আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা‘ একটি অমূল্য গ্রন্থ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে ভারতের যে অনন্য অবদান ছিল সেটা অনস্বীকার্য। ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেকব। ভারত সরকার একসময় এসে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন ত্বরান্বিত করার জন্য কলকাতায় অবস্থিত ইস্টার্ন কমান্ডকে গুরুদায়িত্ব অর্পন করে। সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা গ্রন্থটি লিখেছেন এই ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জে. জেকব। বইটিতে তিনি অনেক স্পর্শকাতর এবং হাড়ির ভেতরের খবর নিয়ে এসেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে যা অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রথিতযশা প্রকাশনী ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’ থেকে ১৯৯৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। ১৯৯৯ সালে আনিসুর রহমান বইটিকে সাবলীল বাংলা ভাষায় রুপান্তর করেন।
আমাদের আলোচ্য এই বইটি লেখক ১৭টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করলেও এর পরিশিষ্ট ও নির্ঘণ্ট অংশ অনেক সমৃদ্ধ। শুরুর দিকে লেখক তার পাঠককে সৈনিক হয়ে ওঠার গল্প বলে গেছেন। সেখানে আমরা তার সাথে সাথে বোম্বে থেকে বসরা পর্যন্ত গিয়ে মরুভূমির মাছির খবরও পেয়েছি। ২য় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ফেরত এসেছি। লেখক ঘটনাক্রমে কমব্যাট আর্মে না গিয়ে আর্টিলারিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তার জীবন আর্টিলারি কেন্দ্র করেই এগোতে থাকে। বাংলাদেশি পাঠক হিসেবে বইটির মুক্তিবাহিনী, মার্কিন ও চীনা ভূমিকা, লড়াই, যুদ্ধের পরিণতি ও অর্জিত শিক্ষা সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। কারণ ভারতীয় বাহিনীর একজন জেনারেলের বয়ানে যুদ্ধের এই ঘটনাবহুল সময়গুলো অবশ্যই অন্য মাত্রা যোগ করেছে।
অনেকেই বলে থাকেন, ঢাকার পৃথকীকরণে ভারত অনেক আগে থেকেই তৎপর ছিল। কিন্তু লেখকের এই বইয়ে দেখা যায়- বাংলাদেশকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ ছিলো। তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, বিএসএফকে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পালাবদলে ভারত কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করে।
সামরিক জীবনে লে. জে. জেকব খুবই পেশাদার একজন মানুষ ছিলেন। সরকার এবং দিল্লির হাই কমান্ড থেকে যখন এপ্রিলের মাঝামাঝি ইস্টার্ন কমান্ডকে বাংলাদেশ অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়, তখন তার বক্তব্য খুবই স্পষ্ট ছিল। ভারতীয় বাহিনী তখন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অবকাঠামোগতভাবে শক্তিশালী হওয়ার জন্য আরো সময় প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশে তখন বর্ষাকাল ছুঁই-ছুঁই করছে। তাই সময় চেয়ে তিনি দিল্লিতে বার্তা পাঠান। পরবর্তীতে তার কথামতোই নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে ইস্টার্ন কমান্ড মুভ করার মতো পর্যায়ে চলে যায়।
বইয়ে লেখক কাদের সিদ্দিকীর বর্ণনা দিয়েছেন, মুক্তিবাহিনীর সেনানায়ক ওসমানীরও বর্ণনা দিয়েছেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে বাঘা সিদ্দিকীর বেয়নেট চার্জকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়, পাকিস্তানিরা যদি মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতো, তাহলে মুক্তিবাহিনী জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করতো কি না তা নিয়ে তার ‘সম্ভবত’ কিছুটা সন্দেহ ছিল।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কর্নেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না। এ বিষয় নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এ ব্যাপারে জেনারেল জেকব বলেন,
দুর্ভাগ্যবশত কর্নেল ওসমানী এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তার জন্য পাঠানো হেলিকপ্টার পথিমধ্যে শত্রুর গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সময়মতো সেটা মেরামত করে তোলা সম্ভব হয়নি। তার অনুপস্থিতির ভুল ব্যাখ্যা করা হয় এবং পরবর্তীতে অনেক সমস্যার জন্ম দেয়।
আরো কিছু বিষয় তিনি তার গ্রন্থে খোলাসা করেছেন। বাংলাদেশের সব দালিলিক ইতিহাসে আত্মসমর্পণের সময় বিকাল ৪:৩১ লেখা রয়েছে। কিন্তু লেখক নিজে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে, আত্মসমর্পণের সময় ছিলো বিকাল ০৪:৫৫ মিনিট, তবে দলিলে লেখা সময়টি ছিলো পূর্ব-নির্ধারিত। আরেকটি মজার বিষয় হলো, আত্মসমর্পণের সময় জেনারেল নিয়াজির হস্তান্তর করা ৩৮ রিভলবারটি তার নিজের ছিল না!
বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত। তাই এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা আসবে না তা কল্পনাও করা যায় না। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বলেন,
আমি ঢাকায় গিয়ে মুজিবের সাথে দেখা করি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সদাশয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার সাথে আমি বেশ কয়েক ঘন্টা সময় অতিবাহিত করি এবং তার অনাড়ম্বর কাজকর্মে আমি চমৎকৃত হই।
বাংলাদেশে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার বিষয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। অনেক লেখক ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের সাথে মিশিয়ে ফেলেন। বলে থাকেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপেই ভারত তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা বইটি পড়লে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেকব সবসময়ই চেয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব ভারতীয় বাহিনী যেন তাদের দেশে ফিরে যায়। এক্ষেত্রে তার মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ ইতিবাচক।
লেখক নিজে এই অভিযানে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, এই স্বাধীনতা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অর্জন করেছেন জনশক্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার চমৎকার অভিজ্ঞতা। এবং তিনি বলেছেন, কেউ যদি তার কাজে দক্ষ এবং কৌশলী হয়, তাহলে পুঞ্জিভূত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারবে। যুদ্ধ পরবর্তীতে সিমলার বৈঠক নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেকব বইয়ে তার দ্বিমত প্রকাশ করেছেন৷ তিনি মনে করেন, যুদ্ধে ৯৩ হাজার বন্দী পেয়েও তারা সিমলায় এই যুদ্ধের অর্জিত সাফল্য এবং সুবিধাগুলো বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন। লেখকের এই মতের সাথে হয়তো অনেকেই একমত পোষণ করবেন না, তবু তার লেখনীতে সৈনিকসুলভ মনোভাব আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল।
সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা একটি সময়ের দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। বইটির সামরিক তথ্যগুলো আগামী দিনের সৈনিকদের পথ তৈরিতে কাজ করবে বলে পাঠক হিসেবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। লেখকের বর্ণনার মতোই অনুবাদ সহজ ও সরল ছিলো। একবারের জন্যও মনে হয়নি যে অনুবাদ বই পড়ছি। কোথাও কোনো বানান বিভ্রাট চোখে পড়েনি। লেখক বইটির শেষের দিকে একটি সমৃদ্ধ পরিশিষ্ট যোগ করেছেন। এই পরিশিষ্ট অনেক ক্ষেত্রে তার মূল বইয়ের অনেক বিষয়কেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন দলিলের পাশাপাশি তিনি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ এখানে যোগ করেছেন। বইটির শেষে ভারী মলাটের সাথে ভাজ করা একটি সেনাবিন্যাস ও আক্রমণরেখা বিষয়ক মানচিত্র দেয়া আছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে হলে এই বইটি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবে। ভারতীয় সেনার বয়ানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পাঠককে ভিন্ন স্বাদ উপহার দেবে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর স্ট্র্যাটেজিক লাইন ও ক্রমান্বয়ে ঢাকা আক্রমণ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে লেখককে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য নিয়ে যেসব পাঠকের আগ্রহ রয়েছে, তাদের জন্য নির্দ্বিধায় পড়ে নেয়ার মতোই একটি বই ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’।
অনলাইনে কিনুন- সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা