ইউরোপে তখন শিল্পবিপ্লবের জোয়ার। আর এদিকে প্রায় ছয়শো বছরের দাপুটে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পড়ন্তবেলা। আজকের দিনে আমরা যে আধুনিক তুরস্ক দেখি, তৎকালে এটিই ছিল মুসলিমদের সর্বশেষ খিলাফতের প্রাণকেন্দ্র।
খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর পূর্বসূরিদের গৌরবময় ইতিহাসের সাথে পেয়েছিলেন একদল দুর্নীতিপরায়ণ আমলা, শূন্যপ্রায় রাজকোষ, সেই সাথে মূলধারার ধর্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি শিক্ষিত কুচক্রী মহল। যাদের লক্ষ্য ছিল যেকোনোভাবেই হোক খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইউরোপের আদলে তুরস্ককে গড়ে তোলা। একদিকে অভ্যন্তরীণ দুর্দশা, অন্যদিকে ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র, সব মিলিয়ে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ একরকম নড়বড়ে অবস্থায় মসনদে বসেন।
ওসমানী সাম্রাজ্যের এমন ক্রান্তিকালে তুর্কি মুসলিমদের আলোর দিশারি হয়ে আবির্ভাব ঘটে একজন মহামানবের। বলা হচ্ছে সাঈদ নুরসির কথা, অসাধারণ মেধার কারণে তিনি পরিচিত ছিলেন বদিউজ্জামান হিসেবে, যার অর্থ ‘সময়ের বিস্ময়’।
বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির জন্ম তুরস্কের ভিতলিস ভিলায়েত প্রদেশের নুরস নামক এক কুর্দি গ্রামে। বাল্যকালে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় মুহাম্মদ এফেন্দির মাদ্রাসায়। এরপর ১৮৮৮ সালে শাইখ আমিন এফেন্দির মাদ্রাসা এবং পরে আরো বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন শেষে শাইখ মুহাম্মাদ জালালির কাছ থেকে শিক্ষাসনদ লাভ করেন।
বদিউজ্জামান যে সময়টায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন তখন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মাদ্রাসাগুলোর ভীষণ দরিদ্রাবস্থা। অধিকাংশ মাদ্রাসা চলতো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অনুদানে অথবা জনগণের যাকাত ও সাদকার মাধ্যমে। তবে নুরসি ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি কখনোই যাকাত বা সাদকার অর্থ গ্রহণ করতেন না এবং পুরো জীবন এই আদর্শে অটল ছিলেন।
বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। শাইখ জালালির নিকট থেকে শিক্ষাসনদ লাভ করার পূর্বেই তিনি পারিপার্শ্বিক নানাবিধ গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন এবং এমনভাবে অধ্যয়ন করেন যে এগুলো থেকে কোনো প্রশ্ন করে তাকে আটকানো যেত না। খুব অল্প সময়েই তার এ অসাধারণ মেধার খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি যতবারই তার জ্ঞানের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন, ততবারই সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। ফলে লোকমুখে বদিউজ্জামান হিসেবে পরিচিতি পান।
শিক্ষাজীবনের শুরুতেই নুরসি তুরস্কের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করতে পেরেছিলেন। একটি ইসলামি সাম্রাজ্য, যারা প্রায় ছয়শো বছর ধরে মুসলিম জাতির নেতৃত্বে ছিল, সেই দেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষের অনীহা তাকে বেশ চিন্তিত করে তোলে। শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপ আকস্মিকভাবে অনেকটা এগিয়ে যায়। এদিকে সময়োপযোগী সংস্কারের অভাবে পিছিয়ে পড়ে ওসমানীয় সাম্রাজ্য তথা তুরস্ক। ফলে তুর্কি জনমনে ইউরোপের প্রতি প্রবল আগ্রহের জন্ম হয় এবং ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও জীবনযাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
নুরসি জাতির এ সমস্যা বুঝতে পেরে যথাযথ সমাধানের পথ বের করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি থাকবে যুগোপযোগী আধুনিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সুবিধা। সেই লক্ষ্যেই তিনি মাদরাতুজ জাহারা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালান। কারণ তিনি মনে করতেন ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
নুরসি মাদরাতুজ জাহারার মডেল সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের নিকট তুলে ধরেন, আর এ কারণে তিনি তৎকালের তথাকথিত সেক্যুলার গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। কারণ তারা নুরসিকে সেক্যুলার তুরস্ক গড়ার পথে প্রতিবন্ধকতা মনে করত। এর যথেষ্ট কারণও ছিল, কেননা সেসময় তুরস্কের ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজে বদিউজ্জান সাঈদ নুরসির ইসলামকে পুনর্জীবিত করার প্রচেষ্টা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
২
