ধরুন, আপনি দূরে কোথাও ভ্রমণে যাবেন। এই দীর্ঘ ভ্রমণের বিরক্তিকর সময়টা উপভোগ্য করার জন্য সাথে করে কিছু বই নিলেন, বাসের মধ্যে বসে পড়বেন বলে। কিন্তু যাত্রাপথে ইট-পাথুরে সড়কের ধুলাবালি, চিৎকার-চেঁচামেচি, গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের তীব্র শব্দ আর দূষিত কালো ধোঁয়া আপনার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিল। বই পড়া তো দূরে থাক, একটু পরপর গাড়ির শক্ত ব্রেকের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতেই বেগ পেতে হচ্ছে।
অথচ রেলের কথা ভাবুন, দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে ঝকঝক রব তুলে ছুটে চলেছে ট্রেন। ট্রেনের জানালা খুলে দিতেই প্রকৃতির স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া আপনার হৃদয়ে পরশ বুলিয়ে দিল, হাতে একখানা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বই আর এক হাতে চায়ের কাপ, যাত্রাপথে এর চেয়ে উপভোগ্য সময় আর হতে পারে না। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে জানালা দিয়ে চোখ বোলালেই সবুজের ওপারে আবছা গ্রামগুলো দেখা যায়। কখনও সবুজ ধানের মাঠ, কখনও সারি সারি খেজুর গাছ, কখনও আঁকাবাকা গ্রামীণ মেঠো পথ, কখনও সর্পিলাকার নদী, কখনও আবার বিলের বিস্তৃত জলরাশি; সবকিছুই উপভোগ করা যায় ট্রেনে চড়ে।
যাত্রীবান্ধব বাহন হিসেবে রেলের সুনাম সেদিন থেকেই, যেদিন থেকে পৃথিবীর বুকে রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছে। নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা, আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা, প্রকৃতির হাতছানি, ক্লান্তিহীন দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া, বিলাসী ভ্রমণ, কিংবা নিরাপদ যাত্রা; সবখানেই রেলের কর্তৃত্বটা সবথেকে বেশি। রেল হচ্ছে স্থলপথের সবচেয়ে নিরাপদ বাহন। স্থলপথে যোগাযোগের জন্য কিংবা ভ্রমণের জন্য রেলের চেয়ে পরিবেশবান্ধব এবং নিরাপদ বাহন আর দ্বিতীয়টি নেই। তাছাড়া রেল স্থলপথের অন্যান্য বাহনের চেয়ে তুলনামূলক গতিশীল হয়ে থাকে। খুব কম সময়ের মধ্যেই পৌঁছানো যায় দূর গন্তব্যে। তাই যুগ যুগ ধরে রেল ভ্রমণের আনন্দ এবং রেলের সুবিধা বিবেচনায় স্থলপথের বাহন হিসেবে এর গুরুত্ব ছিল সবথেকে বেশি।
রেল যখন আবিষ্কৃত হয়েছে, যখন স্থলপথের বাহন হিসেবে অটোমোবাইল ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়নি। তাই এ সময় স্থলপথে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে গরুর গাড়ি। ক্লান্তিকর এবং যন্ত্রণাদায়ক এই যাত্রাপথকে নির্বিঘ্ন করেছে রেলওয়ের আবিষ্কার। রেল চলার পথকে করেছে সহজ এবং আনন্দদায়ক। ট্রেনে চেপে বসে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দূরতম গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। এমনকি ট্রেনের মধ্যে বসে গেম খেলা, লেখালেখি, বই পড়া, চায়ের কাপে চুমুক কিংবা রহস্য নিয়ে গবেষণা, সবকিছুই করা সম্ভব। বাংলাদেশের রেলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের রেল আবিষ্কারের ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়া প্রয়োজন।
রেলগাড়ি সাধারণত সড়কপথের অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় কম ঘর্ষণজনিত বাধার সম্মুখীন হয়। যার কারণে রেলপথের যাত্রা হয় সড়কপথের তুলনায় মসৃণ। ঘর্ষণজনিত বাধা কম থাকার কারণে একাধিক বগি সংযুক্ত করার পরও একটি ট্রেন তার স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, আমরা প্রায়ই একটা জিনিস ভুল করে থাকি। আর তা হলো, আমরা যেটাকে রেলগাড়ি বলে থাকি, সেটা মূলত রেলগাড়ি নয় সেটা হল ট্রেন। অর্থাৎ, যখন একাধিক রেলগাড়ি একটার সাথে অন্যটা জুড়ে দেয়া হয়, তখন সেটাকে বলে ট্রেন। আর ট্রেনের প্রত্যেকটি কোচ এবং বগির সমন্বিত অংশকে বলে রেলগাড়ি। আবার সচরাচর আমরা যেটাকে বগি বলে থাকি, সেটা মূলত রেলওয়ে কোচ। বগি হল একটা রেলগাড়ির নিম্নাংশের মূল গঠন। আর এ গঠনের উপরের যে অংশে বসে আমরা ভ্রমণ করি, সেটা হলো কোচ।
