দিল্লি শহর জনমানবহীন এক সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। কাদের জন্য আমি লিখব? কে উর্দু পড়বে? দিল্লি আজ মহাশ্মশান। দোকান-পাট, বাজার-ঘাট, নহর-ফোয়ারা সবই বিধ্বস্ত। রক্তের মহাসমুদ্রে মাঝখানে আমি একাকী দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাজার হাজার প্রিয় বন্ধু আর ভক্ত পাঠক আজ পরপারে। আমি কার সাথে কথা বলব? কার কাছে প্রকাশ করব আমার মর্মবেদনা? কে আমাকে সহানুভূতি জানাবে? কে দেবে আমাকে সান্ত্বনা? আমার দুঃখে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার মতো মানুষও নেই দিল্লিতে। জানি না, আমাকে আর কী কী দেখতে হবে?
উর্দু কবি মীর্জা গালিব
১৮৮৭ সালের কথা। মার্চ মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। প্রকৃতি হিমেল হাওয়া বইয়ে জুড়িয়ে দিচ্ছে শীতল বাতাসে সকলকে। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের এক প্যারেড গ্রাউন্ডে সামরিক কসরত ও মহড়া দিতে অশ্বারোহী বাহিনীর জোয়ানেরা সমবেত হয়েছে। মেজর নীল রয়েছেন জোয়ানদের দায়িত্বে। তার আদেশেই শুরু হলো কুচকাওয়াজ। শেষ হতেই শুরু হলো বন্দুকের কসরত।
আচমকাই একটা গুলি এসে মেজর নীলের উন্মুক্ত বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তেই ঘোড়া থেকে গড়িয়ে ধুলোয় লুটোপুটি খেল নিথর দেহটা। আটক করা হলো মজর আলী নামে এক জোয়ানকে। শুরুতে সবাই একে দুর্ঘটনা ভাবল। কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সকলের সামনে স্পষ্টভাবেই মজর আলী বলল,
ঠিক ত্রিশ বছর আগে বিনা কারণে আমার পিতা ফজর আলীকে জেনারেল নীল হত্যা করেছিলেন। বিচারের ধার ধারেননি তিনি। এক মিথ্যাবাদীর সাক্ষ্যে অন্যায়ভাবে আমার পিতাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন তিনি। বিবিঘরের শুকনো রক্ত জিভ দিয়ে চাটতে বাধ্য করেছিলেন তিনি আমার পিতাকে। মৃত্যুর আগে পিতা আমাকে তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে বলেছিলেন। ত্রিশ বছর অপেক্ষা করেছি আমি সেই সুযোগের আশায়। জেনারেল নীলকে পাইনি আমি। পেয়েছি তারই ছেলে মেজর নীলকে। পিতার দোষের দণ্ড পুত্রকে দেয়ার ব্যাপারে মানসিক অশান্তিতে ভুগেছি আমি। কিন্তু পিতার এমন ন্যাক্কারজনক মৃত্যুর বেদনা ছিল তার চাইতেও ঢেরগুণ বেশি। তাই নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করেছি মেজর নীলকে।
এমন বয়ানের ভিত্তিতে ১৮৮৭ সালের ১৪ই মার্চ তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। সিপাহী বিদ্রোহের এমনই অনেক অজানা গল্প নিয়েই আনিস সিদ্দিকীর বই ‘সিপাহী যুদ্ধের ট্র্যাজেডী’। মীর্জা গালিবের কবিতাতেই তো প্রকাশ পেয়েছে সেই সময়কার ভয়াবহতা। তবে শুরুতে এমন গল্প পড়ে পাঠক হয়তো ভাবছেন, মজর আলী এমন না করলেও পারত। কিন্তু মজর আলীর পিতার ঘটনা সকল নৃশংসতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
একে তো ফজর আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। এমনকি সিপাহী যুদ্ধের বিদ্রোহীই ছিলেন না তিনি। জেনারেল নীল তখন প্রতিশোধের নেশায় বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছিল। মিথ্যা এক সাক্ষীর কথায় ফজর আলীকে ধরে নিয়ে আসে তার লোকেরা। ফজর আলী বারকয়েক বলেও জেনারেল নীলকে সত্যিটা বিশ্বাস করাতে পারেননি। ফজর আলী সুষ্ঠু বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু সেসব কিছুই জেনারেলের কান অবধি পৌঁছেনি।
