ঠিক এই মূহুর্তে আপনার অন্য এক মহাবিশ্বের যমজ কি এই লেখাটি পড়ছেন? এমন এক ব্যক্তি যিনি আপনি নন কিন্তু আপনার মতোই পৃথিবী নামক নীলচে সমুদ্র ও সবুজ উর্বর ভূমির গ্রহে বাস করে? প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই মানুষটির জীবন আপনার সাথে মিলে যায়। কিন্তু আপনাদের দুইজনের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো অনেক ভিন্ন। হয়তো তিনি এতক্ষণে এই লেখাটি সম্পূর্ণ না পড়েই রেখে দিয়েছেন কিন্তু আপনি পুরোটা পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এরকম একটি ধারণা শুনতে খুব আজব এবং অকল্পনীয় মনে হলেও পপ কালচার ও কল্পকাহিনীর সৌজন্যে ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’ শব্দযুগল আমাদের খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে। কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এই ধারণাটিকে সমর্থন করে। তবে প্যারালাল ইউনিভার্স কোনো মৌলিক তত্ত্ব নয়, অনেকগুলো তত্ত্বের অনুসিদ্ধান্ত হিসেবে এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সবচেয়ে সহজ জ্যোতির্বিদ্যার মডেলটি ধারণা করে, ১০^(১০^২৮) মিটার দূরের একটি গ্যালাক্সিতে আপনার একজন যমজ (টুইন) রয়েছে। এই দূরত্বটি এতোই বিশাল যে এটি অনুমান করাও কঠিন। দূরত্বটি পরিমাপ করা হয়েছে সম্ভাব্যতার প্রাথমিক ধারণা থেকে যেখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে স্পেস বা স্থান আকারে অসীম। অসীম স্পেসে সবচেয়ে অকল্পনীয় ব্যাপারগুলোও ঘটার সম্ভাবনা থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অসীম স্পেসে অসীম সংখ্যক বাসযোগ্য গ্রহ থাকতে পারে। সে গ্রহগুলোতে অসীম সংখ্যক মানুষ থাকতে পারে যাদের মধ্যে অনেকেই দেখতে একই রকম। আপনার মতোই তারা একই রকম ঘটনা ও স্মৃতির মধ্যে বড় হতে পারে যারা জীবনে একইরকম প্রতিটি সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছে।
আপনার সাথে এরকম কোনো যমজের দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ সর্বোচ্চ যতদূর পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে বিগ ব্যাংয়ের পরের প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর ধরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছে। সবচেয়ে দূরের যে বস্তুটি আমরা দেখতে পাই তা প্রায় ৪*(১০^২৬) মিটার দূরে অবস্থিত। এই দূরত্বটি আমাদের দিগন্তের সীমানা দেখিয়ে দেয়। এই দূরত্বের ভেতরের পুরো স্থানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হাবল ভলিউম’। একইরকমভাবে, আপনার প্রতিটি যমজের মহাবিশ্ব এরকম একটি সীমানায় নির্ধারিত। এটাই প্যারালাল ইউনিভার্সের সবচেয়ে সোজাসাপটা উদাহরণ। প্রতিটি মহাবিশ্বই একটি মাল্টিভার্সের ছোট উপাদানমাত্র।