বিশ্বের সর্বপ্রথম স্টিম রেল ইঞ্জিন তৈরি হয় ইংল্যান্ডে। জর্জ স্টিফেনসন এবং তার ছেলে রবার্ট স্টিফেনসনের এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টায় ১৮২৫ সালে আবিষ্কৃত হয় বিশ্বের প্রথম ট্রেন। সে বছরই ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ডার্লিংটন পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয় এবং ট্রেন চলতে শুরু করে। ২৭শে সেপ্টেম্বর জনসাধারণের জন্য রেলপথটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। চলতে শুরু করে বিশ্বের প্রথম আবিষ্কৃত বাষ্পচালিত ট্রেনটি। বিশ্বের প্রথম এই বাষ্প চালিত ইঞ্জিন গাড়ির নাম ছিল লোকোমোশন-১। এজন্য যুক্তরাজ্যের রেল ব্যবস্থাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন রেল ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়। আবার বিশ্বের প্রথম পাতালরেলও ১৮৬৩ সালে লন্ডনে নির্মিত হয়েছিল।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম ট্রেন চলতে শুরু করে ১৮২৭ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওতে রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে সেদেশের রেলের সূচনা ঘটে। এরপর জার্মানিতে ১৮৩৫ সালে, ইতালিতে ১৮৩৯ সালে, ফ্রান্সে ১৮৪৪ সালে, স্পেনে ১৮৪৮ সালে এবং সুইডেনে ১৮৫৭ সালে রেলওয়ে উদ্বোধন করা হয়।
১৮৮০ সালের পর ইউরোপ জুড়ে বিদ্যুৎচালিত রেলগাড়ির উদ্ভাবন ঘটে। ফলে দ্রুতগামী জনপরিবহন ব্যবস্থা ও ট্রামগাড়িগুলোর বৈদ্যুতায়ন ঘটে। রেলওয়ে প্রবেশ করে এক নতুন জগতে। ১৯৪০-র দশকের শুরুর দিকে বাষ্পচালিত রেলগাড়ির বদলে ডিজেলচালিত লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ব্যবহার শুরু হয়। এরপর ১৯৬০-র দশকে জাপানে বিদ্যুতায়িত উচ্চগতির রেলব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। বর্তমান বিশ্বে বাষ্প চালিত লোকোমোটিভ তেমন একটা দেখা যায় না। তবে জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ঐতিহ্য রক্ষায় পর্যটকদের জন্য স্টিম ইঞ্জিন চলিত রেল চালানো হয়ে থাকে।
এ তো গেল আধুনিক রেলওয়ের কথা। কিন্তু এর বহু আগেই রেলপথ নির্মিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিসে রেল চলাচলের ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। সে সময় গ্রিসের কোরিন্থের ইসথমাস প্রদেশ জুড়ে ৬ থেকে ৮.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ডিওলকস নামক পাকা ট্র্যাকের রাস্তা ছিল। মানুষ অথবা পশুচালিত চাকাওয়ালা যানবাহন চুনাপাথরের খাঁজের উপর দিয়ে চলাচল করত, যা ট্র্যাকের উপর দিয়ে ওয়াগনটিকে সঠিক পথে নিয়ে যেত। তখন রেলগাড়ি ছিল চার চাকার অনেকটা ঘোড়ার গাড়ির মতো। এগুলো আবার চলতও ঘোড়া কিংবা গাধা দিয়ে। ঘোড়ার গাড়ির সাথে এর পার্থক্য হলো, এই গাড়িগুলো শুধু একটা নির্দিষ্ট লাইনের উপর দিয়ে চলাচল করত। এতে করে চলাচলটা নির্বিঘ্ন হয়। ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে জার্মানিতে ঘোড়ায় চালিত রেলগাড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে মোটরযান শিল্প এবং অটোমোবাইল শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হলে রেলশিল্পে ভাটা পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেল ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, বৈশ্বিক ভূমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং যানজট ইত্যাদির কারণে রেলশিল্পে আবার বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। পাশাপাশি আধুনিক ও বিলাসবহুল রেলওয়ে ব্যবস্থা আবিষ্কারের ফলে জনপ্রিয়তাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতবর্ষে রেলওয়ে
অন্যান্য ঔপনিবেশিক অঞ্চলের মতো ভারতবর্ষেও রেলওয়ে এসেছে ব্রিটিশদের হাত ধরে। উপমহাদেশে ততদিনে ব্রিটিশ শাসন গেঁড়ে বসেছে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো এদেশে একচেটিয়াভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না তারা। ততদিনে ইউরোপে রেলপথ আবিষ্কারের ফলে শিল্পখাতে এক বিপ্লব ঘটে যায়। একটা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা শিল্পায়নের চাবিকাঠি হলো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই শিল্পখাতে উন্নয়ন করার জন্য ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে রেল বিপ্লব সংঘটিত হলে শিল্প-বাণিজ্য এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সেই সুবিধাদি বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশে রেলপথ স্থাপন নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন। এই পরিকল্পনা যতটা না ছিল এদেশের মানুষের সুবিধার জন্য, তার থেকে বেশি জড়িত ছিল ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সুবিধা এবং তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ।
