছে সফলতার মাল্য।
প্যারা কমান্ডোর পরিচালিত অভিযানসমূহ
অপারেশন দাবানল
পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘সন্ত্রাস-বিরোধী’ অপারেশনে অংশ নিয়ে এই ব্রিগেডের সদস্যরা সফলতার সাথে সন্ত্রাস দমন করেছে এবং পাহাড়ে শান্তি আনয়নে ভূমিকা রেখেছে।
অপারেশন মরুপ্রান্তর
১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর একটি পদাতিক ইউনিট, একটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিট, একটি মেডিক্যাল ইউনিট, একটি লজিস্টিক্স ইউনিট ও একটি প্যারা কমান্ডো প্লাটুন মিলে একটি বিশেষ ব্রিগেড গঠন করে সেটিকে কোয়ালিশন বাহিনীর অংশ হিসেবে সৌদি আরবে প্রেরণ করা হয় দুই পবিত্র নগরের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোসহ বিশেষায়িত এই ব্রিগেড অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করে।
অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম
১৯৯১ সাল। উপসাগরীয় যুদ্ধে প্রেরিত বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনীর যোদ্ধারা শুরু করে আরব ভূমি পুনরুদ্ধারের এক মহতী অভিযান। ১৯৯১ সালের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ‘অপারেশন ডেজার্ট শিল্ড’-এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’। কোয়ালিশন বাহিনীর অন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যায় বাংলা মায়ের সন্তানেরা।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ বিশ্বশান্তি রক্ষায় এক অনন্য নাম। পৃথিবীর সমস্যা আর যুদ্ধ কবলিত অঞ্চলগুলোতে এনে দিচ্ছে শান্তির পরশ।
এই মিশন এলাকাগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু কিছু অঞ্চল এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে, সেখানে বসবাস করাই রীতিমতো ভয়ের ব্যাপার। অন্যরা যেখানে কাজ করতে পিছিয়ে যায় বা দশবার ভাবে, সেই জায়গাগুলোতেই স্থানীয়দের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কাজ করছে আমাদের নির্ভীক সেনারা।
বর্তমানে বিশ্বের বারোটি দেশের এগারোটি মিশনে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে চারটি এলাকায় আছে আমাদের ‘ব্যান এসএফ’ বা ‘বাংলাদেশ স্পেশাল ফোর্স’।
অপারেশন থান্ডারবোল্ট
২০১৬ সালের পয়লা জুলাই। রমজান মাস, তারাবির নামাজের পর ক্লান্ত দেহে লোকজন ফিরছিলেন ঘরে। ঠিক তখনই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে খবর আসতে থাকে ঢাকাস্থ গুলশানের ‘হলি আর্টিজান’ নামক রেস্তোরাঁয় জঙ্গী হামলার খবর। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঘটনাস্থলে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
কিন্তু ঘটনা ক্রমশই খারাপের দিকে মোড় নিতে থাকে। এর মাঝে খবর আসে জঙ্গীদের ছোঁড়া গুলিতে ও গ্রেনেড হামলায় পুলিশের দুজন কর্মকর্তা আহত হয়ে পরবর্তীতে হাসপাতালে মারা যান।
এরপরই ঘটনাস্থলে আসে পুলিশের বিশেষায়িত দল ‘সোয়াট’। সাথে র্যাব ও বিজিবিকে নিয়ে অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু জঙ্গীরা তখন হামলা করতে মরিয়া; ভেতর থেকে একটানা এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা। এমতাবস্থায় ভেতরের আটকা পড়া দেশি-বিদেশি জিম্মিদের কথা ভেবে দেশের সর্বোচ্চ বাহিনীকে দিয়ে অভিযান পরিচালনা করার কথা চিন্তা করা হয়।
তারই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী মাননীয় সরকার প্রধানের কাছে ‘প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড’কে দিয়ে অভিযান পরিচালনার সুপারিশ করে। সরকার প্রধান কর্তৃক আদেশপ্রাপ্ত হয়ে “চিতা’স ডেন” নামে পরিচিত সিলেটস্থিত প্যারা কমান্ডো সদরদপ্তর থেকে ১০০ জন অকুতোভয় কমান্ডোকে বিমান বাহিনীর এএন-৩২ বিমানে করে ঢাকায় উড়িয়ে আনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এরপর প্যারা কমান্ডো ব্রিগেডের অধীনস্থ ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এম. এম. ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে সরাসরি হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় অপারেশন পরিচালনায় পাঠানো হয়।
পরদিন সকাল সাতটা চল্লিশ মিনিট। নিজস্ব স্নাইপারদের বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের জায়গামতো বসিয়ে এপিসি নিয়ে সরাসরি অভিযানে নামে প্যারা কমান্ডোরা। প্রথমেই এপিসির ধাক্কায় দেয়াল ভাঙার মাধ্যমে শত্রুদের দেয়া হয় এক প্রচণ্ড ও আকস্মিক ‘ব্যাটেল শক’।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে জঙ্গিরা বাইরে এসে হামলা করতে উদ্যত হলে, একে একে ছয়জন জঙ্গীকেই এক নিমিষেই কৌশল আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মাধ্যমে শেষ করে দেওয়া হয়। অপারেশন শুরুর মাত্র তেরো মিনিটের মাথায় নিজেদেরকে সম্পূর্ণ অক্ষত রেখে টার্গেট এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপন করে বাংলার প্যারা কমান্ডোরা।