এই সংজ্ঞা দেওয়ার পরে অনেকে হয়তো মাল্টিভার্স ব্যাপারটিকে চিরতরে ‘মেটাফিজিক্সে’র কাতারে ফেলে দেবেন। কিন্তু ‘ফিজিক্স’ আর ‘মেটাফিজিক্সে’র মাঝের দেয়ালটা সংজ্ঞায়িত হয় একটা তত্ত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা যায় কিনা তার উপর; এটা কতটুকু অদ্ভুত তার উপর নয়। সময়ের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের সীমানা প্রসারিত হতে হতে তা অনেকগুলো বিমূর্ত ধারণাকে গ্রহণ করেছে যেমন: অদৃশ্য তড়িৎ চুম্বক বল, সময়ের আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টাম সুপারপজিশন, স্থানের বক্রতা, ব্ল্যাক হোল ইত্যাদি। বিগত কয়েক বছর ধরে মাল্টিভার্সের ধারণাটিও এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। রিলেটিভিটি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো মৌলিক তত্ত্বগুলোতে এটি বেশ প্রতিষ্ঠিত। একইসাথে ধারণাটি গবেষণামূলক বিজ্ঞানের দুইটি প্রধান শর্তই পূরণ করে: এটা অনুমান করতে পারে এবং তাকে মিথ্যা বর্ণনা করা যায়।
বিজ্ঞানীরা প্রধানত চার ধরনের ভিন্ন লেভেল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। তাই মূল প্রশ্নটি প্যারালাল ইউনিভার্স আসলেই সম্ভব কিনা তা নয় বরং এর প্রকৃতি কেমন সেটা।
লেভেল এক: মহাবিশ্বের বাইরে
আমরা যেসব বস্তু দেখতে পাই না তাদের উপস্থিতি স্বীকার করে নেই যদি ভিন্ন কোনো সুবিধাজনক অবস্থান বা সময়ে যাওয়ার পরে বস্তুটি দেখতে পাওয়া যায়। অনেকটা সমুদ্র দিগন্তের ওপার থেকে জাহাজ আসার মতো। হাবল সীমানার বাইরের বস্তুগুলোর জন্যেও একইরকম ভাবা যায়। প্রতি বছরই দৃষ্টিমান মহাবিশ্বের সীমানা এক আলোকবর্ষ করে বৃদ্ধি পায়। আলো এক বছরে ওই বাড়তি জায়গাটুকু পরিভ্রমণ করে আমাদের জন্যে তথ্য নিয়ে আসে। এভাবে যদি চলতে থাকে, আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার জন্যে দিগন্তের ওপারে এক অসীম পরিমাণ স্পেস অপেক্ষা করে আছে।
লেভেল এক মাল্টিভার্স অনেকটাই অনস্বীকার্য। স্থান অসীম হওয়া ছাড়া বোধগম্য হওয়ার মতো না। কারণ যদি কোথাও এর সীমানা শেষ হয়ে যায় খুবই প্রকটভাবে পরের প্রশ্নটি আসবে, ‘এই সীমানার ওপাশে কি রয়েছে?’ এখন পর্যন্ত অসীম মহাবিশ্বই সকল তথ্য এবং তত্ত্বকে সমর্থন করে। অবশ্য অন্য আরেকটি ভাবনা আসতে পারে, স্পেস অসীম হলেও পদার্থ একটি সীমিত আয়তনে সীমাবদ্ধ হয়ে আমাদের চারপাশে একটি দ্বীপ মহাবিশ্ব গড়ে তুলেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ত্রিমাত্রিক গ্যালাক্সির পর্যবেক্ষণ এবং ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’ পদার্থের প্রায় সমানভাবে বিন্যস্ত হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে। এরকম বিন্যাস অবিরত থাকলে দৃষ্টিগোচর মহাবিশ্বের বাইরেও গ্যালাক্সি, নক্ষত্র ও গ্রহ থাকার কথা।
