Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়: আকাশজয়ের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার কারিগর

আমরা মানব সভ্যতার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এমন এক পর্যায়ে অবস্থান করছি যে, আমরা ভেবে দেখার অবকাশও পাচ্ছি না আমরা ঠিক কী কী প্রযুক্তি অবলীলায় ব্যবহার করে যাচ্ছি। আজকাল মানুষ সময় বাঁচানোর জন্য যেসব প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয়, সেসবের তালিকা অনেক লম্বা। এর মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিমানযাত্রা মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে সময় বাঁচিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপায়। প্রযুক্তির বিকাশে দিন দিন আকাশপথে ভ্রমণ করার যে খরচ, তার সাথে সড়ক বা নদীপথে যাত্রার খরচের পার্থক্য অনেক কমে আসছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সড়কপথে যাতায়াত করার চেয়ে বিমানে ভ্রমণ করা অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী।

এই ব্যাপারটিতে আমরা দিন দিন এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠছি যে, আমরা প্রায় ভুলেই গেছি একসময় মানুষ অসহায়ের মতো পাখিদের উড়ে বেড়ানো দেখতো; কাল্পনিক ডানায় ভর করে আকাশে উড়ে বেড়ানোর সময় নিচের পৃথিবীটাকে কেমন দেখা যেতে পারে, সেই দিবাস্বপ্নে বিভোর হতো।

খুব বেশি নয়, মাত্র একশো বিশ বছর পূর্বেও আকাশে ওড়ার স্বপ্নটা মানুষের কাছে অধরা ছিল। যুগে যুগে অনেক মহাপ্রাণ কিংবদন্তীতুল্য ব্যক্তি মানুষকে আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন কিংবা নিজেরাই হুট করে উড়াল দিয়েছেন আকাশে। কিন্তু তাদের সেসব সাফল্য ছিল ক্ষণস্থায়ী, যা মানুষের স্বপ্নকে আরো খানিকটা নাড়া দিয়ে গেছে বড়জোর, কিন্তু বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি। যারা সেই স্বপ্নকে অবশেষে সফলভাবে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, তারা ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জন্ম নেওয়া দুই সহোদর, যাদেরকে সারা দুনিয়া ‘রাইট ব্রাদার্স’ হিসেবে চেনে। তাদের আকাশ জয়ের গল্পটাই বলবো আজ।

শৈশবকাল

উইলবার ও অরভিল এর বাবা মিল্টন রাইট ছিলেন ইউনাইটেড ব্রেদরেন চার্চের একজন পাদ্রী এবং তাদের মা সুসান ক্যাথেরিন ছিলেন গৃহিনী। তারা মোট সাত ভাইবোন ছিলেন। উইলবার রাইট এবং অরভিল রাইট ছিলেন তাদের বাবা-মায়ের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ সন্তান। উইলবার ১৮৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার মিলভিলে এবং অরভিল ১৮৭১ সালে ওহাইয়োর ডেটনে জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু তারা পাশাপাশি দুই ভাই ছিলেন, পরস্পরের কাঁধে কাঁধ রেখেই বড় হয়ে উঠেছেন বলা চলে। ছেলেবেলা থেকে দুজন ছিলেন পরস্পরের খেলার সাথী।

শৈশবে অরভিল রাইট (বামে) ও উইলবার রাইট, ১৮৭৮ সাল; Image source: The History Center via The Gazette

জীবনের বেশিরভাগ সময় একসাথে কাটালেও দুই ভাইয়ের চালচলন ও বৈশিষ্ট্যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। বড় ভাই উইলবার ছিলেন খানিকটা গম্ভীর ও ভাবুক স্বভাবের। অপরদিকে অরভিল ছিলেন বেশ প্রাণবন্ত ও কর্মচঞ্চল। দুই ভাই মিলে যা যা করেছেন, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিকল্পনা, ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা ও দিকনির্দেশনার দায়িত্বে থাকতেন উইলবার আর অরভিল সেসব পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। বিশেষ করে নিত্যনতুন ধারণা আর যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে অরভিলের ছিল দুর্দান্ত আগ্রহ।

দুই ভাইয়ের কেউই তাদের ছাত্রজীবনকে কলেজ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি। তবে উইলবারের পড়াশোনায় বেশ আগ্রহ ছিল। কিন্তু হাই স্কুলে থাকাকালে হকি খেলতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় উইলবার দারুণভাবে আহত হন। এ ঘটনায় তার শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে এটিই একমাত্র কারণ ছিল না, প্রায় একই সময়ে তার মা-ও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। উইলবার রাইটের উচ্চশিক্ষা অর্জন করার বেশ আগ্রহ ছিল। এমনকি তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন বলেও মন স্থির করে ফেলেছিলেন! কিন্তু জীবনের প্রতিকূলতা তার সে স্বপ্ন পূরণ হতে দিলো না। তবুও মায়ের সেবা-শুশ্রুষাকালীন সময়ে উইলবার তাদের ঘরোয়া লাইব্রেরিতে থাকা বইগুলো পড়ে সময় কাটিয়েছিলেন, নিজে নিজেই জেনেছিলেন এবং শিখেছিলেন অনেক কিছুই।

