সুন্দরবনের কোলঘেঁষা শরণখোলায় বেড়ে ওঠা। এই এলাকার পশ্চিম পাশে বহমান ভোলা নদী। সেটি পার হলেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন। পূর্ব পাশে বলেশ্বর নদী; যার বুকে ঘণ্টা দেড়েক ট্রলার চালালেই বঙ্গোপসাগরের দেখা মেলে।
ছোটবেলায় দেখা যেত, মাঝেমাঝে ভোলা নদী পাড়ি দিয়ে বনের বাঘ উপকূলে চলে এসে মানুষের ওপর হামলা করতো; নিরূপায় মানুষ গণধোলাই দিয়ে সেসব বাঘদের হত্যা করে ফেলত। তখনকার দিনে বন্য প্রাণী রক্ষায় আজকের মতো তোড়জোড়ও ছিল না।
আবার বলেশ্বর নদীতে পাল তুলে অনেক জেলে ঐ বাঘদের আবাসভূমিতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে যেত। অবশ্য বাঘের রাজ্যে বাঘই রাজা। সেখানে বাগে পেয়ে অনেক জেলের জীবন ছিনিয়ে নিত বাঘেরা। অনেকে আবার ফিরে আসত বাঘের সাথে লড়াই করে। তবুও জীবিকার এই যাত্রা যেন থামবার নয়; দুর্ঘটনার হার কিছুটা কমে আসলেও মাছের সন্ধানে গহীন সুন্দরবনে জেলেদের যাতায়াত এখনো অনেকটা নিয়মিত।
তবে আগেকার দিনে নিয়মকানুন কম ছিল; অথবা আইন বাস্তবায়নে শিথিলতা ছিল। যেমন তখনকার দিনে এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম ব্যবসা ছিল বনের সুন্দরী কাঠ কালো বাজারে বিক্রি করা। এটা ছিল অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। অর্থাৎ, নিষিদ্ধ হলেও সবাই মিলেমিশে এই অবৈধ কাজটি অবাধে করতেন।
কাঠের জন্য বিখ্যাত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে এসব অবৈধ কাঠের অবাধ বেচাকেনা হতো। তখনকার দিনে এই কাঠ দিয়ে ঘর নির্মাণ বা ফার্নিচার তৈরি করতে পারা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।
কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। বর্তমানে সুন্দরী কাঠের ক্রয়-বিক্রয় প্রায় শূন্যের কোঠায়। আইনের বাস্তবায়নই সুন্দরবনকে এই সুফল বয়ে এনে দিয়েছে।
শুধু কাঠ নয়; এই কড়াকড়ি আরোপিত হয়েছে মধু সংগ্রহ বা মাছ ধরার ক্ষেত্রেও। আগেকার দিনে কাঠের মতো মধু বা মাছও অবাধে সংগ্রহ করা যেত সুন্দরবনের অভ্যন্তর থেকে। যদিও এ বিষয়ে বিস্তারিত আইন ও নীতিমালা ছিল। কিন্তু দিন বদলেছে। এখন শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত খাজনা প্রদান সাপেক্ষে জেলে ও মৌয়ালরা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেন।
এ নিয়ম এখন সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অর্থনৈতিক বিষয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন পূর্বে, গভীর সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট কিংবা দুবলার চরের মতো গহীন বনেও যদি কেউ ঘুরতে যেতে চাইত, তাহলে আঞ্চলিক যেকোনো একটি ট্রলারে করে দল বেঁধে তারা ঘুরতে চলে যেত।
এখন আর সেই দিন নেই; শুধুমাত্র সরকার অনুমদিত পর্যটক লঞ্চে করে সুন্দরবনের গভীরে প্রবেশ করা যায়; যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল (১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা জনপ্রতি)। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটে প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে- সে আলোচনায় পরে আসছি।
উপর্যুক্ত আলোচনাগুলো করলাম মূলত সুন্দরবন উপকূলীয় মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক সংস্থানের একটি মানসিক চিত্রপট আপনাদের হৃদয়ে গ্রথিত করার জন্য। নতুবা এই সুন্দরবনকে ঘিরে যেসব মিথ বা উপকথা স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত আছে, সেসব বিশ্বাস করা হয়তো পাঠকদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যেতে পারে।
তবে সবকিছু নিয়ে তো আলোচনা করা সম্ভব নয়; আজকে শুধু গভীর সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে অবস্থিত দুবলার চরের বার্ষিক রাস মেলা নিয়ে আলোচনা করব।
আপনি একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন, যে বনে মানুষ খেকো বাঘ, কুমির, সাপ সহ বিভিন্ন ভয়ঙ্কর প্রাণীর বসবাস, সেই ঘন জঙ্গলে মানুষ কীভাবে জীবিকার তাগিদে ছুটে যায় নিরস্ত্র হাতে!