এই ধারণা থেকে বলা যায় আপনার সবচেয়ে কাছের যমজ মানুষটি ১০^(১০^২৮) মিটার দূরে অবস্থিত। প্রায় ১০^(১০^৯২) মিটার দূরে একশো আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের একটি গোলক থাকার কথা যেটি ঠিক আমাদের পৃথিবীর চারপাশের একশো আলোকবর্ষের মতো। আর এই অনুমান ঠিক ধরলে প্রায় ১০^(১০^১১৮) মিটার দূরে ঠিক আমাদের হাবল ভলিউমের একটি যমজ রয়েছে। হাবল ভলিউমের তাপমাত্রা যদি ১০^৮ কেলভিনের বেশি না হয় তাহলে তার সবগুলো কোয়ান্টাম অবস্থা কেমন হবে তা গণনা করে এই সংখ্যাগুলো বের করা হয়েছে।
প্যারালাল ইউনিভার্স পরীক্ষার প্রধান চাবি হচ্ছে সবগুলো ইউনিভার্সের সমষ্টির একটি অনুমান করে তার উপর সম্ভাবনা যাচাই করা। এই হিসেবে সবচেয়ে সম্ভাব্য হিসেবে আমাদের মহাবিশ্বটি আউটপুটে আসার কথা। যদি না আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেই তত্ত্বে ভুল রয়েছে অথবা তত্ত্বটিই ভুল।
লেভেল দুই: ইনফ্লেশন পরবর্তী বাবল
লেভেল এক মাল্টিভার্সের একটি অসীম সেট কল্পনা করা যাক যেখানে স্পেসটাইমের বিভিন্ন মাত্রা থাকবে এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের সবগুলো ধ্রুব সংখ্যার মানও ভিন্ন ভিন্ন হবে। এই সবগুলো লেভেল এক মাল্টিভার্স মিলে তৈরি হয়েছে একটি লেভেল দুই মাল্টিভার্স। ‘Chaotic Eternal Inflation’ তত্ত্ব মাল্টিভার্স বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করে।
ইনফ্লেশন আসলে বিগ ব্যাংয়েরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। এখানে ‘Chaotic Eternal’ শব্দযুগল সবচেয়ে বড় স্কেলের ঘটনাবলিকে নির্দেশ করে। সম্পূর্ণ স্পেসই প্রসারিত হচ্ছে এবং অনন্তকাল ধরে তা-ই হতে থাকবে। এই প্রসারণের মাঝে স্পেসের কিছু অংশ প্রসারণ বন্ধ করে বাবলের রূপ নেয়। অনেকটা পাউরুটির মাঝের গ্যাস পকেটের মতো। প্রতিনিয়ত এরকম অসীম সংখ্যক বাবলের জন্ম হচ্ছে যেগুলোর প্রত্যেকটি লেভেল এক মাল্টিভার্স। সবগুলোই আবার অসীম আকারের যা পদার্থ দিয়ে পরিপূর্ণ। যে ফিল্ডগুলো এই ইনফ্লেশনের জন্যে দায়ী সেগুলোই এই পদার্থগুলো তৈরি করেছিল।
এই বাবলগুলোর একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব এতোই বেশি যে আলোর গতিতে চিরকাল চলতে থাকলেও সেখানে পৌঁছানো যাবেনা। তার কারণ হচ্ছে বাবলগুলোর মধ্যকার দূরত্ব প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং তার গতি আলোর চেয়েও বেশি। এই একই গতির কারণে আপনি কখনো লেভেল এক মাল্টিভার্সেও নিজের যমজকে দেখতে পাবেন না।
লেভেল দুই মাল্টিভার্স অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। এই বাবলগুলো শুধুমাত্র নিজেদের প্রাথমিক অবস্থায়ই ভিন্ন হয় না বরং প্রকৃতির সবচেয়ে ধ্রুব যে ব্যাপারগুলো আমরা জেনে এসেছি সে ব্যাপারগুলোতেও অনেক ভিন্নতা প্রদর্শন করে। বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে ধরা হয় স্পেসটাইমের মাত্রা, মৌলিক কণাগুলোর প্রকৃতি এবং বিভিন্ন ধ্রুব সংখ্যা যেমন আলোর গতি, প্লাংকের ধ্রুবক ইত্যাদি। লেভেল দুই মাল্টিভার্সে এই বিষয়গুলোকে মৌলিক ধরা হয় না। যেমন: অনেক পদার্থবিজ্ঞানী ভাবছেন যে আমাদের মহাবিশ্ব প্রথমে নয়মাত্রিক ছিল। কিন্তু এখন আমরা যা দেখি শুধুমাত্র সেই তিনটি মাত্রা সম্প্রসারণে অংশ নিয়েছিল। অন্য ছয়টি মাত্রা এখন দৃষ্টিগোচর হওয়ার মতো অবস্থায় নেই। এর কারণ হতে পারে তারা খুব মাইক্রোস্কোপিক লেভেলে রয়েছে অথবা নয় মাত্রার স্পেসে শুধুমাত্র ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠতলেই সকল পদার্থ সীমাবদ্ধ রয়েছে।