ওদিকে বড়ভাইয়ের মতো অরভিলের পড়াশোনায় ততটা আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না। বরং বিভিন্ন প্রকার যন্ত্রপাতির প্রতি জন্ম থেকেই তার এক অদম্য ঝোঁক ছিল এবং তিনি বাস্তবজীবন থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগ্রহণে অধিক আগ্রহী ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সে অরভিলকে ঘুড়ি বানানোর নেশা পেয়ে বসে এবং মাত্র ষোল বছর বয়সেই তিনি এক প্রিন্টিং শপে কাজ করা শুরু করেন

তবে দুই ভাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজে নিজে কোনোকিছু শিখে নেওয়ার উপর সর্বদা বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। এবং এই প্রক্রিয়াটা তাদের জীবনে অনেক সাফল্য বয়ে এনেছিল।

পেশাজীবন

উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট- দুই ভাইয়ের মধ্যকার বন্ধন আজীবন এতই দৃঢ় ছিল যে তাদের যেকোনো একজন সম্পর্কে আলাদা করে কথা বলতে গেলে আলোচনার একপর্যায়ে আপনাআপনিই অপরজনও চলে আসেন। বস্তুত, এ দুই ভাইয়ের কাজকে আলাদা করা যায় না; জীবনভর তারা যা করে গেছেন, জুটি হিসেবেই করে গেছেন এবং কোনো কাজের কৃতিত্ব কেউ একা নেওয়ার চেষ্টা করেননি।

উদ্যোক্তা হিসেবে দুই ভাইয়ের প্রথম কাজ ছিল ‘ওয়েস্ট সাইড নিউজ’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করা। কোনো প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই উইলবার ছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক আর অরভিল সে পত্রিকার একাধারে মুদ্রক ও প্রকাশক। উল্লেখ্য, পূর্বে অরভিলের প্রিন্টিং শপে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। তার সুবাদে তিনি নিজেই তাদের পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রিন্টিং প্রেসের নকশা ও যন্ত্রপাতি তৈরি করে ফেলেছিলেন! তাদের এই পত্রিকার ব্যবসা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। নিজ উদ্যোগে পত্রিকা প্রকাশ করার ব্যাপারটি রাইটদের যতটা না শখের বশে ছিল, তার চেয়ে বেশি তাদের উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় বহন করে। জীবনের এই অধ্যায়টি থেকে তারা ব্যবসা সম্পর্কেও অনেক প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে যুক্তরাষ্ট্রে বাইসাইকেল বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উইলবার ও অরভিল দুই ভাই-ই ছিলেন সাইকেল চালনায় বিশেষ পারদর্শী, তার উপর সাইকেলের গঠন ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। পত্রিকার ব্যবসা যখন মিটমাট হয়ে গেলো, তখন তাদের মাথায় চিন্তা আসলো যে, তারা তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সাইকেলের ব্যবসা শুরু করতে পারে। যেহেতু তারা উদ্যোগী মানুষ ছিলেন, তাই সে চিন্তাকে বাস্তবেই রূপ দিয়ে ফেললেন।

রাইট ভাইদের তৈরি ‘সেন্ট ক্লেয়ার’ মডেলের বাইসাইকেল, এটি জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য সংরক্ষণ করে রাখা আছে; Image source: Smithsonian National Air and Space Museum

প্রথমদিকে তারা সাইকেল ভাড়া দিতেন এবং সাইকেল ও সাইকেলের খুচরা যন্ত্রপাতি বিক্রি করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ব্যবসা আরো বিস্তৃত হয়; তারা তাদের নিজস্ব নকশায় সাইকেল বানানো শুরু করেন এবং সেগুলো বিক্রি করেন। ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারেও তারা সাইকেলের নকশা করতেন এবং সাইকেল বানিয়ে দিতেন। তাদের নকশা করা সাইকেলগুলোর মধ্যে ‘ভ্যান ক্ল্যাভ’, ‘রাইট স্পেশাল’ ও ‘সেইন্ট ক্লেয়ার’ উল্লেখযোগ্য। তাদের তৈরি সাইকেলগুলো সমসাময়িক অন্যান্য সাইকেলের তুলনায় বেশ যুগোপযোগী ছিল এবং সাইকেলের নকশায় দুই ভাই তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সাইকেল ব্যবসায় তারা ছিলেন পুরোদস্তুর সফল। পরবর্তীতে বিমানের নকশা করার জন্য যন্ত্রপাতি বিষয়ক যেসব মৌলিক জ্ঞানের দরকার ছিল, তার ভিত্তিটা তাদের মধ্যে রচিত হয়েছিল এই সাইকেল ব্যবসা করার সময়ই।

তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘দ্য রাইট সাইকেল কোম্পানি’ নামক শপটি আজও টিকে আছে ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের ডেটনে। তবে সেখানে এখন কোনো সাইকেল বিক্রি হয় না। এটি এখন কেবল একটি জাদুঘর, যা দুই ভাইয়ের স্মৃতিগুলোকে সাক্ষী করে দাঁড়িয়ে আছে।

সাইকেল ব্যবসা ছিল রাইট ভাইদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাদের সাইকেলের ব্যবসা প্রায় ২০ বছরের মতো টিকে ছিল, এবং এ থেকে তারা বেশ ভালো পরিমাণ সঞ্চয় গড়ে তুলেছিল। এ সঞ্চয়ই পরবর্তীতে তাদের আকাশ জয়ের নেশাকে বাস্তবে রূপ দিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