উদ্ধার করা হয় ভেতরে আটকা পড়া তেরোজন দেশি-বিদেশি জিম্মিকে। এছাড়া উদ্ধার করা হয় বিশজনের মৃতদেহ, যাদের আগেরদিন রাতে জঙ্গীরা উক্ত রেস্তোরাঁয় হামলা করার পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের মাথায় ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে। তাছাড়া উদ্ধার করা হয় জঙ্গীদের ব্যবহৃত বন্দুক, পিস্তল, গ্রেনেড ও ধারালো অস্ত্র, নিষ্ক্রিয় করা হয় আইইডি।
‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ দেশে-বিদেশে বিশেষ সুনাম অর্জন করে। বিশ্বের অন্যতম সফল জঙ্গী বিরোধী অপারেশন হিসাবে এটিকে ধরা হয়।
অপারেশন টোয়াইলাইট
২৪ মার্চ ২০১৭, দিবাগত রাত। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ‘আতিয়া মহল’ নামের একটি বাড়ি ঘিরে রাখে পুলিশ। পুলিশের কাছে তথ্য যে, ভেতরে জঙ্গীরা অবস্থান করছে আর তাদের সাথে আছে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও বিস্ফোরক। তাই অপারেশনে ডাকা হয় পুলিশের বিশেষ দল ‘সোয়াট’কে।
সোয়াট এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর প্যারা কমান্ডো দ্বারা উক্ত অভিযান পরিচালনা করার সুপারিশ করে। ঠিক তার পরদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা মাননীয় সরকার প্রধান কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে উক্ত স্থানে এসে অপারেশন পরিচালনার দ্বায়িত্ব নেয়। শুরু হয় প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে আতিয়া মহলকে জঙ্গী মুক্ত করতে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।
টানা ১১১ ঘণ্টা এই অভিযানে কমান্ডোরা তাদের জীবন বাজি রেখে অভিযান পরিচালনা করেন। ২৫ মার্চ দুপুরে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাঁচ তলা বাড়িটির প্রতি তলায় ৬টি করে মোট ৩০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৮টি ফ্ল্যাটে বসবাসকারী ৭৮ জন জিম্মিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে, যাদের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ শিশু ছিল।
প্যারা কমান্ডোদের গুলিতে নিহত হয় চার জঙ্গী, যাদের মধ্যে একজন ছিল গুলশান হামলার অন্যতম ‘মাস্টার-মাইন্ড’। চতুর্দিকে জালের মতো আইইডি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আতিয়া মহলকে এরপর কমান্ডোরা বিস্ফোরক-মুক্ত করেন।
অপারেশন টোয়াইলাইট অপ্রচলিত যুদ্ধাভিযানগুলোর মধ্যে অন্যতম দীর্ঘতম ও সফল অভিযান। এ অভিযানে বাংলাদেশের প্যারা কমান্ডোরা তাদের ধৈর্য, মেধা, শ্রম ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনীর মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি করেছেন।
অপারেশন চিটাগং এয়ারপোর্ট
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের কন্ট্রোলরুম থেকে ভেসে আসতে থাকে লাল সংকেত। মাইকে ঘোষণা হতে থাকে, “ময়ূরপঙ্ক্ষী এয়ারক্রাফট হ্যাজ বিন হাইজ্যাকড”।
বিমানটি জরুরি অবতরণ করে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। বিএএফ ঘাঁটি জহুরুল হক থেকে উড়ে আসে বিমান বাহিনীর বিশেষ দল। বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের নেতৃত্বে বিমান বাহিনীর সদস্যরা ছিনতাইকারীর সাথে কথা বলতে থাকেন।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস. এম. মতিউর রহমান। তিনি এসেই উক্ত অভিযানের কমান্ড গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের বিএনএস ঈসা খাঁ-তে তখন সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোরা নৌবাহিনীর সাথে অন্য একটি মহড়ায় ব্যস্ত ছিল। সেখান থেকে দ্রুততম সময়ের মাঝেই তারা সেখানে এসে পৌঁছান।
শুরু হয় বিমান ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে অভিযান। উক্ত অভিযান শুরুর প্রাক মুহুর্তে সকল যাত্রীকে বিমানের জরুরি দরজা দিয়ে বের করে আনা হয়। কমান্ডো অভিযান শুরুর মাত্র আট মিনিটের মাথায় কমান্ডোদের গুলিতে ছিনতাইকারী প্রথমে আহত হয় এবং পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করে। তার কাছ থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়।
সামরিক অভিযান পরিচালনায় বিশেষভাবে পারদর্শী বাংলাদেশের এই কমান্ডোরা সারা বছরই বিভিন্ন মহড়ায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। প্রচলিত ও অপ্রচলিত যুদ্ধের সব রকম হুমকি মোকাবেলা করে দেশকে সদা নিরাপদ রাখতে তাঁরা প্রস্তুত।