১.
কথাটি শচীন টেন্ডুলকার বলাতেই কোনো আপত্তির সুর ভেসে আসেনি। গ্যালারিভর্তি ওয়েংখেড়ে স্টেডিয়ামের সামনে তিনি যখন ঘোষণা দিলেন, ‘জীবনের সেরা জুটিটি তিনি গড়েছিলাম অঞ্জলি টেন্ডুলকারের সঙ্গে’, আপত্তি করবার সুযোগই তো ছিল না। ততদিনে যার সঙ্গে মিলে এক ছাদের কাটিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের ১৮ বসন্ত, তাকে নিয়ে তেমনটা তিনি বলতেই পারেন। টিম সাউদিও কি সেই একই পথেই হাঁটবেন? ‘জীবনের সেরা জুটিটি গড়েছিলাম ব্রিয়া ফ্যাহির সাথে’, তিনিও কি এমন কিছুই বলবেন? তা না বললেই ভালো, আপত্তি করবার জন্যে যে পরিসংখ্যানের অভাব হবে না।
যে পরিসংখ্যানের প্রতি পাতাই জানান দেবে, টিম সাউদি জীবনের সেরা জুটিটি গড়েছিলেন ট্রেন্ট বোল্টের সঙ্গে।
২.
শুরুতে যার কিছুটা পূর্বাভাস পাওয়া গেলেও যা মিথ্যে আশ্বাস বলেই মনে হচ্ছিল একটা সময়। ২০০৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন দুজনই, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সাত উইকেট পেয়েছিলেন বোল্ট, আর কোহলি, উইলিয়ামসনদের আবির্ভাবের আসরে সেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কার জিতেছিলেন টিম সাউদিই। দুজনে মিলে নিউজিল্যান্ডের বোলিংকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন অনেকদূর, এই ভাবনা যখন দোল দিচ্ছে নিউজিল্যান্ড সমর্থকদের মনে, দুজনের ক্যারিয়ার দুদিকে মোড় নিয়েছিল তখনই।
সাউদির জন্যে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের দরজা খুলে যায় সে বছরেরই মার্চে। প্রথম ইনিংসেই বল হাতে পাঁচ উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে ৪০ বলে ৭৭ রানের ইনিংস খেলে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই মঞ্চে তিনি থাকতেই এসেছেন। অবশ্য তখন লড়াই করছিলেন বোল্টও, পিঠের চোটের সঙ্গে। যে কারণে সাউদির চাইতে মাস সাতেকের ছোট হলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আবির্ভাব ঘটেছিল তার চেয়ে বছর চারেক পরে। সূচনাটাও সাউদির মতো অমন আলো ঝকমকে হয়নি। হোবার্টে অজিদের বিপক্ষে ৭ রানের স্মরণীয় এক জয়ে পেয়েছিলেন চার উইকেট।
সেই ম্যাচে অবশ্য একসাথে নতুন বল হাতে নেয়া হয়নি দুজনের, ক্রিস মার্টিনের সঙ্গে ইনিংসের উদ্বোধন করেছিলেন বোল্ট, সাউদি এসেছিলেন প্রথম বদলি বোলার হয়ে। দুজনে মিলে ইনিংস শুরু করবার সুযোগ পাননি পরের সাত ম্যাচেও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে সুযোগ প্রথমবার মিলেছিল ২০১২ সালের আগস্টে, ভারতের বিপক্ষে। খুব সম্ভবত, নিউজিল্যান্ডের বোলিং ইতিহাসের বাঁক বদলে গিয়েছিল ঐ এক সিদ্ধান্তেই।
প্রথম ইনিংসেই পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা সাউদি পরবর্তী পঞ্চ-শিকারের জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন ঐ ম্যাচ অব্দি। মাসছয়েক বাদে প্রথম ফাইফারের দেখা পেয়েছিলেন বোল্টও। যে ম্যাচে ইনিংসের উদ্বোধন করেছিলেন ওই সাউদির সাথেই।
৩.