আকাশ জয়ের নেশা

উইলবার রাইটের বয়স যখন ১১ বছর, অরভিলের বয়স তখন ৭। বলা হয়ে থাকে, সে সময়টাতে তাদের বাবা তাদেরকে একটি খেলনা উপহার দেন। খেলনাটি ছিল পেনাউডের হেলিকপ্টার। খেলনাটিকে একটি রাবার ব্যান্ডের সাহায্যে টেনে ছেড়ে দেওয়া হলে এটির পাখা ঘুরতে ঘুরতে খানিকটা উঁচুতে উড়ে আবার ফিরে আসতো। এই খেলনাটি শিশু দুটির মনে যে আগ্রহ আর কৌতূহল জন্ম দিয়েছিল, তা-ই মানব সভ্যতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

‘দ্য রাইট সাইকেল কোম্পানি’ এখন জাদুঘর হিসেবে টিকে আছে; Image source: Dayton Vistas

মানুষের আকাশ জয়ের স্বপ্ন পূরণের প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলো ছিল ত্রুটিপূর্ণ, কেননা সেগুলোতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি বা করার সুযোগ ছিল না। সুষ্ঠু ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে আকাশে ওড়ার মতো কোনো যন্ত্র বানানোর চিন্তাভাবনা শুরু হয় মূলত উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। এক্ষেত্রে সবার আগে উল্লেখ করা যায় ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার জর্জ কেলির নাম। তিনিই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন আকাশে ওড়ার মতো কোনো যন্ত্র বানাতে গেলে প্রথমেই এরোডাইনামিক্স বা বায়ুগতিবিদ্যার উপর অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে এবং সেগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা করতে হবে; তথ্য-উপাত্ত ও সুষ্ঠু বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন না করে কোনো পরিকল্পনা ছাড়া শুধু শ্রম বিনিয়োগ করেই এক্ষেত্রে সাফল্য আনা যাবে না। তিনি নিজে বায়ুগতিবিদ্যার উপর অনেক কাজ করেন এবং আকাশে ওড়ার মতো একটি যন্ত্র বানাতে হলে এর নকশা কেমন হতে হবে, তা নিয়ে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করেন। বস্তুত, পরবর্তীতে যারা আকাশ জয়ের পথিকৃত হিসেবে কাজ করেছিলেন, স্যার জর্জ কেলির কাজ তাদের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় ছিল। তিনি ছিলেন এক নতুন যুগের সূচনাকারী।

স্যামুয়েল ল্যাংলি’র তৈরি এরোড্রোমের উড্ডয়ন, ১৮৯৬ সাল, যদিও তা পুরোপুরি সফল হয়নি © Smithsonian Institution

অপরদিকে, ভাগ্যক্রমে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের জীবদ্দশাতেই ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো। স্বয়ংক্রিয় মেশিনগানের আবিষ্কারক স্যার হিরাম ম্যাক্সিম ১৮৯৪ সালে ইঞ্জিনচালিত এক উড়োযান উড্ডয়ন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

সে দশকেই দুজন আকাশযাত্রার পথিকৃত, অক্ট্যাভ শ্যান্যুট ও অগাস্টাস হেরিং এর যৌথ প্রচেষ্টায় অনেকগুলো উন্নত নকশার গ্লাইডারের পরীক্ষা চালানো হয়।

১৮৯৬ সালে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের একজন সম্পাদক, স্যামুয়েল ল্যাংলি বাষ্পচালিত উড়োজাহাজ সফলভাবে উড্ডয়ন করাতে সমর্থ হন, যদিও তার প্রচেষ্টা যথেষ্ট ফলপ্রসু ছিল না; তার উড়োযানটি শেষপর্যন্ত পটোম্যাক নদীতে আছড়ে পড়ে।

সেই বছর আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেটি ছিল দুর্ঘটনা; মানবজাতির আকাশ জয়ের স্বপ্ন পূরণের ইতিহাসে অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা, বিখ্যাত জার্মান কিংবদন্তী অটো লিলিয়েনথেল তার একটি গ্লাইডারে চড়ে পরীক্ষা করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হন।

অটো লিলিয়েনথেল ও তার গ্লাইডার; Image source: World History Facts

এ দুর্ঘটনা রাইট ভাইদেরকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। তখন তারা তাদের সাইকেল ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। অনেক ছোটবেলা থেকেই তাদের আকাশে ওড়ার নেশা ছিল আর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রকারের কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সেগুলোর নকশা সম্পর্কে তাদের অনেক ভালো ধারণা জন্মে গিয়েছিল। তাদের অন্যতম আইকন অটো লিলিয়েনথেলের মৃত্যুর ঘটনা তাদের উপলব্ধিকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করলো। তারা অনুভব করলেন লিলিয়েনথেল আর তাদের জীবনের গন্তব্য যেন একই রাস্তায় গিয়ে মিলেছে।

মূলত এরপর থেকেই দুই ভাই আকাশকে জয় করার মিশনে নামলেন। মোটাদাগে বলতে গেলে এ ব্যাপারটাতে প্রাথমিক উদ্যোগ উইলবার রাইটই নিয়েছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন বরাবর একটি চিঠি লিখেন। চিঠিতে সে প্রতিষ্ঠানটির কাছে থাকা তখন পর্যন্ত আকাশযান ও বায়ুগতিবিদ্যা নিয়ে যত কাজ বা গবেষণার রেকর্ড আছে, সেগুলো পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অধীনে পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় জাদুঘর ও গবেষণাকেন্দ্র।

