এমন দৃশ্য এর আগে কেবল সিনেমার পর্দাতেই দেখেছিলাম, কিন্তু বাস্তব জীবনে কখনোই না।
সময়টা ছিল ২০০৫ সালের অক্টোবর। সদ্য ক্রিকেটকে বিদায় জানানো টাটেন্ডা টাইবু বসে ছিলেন রবার্ট মুগাবের জানু-পিএফ পার্টির তথ্য উপমন্ত্রী ব্রাইট মাতোঙ্গার অফিসে। হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্ত নেয়ায় এর আগেও টাইবুকে জিম্বাবুয়ের অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করে তার অবসর নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল। তাইবু জানতেন, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সংস্কার প্রয়োজন। তিনি দেখতে পেলেন, জিম্বাবুয়ের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি সেই বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। তাই তিনি ভেবেছিলেন, মাতোঙ্গার সাথে এই আলোচনাতে তার ব্যতিক্রম কিছু হবে না।
কিন্তু তার আশাভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। মাতোঙ্গা তার ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটি বাদামি খাম বের করে সেটি ছুঁড়ে দিলেন ডেস্কের ওপারে থাকা টাইবুর দিকে। একটু আগেই তাইবু তার দেয়া একটি ফার্মের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই টাইবু ধরেই নিয়েছিলেন, এই খামটি টাকাভর্তি, যা দিয়ে উপমন্ত্রী তার মুখ বন্ধ করতে চাইছেন।
টাইবু খামটি খুললেন। কিন্তু তাতে কোনো টাকা ছিল না। ছিল বেশ কয়েকটি ছবি, মৃত জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের ছবি।
এক অজানা আতংক টাইবুর শিরদাঁড়া দিয়ে প্রবাহিত হলো। একের পর এক ছবি দেখতে থাকলেন, সবগুলোই মৃত মানুষের বীভৎস ছবি। তিনি ভাবতে লাগলেন, ছবিগুলোর মাধ্যমে কী বোঝাতে চাইছে মাতোঙ্গা? এগুলো কি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যার ছবি? এর মাধ্যমে কি বোঝানো হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গরা খারাপ? কিন্তু মাতোঙ্গার স্ত্রী-ই তো একজন শ্বেতাঙ্গ। নাকি বোঝাতে চাচ্ছেন, তার কথা না মানলে এটাই টাইবুর পরিণতি হবে?
টাইবু সেখানে বসে এর অর্থ বের করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। যত দ্রুত পারলেন, সেই অফিস ত্যাগ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট সংস্কার করার উদ্দেশ্যে তাকে ডাকা হয়নি। বরং হুমকি দিয়ে তাকে থামিয়ে দিতেই এই আয়োজন।
সেদিনের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এভাবেই নিজের আত্মজীবনী ‘কিপার অফ ফেইথ’-এর শুরুতে বর্ণনা করেছেন সাবেক জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার টাটেন্ডা টাইবু। জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হবার পাশাপাশি তিনিই জেলাভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে জাতীয় দলে প্রবেশ করা প্রথম ক্রিকেটার। মাত্র ১৮ বছর বয়সে টেস্ট দলে জায়গা করে নিয়ে ১৯ বছর বয়সে সহ-অধিনায়ক এবং ২০ বছর বয়সে অধিনায়ক হয়ে সে সময়ে সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে নাম লেখিয়ে নেন ইতিহাসে। যে টাইবু স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশের হয়ে অন্তত ২০ বছর ক্রিকেট খেলার, কিংবা সেরাদের কাতারে নিজের নাম লেখিয়ে নেয়ার, সেই টাইবুকেই মাত্র ২২ বছর বয়সেই ছাড়তে হয়েছে অধিনায়কত্ব, ছাড়তে হয়েছে নিজ দেশ।
ক্রিকেটে তার শুরুটা যেভাবে