এভাবে সবগুলো মাত্রার মধ্যকার সাম্য ভেঙে গিয়েছিল। সাম্য ভেঙে যাওয়ার এই ঘটনাকে ‘সিমেট্রি ব্রেকিং’ বলা হয়। যে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন এই ইনফ্লেশন চালনা করেছে তা ভিন্ন ভিন্ন বাবলে ভিন্ন রকমের সিমেট্রি ব্রেকিং ঘটাতে পারে। কোনো বাবলে হয়তো চতুর্মাত্রা দেখা যাবে, কোনোটিতে হয়তো কোয়ার্কের তিনটি জেনারেশনের বদলে শুধু দুইটি জেনারেশনের দেখা মিলবে। আরেকটিতে হয়তো আলোর গতি এবং প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক আমাদের চেয়ে ভিন্ন হবে।
অন্য প্যারালাল ইউনিভার্সের সাথে আমরা যোগাযোগ না করতে পারলেও পরোক্ষভাবে তাদের উপস্থিতি অনুমান করা যায়। তাদের অস্তিত্ব আমাদের মহাবিশ্বের অনেকগুলো কাকতালীয় ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
একটি নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য ও তা কতটুকু শক্তি বিকিরণ করবে তা তার ভর দ্বারা নির্ধারিত হয়। আমাদের ঘরের কাছে সূর্য নামের যে নক্ষত্র রয়েছে তার ভর হচ্ছে ২*১০^৩০ কিলোগ্রাম। এরচেয়ে একটু কমবেশি হলেই পৃথিবীর তাপমাত্রা মঙ্গলের চেয়েও কম কিংবা বুধের চেয়েও বেশি হত। তখন এই গ্রহে কোনো প্রাণের বিস্তার সম্ভব হতো না।
পৃথিবীতে যেরকম প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে তার জন্যে সূর্যের ভর এতটা উপযুক্ত হলো কীভাবে? প্রাথমিক চিন্তায় মনে হবে সূর্যের ভরকে যেন বেছে বেছে এই নিখুঁত সংখ্যাটাই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রচণ্ড কাকতালীয় ঘটনাটিকে খুবই বিচক্ষণতার সাথে ব্যাখ্যা করা যায়। মহাবিশ্বে এতো বেশি পরিমাণ নক্ষত্র রয়েছে যে তারমধ্যে অনেকগুলোর ভরই সূর্যের মতো হওয়া সম্ভব। এটা খুবই সাধারণ সম্ভাবনার গণিত। এতোগুলো বিচিত্র ভরের নক্ষত্রের মাঝে সূর্যের পাশেই আমাদের জন্ম হয়েছে কারণ আমাদের প্রাণব্যবস্থার জন্যে এই ভরটি সবচেয়ে উপযুক্ত। অন্য কথায়, পৃথিবীতে প্রাণ বিকাশের জন্যে সূর্যের ভরকে উপযুক্ত করা হয়নি বরং এই ভর অনেকগুলো এলোমেলো সংখ্যার মধ্যে একটি।
একইভাবে আমাদের মহাবিশ্বেই সবচেয়ে উপযুক্তভাবে সিমেট্রি ব্রেকিং ঘটেছে যার কারণে গ্রহ-নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির জন্ম সম্ভব হয়েছে। যেমন: প্রোটন যদি আরো ০.২ শতাংশ ভারি হত তখন তারা নিউট্রনে পরিণত হত এবং পরমাণুর মধ্যকার সাম্যাবস্থা ভেঙে পড়ত। তড়িৎচুম্বক বল যদি আরো ৪ শতাংশ দূর্বল হত তাহলে কোনো হাইড্রোজেনের অস্তিত্ব থাকত না এবং তা থেকে অন্য মৌল তৈরি হতে পারত না। এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। মূল প্রশ্নটি হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব এতোটাই উপযুক্তভাবে ফাইন টিউনড কেন? এর উত্তর দিতে গেলে সূর্যের মতো করেই বলতে হবে ঘটনাটি কাকতালীয় নয়। ইনফ্লেশন পরবর্তী অসীম সংখ্যক বাবলের মতো আমাদের মহাবিশ্বও একটি যেখানে উপযুক্ত সংখ্যাগুলো মিলে যাওয়ায় গ্যালাক্সি জন্ম নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