কাঙ্ক্ষিত নথিপত্র ও রেকর্ড হাতে পাওয়ার পর তারা শুরু করেন বিস্তর পড়াশোনা। তারা দেখতে পান সে সময় পর্যন্ত যত গবেষণা ও কাজ হয়েছে, তা ছিল অপ্রতুল। তাই তারা নিজস্ব গবেষণা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় তাদের স্বপ্নযাত্রা।

স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের উদ্দেশ্যে পাঠানো উইলবার রাইটের হাতে লিখা চিঠি; Image source: Smithsonian Institution Archives

স্যার জর্জ কেলির গবেষণার সাথে নিজেদের গবেষণা মিলিয়ে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, চলনসই একটি উড়োযান তৈরি করতে গিয়ে প্রধানত তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে-

  •  যানটির পাখার ওজন ও নকশা।
  •  উড়ন্ত অবস্থায় এর ভারসাম্য বজায় রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করা।
  •  শক্তি উৎস, অর্থাৎ যানটি চালনার জন্য শক্তি কোত্থেকে আসবে সে সমস্যা।

অনেক ভাবনাচিন্তা ও পরিকল্পনার পর তারা পরীক্ষামূলকভাবে একটি বিশাল ঘুড়ি তৈরি করলেন, যেটি বাতাসের শক্তি ব্যবহার করে উড়তে সক্ষম। এটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল পর্যবেক্ষণ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণা করা, যেন পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে আরো কার্যকর কোনো মডেল তৈরি করা যায়।

রাইটদের তৈরি প্রথম গ্লাইডার, ১৯০০; Image source: Library of Congress

একপর্যায়ে তারা অনুধাবন করলেন এখন পর্যন্ত যারা এ বিষয়ে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে শ্যান্যুট-হেরিং এর পরীক্ষাকৃত গ্লাইডারের নকশা অনেক উন্নতমানের ছিল। তারা তাদের যানটিকে (ঘুড়ি) নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শ্যান্যুট-হেরিং এর গ্লাইডারের নকশা খানিকটা অনুসরণ করলেন। আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজনের পর ঘুড়িটি আশানুরূপ কাজ করলো। এবার তারা আরো বড় কিছু তৈরিতে অনুপ্রাণিত হলেন; এবারের লক্ষ্য গ্লাইডার বানানো।

এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৯০০ সালে রাইট ভাইদের হাতে তৈরি হলো এক নতুন গ্লাইডার। ঘুড়ি আর গ্লাইডার বানানোর প্রক্রিয়ায় তফাৎ রয়েছে; গ্লাইডারটি এমনভাবে বানাতে হয়েছিল যেন এতে একজন মানুষ চড়তে পারে। অত্যন্ত যত্নে বানানো এ গ্লাইডারটির ভর ছিল ২৪ কিলোগ্রাম এবং এর দু’পাশের ডানা মিলে মোট প্রস্থ ছিল ১৭ ফুট। এটি ছিল কাঠ ও কাপড়ের তৈরি।

এই গ্লাইডারটি পরীক্ষা করার জন্য রাইট ভাইদের খুঁজে বের করতে হতো এমন একটি খোলামেলা বিস্তৃত ও নির্জন স্থান, যেখানে পর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহ আছে এবং যেখানকার মাটি নরম। উত্তর ক্যারোলাইনার কিটি হক নামক স্থানটি তাদের এ চাহিদা পূরণ করলো।

প্রথম গ্লাইডারটি বিধ্বস্ত হয় © Smithsonian Institution

কিটি হকে এই গ্লাইডারটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় তারা নতুন অনেক কিছু শিখলেন। এ মডেলটি সম্পূর্ণ তাদের আশানুরূপ কাজ না করলেও এই পরীক্ষণ থেকে তারা যেসব উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন, তা ছিল খুবই মূল্যবান। এই গ্লাইডারকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা ‘উইং-ওয়ার্পিং’ নামক একটি কৌশল পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন এবং এতে তারা সফল হয়েছিলেন। বছরজুড়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একপর্যায়ে গ্লাইডারটি বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, ফলে নতুন একটি গ্লাইডার বানানো দরকার হয়ে পড়লো। অবশ্য ইতোমধ্যে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত পরীক্ষণ শেষ করে ফেলেছিলেন এবং এমনিতেও নতুন নকশার আরেকটি গ্লাইডার বানানোর প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করছিলেন। অর্থাৎ তাদের এ কিটি হক যাত্রা সফলই বলা চলে। জায়গাটি তাদের বেশ পছন্দ হলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন পরবর্তীতে আবার এখানেই আসবেন তাদের নতুন কোনো উড়োযান পরীক্ষা করার জন্য।

রাইটদের হাতে আঁকা ‘উইং-ওয়ার্পিং’ বা ডানা মোচড়ানোর মাধ্যমে উড়োযান গতবিধি নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলের ধারণামূলক চিত্র © Smithsonian Institution