দাদির হাত ধরে ভাগ্যের আশায় টাটেন্ডা টাইবুর বাবা ১৯৬০ সালের দিকে মালাউই ছেড়ে ‘আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি’ হিসেবে খ্যাত তৎকালীন রোডেশিয়ায় আসেন। জিম্বাবুয়ের বেশিরভাগ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের মতো টাইবুর পরিবারের সাথে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক ছিল না, যদিও সাত ভাইবোনের সবাই বেশ ভাল অ্যাথলেট ছিলেন।তার ছোট দুই ভাই কুদজাই এবং তাপিওয়া ক্রিকেটের দিকে পা-ও বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু কেউই তেমন সফল হননি।
ফুটবলকে ক্রিকেটের চাইতে বেশি ভালবাসলেও ক্রিকেটে পা দেয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে তার বন্ধু স্টুয়ার্ট। টাইবু তখন চিপেমব্রে স্কুলের ফিফথ গ্রেডে ছিলেন। সকালের শারীরিক শিক্ষা এবং বিকেলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইউনিয়নের জেলাভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় কোচিং সেশনের মাধ্যমেই ক্রিকেটের সাথে তার পরিচয়। যদিও তার ইচ্ছা ছিল চিপেমব্রের পর ইগলসভেইল স্কুলে ভর্তি হওয়া। কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর এত বড় পরিবার নিয়ে মায়ের কষ্ট অনুধাবন করে তিনি তার সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন ক্রিকেটেই, যা তাকে চার্চিল স্কুলে স্কলারশিপ পেতে সাহায্য করে।
প্রথমে একজন অলরাউন্ড হিসেবেই তিনি তার ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন, যেখানে ডান হাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অফ স্পিন করতেন। কিন্তু একদিন তার দলের উইকেটরক্ষক মাঠে উপস্থিত না হওয়াতে তাকেই গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছনে দাঁড়াতে হয়। সে ম্যাচে যদিও তেমন চমক দেখাতে পারেননি, কিন্তু মাঠে উপস্থিত থাকা বিল ফ্লাওয়ার, অ্যান্ডি এবং গ্র্যান্টের বাবা তার বেশ প্রশংসা করেন।
তারপর ১৪ বছর বয়সে সেই উইকেটরক্ষক হিসেবেই জায়গা করে নিয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলে। পরের বছরেই জোন সিক্স ডেভেলপমেন্ট টিমের হয়ে নামিবিয়া সফরে যান, যেখানে একমাত্র তিনিই কিশোর ছিলেন। নিজের ব্যাটিং নৈপুণ্যে তিনি ১৬ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের জন্য মূল দলে খেলার সুযোগ পান। যদিও প্রস্তুতি হিসেবে আফ্রিকা সফরে অতটা মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে। যার মূল কারণ ছিল সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা। তাই কোচ বিশ্বকাপে তাকে তিন নাম্বারে ব্যাট করানোর সিদ্ধান্ত নেন। দু’টি অর্ধশতকের মাধ্যমে কোচের সেই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেন। নিউ জিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০০২ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও খেলার সুযোগ হয়েছিল তার। সেখানে ব্যাট হাতে ৫০ গড়ে মোট ২৫০ রান করার পাশাপাশি বল হাতে তুলে নেন ১২ উইকেট। এমনকি উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে লুফে নেন ৫টি ক্যাচ। অধিনায়ক টাইবু সেই বিশ্বকাপে অসাধারণ অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট নির্বাচিত হন।