১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তবে পরবর্তী প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এ পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। সে সময় ব্রিটিশ রাজা ছিলেন চতুর্থ উইলিয়াম। এরপর ১৮৪৪ সালের ২৩শে জুলাই, ভারতীয় উপমহাদেশের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ। যেহেতু ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত উপমহাদেশে রেলপথ আলোর মুখ দেখছে না, সেহেতু লর্ড হেনরি হার্ডিঞ্জ ক্ষমতা গ্রহণ করেই বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের নিজেদের সুবিধায় রেলপথ নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সরকার নতুন নতুন রেলওয়ে কোম্পানিকে ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। একটি স্কিমের আওতায় জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। শুরুর বছরগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বার্ষিক মুনাফা নিশ্চিত করা হয়। কোম্পানিগুলো ৯৯ বছরের লিজে রেলপথ নির্মাণ ও পরিচালনা করতে থাকে। অবশ্য সরকারেরও সুযোগ রাখা হয় নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সেগুলো কিনে নেবার।
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করার পর এই কোম্পানিকে পশ্চিমবাংলার হাওড়া থেকে কয়লা খনি সম্পৃদ্ধ শহর রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত প্রায় ১২১ মাইল রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠনের মূলে ছিলেন রাওল্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন। পরে তাকে সেই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন জর্জ টার্নবুল।
এদিকে ১ আগস্ট, ১৮৪৯ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করা হয় গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানি। গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানির সদর দপ্তর ছিল লন্ডনে। মূলত মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয় গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানি। এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত প্রায় ৩৩ কিলোমিটার পরীক্ষামূলক রেললাইন নির্মাণকাজ শুরু করে দেয়। উল্লেখ্য যে, ১৮৫১ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতে প্রথম রেল চালু হয়। রুরকিতে স্থানীয় একটি খাল নির্মাণকার্যে মালপত্র আনা-নেওয়া করার জন্য ট্রেনটি চালু করা হয়েছিল। তবে এটি কোনো বাণিজ্যিক রেলপথ ছিল না।
এর ঠিক দু’ বছর পরে মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়। ১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল, ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে রেললাইনটি উদ্বোধন করা হয়। এটাই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। সাহিব, সিন্ধ এবং সুলতান নামে তিনটি বাষ্পীয় লোকোমোটিভ দ্বারা ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম রেলওয়ে পরিষেবার সূচনা ঘটে।
এদিকে হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্তু রেললাইন নির্মাণকাজের দায়িত্ব গ্রহণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি। এই রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেললাইনের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। সে বছরেরই ১৫ আগস্ট লাইনটি উদ্বোধন করা হয় এবং ট্রেন চলাচল শুরু করে। সকাল ৮:৩০ মিনিটে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে হুগলিতে পৌঁছায় ১০:০১ মিনিটে। যাত্রা পথে ৩৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে মোট সময় ব্যয় হয় ৯১ মিনিট। এই ছিল ব্রিটিশ বাংলায় সর্বপ্রথম ট্রেন চলাচল।
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বাংলায় সর্বপ্রথম রেলওয়ে এসেছে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির হাত ধরে। এ কোম্পানি সর্বপ্রথম বাংলায় রেলপথ নির্মাণের জন্য ভূমি জরিপ, ভূপ্রকৃতি যাচাই, রেলপথ নির্মাণের খরচ এবং রেলপথ নির্মাণের ফলে সুবিধা সম্পর্কে সমীক্ষা চালায়।
১৮৪৫ সালের শুরুর দিকে ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন তার তিনজন সহকারীসহ ভারতীয় উপমহাদেশে পর্যবেক্ষণে আসেন। সর্বপ্রথম তারা মির্জাপুর হয়ে কলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য খরচ এবং সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করেন। তারা পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান, প্রতি মাইল ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণের জন্য খরচ হবে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার পাউন্ড। এই প্রতিনিধি দল লন্ডনে ফেরত গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে সে অনুযায়ী প্রতিবেদন জমা দেন। এই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করেই লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব পাশ করা হয়। তারপরই লন্ডনে এ কোম্পানির জন্য তহবিল সংগ্রহ করা শুরু হয়।