পরবর্তী বছর, ১৯০১ সালে, রাইট ভাইরা তৈরি করলেন নতুন আরেকটি গ্লাইডার। পূর্বের গ্লাইডারটি বাতাসে ভেসে থাকার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে পারছিল না। তাই এবারের গ্লাইডারটির ডানা আরো বড় করা হলো, যা লম্বায় ছিল ২২ ফুট। তবে এর ভরও বেড়ে দাঁড়ালো প্রায় ৪৫ কিলোগ্রামে। এতে ল্যান্ডিংয়ের জন্য চাকাও যুক্ত করা হয়েছিল যেন উড্ডয়নের পর একে মসৃণভাবে মাটিতে নামানো সম্ভবপর হয়। পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেলো ডানার দৈর্ঘের অনুপাতে এর ভর বেশি হয়ে গেছে, ফলে এটি পূর্বের গ্লাইডারটির চেয়ে আরো বাজে ফল দিলো। এছাড়াও এ গ্লাইডারটির নকশাতেও কিছু মারাত্মক ত্রুটি ছিল। ফলে এর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়লো।

এ পর্যায়ে এসে দুই ভাই খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লেন। এমনকি তারা এটাও ভাবতে শুরু করলেন যে, তাদের জীবদ্দশায় হয়তো মানুষ আকাশে উড়ার কার্যকর কোনো উপায় বের করতে পারবে না। কিন্তু তাদের কাজ থেমে থাকলো না; তারা আবারো তাত্ত্বিক পড়াশোনা শুরু করলেন এবং আবিষ্কার করলেন, অটো লিলিয়েনথেলসহ আরো কয়েকজনের দিয়ে যাওয়া যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে তারা গ্লাইডারের নকশা করেছিলেন, সেগুলোতে ভুল রয়েছে। সেই বছরের বাকি সময়টা তাদের নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে পুরোনো তথ্য-উপাত্তের ভুল সংশোধন ও গ্লাইডারের ত্রুটি দূর করাতেই চলে গেলো।

১৯০১ সালে তৈরিকৃত দ্বিতীয় গ্লাইডারটি © Smithsonian Institution

সে বছর তারা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন, তারা তাদের গাণিতিক হিসাব-নিকাশ থেকে বুঝতে পেরেছিলেন যে গ্লাইডার বা যেকোনো প্রকার উড়োযানের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ডানার নকশা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু বার বার বড় আকৃতির ডানা বানিয়ে সেসব নিয়ে বাস্তবিক পরীক্ষায় নামাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার এবং ব্যয়বহুলও বটে। তাই নানা ধরনের ডানার ছোট মডেল তৈরি করে সেগুলো ঘরে বসে পরীক্ষা করার জন্য ‘উইন্ড টানেল টেস্টিং’ নামক পরীক্ষণ শুরু করেন। সময়ের তুলনায় এটি ছিল একটি যুগান্তকারী কাজ। আজকের যুগে যত উড়োযান বা উচ্চগতির গাড়ি তৈরি করা হয়, সেগুলোর বিভিন্ন অংশকে একই রকমের পরীক্ষণ, অর্থাৎ ‘উইন্ড টানেল টেস্টিং’ এর মধ্য দিয়ে নেওয়া হয় তাদের পারফর্মেন্স পরীক্ষা করার জন্য। রাইটরা প্রায় ২০০ প্রকার পাখার নকশা পরীক্ষা করেছিলেন এভাবে।

‘উইন্ড টানেল টেস্টিং’ তাদের গবেষণার মোড় ঘুরিয়ে দিলো, তারা অনুধাবন করলেন যে, উড়োযানের একেকটি বিশেষ নকশার উপর বাতাসের গতিবিধি ও চাপ কীরকম প্রভাব ফেলবে, তা তারা আগের চেয়ে অনেক ভালো করে বুঝতে পারছেন। এই পরীক্ষণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বাস্তব ঘটনাগুলোর সাথে মিলিয়ে তারা দেখতে পেলেন এবার তাদের হিসাব-নিকাশগুলো অনেকাংশেই মিলে যাচ্ছে।

নিজেদের তৈরি দ্বিতীয় গ্লাইডারটিতে চেপে বাতাসে উড়ছেন উইলবার রাইট © Smithsonian Institution

তাদের হতাশা পুনরায় অনুপ্রেরণায় রূপ নিলো, রাইটরা বুঝতে পারলেন যে তারা এখন সত্যিকার অর্থেই কোনো উড্ডয়নক্ষম যন্ত্র বানাতে প্রস্তুত, যেটি মানুষকে নিয়ে উড়তে পারবে। কিন্তু এর আগে তারা ঝুঁকিগুলো নিয়ে আরো কাজ করতে চাইলেন এবং আরো কিছু শিখে নেওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলেন।

এবার তাদের লক্ষ্য একটি পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল গ্লাইডার বানানো যেটি হবে ত্রুটিমুক্ত ও তাদের আশানুরূপ কাজ দেখাতে সক্ষম হবে। ১৯০২ সালে তারা বানালেন তৃতীয় গ্লাইডার। ডানাসহ সেটির প্রশস্ততা ছিল ৩২ ফুট, ভর ছিল ৫৩ কিলোগ্রাম। ইতোমধ্যে তারা যেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সেগুলো কাজে লাগালেন এতে, তাদের শ্রম পুরোটা ঢেলে দিলেন এ গ্লাইডারের পেছনে, এমনকি অক্ট্যাভ শ্যান্যুট ও অগাস্টাস হেরিংকেও তারা তাদের কাজের সাথে যুক্ত করেছিলেন।