সেই শুরু। সেই থেকে আজ অব্দি দুজনে একত্রে খেলেছেন ৫৫ টেস্ট। দুয়ে মিলে সেই টেস্টগুলোতে শিকার করেছেন ৪৪৭ উইকেট। কিছুটা দেরিতে শুরু করলেও বোলিং গড়, স্ট্রাইক রেট কিংবা পাঁচ উইকেট শিকার সবগুলো পরিসংখ্যানেই ট্রেন্ট বোল্ট এগিয়ে টিম সাউদির চেয়ে, যদিও খুবই সামান্য ব্যবধানে।
যে নতুন বলে বোলিং নিয়ে এত কথা, তাতে এই জুটির সাফল্য তো রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ঘরের মাঠে দুই প্রান্ত থেকে দুজনে মিলে ইনিংসের সূচনা করেছেন, এমন ম্যাচগুলোতে তারা এখন অব্দি উইকেট শিকার করেছেন ৪২৬টি। যা তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জেমস অ্যান্ডারসন-স্টুয়ার্ট ব্রড কিংবা টু ডব্লিঊ (ওয়াকার ইউনুস-ওয়াসিম আকরাম) জুটির সঙ্গে এক কাতারে। নতুন বল হাতে তুলেছেন, এমন বোলারদের মধ্যে টিম-ট্রেন্টের চেয়ে বেশি উইকেট তুলেছেন তো ওই দুই জুটিই।
পরিসংখ্যানের প্যারামিটারকে কেনলই নিউজিল্যান্ডের মাঝে রাখলে অবশ্য তারা দুজনই উঠে যাচ্ছেন শীর্ষস্থানে। যে তালিকায় তাদের পরে অবস্থান করছেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি-এউইন চ্যাটফিল্ড জুটি, ইনিংসের শুরুতে বল হাতে নিয়ে তারা দখলে নিয়েছিলেন ৩১০ উইকেট। (হ্যাডলির প্রসঙ্গ যখন এলোই, তখন ল্যান্স কেয়ার্ন্সের নাম না নেয়াটা অন্যায়ই হবে। হ্যাডলি তার সেরা জুটিটি তো গড়েছিলেন এই পেসারের সঙ্গেই। দুজনে একত্রে খেলেছিলেন ৪২ টেস্ট, তাতে উইকেট তুলেছিলেন ৩৩৭টি।)
কেবলই ঘরের মাঠ বিবেচনায় নিলে সাউদি-বোল্টের পেছনে পড়ে যাচ্ছেন ওয়াসিম-ওয়াকাররাও। ২৪.৩০ গড়ে দুজনে মিলে নিয়েছেন ২৫৬ উইকেট। উইকেটসংখ্যায় তাদের ওপরে অবস্থান করছেন কেবল অ্যান্ডারসন-ব্রড জুটি।
৪.
ঘরের মাঠে উইকেট তুলে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং লাইন-আপ গুড়িয়ে দেবার কাজটা দুজনে মিলে বেশ নিয়মিতই করছেন। উদাহরণ খুঁজতে খুব বেশি দূরে যাবারও দরকার নেই। সদ্য শেষ হওয়া ভারত-নিউজিল্যান্ড সিরিজের কথাই ধরা যাক। চোটের কারণে ট্রেন্ট বোল্ট ছিলেন না সীমিত ওভারের ম্যাচগুলোতে। সঙ্গী হারিয়েই কি না, টিম সাউদিও গিয়েছিলেন মিইয়ে। পাঁচ ম্যাচের টি-২০ সিরিজে উইকেট পেয়েছিলেন মোটে তিনটি, ইকোনমি রেট নয় পেরিয়েছিল তিন ম্যাচে, দুই ম্যাচে তো ছাড়িয়েছিল বারোর ঘর।
ওয়ানডে সিরিজেও ছিলেন একই রকম বিবর্ণ। সেডন পার্কের প্রথম ম্যাচে রান বিলিয়েছিলেন ৮৫, ওভারপ্রতি ছয়ের বেশি রান বিলিয়েছিলেন বে ওভালেও। সেখান থেকে পোশাকের রঙ বদলে সাদা হতেই টিম সাউদির ফর্ম ঘুরে গেল ১৮০°। বেসিন রিজার্ভে প্রথম টেস্টে ফিরেছিলেন ট্রেন্ট বোল্ট, ভারতের ২০ উইকেটের চৌদ্দটিই তুলেছিলেন দুজনে মিলে। দুজনের কেমিস্ট্রিটা বোঝাতে একটি পাদটীকা যোগ করে দিতেই হচ্ছে। আগের আট আন্তর্জাতিক ম্যাচে মোটে ৭ উইকেট পাওয়া সাউদি, বোল্ট ফিরতেই তুলেছিলেন ৯ উইকেট। ‘কাপল গোলস’ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কথা ঘুরে বেড়ায়, তা বোধহয় এমন কিছুকেই বোঝায়!