তারপরের গল্পটা স্বপ্নের মতোই ছিল। ২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের জন্য টাইবুকে জাতীয় দলের হয়ে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচক কমিটি। বিষয়টা অবাক করে টাইবুকে, কারণ সে এর আগে কোনো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট পর্যন্ত খেলেননি। যদিও টাইবুকে বলা হয়েছিল, তাকে নেয়া হয়েছে কেবল অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়ায় ঢালাওভাবে প্রচার হয়েছিল সেই খবর। কারণ ডেভেলপম্যান্ট প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া প্রথম ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। অনেকেই তাকে দেখতে পাচ্ছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের উত্তরসূরি হিসেবে। ব্রায়ান লারা, কার্টলি অ্যামব্রোসের মতো ক্রিকেটারেরা তার প্রশংসা করেন। দর্শকরাও মাঠে হাততালির মাধ্যমে তাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তবে এই সফরে টাইবু সবচাইতে বড় পাওয়া হলো অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো একজন পরামর্শদাতা।
জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের অন্ধকার অধ্যায়ের শুরু
২০০০ সালের পর থেকেই খারাপ হতে থাকে জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক পরিবেশ। প্রেসিডেন্ট মুগাবের সংবিধানকে গণভোটে প্রত্যাখ্যান করে জনগণ। তারপর শুরু হয় শ্বেতাঙ্গদের জোরপূর্বক জমি অধিগ্রহণ। ২০০২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিতর্কিতভাবে জয়লাভ করেন মুগাবে। এর মাঝেই ভেঙ্গে পড়েছিল জিম্বাবুয়ের অর্থনীতি। মানবাধিকার হরণ এবং নানা সামাজিক ইস্যুতে চলছিল বিতর্ক। যার বিরাট প্রভাব এসে পড়ে ক্রিকেট অঙ্গনেও। জাতীয় দলে কৌটা ভিত্তিক নির্দিষ্ট সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার খেলানোর জন্য রাজনৈতিকভাবে চাপ দেয়া হচ্ছিল। এর মাঝেই জিম্বাবুয়ে প্রথমবারের মত দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কেনিয়ার সাথে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পায়। সে বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের প্রথম ম্যাচেই নামিবিয়ার বিপক্ষে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার এবং বোলার হেনরি ওলোঙ্গা কালো ব্যাজ পড়ে মাঠে নামেন। কালো ব্যাজের মাধ্যমে তারা ইঙ্গিত করছিলেন ‘গণতন্ত্রের মৃত্যু’।
এই ঘটনার ফল যে ভয়াবহ হবে, সেটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন দুজন। ওলোঙ্গাকে পরের ম্যাচেই দল থেকে বাদ দেয়া হয়। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের মতো সে সময়ের সেরা একজন ক্রিকেটারকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তাছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে মৃত্যুর হুমকি তো ছিলই। এই ঘটনার মাধ্যমেই জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট এক অন্ধকার অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
প্রায় একই ভাগ্য বরণ করতে হয় জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক হিথ স্ট্রিককে। বর্ণবাদের বিষাক্ত ছোবলে বিপর্যস্ত জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে দল নির্বাচনেও শুরু হয় বৈষম্য। হিথকে ক্রমাগতই আদেশ দেয়া হচ্ছিল, তিনি যেন দলের শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারদের বলেন, তাদের খেলা আশানুরূপ হচ্ছে না, কিংবা তারা জাতীয় দলে খেলার উপযুক্ত না। শেষে যখন তিনি ক্রিকেট বোর্ডের কাছে এই সমস্যার সমাধান চান, তাকে জাতীয় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপর দলের ১৩ জন ক্রিকেটার হিথ স্ট্রিকের বহিষ্কারসহ আরো আটটি ইস্যুতে আন্দোলন করে খেলা বয়কটের ঘোষণা দেয়।