১৯০২ সালে রাইটদের তৈরি তৃতীয় গ্লাইডারের সফল পরীক্ষা শেষে অক্ট্যাভ শ্যান্যুট ও অগাস্টাস হেরিং এর সাথে রাইট ভাইরা © Smithsonian Institution

ফলাফল হলো চমকপ্রদ, এত শ্রম আর প্রচেষ্টা বৃথা যেতেই পারে না; গ্লাইডারটি জাদুর মতো কাজ করলো আর পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে দিলো। এমনকি তাদের তৈরি পূর্বোক্ত দুটি গ্লাইডারের চেয়ে এটি ছিল অনেক বেশি কার্যকরী ও উন্নতমানের। এই গ্লাইডারটিকে এক বছরের মধ্যে তারা প্রায় এক হাজারবারের মতো পরীক্ষা করেন এবং উড্ডয়ন, বায়ুগতিবিদ্যা ও উড়ন্ত অবস্থায় গ্লাইডার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারগুলোকে পুরোদস্তুর আয়ত্ত্বে নিয়ে আসেন। একটি সার্থক উড়োযান তৈরি করতে গিয়ে যে তিনটি মূল সমস্যায় পড়তে হয়, তার প্রথম দুটির সমাধান এ গ্লাইডারটির মাধ্যমে এসে পড়েছিল। এবার তৃতীয় সমস্যাটি সমাধান করার পালা। এটি সমাধান করতে পারলে ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচিত হবে। দুই ভাই তখনো জানতেন না যে, সে দিনটি খুব বেশি দূরে নয়।

 সত্যিকারের উড়োযান

রাইট ভাইদের সাফল্যের শেষ ধাপ এটি, কিন্তু এতদিন যাবত তারা যে পরিমাণ শ্রম বিনিয়োগ করেছেন আর গবেষণা করেছেন, এই শেষ ধাপে এসে প্রায় ততটুকুই বা তার চেয়েও বেশি কাজ করতে হবে- সেটা কাজে নেমেই তারা বুঝতে পারলেন। এবার তারা সত্যিকারের একটি উড়োযান বানাবেন, যেটির নকশা হবে নিখুঁত, যেটিকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, মধ্য আকাশে যেটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে না- এই পর্যন্ত ঠিক আছে, তারা এটুকু করে দেখিয়েছেন। কিন্তু যে চ্যালেঞ্জটি এখনো মোকাবেলা করা হয়নি, তা হলো উড়োযানের নিজস্ব শক্তির উৎসের ব্যবস্থা করা। এ যাবত যত উড়োযান বানানো হয়েছে তার প্রায় সবগুলোই ছিল বাতাসের চেয়ে হালকা, কিংবা বাতাসের শক্তির উপর নির্ভর করে চলেছে। কিন্তু তাদের উড়োযান বাতাসের চেয়ে হালকা আর ঢাউস আকৃতির হবে না এবং সেটি নিজস্ব কোনো শক্তির উৎস ব্যবহার করে চলবে।

এ সমস্যা সমাধান করার জন্য তারা একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন বানানোর পরিকল্পনা হাতে নিলেন, যেটি হবে ওজনে হালকা, তবে তাদের উড়োযানকে পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এমন একটি ইঞ্জিন তৈরি করতে গিয়ে তারা দেখলেন তাদের পূর্বে এরকম ইঞ্জিন নিয়ে বিস্তর গবেষণা কেউ করেনি। তাই তারা নিজেরাই প্রপেলার ও ইঞ্জিন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। এ পর্যায়ে তাদেরকে সাহায্য করলেন তাদেরই পুরোনো এক সহকর্মী চার্লি টেইলর, যিনি একসময় তাদের সাইকেল শপে কাজ করতেন।

প্রায় দুই মাস চেষ্টার পর একটি ইঞ্জিন তৈরি করা হলো যার ভর প্রায় ৭০ কিলোগ্রাম এবং ক্ষমতা ৮ অশ্বশক্তি (হর্সপাওয়ার) বা প্রায় ৬ কিলোওয়াট। তবে ইঞ্জিনটির সক্ষমতা প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করতে গিয়ে এটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এটি বাতিল করে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। পরবর্তীতে আরো দুই মাস নিরলস পরিশ্রম করে তারা তিনজন মিলে তৈরি করেন নতুন আরেকটি ইঞ্জিন। এটি ছিল পূর্বেরটির চেয়ে অধিক শক্তিশালী, ১২ অশ্বশক্তি ক্ষমতা বিশিষ্ট।

এদিকে ইঞ্জিনের পাশাপাশি মূল উড়োযানটির কাজও চলছিল, এটি দেখতে গ্লাইডারের মতোই ছিল, তবে এর নকশায় কিছুটা পরিবর্তন এনে একে আরো সুচারু করে তোলা হয়েছিল। উড়োযানটিতে যখন ইঞ্জিন যুক্ত করা হলো, তখন এটি প্রকৃতপক্ষে আর গ্লাইডার রইলো না, এটি যে উড্ডয়ন যন্ত্রে পরিণত হলো তাকে আমরা বর্তমান যুগে ‘বিমান’ নামে চিনি, যা তৈরি করা উইলবার রাইট ও অরভিল রাইটের আজন্ম স্বপ্ন ছিল। এর নাম দেওয়া হলো ‘ফ্লায়ার’ (Flyer)।

