নিজের মানুষের ব্যাপারগুলো নিয়ে একটা মেয়ে সবসময় যতটা ভাবে, অচেনা কারো ব্যাপারে কিন্তু ততটা ভাবে না। -গল্প বৈদেশী।
এই বিশ্বে শত শত জাতি গোষ্ঠীর দর্শন, চিন্তাধারা, খামখেয়াল একজনের থেকে অন্যজনের আলাদা। এক দেশের ভাষা অন্য দেশের বুলিতে পরিণত হয়। এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের অপসংস্কৃতি হিসেবেও বিবেচিত হয়। এক দেশের ভালো লাগা অন্য দেশের মর্মান্তিকতার কারণ বলেও গণ্য হতে পারে।
বিশ্বের নানান খ্যাত, নাতি-খ্যাত সাহিত্যিকের তেরোটি অনবদ্য গল্পের অনুবাদ সংকলন গল্প বৈদেশী। ইংরেজী, হিস্পানি, চেক, আরবী, লাতভীয় ও রুশ ভাষার সাহিত্য থেকে নানা ধরনের গল্প এখানে সংকলিত হয়েছে। বাস্তবধর্মী, রম্য, শ্লেষাত্মক, অ্যাডভেঞ্চারমূলক, এমনকি সায়েন্স ফিকশন গোত্রীয় গল্পও আছে। রূপকথা, লোকগাথা ও ফ্যান্টাসিমূলক গল্পও স্থান পেয়েছে।
সর্বমোট তেরোটি অনুবাদ গল্প আছে এতে। গল্পগুলো যেহেতু বিভিন্ন জাতির, তাই প্রত্যেকটা গল্পেই লেখক বা লেখকের সংস্কৃতির একটা আলাদা নিজস্বতার ছাপ স্পষ্ট। কোনো কোনো গল্পে রূপকথা উঠে এসেছে, কোনো গল্পে আবার শ্রেণিবৈষম্যটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, আবার রাজনৈতিক বাস্তবতা আর মানুষের আত্ম-অহমিকার গল্পও পেয়েছি। প্রেমের বয়ানের পাশাপাশি চিরাচরিত নারী সত্ত্বার নিয়তি, ফ্যান্টাসি গল্প পড়ে কল্পনার জগত গিয়েছি, পরে আবার বাস্তবে ফিরে এসেছি শিক্ষামূলক গল্পের ছোঁয়ায়৷
খুব দক্ষ হাতে অনেকটা সময় নিয়ে এমন একটা সাহিত্যকর্মের অনুবাদ করতে হয়। জি এইচ হাবীব এই অনুবাদটিও সেইভাবেই করেছেন। বিশ্বের তেরোটি ভিন্নধর্মী সাহিত্য অনুবাদ করা মোটেই সহজ নয়। অনুবাদক শব্দের সুখপাঠ্যতা যাতে না হারায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য করেছেন।
লাতভিয়ার লেখক মারা সিয়েলেনার আপেলকিন আর বেরি গল্পটি এককথায় রূপকথার গল্প বলে চালিয়ে দেওয়া যায় নিঃসন্দেহে, মেক্সিকোর হুয়ান হোসে আররেওলার সত্যি কথাই বলছি আপনাদের গল্পটি শ্রেণি সম্প্রদায়ের আক্ষেপ মাখানো এক গল্প, কলম্বিয়ার এর্নান্দো তেইয়েসের স্রেফ সাবানের ফেনা, তাই গল্পটি যথেষ্ট রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং কঠিন বাস্তবতার মিশেলে তৈরি আতঙ্কগ্রস্ত এক আখ্যান, আর্জেন্টিনার মানুয়েল মুহিকা লাইনেসের গুরুত্ব গল্পটি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্ম-অহমিকাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, আর কিউবার বির্শেলিউ পিনিয়েরার মাংস গল্পটিতে এক অদ্ভুত কাল্পনিক ভবিতব্যের গল্প শুনি যেখানে বাস্তবতার কষাঘাতে মানুষ বিবর্তিত হয়ে প্রতীকী জন্তু-জানোয়ারে পরিণত হয়।