এমন পরিস্থিতিতেই জিম্বাবুয়ের মাটিতে শ্রীলঙ্কা সিরিজের জন্য ১৪ সদস্যের একটি দল ঘোষণা করা হয়, যার মধ্যে মাত্র ছয়জন ক্রিকেটারের এর আগে জাতীয় দলে খেলার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে দলের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন ২০ বছর বয়সী টাটেন্ডা টাইবু। দেশের মাটিতে সেই সিরিজে শ্রীলঙ্কার কাছে টেস্ট এবং ওয়ানডে দুটোতেই হোয়াইটওয়াশের লজ্জায় ডুবতে হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আনকোরা নতুন এই দল নিয়ে টাইবুর যাত্রা মোটেই মসৃণ ছিল না।
কিন্তু এর চাইতেও বাজে কিছু অপেক্ষা করছিল টাইবুর জন্য। তার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার সেই সফরে জিম্বাবুয়ে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। আফ্রিকা বিশাল ব্যবধানে জিতে নেয় তিনটি ওয়ানডে এবং দুইটি টেস্ট। সেই সফরটিকে ২০০৬ সালে উইজডেন ‘জঘন্য’ এবং ‘যারা এটি দেখেছে তাদের জন্য লজ্জাকর’ বলে আখ্যায়িত করে। তাছাড়া ভেঙ্গে পড়া দলটি নিয়েও অধিনায়ক টাইবু কোনো সফলতাই পাননি। দশটি টেস্টের মধ্যে হারতে হয়েছে নয়টিতেই, আর ২৯টি একদিনের ম্যাচে হেরেছে ২৭টিতে।
টাইবুর আন্দোলন এবং নির্বাসন
২০০৫ সালের আগস্টে বোর্ড ক্রিকেটারদের সাথে নতুন চুক্তি আয়োজন করে, যেখানে বেতন কাঠামো ছিল আগের চাইতে অনেক কম। এরপরেই টাইবু এবং তার কয়েকজন টিম-মেট একটি সংবাদ সম্মেলনে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের এই হতশ্রী অবস্থা তুলে ধরেন। টাইবু চেয়েছিলেন, বোর্ড যাতে ক্রিকেটারদের দিকে নজর দেয়, তাদের বেতন বাড়ানো হয়। টাইবু দেখেছিলেন, প্রেসিডেন্ট মুগাবের লোকেরা- যারা বোর্ডের বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন, তারা বিভিন্ন খাতে দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। এমনকি আইসিসি থেকে পাওয়া অর্থ ক্রিকেটারদের হাতে না গিয়ে পুরোটাই যাচ্ছিল তাদের পকেটে। তাইবু চেয়েছিলেন সেসব দুর্নীতি যাতে বন্ধ হয়।
সরকার এবং বোর্ডের বিপক্ষে যাওয়ার পরিণাম কী হতে পারে, তা এতদিনে বুঝে ফেলেছিলেন ২২ বছর বয়সী টাইবু। তিনি দেখেছেন, কী হয়েছিল অ্যান্ডি-ওলোঙ্গা এবং হিথের সাথে। তিনি দেখেছেন কীভাবে সরকার নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে মানুষদের দমিয়ে রাখছে। কিন্তু টাইবু ভেবেছিলেন, তিনি জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে পরিবর্তন আনতে পারবেন। এতে সরকারের তো কোনো ক্ষতি নেই, বরং ক্রিকেটে উন্নতি করলে তাদের খ্যাতিই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু এরপরেই তার স্ত্রী লাভনেসকে টেলিফোনে বেশ কিছু পরিচিত লোক মৃত্যুর হুমকি দেয়। তার বাসার সামনেও অপরিচিত কিছু লোকদের ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, এবং বাইরে বের হলেই কয়েকটি গাড়ি তাদের অনুসরণ করতো। কিন্তু যখনই তার স্ত্রীকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়, তখনই টাইবু বুঝে গিয়েছিলেন, তাকে কী করতে হবে। তবে টাইবু ভেবেছিলেন, অ্যান্ডি বা ওলোঙ্গারা তাদের সতীর্থদের কাছ থেকে যে পরিমাণ সাহায্য পেয়েছিলেন, তিনিও তা পাবেন। কিন্তু কয়েকদিন পরেই তারা বোর্ডের সাথে নতুন চুক্তিতে যোগ দেয়, যা খুবই ব্যথিত করে তাকে। তিনি বলেছিলেন,
”আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি ক্রিকেটারদের জন্য সাঁতরে সাগর পাড়ি দিচ্ছিলাম, কিন্তু তারা আমার জন্য কাদাতে নামতে পারেনি।”