‘ফ্লায়ার’ এর ইঞ্জিন © Smithsonian Institution

৪০ ফুট ডানাযুক্ত সেই উড়োযান বা প্লেনটির ইঞ্জিনসহ ভর হলো প্রায় আড়াইশো কিলোগ্রাম, একজন আরোহীসহ সেই ভর প্রায় সাড়ে তিনশোতে গিয়ে ঠেকে। তবে প্লেনটির ইঞ্জিন এই ভরকে মাটি থেকে বাতাসে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ইঞ্জিনের সাথে ৮ ফুট ব্যাসের বড় আকৃতির দুটি প্রপেলার যুক্ত করা হয়। প্রপেলারের কাজ হচ্ছে প্রচন্ড বেগে ঘুরে প্লেনের সামনে থেকে বাতাসকে টেনে সবেগে পেছনের দিকে ধাবিত করার মাধ্যমে প্লেনটিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তি প্রদান করা। ব্যাপারটা সহজে বোঝার জন্য অন্য আরেকটি ঘটনার সাথে তুলনা করা যেতে পারে, আমরা যখন একটি শক্ত ও কোনোকিছুতে আটকানো রশিকে সজোরে নিজের দিকে (সামনে থেকে পেছনে) টানি, তখন আমরা পেছন থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। প্রপেলারের ব্যাপারটা পুরোপুরি সেরকম না হলেও এ ঘটনার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বেশ খানিকটা।

উড্ডয়ন

একটি সত্যিকারের উড়োযান বলতে যা বোঝায়, অন্তত রাইট ভাইরা যা বোঝতেন, তা তৈরি করার কাজ সমাপ্ত হয়েছে, এবার উড্ডয়নের পালা। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তাদের তৈরি ‘ফ্লায়ার’ নিয়ে তারা আবার রওনা হলেন কিটি হক সংলগ্ন ‘কিল ডেভিল হিল’ এর উদ্দেশ্যে; সেখানেই তারা তাদের নব্যনির্মিত এ যন্ত্রটি পরীক্ষা করবেন। সাথে নেওয়া হলো আরো পাঁচজন সহায়তাকারী।

কিল ডেভিল হিলের যে স্থানটিতে ফ্লায়ারকে ওড়ানোর কথা, সেখানকার মাটি ছিল নরম এবং ভূ-পৃষ্ঠ ছিল এবড়োথেবড়ো। উপযুক্ত রানওয়ে না থাকায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তারা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কাঠের তৈরি ট্র্যাক (রেলপথের মতো)। সে ট্র্যাককে জায়গামতো বসানোর পর ফ্লায়ারকে এর উপর স্থাপন করা হলো। ১৪ ডিসেম্বর ফ্লায়ারকে আকাশে ওড়ানোর জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেললেন দুই ভাই।

কিন্তু কে হবেন ফ্লায়ারের প্রথম যাত্রী? কে ইতিহাসের পাতায় প্রথম সফল উড্ডয়নকারী হিসেবে নাম লেখাবেন? এর উত্তর নির্ধারণ করা হলো একটি মুদ্রা টস করার মাধ্যমে, দেখা গেলো বড় ভাই উইলবার রাইটের ভাগ্য সুপ্রসন্ন। সেদিন, অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর তিনিই চড়ে বসলেন ফ্লায়ারে। কিন্তু, আসলে উইলবার রাইটের ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। আকাশে উড়ার আগেই তিনি ফ্লায়ারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। নিজে খুব একটা আহত না হলেও তাদের সাধের ফ্লায়ারের একটি ডানা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলো এতে।

একদিন সময় লাগলো সেই ডানাটি সারাতে। দুদিন পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর আবারো তারা কাজে লেগে পড়লেন ফ্লায়ারকে আকাশে ওড়ানোর জন্য। কিন্তু সেদিনও ভাগ্য বেঁকে বসলো, একদমই বাতাস ছিল না সেদিন। তাদেরও করার ছিল না কিছুই। অগত্যা আরেকটি দিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

১৭ ডিসেম্বর, বর্তমানে এটি আমাদের কাছে একটি স্মরণীয় দিন। তবে সেদিন সকাল পর্যন্ত রাইটরা জানতেন না তাদের ভাগ্যে কী আছে। খুব সকাল থেকেই দেখা গেলো আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা; শুধু ঠান্ডা নয়, প্রায় বরফঠান্ডা। সেই সাথে প্রবল বাতাস। এর আগের দিন বাতাসের অভাবে ফ্লায়ারের ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি, আর আজ অত্যাধিক বাতাসের জন্য তা করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই ভাই খানিকটা আশাহত আর বিরক্ত হলেও তীরে এসে তরী ডুবতে দিতে রাজি ছিলেন না। যদিও তাদের মাথায় একবার চিন্তা খেলে গিয়েছিল এবারের মতো আশা বাদ দিয়ে পরবর্তী বছর পুনরায় প্রস্তুত হয়ে আসার, যা শেষ মুহূর্তে বাদ দেন তারা; যে করেই হোক সেদিনই তাদের উড়োযানটা অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখতে রাইটরা বদ্ধপরিকর।