নুরসি যখন মাদরাসাতুজ জাহারা নিয়ে চিন্তা করছিলেন তখন তুর্কিতে ধেয়ে আসছিল আরেক বিপদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি সুলতান জার্মানির পক্ষ হয়ে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলে শাইখুল ইসলামের কার্যালয় থেকে এই যুদ্ধকে জিহাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জিহাদের ব্যাপারে যে ক’জন ফতোয়া প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে নুরসি অন্যতম। নুরসি ফতোয়া দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন এবং একপর্যায়ে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর হাতে আটক হন। রাশিয়ার কারাগারে কারাগারে কঠিন বন্দী জীবন পার করার পর ১৯১৮ সালে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন।
দেশে ফিরে আসলে সুলতান তাকে ‘দারুল হিকমায়ে ইসলামিয়া’ সংগঠনের সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন, যা ছিল অত্যন্ত সম্মানের, কেননা কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাই এই ইসলামিক সংগঠনটির সদস্য হতে পারতো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বর্তমান তুরস্কের মূল ভূ-খণ্ড ছাড়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সমস্ত অঞ্চল মিত্রশক্তিরা ভাগাভাগি করে নেয়। এতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি। এরপর গ্রিসের আক্রমণের শিকার হয় মূল ভূ-খণ্ডও। কামাল পাশার কৃতিত্বে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা হয়। এরপরই কামাল পাশা ১৯২৪ সালের ১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফতের অবসান ঘটান।
খিলাফত পতনের পর কামাল পাশা সেক্যুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্ম বিরোধী কার্যক্রম শুরু করেন। সেই সাথে নুরসির জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। একদিকে কামাল পাশার ধর্মকে মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে বদিউজ্জামান সাইদ নুরসির ইসলামকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম।
৩
খিলাফত বিলুপ্তির পরের বছরই কামাল পাশার নীতিনির্ধারকেরা জুব্বা ও ইসলামি টুপি পরিধান নিষিদ্ধ করেন। সেসময় টুপি-জুব্বা পরার কারণে অনেক মুসলমানকে গ্রেফতার করে জেল পাঠানো হতো, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়। ১৯২৮ সালে সকল প্রকার ধর্মীয় বই ছাপানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ১৯৩৩ সালে কামাল পাশা তুরস্কের সকল মসজিদে আরবি ভাষায় আযান ও কুরআন তিলাওয়াত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
কামাল পাশার একের পর এক ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডে তুর্কি জনমনে প্রচন্ড ঘৃণার জন্ম নিলেও প্রাণের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি। এমন সময় নুরসি তার রিসালায়ে নূরের কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী যিনি কখনোই নিজ দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। কারণ তিনি মনে করতেন এতে করে মুসলিমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে জড়াবে। তাই তিনি রিসালায়ে নূরের মাধ্যমে কুরআনের প্রকৃত মাহাত্ম্য তুলে ধরার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় বই ছাপানো ছিল দণ্ডনীয়, অপরাধ তাই রিসালায়ে নুরের পাণ্ডুলিপি হাতে লিখেই প্রচার করা হতো। এতে অংশ নেয় রিসালায়ে নুরের হাজার হাজার ছাত্র। কেউ লেখার কাজ করতেন, কেউ ছিলেন প্রচারের দায়িত্বে। ওদিকে সরকারও বসে ছিল না। রিসালায়ে নুরের ছাত্রদের উপর নানা রকম অত্যাচার শুরু হয়। বার বার আদালাতে হাজির করা হয় নুরসিকে। কখনো রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ডের অপরাধে, কখনো বা সংবিধান লংঘনের দায়ে। অথচ আদালত কখনোই নুরসি বা রিসালায়ে নুরকে রাষ্ট্র বা সংবিধান বিরোধী প্রমাণ করতে পারেনি। তবুও নুরসিকে জীবনের অধিকাংশ সময় নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছে। থাকতে হয়েছে পুলিশের নজরবন্দি হয়ে।
এত অত্যাচার, অপবাদের পরও বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসিকে আপোষ করেনি। সর্বস্ব দিয়ে রিসালায়ে নুরের কার্যক্রম চালু রেখেছিলেন। তিনি সবসময়ই একটা কথা বলতেন, “সময় এখন ঈমান রক্ষার, মতবাদ রক্ষার নয়।“
‘বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি এবং রিসালায়ে নুর’ বইটিতে নুরসির সংগ্রামী জীবন ও খিলাফত পরবর্তী আধুনিক তুরস্কের সেক্যুলার সমাজ ব্যবস্থায় রিসালায়ে নুরের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটি লিখেছেন মেধাবী লেখক মুহাম্মদ ইরফান হাওলাদার, যিনি পড়াশোনার সুবাদে দীর্ঘদিন তুরস্কে অবস্থান করেন। ফলে তুরস্কের সমাজ ও সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে ইসলামি জাগরণের পেছনে রিসালায়ে নুর ও সাঈদ নুরসির অবদান গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। বইটির শেষের দিকে রিসালায়ে নুরের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে। লেখক মনে করেন, সাঈদ নুরসির আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পেতে হলে অবশ্যই রিসালায়ে নুর অধ্যয়ন করা জরুরি।
অনলাইনে কিনুন- বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি এবং রিসালায়ে নুর