কিছুদিন আগেই তাইবু এবং লাভনেসের কোলে আসে তাদের প্রথম সন্তান টাইবু জুনিয়র। টাইবু বুঝতে পারলেন, এই মুহূর্তে তার পরিবারের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। তাই তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন। তিনি বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে ৮০% কারণ হলো জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা এবং বাকি ২০% ছিল নতুন চুক্তিটি পছন্দ না হওয়া। কিন্তু জাতীয় দলে মাত্র পাঁচ বছর কাটানো টাইবুর জন্য এটি স্বপ্নভঙ্গ ছাড়া আর কিছুই না।
“আমার এখনো মনে পড়ে প্রথমবারের মতো ২০০০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাওয়ার কথা। এরপর ইংল্যান্ডে ক্রিকেটার হিসেবে আমার প্রথম সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম, আমি ২০ বছর আমার দেশের জন্য খেলতে চাই। অথচ আজ আমার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, যা খুবই দুঃখের।”
কিন্তু অবসরেই তা থেমে থাকেনি। তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তিনি প্রথমেই আসেন বাংলাদেশে এবং বেশ কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। তারপর তিনি ইংল্যান্ড হয়ে নামিবিয়ায় যান। সেখানে কিছুদিন খেলার পর চলে যান আফ্রিকায় কেপ কোবরাসের হয়ে খেলতে।
দুই বছর পর স্পন্সরদের অনুরোধে অবসর ভেঙ্গে জিম্বাবুয়েতে ফিরে এসে জাতীয় দলে যোগ দেন টাইবু। যোগ দেয়ার আগে তিনি গ্যারি কারস্টেনের পরামর্শও নিয়েছিলেন।
২০০৫ সালে অবসর নেয়ার আগে টাইবু মোট ২৪ টি টেস্ট খেলেছিলেন। তার মধ্যে ২০০৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে ৮৫ এবং ১৫৩ রানের ইনিংসটি সেই টেস্ট ড্র করে তাকে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের সম্মান এনে দেয়। প্রথম ম্যাচেও ৯২ রানের একটি ইনিংস খেলেন তিনি। ২৪ ম্যাচে ১,২৭৩ রান করেন তিনি, সাথে ছিল ৪৮টি ক্যাচ এবং চারটি স্ট্যাম্পিং। ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ে যখন নির্বাসনের পর আবার টেস্টে ফিরে আসেন, তখন আরো চারটি ম্যাচ খেলেন তিনি। তিনটি অর্ধশতক তুলে নিয়ে মোট ১৮৪ রান করেন। অর্থাৎ গোটা টেস্ট ক্যারিয়ারে টাইবু ৩০.৩১ গড়ে ১,৫৪৬ রান করেন। প্রথম দর্শনে সেটা অতটা আহামরি না হলেও ধুঁকতে থাকা জিম্বাবুয়ের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে অবসরের আগে ৮৪টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সাত অর্ধশতক নিয়ে ১,৪১০ রান করেন। আর ক্যারিয়ারের মোট ১৫০টি ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করা দু’টি শতকের পাশাপাশি ২২টি অর্ধশতক নিয়ে ২৯.২৫ গড়ে মোট রান করেছিলেন ৩,৩৯৩।
২০১১ সালেই ২৯ বছর বয়সে ক্রিকেটকে চিরবিদায় জানান টাইবু। তার মূল ইচ্ছা ছিল, এবার ঈশ্বরের কাজেই বাকি জীবন ব্যয় করবেন। ছোটবেলায় তার বাবা মনে করতেন, তিনি একসময় অনেক বড় কিছু হবেন। বাবার কথা সত্য প্রমাণ করে ক্রিকেটে তিনি এসেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়। তার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল জিম্বাবুয়ের সোনালি সময়গুলোর। কাছে পেয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের সেরা কিছু ক্রিকেটারকে। কিন্তু এরপর বেশিরভাগ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের কালো অধ্যায়ে। মুখোমুখি হতে হয়েছে জিম্বাবুয়ের নোংরা এবং কলুষিত রাজনীতির। যে স্বপ্ন নিয়ে ক্রিকেট শুরু করেছিলেন, তার কিছুই পূরণ করতে পারেননি তিনি। তিনি এখনো আশা করছেন, জিম্বাবুয়ে আবার তাদের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। শুধু সেটাই তার আক্ষেপ দূর করতে পারবে।