এর আগেরবার টসে জিতে উইলবার চড়েছিলেন ফ্লায়ারে, কিন্তু তার ভাগ্য অনুকূলে নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এবার অরভিলের ভাগ্য পরীক্ষার পালা। ১০:৩০ এ অরভিল উপুর হয়ে শুয়ে ফ্লায়ারের আরোহীর জন্য নির্ধারিত কাঠের পাটাতনের উপর চড়লেন।

উড্ডয়নের প্রক্রিয়া শুরু হলো। ফ্লায়ারের ইঞ্জিন চালু করা হলো, উড়োযানটির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য হোক বা ছোট ভাইকে ভরসা দেওয়ার জন্যই হোক, এর একপাশের ডানায় চেপে ধরে রইলেন উইলবার রাইট। ধীরে ধীরে ৬০ ফুট লম্বা কাঠের ট্র্যাকের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলতে শুরু করলো ফ্লায়ার, গতি ক্রমেই বেড়ে চলেছে, পাশে থেকে দৌঁড়াচ্ছেন উইলবার রাইট।

ঐতিহাসিকভাবে এ ছবিটি অশেষ মূল্যবান। এটি সেই মুহূর্তের ছবি ঠিক যখন ফ্লায়ার আকাশে উড়াল দিলো; Image source: Library of Congress

১০:৩৫ মিনিটে একসাথে তিনটি ঘটনা ঘটলো- অরভিল রাইট ট্র্যাকের সাথে ফ্লায়ারকে আটকে রাখা ক্যাবলটি ছেড়ে দিলেন, উইলবার রাইটও ডানা থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন আর সেই সাথে ফ্লায়ার মনুষ্যজাতির আকাশে ওড়ার স্বপ্নকে চিরদিনের জন্য পাকাপোক্ত করে কাঠের ট্র্যাকটিকে ছেড়ে শূন্যে উঠে গেলো! কোনোপ্রকার কাকতালীয় ব্যাপার ছাড়াই রচিত হলো ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অরভিল রাইট ফ্লায়ারকে নিয়ে প্রায় ১২ সেকেন্ড উড়েছিলেন, এ সময়ের মধ্যে তিনি ১২০ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করে সফলভাবে ল্যান্ডিংও করেছেন।

মানবজাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিজস্ব শক্তি ব্যবহার করে বাতাসের চেয়ে ভারী কোনো উড়োযান মানুষকে নিয়ে আকাশে উড়লো, মানুষ সেই যানকে নিজের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করলো এবং সফলভাবে ভূমিতে অবতরণও করলো। কী যুগান্তকারী অর্জন!

সেদিন আরো তিনবার আকাশে উড়ানো হয়েছিল ফ্লায়ারকে, সর্বশেষবার ওড়ালেন উইলবার রাইট, যিনি এই আকাশ জয়ের মিশনের প্রধান উদ্যোক্তা; যদিও দুই ভাইয়ের অবদানকে আলাদা করে দেখার কোনো উপায় তারা রাখেননি। সর্বশেষ উড্ডয়নে উইলবার রাইট প্রায় এক মিনিট উড়ে বেড়ান আর প্রায় ৮৫০ ফুট পথ পাড়ি দেন, যা তাদের অর্জনকে আরো শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করায় এবং সন্দেহাতীত করে তোলে। শেষবারের মতো উড্ডয়নের পর অবতরণ করার সময় ফ্লায়ার আবারো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে তা রাইট ভাইদের সাফল্যের হাসিকে মলিন করতে পারেনি।

মানুষের আকাশ জয়ের স্বপ্নকে স্থায়ীভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পর রাইটদেরকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাকি জীবন তারা আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাদের এ বিশাল আবিষ্কারকে ছড়িয়ে দিতে থাকলেন, ব্যবসায়িকভাবে অর্জন করলেন বিরাট সফলতা। তাদের হাত ধরে আসতে থাকে আরো উন্নত মডেলের সব বিমান।

উইলবার রাইট (বামে) ও অরভিল রাইট © Carillon Historical Park

উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট, দুই ভাই এতটাই কাজপাগল ছিলেন, তারা আজীবন অবিবাহিতই রয়ে গেছিলেন। উইলবার ১৯১২ সালে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। চিরদিনের সুখ-দুঃখ আর ব্যর্থতা-সফলতার সঙ্গী, প্রিয় ভাইকে ছাড়া আমৃত্যু একাই বিমান নিয়ে গবেষণা ও কাজ করে গেছেন অরভিল রাইট।

অরভিল মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৮ সালে ওহাইওর ডেটনে নিজের বাসায়, যে বাসাটিতে তিনি বড়ভাই উইলবারের মৃত্যুর পর থেকেই বসবাস করছিলেন। সে বাসাটি দুই ভাই মিলে বানানোর কথা থাকলেও উইলবার তার কথা রেখে যেতে পারেননি, অরভিলকে একাই গড়ে তুলতে হয়েছিল সেটি।

This article is in Bengali language. It is a short biography of the Wright brothers and a brief history of the invention of the airplane. Necessary sources of information have been hyperlinked inside the article.

More references:

1. The History of Airplanes and Flight - ThoughtCo.

2. Inventing a Flying Machine - Smithsonian National Air and Space Museum

3. Wright Brothers - History

4. Wright Brothers & First Flight - LiveScience

5. First Flight: How Wright Brothers Changed the World - National Geographic

Featured Image © Library of Congress Prints and Photographs Division, Washington, D.C. 20540 USA

Related Articles