লেভেল তিন: অসীম কোয়ান্টাম জগৎ
লেভেল এক ও লেভেল দুই যে প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলে সেগুলো এতোই দূরে যে তা জ্যোতির্বিদদের সীমানার বাইরে। কিন্তু এরপরের মাল্টিভার্স লেভেলটি ঠিক আমাদের চারপাশেই অবস্থিত। এটার উদ্ভব হয়েছে বেশ বিখ্যাতভাবেই বিতর্কিত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ‘Many Worlds Interpretetion’ থেকে। এই ধারণাটি দাবি করে এলোমেলো অনেকগুলো কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া মহাবিশ্বকে অনেকগুলো শাখায় বিভক্ত করে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদার্থবিজ্ঞানে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। এই মেকানিক্স নিউটনের মেকানিক্স থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রচণ্ড সাফল্য পাওয়ার পরেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স আসলে ঠিক কী বলতে চায় তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এই তত্ত্ব মহাবিশ্বকে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের রাশি যেমন অবস্থান, গতি ইত্যাদি দিয়ে ব্যাখ্যা করে না। এর গণনার মূল ভিত্তি হচ্ছে একটি গাণিতিক অবজেক্ট যার নাম ‘ওয়েভ ফাংশন’। শ্রোডিঙ্গারের বিখ্যাত সমীকরণ ব্যাখ্যা করে, মহাবিশ্বের অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যাকে গণিতজ্ঞরা ‘Unitary’ বা ‘ঐকিক’ বলে থাকেন। এর অর্থ হচ্ছে ওয়েভ ফাংশনটি একটি অসীম মাত্রিক স্পেসে ঘুরপাক খেতে থাকে যার নাম দেওয়া হয়েছে হিলবার্ট স্পেস। যদিও কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে প্রায়ই অনিশ্চিত বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে, ওয়েভ ফাংশন একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই পরিবর্তিত হয়। এখানে কোনো অনিশ্চয়তা নেই।
সবচেয়ে কঠিন অংশটি হচ্ছে এই ওয়েভ ফাংশনের সাথে আমরা যা ‘দেখি’ বা পর্যবেক্ষণ করি তা কীভাবে সংযুক্ত করা যায়। অনেকগুলো ওয়েভ ফাংশন অনির্দিষ্ট একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির দিকে নির্দেশ করে যেখানে সম্ভাব্য সবগুলো অবস্থাই একত্রে বিরাজ করে। উদাহরণ হিসেবে এমন একটি সুপারপজিশনের কথা বলা যায় যেখানে বাক্সের ভেতরে একটি বিড়াল একইসাথে জীবিত ও মৃত। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যাখ্যা করার সময়ে শ্রোডিঙ্গার বেশ বিখ্যাতভাবেই এরকম একটি বিড়ালের উদাহরণ দিয়েছিলেন। ১৯২০ এর দশকে বিজ্ঞানীরা এই অদ্ভুত ধারণাকে একটি স্বীকার্যের মাধ্যমে মেনে নিয়েছিলেন যে যখন কেউ পর্যবেক্ষণ করে তখন ওয়েভ ফাংশনের ‘পতন’ ঘটে এবং তা নির্দিষ্ট একটি ফলাফলে পর্যবসিত হয়। অর্থাৎ বাক্সের ভেতরে কেউ তাকালেই বিড়ালটি জীবিত নাকি মৃত তা নির্ধারিত হয়ে যায়। এর পূর্বে একইসাথে দুইটি অবস্থাই পাশাপাশি অবস্থান করে। এই স্বীকার্যটি ‘দেখা’ ব্যাপারটিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছিল কিন্তু একইসাথে তত্ত্বটির ‘Unitary’ বৈশিষ্ট্যটি মুছে দিয়েছে।
১৯৫৭ সালে প্রিন্সটনের একজন গ্র্যাজুয়েট হিউগ এভারেট ব্যাখ্যা করেন, দেখার মাধ্যমে ওয়েভ ফাংশনের ‘পতন’ স্বীকার্যটি অপ্রয়োজনীয়। তাতে বিশুদ্ধ কোয়ান্টাম তত্ত্ব কোনো বিরোধ দেখায় না। এই প্রস্তাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুমান করে যেখানে একটি রিয়েলিটি ধীরে ধীরে অনেকগুলো রিয়েলিটিতে বিভক্ত হয়। সবগুলো রিয়েলিটি প্রথম থেকেই সুপারপজিশনে থাকে এবং একেকজন পর্যবেক্ষক একেকটি অবস্থা অনুভব করেন। বিড়ালের উদাহরণ টানলে বলা যায়, বাক্সের ভেতরে উকি দেওয়া মাত্র একটি রিয়েলিটি দুইটি ভিন্ন জগতে ভাগ হয়ে গেছে। একটি জগতে বিড়ালটি জীবিত এবং অন্য জগতে বিড়ালটি মৃত। তবে আপনার জগতে বিড়ালটি মৃত কি জীবিত তা নির্ণয় করা পুরোপুরি সম্ভব নয়। শুধুমাত্র সম্ভাবনার হিসাব কষে অনুমান করা যেতে পারে। অনেকগুলো রিয়েলিটির এই সুপারপজিশনই লেভেল তিন মাল্টিভার্স।
হিউগ এভারেটের এই অনেকগুলো রিয়েলিটির ব্যাখ্যা পদার্থবিজ্ঞানের ভেতরের এবং বাইরের অনেককেই চার দশকেরও বেশি সময় ধরে হতবুদ্ধি করে রেখেছে। কিন্তু বিষয়টি বুঝা সহজ যখন কেউ কোনো পদার্থবিদ্যাগত তত্ত্ব দেখার দুইটি উপায়কে আলাদা করতে পারে যার বাইরের রুপটি হচ্ছে গাণিতিক সমীকরণগুলো দিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বটি ভাবা যা অনেকটা উপর থেকে পাখির নিরীক্ষা করার মতো। আর ভেতরের রুপটি হচ্ছে সমীকরণের ব্যাখ্যা করা দুনিয়াটি অনুভব করা যা অনেকটা নিচে থাকা পৃথিবীর একটি ব্যাঙের মতো।
পাখির চোখে লেভেল তিন মাল্টিভার্স অনেক সরল। একটিমাত্র ওয়েভ ফাংশন রয়েছে যা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তিত ওয়েভ ফাংশন দ্বারা বর্ণিত বিমূর্ত কোয়ান্টাম জগতটি অনেকগুলো প্যারালাল অবস্থা (বিড়ালের জীবিত বা মৃত অবস্থার মতো) ধারণ করে যা প্রতিনিয়ত বিভক্ত হচ্ছে আবার মিলেও যাচ্ছে। ব্যাঙ এই সবগুলো রিয়েলিটির শুধুমাত্র একটি ভগ্নাংশ অনুভব করতে পারছে। ‘Decoherence’ নামের একটি প্রক্রিয়া ব্যাঙকে নিজের এই প্যারালাল কপিগুলো দেখা থেকে বিরত রাখে।
যখন পর্যবেক্ষক একটি সিদ্ধান্ত নেয় তখন কোয়ান্টাম ইফেক্টের ফলে অনেকগুলো ফলাফলের একটি সুপারপজিশন তৈরি হয়। এরকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে পাখি অনেকগুলো রিয়েলিটি তৈরি হতে দেখে। যেমন: রিয়েলিটিগুলোর একটিতে আপনি এই লেখাটি পড়ছেন, অন্যটিতে লেখাটি পড়ছেন না। কিন্তু ব্যাঙের দৃষ্টিকোণে এরকম একেকটি রিয়েলিটির মানুষ নিজেদের যমজ সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখেনা। তার কাছে সিদ্ধান্তটি হচ্ছে একটি সম্ভাবনার প্রশ্ন। যেমন: আপনার এই লেখাটি পড়া চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু।