আফ্রিকার গল্পগুলোয় ফুটে উঠেছে একইসাথে নারীদের অপরিণত নিয়তির চিরচেনা রূপ, আবার ফ্যান্টাসির বর্ণনায় রাষ্ট্রের নির্মম স্বরূপ কিংবা নারী-পুরুষের প্রেম-ভালোবাসা অথবা স্বার্থসিদ্ধির অনবদ্য উপস্থাপন। গল্পগুলো হচ্ছে- মিশরের সাবরি মুসার উপচিকীর্ষা, সিরিয়ার জাকারয়া তামেরের মোহাম্মদ আল-মাহমুদীর বরাতে যা ঘটেছিল তার সারসংক্ষেপ, তিউনিসিয়ার ইব্রাহিম দারগোদির বেহেশিতী আপেল এবং নাইজেরিয়ার আমোস তুতুওলার লোভী কাছিম এবং ওরিসা-ওকো। অবশ্য এই আফ্রিকার গল্পগুলোর মাঝখানে মিলান কুন্দেরার হিচহাইকিং গেম গল্পটাও আছে- যে গল্পে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার মাধ্যমে মানব-সম্পর্কের বিচিত্র মনস্তত্বকে তুলে ধরা হয়েছে।
শার্লক হোমসের রচয়িতা আর্থার কোনান ডয়েলের ব্রাজিলের বেড়াল গল্পটি আদতে একটি রোমহর্ষক গল্পের ব্যাখ্যা দেয়, যেখানে গল্পকথক সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে। এরপরের রুশ গল্পটা আসলে কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে দেওয়া হলেও এর কৌতুকরস দারুণভাবে উপভোগ্য। এবং পরিশেষে, ইউরি গাগরিনের শীতের ওক গাছ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের নির্মল আর দরদী চিত্র ফুটিয়ে তুললে এর গভীরে চরম শিক্ষামূলক এক গল্পের প্রতিস্ফুটন ঘটেছে।
কোন দেশের গল্প আমাদের হাসায়, আবার কাঁদায়, আবার কখনো রূপকথার রাজ্য থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। পড়তে পড়তে মনে হয় ফিরে গেছি শৈশবে কিংবা কখনো মনে হয় চলে গেছি ভবিষ্যতের আগাম বছরগুলোতে। লেখকের দূরদৃষ্টিতে আমরা জীবনবোধ খুঁজি, আশার গল্প শুনতে চাই, হতাশাগুলোকে মুছে ফেলতে চাই, জীবনের চলার পথের সঠিক দিকনির্দেশনা চাই, আরো কত কি কি যে চাই সেসব হয়তো আমরা নিজেরাও জানি না কিন্তু তবুও আমরা চাই।
মানুষের ত্বকের মতো এত কোমল আর কিছু নেই। তাছাড়া, বেরিয়ে আসার জন্যে রক্ত সবসময় মুখিয়েই থাকে তার নিচে৷ -গল্প বৈদেশী।
সবগুলো গল্পই যে ভালো লাগবে এমনটা কিন্তু নয়। কিছু পড়ে কেবল স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে, কয়েকটা আবার বিরক্তিরও উদ্রেক ঘটাতে পারে আর কিছু ভালো লাগতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, বিশ্বসাহিত্যের অলিগলির গল্পগুলোর হালকা একটা পরশ পেতে এই সংকলনটি পড়তে পারেন।
বই : গল্প বৈদেশী || অনুবাদ : জি এইচ হাবীব
প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত || প্রকাশক : বাতিঘর প্রকাশনা সংস্থা
অনলাইন প্রাপ্তিস্থান : রকমারি.কম