“বয়স তখন উনিশ। মন আবেগে পূর্ণ। ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়েছে। ছুটি কাটাতে বরিশালের পিরোজপুরে গিয়েছি। একগাদা Chemistry বই নিয়ে গেছি। আগামীকাল থেকে পড়তে শুরু করব, এই ভেবে সময় কাটাচ্ছি। বইয়ের পাতা খোলা হচ্ছে না। বিকেলে কেমন যেন অস্থির লাগে। আমি হাঁটতে বের হই। … প্রথমেই একটা কবরখানা পড়ে। গাছপালায় ঢাকা এমন সুন্দর একটা জায়গা। একদিন কবরখানার ভেতরে ঢুকলাম। অবাক কাণ্ড, কবরখানার ভেতর টলটলে পানির ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুরের পাশে শ্যাওলা ধরা এক কামরার মসজিদ।
আমার বৈকালিক ভ্রমণে পিরোজপুর কবরখানা একটি বিশেষ জায়গা দখল করে ফেলল। প্রায়ই সেখানে যাই, কবরের গায়ে লেখা নামগুলি পড়ি। … আমি একদিন এই কবরস্থান থেকে ফিরেই প্রথম উপন্যাস লেখায় হাত দিই। সন্ধ্যবেলা আয়োজন করে Chemistry’র বই বের করে পড়তে বসি। খাতায় লিখি- The term ‘macromolecule’ was first suggested by Staudinger.
এইটুকু লিখেই পরের লাইনে লিখলাম- বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম।
Macromolecule এর সাথে বাসের কোনো সম্পর্কই নেই। তারপরও কেন লিখলাম!
বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসার সামনে বিশাল পুকুর। পুকুর থেকে ঝুপঝুপ বৃষ্টির শব্দ আসছে। পিরোজপুর শহরে বৃষ্টি হওয়া মানেই কারেন্ট চলে যাওয়া। আমি সিরিয়াসলি পড়ছি ভেবেই আমার সামনে হারিকেন দেয়া হয়েছে। আমার মাথার ভেতর একের পর এক লাইন আসছে। একধরনের অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আমি লিখতে শুরু করেছি আমার প্রথম উপন্যাস- শঙ্খনীল কারাগার।
শঙ্খনীল কারাগার আমার প্রথম লেখা উপন্যাস, যদিও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে।”
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ লেখার ঘটনাটি হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই বর্ণনা করেছেন তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘বলপয়েন্ট’ এ।
১৯৭৩ সালে (বৈশাখ ১৩৮০ বঙ্গাব্দে) খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় ‘শঙ্খনীল কারাগার।’ এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর একান্ত কাছের দুজন মানুষ- আহমদ ছফা এবং আনিস সাবেতকে। প্রথম প্রকাশের ভূমিকায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন,
“সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোট গল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পরই নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘মনসুবিজন’ নামে তিনটি আলাদা গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি। নিজের উপরে বিশ্বাসের অভাবের জন্যেই লেখাগুলি দীর্ঘদিন আড়ালে পড়ে থাকে। যা-ই হোক, জনাব আহমদ ছফা ও বন্ধু রফিক কায়সারের আগ্রহে ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয় মাসছয়েক আগে। এবারে প্রকাশিত হলো ‘শঙ্খনীল কারাগার’।”
‘শঙ্খনীল কারাগার’ হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস হলেও এর প্রতিটি পাতায় দক্ষ জীবনশিল্পীর ছোঁয়া পাওয়া যায়। এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে লেখক অত্যন্ত মমতার সাথে সৃষ্টি করেছেন। উপন্যাসের গল্প বলাতেই লেখক হুমায়ূন আহমদের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। সরল ভঙ্গিতে গল্প না বলে তিনি কিছু রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছেন এবং সকল রহস্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন উপন্যাসের সমাপ্তিতে।
নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ এর মতো অপূর্ব কোমল উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে খুব কমই লেখা হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের এই অনন্য সৃষ্টিটি তাই তাঁর সকল পাঠকের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
উপন্যাসের কথক ‘খোকা’। সে একটি কলেজের শিক্ষক। তারা ছয় ভাইবোন- রাবেয়া, খোকা, রুনু, ঝুনু, মন্টু আর নীনু। সবার বড় বোন রাবেয়া। রাবেয়া খোকার মায়ের আগের পক্ষের মেয়ে। আবিদ হোসেন নামে এক ধনী ব্যক্তির সাথে খোকার মা শিরিন সুলতানার বিয়ে হয়েছিল। সেই পরিবারে জন্মায় রাবেয়া। আবিদ হোসেনের সাথে কোনো এক অজানা কারণে খোকার মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তখন তাদের বাড়ির চিলেকোঠায় আশ্রিত চাকরি সন্ধানরত বিএ পাস আজহার হোসেনকে বিয়ে করেন তিনি।
খোকাদের মা ছিলেন এমএ পাস এবং অভিজাত শ্রেণীর। তিনি ভালো গানও গাইতেন। আবিদ হোসেনের সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পর তাঁর প্রতি নিতান্ত দরিদ্র আজহার হোসেনের ভালবাসা টের পেয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের সব ঐশ্বর্য ছেড়ে রাবেয়াকে নিয়ে আজহার হোসেনের ভাড়া বাড়িতে এসে ওঠেন। বিবাহিত জীবনে স্বামীর সাথে খুব বেশি অন্তরঙ্গতা ছিল না তার। মনের সব দুঃখ-বেদনা লুকিয়ে চুপচাপ গম্ভীর হয়ে থাকতেন। গানের প্রতি ভালবাসা থাকলেও আর গান গাইতেন না। রাবেয়া ছাড়া আর কারও প্রতি তার ভালবাসা প্রকাশ পেত না।
আজহার হোসেনের সাথে শিরিন সুলতানার দীর্ঘ ২৩ বছরের সংসার জীবনে একে একে জন্মায় খোকা, রুনু, ঝুনু আর মন্টু। সবচেয়ে ছোট মেয়ে নীনুর জন্মের সময় মারা যান খোকার মা।মৃত্যুতে কোনো কিছুই থেমে থাকে না। জীবন চলতে থাকে। এই চলার গল্প নিয়েই মূলত ‘শঙ্খনীল কারাগার।’ ভারিক্কি কোনো বর্ণনা এ উপন্যাসে নেই, বরং সংলাপের পর সংলাপ জুড়ে গল্পটাকে সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে নিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।
গায়ের রঙ কালো হওয়ায় রাবেয়ার আর বিয়ে হয় না। অথচ মেয়েটির গভীর ভালবাসায় পুরো সংসারটা আপন গতিতে চলতে থাকে। বড় হতে থাকে তাদের সবচেয়ে ছোট বোনটি- নীনু।
ঝড়ঝাপ্টা যে আসে না এমন নয়। খোকার ছোট বোন রুনুর সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল পাশের বাড়ির ছেলে মনসুরের। সামান্য একটা চিঠির কারণে বিয়েটা ভেঙে যায়। মনসুরের সাথে বিয়ে হয় অন্য বোন ঝুনুর। একপর্যায়ে দুঃখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায় রুনু।
এ উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে খুব আপন মনে হয়, আমাদের নিজেদের ছায়া এই চরিত্রগুলোতে আমরা খুঁজে পাই।
রুনুর মৃত্যুর পর তাঁর ছোট্ট ট্রাঙ্কটা খুলে একটা ডায়েরি পাওয়া যায়। তার কিছু অংশ-
“১৭-১-৭১
আজ রাবেয়া আপা আমাকে বকেছে। মিটসেফ খোলা রেখেছিলাম আর বিড়ালে দুধ খেয়ে গিয়েছে। প্রথম খুব খারাপ লাগছিলো। আপা সেটি বুঝতে পারল বিকেলে আমাকে ডেকে এমন সব গল্প বলতে লাগলো যে হেসে বাঁচি না। … আপাটা কী হাসাতেই পারে।৫-৬-৭১
মন্টুটা তলে তলে এতো। আমাকে বলেছে তিন তিনটা ডি. সি-তে সিনেমা দেখাবে। যদি না দেখায় তাহলে সব ফাঁস করে দেব। তখন বুঝবে। মন্টুর একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাটি সে শুধু আমাকেই দেখিয়েছে। খুব অশ্লীল কি না তাই কাউকে দেখাতে সাহস হয়নি।৯-৭-৭১
নীনুটার কাণ্ড দেখে শুনে অবাক হয়েছি। সেদিন স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী ফিরেছে। আমি বললাম,
কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
জানো না তুমি, আজ ছেলেরা এক প্রফেসরকে মেরে ফেলেছে। আপা মনি বলেছে ক্লাসে।
তাতে তোর কী হয়েছে?
দাদাকে যদি মেরে ফেলে, সে-ও তো প্রফেসর।
শুনে আমি আর হেসে বাঁচি না। ওর যত টান দাদার জন্য।”
এমন টুকরো টুকরো গল্প তো আমাদের সবার।
খোকার ছোট ভাই মন্টু লেখাপড়ায় অমনোযোগী হলেও সে একজন কবি। তার চমৎকার সব কবিতা ছাপা হতে থাকে পত্রিকায়। অন্যদিকে ছোটখালার মেয়ে কিটকিকে ভালোবাসতো খোকা। কিটকিও হয়তো একসময় তাকে ভালোবাসতো। কিন্তু কিটকি খোকাকে বিয়ে না করে ফরেন সার্ভিসে চাকরিরত এক ডিস্ট্রিক্ট জজের ছেলেকে বিয়ে করে।
এভাবেই দিন চলে যেতে থাকে তাদের। কাছের মানুষগুলো ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। রাবেয়া ময়মনসিংহ শহরের একটি হাই স্কুলের গার্লস হোস্টেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হয়ে পরিবার থেকে কিছুটা দূরে চলে যায়। সেখান থেকে খোকাকে সে একটি চিঠি লেখে। মাধুর্যে ভরা সেই চিঠিটি এ উপন্যাসের অন্যতম অনুষঙ্গ।
“খোকা, তোদের সঙ্গে যখন থাকতাম তখন একধরনের শান্তি পেয়েছি, এখন অন্য ধরনের। এখানে মনে হচ্ছে জীবনের সমস্ত কামনা বাসনা কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। আর বেশি কিছু চাইবার নেই। কাল রাতে ছাদে বসে ছিলাম একা একা। কেন যেন মনে হলো একটু কাঁদি নির্জনে। মার কথা ভেবে, রুনুর কথা ভেবে দু’এক ফোঁটা চোখের জল ফেলি। কিন্তু একটুও কান্না আসলো না! কেন কাঁদবো বল? প্রচুর দুঃখ আছে আমার। এত প্রচুর যে কোনোদিন কেউ তা জানতেও পারবে না। কিন্তু তবুও আমি খোকার মতো ভাই পেয়েছি, কিটকির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে যে ভাই আমাকেই সান্ত্বনা দিতে আসে। রুনু, ঝুনু, মন্টু, নীনু- এরা আমার পারুল বোন চম্পা ভাই। চারদিকে এমন চাঁদের হাটে কি কোনো দুঃখ থাকে?”
এদিকে খোকা ক্রমেই পুরোনো দিনের প্রাচুর্যের স্মৃতি অন্তরে জমিয়ে রেখে নিঃসঙ্গতার বেদনায় ডুবতে থাকে, সেই নিঃসঙ্গতা পাঠকদেরও আঁকড়ে ধরে,
“মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। একঘেয়ে কান্না সুরের মতো সে শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জাম গাছের পাতায় সর সর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা হা করে ওঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কী বিপুল বিষণ্নতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশে অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি।”
এখানেই সমাপ্তি এ উপন্যাসের। ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ একটা অপূর্ব ছন্দময়তা লক্ষ্য করা যায়। একবার পড়া শুরু করলেই এর গল্প শেষ অব্দি পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো, ছোট ছোট ভাল লাগাগুলো এত চমৎকারভাবে এসেছে এখানে যে, ‘খোকা’ চরিত্রটির সাথে মুহূর্তেই পাঠকের একাত্মতাবোধ হয়।
বারবার মনে হয়, এ তো আমার গল্প, এ তো আমাদের গল্প! বাবা, রাবেয়া, রুনু, ঝুনু, মন্টু, নীনুসহ সবাইকে খুব আপন মনে হয়। মনে হয় যেন বহুদিনের চেনা। এর কিছু অংশ পড়তে গিয়ে আবেগে মনের অজান্তেই চোখের কোণা ভিজে ওঠে, আবার কিছু অংশ পড়তে গিয়ে আপন মনেই হা হা করে হেসে উঠতে হয়। মধ্যবিত্তের আবেগ এবং অনুভূতির সূক্ষ্ম বয়ান সংলাপে সংলাপে অপূর্বভাবে ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে।
‘শঙ্খনীল কারাগার’ অবলম্বনে ১৯৯২ সালে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মুস্তাফিজুর রহমান। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, চম্পা প্রমুখ। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে ১৯৯২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
কবিতার যে কোমলতা এবং ছন্দময়তা তা মাঝে মাঝে গদ্যেও পাওয়া যায়। ‘শঙ্খনীল কারাগারে’র ভাষা কবিতার মতই কোমল এবং ছন্দময়। মধ্যবিত্তের আবেগমাখা এমন কোমল গল্প মনে হয় শুধুমাত্র হুমায়ূন আহমেদের দ্বারাই লেখা সম্ভব।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-