অদ্ভুত শোনালেও একইরকম পরিস্থিতি লেভেল এক মাল্টিভার্সেও সৃষ্টি হয়। আপনি এই লেখাটি এখনো পড়ছেন কিন্তু বহুদূরের এক গ্যালাক্সিতে আপনার কোনো এক যমজ প্রথম প্যারার পরেই লেখাটি রেখে দিয়েছেন। লেভেল এক ও তিনের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে এই যমজদের অবস্থান কোথায় সেটা। লেভেল একে তারা বহুদূরেরই অন্য কোনো এক ত্রিমাত্রিক স্পেসে থাকে। কিন্তু লেভেল থ্রিতে তারা অসীম মাত্রিক হিলবার্ট স্পেসের অন্য কোনো কোয়ান্টাম শাখায় বাস করে।
পদার্থবিজ্ঞান যদি এরকম ‘Unitary’ হয় তাহলে বিগ ব্যাঙের সময়কার কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন কিভাবে ঘটেছে সে ধারণাটি পরিবর্তন করতে হবে। এই ফ্লাকচুয়েশনের ফলে বিগ ব্যাঙের শুরুতে এলোমেলোভাবে একটি প্রাথমিক অবস্থা তৈরি হয়নি বরং সবগুলো প্রাথমিক অবস্থার একটি কোয়ান্টাম সুপারপজিশন তৈরি হয়েছে যেগুলো একইসাথে সহাবস্থান করেছিল। এরপরে ‘Decoherence’ এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন কোয়ান্টাম শাখায় একেকটি প্রাথমিক অবস্থা প্রবেশ করেছে।
লেভেল টু মাল্টিভার্সের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। সিমেট্রি ব্রেকিং প্রক্রিয়া একটি অনন্য ফলাফল তৈরি করেনি বরং সবগুলো ফলাফলের একটি সুপারপজিশন তৈরি করেছিল যেগুলো থেকে উদ্ভুত ইউনিভার্সগুলো পরবর্তীতে নিজেদের আলাদা কোয়ান্টাম শাখায় প্রবেশ করেছে। অন্যভাবে বলা যায়, লেভেল থ্রি মাল্টিভার্স আগের দুই লেভেলের তুলনায় নতুন কিছু যুক্ত করে না বরং ভিন্ন ভিন্ন কোয়ান্টাম শাখায় একইরকম অনেকগুলো ইউনিভার্সের কথা বলে।
লেভেল চার: অন্যান্য গাণিতিক কাঠামো
লেভেল এক, দুই ও তিন মাল্টিভার্সে প্রাথমিক বিভিন্ন অবস্থা ও পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন নিয়ম পরিবর্তন হলেও মূল নিয়মগুলো অপরিবর্তনীয়ই থাকে। কিন্তু আমরা সেখানে থামব কেন? এই মৌলিক নিয়মগুলোও পরিবর্তন করা যাক। কেমন হবে একটি মহাবিশ্ব যদি যেখানে সবকিছু নিউটনের পদার্থবিজ্ঞান দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোনো জায়গা নেই সেখানে! অথবা এমন একটি বিশ্ব যেখানে সময় নিরবচ্ছিন্ন না হয়ে কম্পিউটার গণিতের মতো বিচ্ছিন্ন। কেমন হবে সে জগৎ? লেভেল চার মাল্টিভার্সে এরকম সবগুলো রিয়েলিটি সম্ভব।
সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি প্যারাডাইম গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। এই বৈপরীত্য প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের সময় থেকে দেখা যায়। অ্যারিস্টটলের প্যারাডাইম বলে পদার্থবিদ্যাগত যে রিয়েলিটি তা হচ্ছে মৌলিক যেখানে গাণিতিক ভাষা তার একটি মূল্যায়ন মাত্র। অন্যদিকে প্লেটোর প্যারাডাইম বলে, গাণিতিক কাঠামোই সবচেয়ে সত্য রিয়েলিটি যেখানে পর্যবেক্ষকরা এটাকে অসম্পূর্ণরূপে অনুভব করে। সহজ ভাষায় বললে, দুইটি প্যারাডাইম ব্যাঙ ও পাখির মধ্যে কার দৃষ্টিকোণ সবচেয়ে মৌলিক তা নিয়ে তর্ক করে। অ্যারিস্টটলের প্যারাডাইম ব্যাঙের দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করে অন্যদিকে প্লেটোর প্যারাডাইম পাখির দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করে।
আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা প্লেটোকে সমর্থন করেন। এই মহাবিশ্বকে গণিত এতো নিখুঁতভাবে বর্ণনা করে যে তা গাণিতিক হওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত। সম্পূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানকেই একরকম গাণিতিক সমস্যা বলা যায়। একটি গাণিতিক কাঠামো আসলে স্পেসটাইমের বাইরে অবস্থান করা অপরিবর্তনীয় একটি অস্তিত্ব। যদি সম্পূর্ণ ইতিহাস একটি চলচ্চিত্র হত, এই গাণিতিক কাঠামোটিকে চলচ্চিত্রের একটি ফ্রেমে সংযুক্ত করা সম্ভব হত না, সম্পূর্ণ ভিডিও টেপটিই প্রয়োজন পড়ত। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বুঝা সহজ হবে।
একটি মহাবিশ্ব কল্পনা করা যাক যেখানে ত্রিমাত্রিক স্পেসে কতগুলো বিন্দুর মতো কণা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখির দৃষ্টিকোণ থেকে চতুর্মাত্রিক স্পেসটাইমে এই কণাগুলোকে দেখতে জটপাকানো স্প্যাঘেটির মতো মনে হবে। কারণ প্রত্যেকটা কণার প্রতিটি সময়ের সরণ একইসাথে দেখা যাচ্ছে। ব্যাঙের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি একটি কণার ধ্রুব বেগের সরণ দেখা যায় পাখির চোখে তা দেখা যাবে একটি সরল স্প্যাঘেটি দন্ডের মতো সরলরেখা। ব্যাঙ যদি কক্ষপথে ঘুরপাক খাওয়া একজোড়া কণা দেখতে পায়, পাখি দেখবে ডাবল হেলিক্স আকৃতির দুইটি স্প্যাঘেটি দন্ড। ব্যাঙের কাছে কণাটির গতি নিউটনের গতিসূত্র মেনে চলে। আর পাখির কাছে তা স্প্যাঘেটিগুলোর ভেতরের জ্যামিতি যা একটি গাণিতিক কাঠামো।
প্লেটোনিক প্যারাডাইম প্রশ্ন করে এই মহাবিশ্ব যেরকম অবস্থান করছে ঠিক সেরকমই হলো কেন। অ্যারিস্টটলের কাছে এটি একটি অর্থহীন প্রশ্ন। প্লেটোনিস্টের ভাবনায় আসে এটা কেন ভিন্ন হলোনা। যদি সম্পূর্ণ মহাবিশ্বটি গাণিতিক হয় তাহলে এতগুলো গাণিতিক কাঠামোর মধ্যে শুধুমাত্র একটিই কেন মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করে? এমআইটির পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স টেগমার্ক এই ভাবনাটি থেকেই প্রস্তাব করেছেন যে সবগুলো গাণিতিক কাঠামোই আসলে সহাবস্থান করে। আর এরকম একেকটি গাণিতিক কাঠামো তৈরি করে একেকটি প্যারালাল ইউনিভার্স। এই মাল্টিভার্স একই স্পেসে অবস্থান করেনা বরং স্পেস এবং টাইমের বাইরে অবস্থান করে। তাদের বেশিরভাগেরই সম্ভবত কোনো পর্যবেক্ষক নেই।