দুজনের এমন ম্যাচজয়ী বোলিংয়ের ঘটনা অবশ্য সেবারই প্রথম নয়। দুই ইনিংস মিলিয়ে প্রতিপক্ষের বিশ উইকেটের ১৪ কিংবা তার চাইতে বেশি উইকেট শিকার করেছেন, বোল্ট-সাউদি এমন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন পাঁঁচবার। এর মাঝে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে পনেরো উইকেট প্রাপ্তি যেমন আছে, একই কীর্তির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার মাটিতেও।
৫.
বোল্টের অভিষেকের পর থেকে নিউজিল্যান্ড এখন অব্দি টেস্ট খেলেছে ৭৫টি, যার ৫৪-টিতেই দলে ছিলেন বোল্ট-সাউদি দুজনই। এবং সেই ৫৪ টেস্টের ২৮টি ম্যাচেই জয়ী দলের নাম ছিল নিউজিল্যান্ড। বিপরীতে কেবল বোল্ট খেলেছেন কিংবা সাউদি খেলেছেন, এমন ম্যাচে জয়ের চেয়ে নিউজিল্যান্ড পরাজয়ের মুখই দেখেছে বেশি। যে ১৫ টেস্টে সাউদি-বোল্ট জুটি গড়েননি সেই টেস্টগুলোতে তিন জয়ের বিপরীতে নিউজিল্যান্ড হেরেছে ৯ ম্যাচে। নিউজিল্যান্ডের সাউদি-বোল্ট নির্ভরশীলতা প্রমাণ হয় অবশ্য অন্য আরেক পরিসংখ্যানে। তাদের দুজন খেলেননি, বোল্টের অভিষেকের পরে এমন ঘটনা ঘটেছে পাঁচ ম্যাচে এবং কোনো ম্যাচেই জয়ী দলের নাম নিউজিল্যান্ড নয়।
নিউজিল্যান্ডের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে দুজনের জুটির গুরুত্ব আরও ভালো করে বোঝাতে আশ্রয় নেয়া যেতে পারে ক্রিকইনফোর ইমপ্যাক্ট ভ্যালু প্যারামিটারের। বোল্ট-সাউদি জুটি বেঁধেছেন এমন ম্যাচগুলোতে নিউজিল্যান্ডের জয়-পরাজয়ের অনুপাত যেখানে ১.৮৭, তারা জুটি গড়েননি, এমন ম্যাচগুলোতে সেই একই অনুপাত মোটে ০.২৫। প্রাপ্ত সংখ্যা দুটিকে ভাগ করে নিউজিল্যান্ডের জয়ে তাদের প্রভাবের পরিমাণ দাঁড় করাচ্ছে ৭.৫-এ। জুটি গড়ে কমপক্ষে ৩০০ উইকেট নিয়েছেন, সব কাল মিলিয়েই এমন বোলিং জুটির ভেতরে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
১৪৩ বছরের সময়কালে ক্রিকেট কম বোলিং জুটি তো দেখেনি। চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে এমন জুটির সংখ্যাও তো নেহায়েতই কম নয়। সেই বডিলাইন সিরিজের হ্যারল্ড লারউড-বিল ভোস থেকে শুরু করে হালের অ্যান্ডারসন-ব্রড জুটি, চাইলে নাম নেয়া যাবে অনেকেরই। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে, বিদায় নিতে নিতে টু ‘টি’ জুটি নিজেদের রেখে যাবেন সেই চিরস্মরণীয়দের কাতারেই।
ব্যাটিং-বান্ধব আজকের ক্রিকেটের যুগে এই প্রাপ্তিও তো কম নয়!