১৮৪৫ সালের ১১ জুন, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য রেলপথ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মতো লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালে কোম্পানিটির নাম ছিল ‘দি ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি’। সমসাময়িককালে সমগ্র ভারতবর্ষে রেলপথ নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকটি রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল; যেমন- মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলা রেলওয়ে কোম্পানি, দক্ষিণ ভারতে রেলপথ নির্মাণের জন্য সাউথ ইন্ডিয়া রেলওয়ে, মধ্য ভারতে রেলপথ নির্মাণের জন্য বারোডা অ্যান্ড সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া রেলওয়ে এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের জন্য নর্থ ওয়েস্ট রেলওয়ে কোম্পানি। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব কোম্পানি ছিল ইউরোপীয় পুঁজি ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর লন্ডনে ১৩ জন সদস্য নিয়ে এ কোম্পানির পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। সেখানে ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন ছিলেন কোম্পানির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ম্যাকডোনাল্ড স্টিফেনসন পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ব্রিটিশ বাংলায় রেলপথ নির্মাণের জন্য এই লোকটির বেশ বড় ভূমিকা ছিল। যার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে।
প্রতিষ্ঠাকালে কোম্পানির মূলধন ছিল ৪০ লক্ষ পাউন্ড, যার বেশিরভাগই ছিল লন্ডনে পুঁজিবাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ। সেই সময় ইউরোপে রেল বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ফলে রেলশিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ আসতে থাকে। কাজেই কোম্পানিটিকে পুঁজি সংগ্রহে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।
১৮৫৯ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির অধীনে ৭৭টি ইঞ্জিন, ২২৮ যাত্রীবাহী কোচ এবং ৮৪৮টি মালবাহী ওয়াগন ছিল। ১৮৫১ থেকে ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি ভারতবর্ষে যতগুলো রেল ট্রাক নির্মাণ করেছিল, তার সবগুলোতেই প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন জর্জ টার্নবুল। এজন্য ৭ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩ সালে ভারতীয় অফিশিয়াল গেজেটে তাকে ‘ভারতের প্রথম রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বলা হয়ে থাকে, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি ভারতবর্ষে রেলওয়েতে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। হাওড়া থেকে রানীগঞ্জ পর্যন্ত সফলভাবে রেললাইন নির্মাণকাজ সমাপ্ত করার পর কোম্পানিটি বিভিন্ন রুটে রেললাইন নির্মাণ কাজ শুরু করে; যেমন- ১৮৫৯ সালে কানপুর থেকে এলাহাবাদ, ১৮৬২ সালে হাওড়া থেকে দিল্লি, ১৮৬৬ সালে দিল্লি থেকে আগ্রা এবং ১৮৬৭ সালে এলাহাবাদ থেকে জবলপুর পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হয়। ১৮৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর, এক গেজেটের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারত সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি কিনে নেয়। ফলে কোম্পানিটি শতভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশরা তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে রেলপথ নির্মাণ করেছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মাধ্যমেই ভারতবর্ষে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। ব্রিটিশদের হাত ধরে রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আধুনিক ও দ্রুততম যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প এবং শিক্ষাখাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। যার সুবিধা এদেশের মানুষও ভোগ করতে থাকে। কাজেই রেলওয়ের প্রচলন ছিল ভারতবর্ষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ, একথা নিশ্চিত করেই বলা যায়।