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কঠিন বোধ হচ্ছে? বাস্তবতা আপনার চিন্তার চেয়েও তীক্ষ্ণ ও কঠিন! এখনো সুন্দরবন উপকূলীয় জেলে পরিবারগুলোতে খোঁজ নিলে জানা যায়, তাদের কোনো না কোনো আপনজন সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
শুধুমাত্র বাঘের ভয় নয়; প্রাকৃতিক দুর্যোগও তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়। শুধুমাত্র প্রলয়ংকারী সিডরের সময় যে কত জেলে মারা গেছে- তার কোন ইয়ত্তা নেই! নেই কোনো সরকারি হিসেব। আর হ্যাঁ, এইসব ভয়-আতঙ্ক, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্য দিয়েই উপকূলীয় মানুষের মনে গড়ে উঠেছে উপকথা, পৌরাণিক কল্পকাহিনী। প্রতিবছর সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যে রাস উৎসব হয়ে থাকে, তার পেছনেও রয়েছে এমন এক পৌরাণিক বিশ্বাস।
রাস উৎসব মূলত হিন্দু ধর্মালম্বীদের একটি বার্ষিক উৎসব। যদিও বর্তমানে এটা একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর কার্তিক মাসের শেষের দিকে অথবা অগ্রহায়ন মাসের প্রথম দিকের ভরা পূর্ণিমার সময় এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা পূর্ণিমার জোয়ারের নোনা পানিতে স্নান করে পবিত্রতা অর্জন করার জন্য সেখানে গমন করেন। তাদের বিশ্বাস, এই স্নান তাদের পাপ মোচন করে মনের সকল উত্তম কামনা পূর্ণ করবে।
দুবলার চরটি একেবারে সুন্দরবনের শেষ মাথায়, বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপটি মূলত একটি অস্থায়ী জেলে গ্রাম। বছরের চারমাস সেখানে জেলেরা বসবাস করে।
বর্ষা মৌসুমে ইলিশ ধরা শেষ হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জেলেরা দুবলার চরে গিয়ে বসত গড়ে। সেখানে তারা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরে শুঁটকি তৈরি করে থাকে। চার-পাঁচ মাস ধরে শুঁটকি তৈরি করার পর সেগুলো আবার তাদের নৌকায় বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করতে নিয়ে চলে।
এভাবেই কেটে যায় এসব জেলে পরিবারের জীবনচক্র। অনেকসময় পথিমধ্যে কেউ মারা গেলে তার লাশটাও আত্মীয়দের কাছে বয়ে আনতে পারে না সতীর্থ জেলেরা। ভাগ্যের নিষ্ঠুর চক্রে এভাবেই আবদ্ধ তারা!
রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মূলত জেলেদের ফিরে আসার ঠিক আগেভাগে। যেন বিদায়ের আগে উৎসবের আয়োজন!
এই আয়োজন কীভাবে শুরু হলো- তা নিয়ে বহুজনের বহু মত পাওয়া যায়। মতভেদ রয়েছে এটি কবে শুরু হলো, সেটি নিয়েও। কেউ কেউ বলে থাকেন, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই উৎসবটি শুরু হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, তারও বহু আগে এ উৎসবটি শুরু হয়েছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে কীভাবে শুরু হয়েছিল- এ নিয়ে লোকমুখে নানা পৌরাণিক কাহিনী শুনতে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন পুস্তকাদিতে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায়, সেসবও মূলক এসব লোককথার লৈখিক রূপ মাত্র। ১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে এরূপ একটি উপাখ্যান উল্লেখিত আছে।
অনেকদিন আগের কথা, বঙ্গদেশে ধনপতি নামের সওদাগর ছিল। নামের সাথে তার কাজেও মিল ছিল। তিনি প্রকৃত পক্ষেই একজন ধনপতি ছিলেন। তার নিবাস ছিল খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রামনগরে। সেই ধনপতি একদিন সমবিহারে সিংহল যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখতে পান, সমুদ্রের ওপর ফুটে রয়েছে এক মোহনীয় পদ্মফুল। আর সেই পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন অপরূপ এক দেবী।
সওদাগর দেবীদর্শনের পর এ ঘটনা খুলে বলেন সিংহলের রাজা শালিবাহার আর তার মন্ত্রী গজাননের কাছে। বর্ণনা শুনে রাজা সওদাগরকে বললেন, “এ তো দেবী কমলকামিনী। আমরা তার পূজা করি। কিন্তু তার দর্শন আমরা কোনদিন পাইনি।” রাজা দেবী দর্শনের জন্য সমুদ্রে নাও ভাসালেন।
কিন্তু দেবী কমলকামিনীর দর্শন আর মেলে না। রাজা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সওদাগরকে বন্দী করে রাখলেন।
এদিকে সওদাগর সমুদ্রযাত্রায় বের হওয়ার আগে স্ত্রী খুল্লনার গর্ভে একটি পুত্রসন্তান রেখে যান। কিছুদিন পর সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় শ্রীমন্ত। বড় হয়ে শ্রীমন্ত তার মায়ের কাছে জানতে পারেন, তার বাবাকে সিংহল রাজা শালিবাহার অন্যায়ভাবে বন্দী করে রেখেছে।
শ্রীমন্ত তার বাবাকে মুক্ত করার জন্য সিংহলের দিকে রওনা দিলেন। যাত্রাপথে সে-ও পিতার ন্যায় পদ্মের ওপর দেবী কমলকামিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন।
সিংহল পৌঁছে শ্রীমন্তও পিতার ন্যায় রাজাকে এ ঘটনা খুলে বললেন। রাজা শ্রীমন্তকেও মিথ্যবাদী অপবাদ দিয়ে বাবার মতো বন্দী করে রাখলেন। এমনকি তাদের দু’জনকেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলেন।
এবার কার্যকর করার পালা। একদিন বলিকাঠে পিতা-পুত্রকে শোয়ানো হলো। জল্লাদ খড়গ দিয়ে মাথা ফেলে দেবে এখনই। এমন সময় অদৃশ্য দেবী কমলকামিনী দৃশ্যমান হলেন। তিনি বৃদ্ধার বেশে এসে রাজার কাছে পিতা ও পুত্রের জীবনভিক্ষা চাইলেন। সিংহল রাজা সহসা দেবীকে চিনতে পারলেন এবং নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। ফলে পিতা-পুত্রকে মুক্ত করে দিলেন।
শুধু তা-ই নয়, তিনি তার রূপসী কন্যাকে সওদাগরের ছেলের সাথে বিবাহ দিয়ে ধন-রত্ন ও মণি-মুক্তা বোঝাই করে বঙ্গদেশে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে হঠাৎ সমুদ্রে গর্জন শুরু হলো। সওদাগরের তরী ডুবে গেল।
এমন সময় দেবী কমলকামিনী পদ্মে ভেসে এসে তাদের উদ্ধার করে কুঙ্গা নদের মোহনায় পৌঁছে দিয়ে ফের অদৃশ্য হয়ে যান। এই কুঙ্গার তীরই হচ্ছে দুবলার চর। আর সেদিন ছিল রাস পূর্ণিমা তিথি। এরপর থেকেই কুঙ্গা নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দুবলার চরে মা কমলকামিনীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
মা কমলাকামিনী ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর চেহারার অধিকারী। এজন্যই সুন্দরী মেয়েদের বলা হয় ‘কমলাসুন্দরী’।
এখন বছরের এই একটি সময়ে, অর্থাৎ রাস মেলার সময় সহজে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায়। সরকারের কাছে নির্দিষ্ট হারে খাজনা প্রদান করে ট্রলার যোগে দুবলার চরে যাওয়া যায়। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এ চরের দিকে যাত্রা করা যায়। এই এক উপলক্ষে দুবলার চর উৎসবের লোকালয়ে পরিণত হলেও হাজার হাজার জেলের নিষ্ঠুর জীবনযাপনের জীবন্ত ডায়েরিও এ গহীন বনের দুবলার চর!