নির্ধারিত দিনে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাবার পূর্বে জেনারেল নীল আচমকাই ফজর আলীকে নিয়ে বিবিঘরে যান। বিবিঘরে তখন সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সৈন্যদের রক্ত শুকিয়ে জমিনের সঙ্গে লেগে চটচটে হয়ে আছে। তিনি আদেশ দেন ফজর আলীকে, জিভ দিয়ে সেই রক্ত চাটতে। ফজর আলী অস্বীকৃতি জানালে তার চাবুক গর্জে ওঠে। চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত ফজর আলী নিরূপায় হয়ে জিভ নিয়ে ঠেকান সেই শুকনো রক্তের জমিনে। আর এক পৈশাচিক আনন্দে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করেন জেনারেল নীল।
সিপাহী বিদ্রোহের মূল কারণ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে চর্বিযুক্ত কার্তুজের ব্যবহার। এনফিল্ড রাইফেল অন্যতম কারণ ছিল অবশ্যই, তবে একমাত্র নয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় সকল কারণকেই আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করে বলা যাবে। তবে হ্যাঁ, স্ফুলিঙ্গটা ছড়িয়েছিল চর্বিযুক্ত কার্তুজের ব্যবহারের কারণে। ধর্মের অবমাননা বা জাতের অবমাননা মেনে নিতে পারেনি মুসলিম-হিন্দু সম্প্রদায়ের জোয়ানরা।
ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির কারণে দেশীয় রাজ্যগুলো অথর্ব হয়ে পড়েছিল। আর সাধারণ জনগণের আর্থিক ও রাজনৈতিক ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছিল। রাজপরিবারের ভাতা বন্ধ করে দেওয়াতে চটে গিয়েছিল তারাও। এছাড়াও রাজপরিবারের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের উপর অমানবিক অত্যাচার ও ব্যবহার এমনকি সাধারণ প্রজাদেরও ক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। শাহী খাজানা লুট করে হেরেমবাসীকে অপদস্ত করা মোটেই মেনে নেয়নি সাধারণ জনগণ। তাছাড়া ব্রিটিশ কর্মচারীরা দেশবাসীর উপর যে অত্যাচার করত, তা ছিল অসহনীয়।
ব্রিটিশরা ভারতবাসীকে ঘৃণা করত। এমনকি মানুষ বলেই মনে করত না। তাদের দৃষ্টি ছিল কেবলই ভারতবর্ষের খাজানার উপর। এমনকি ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকেও হেনস্তা হতে হতো অযোগ্য ব্রিটিশ কর্মকর্তার কাছে। যেজন্য ভারতবাসীও এড়িয়ে চলত তাদের। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ থেকে প্রচুর সম্পদ বিলেতে পাচার করেছিল। এজন্য ভেঙে পড়েছিল ভারতীয় অর্থনীতি। রাজা-বাদশাহ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের অর্থকোটা চলে এসেছিল শূন্যে। নতুন সংস্কৃতি ও ভাষার প্রয়োগে শিক্ষিত যুবকেরা বেকার হয়ে পড়েছিল।
কর্মক্ষেত্রেও ছিল ব্যাপক বৈষম্য। যেখানে একজন ভারতীয় কর্মকর্তার বেতন ধার্য হতো মাত্র ৯ টাকা; সেখানে একজন ইংরেজ কর্মকর্তা পেতেন ৪০ টাকারও অধিক। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও ছিল এরকমই রেষারেষি। যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতিই ছিল বেশি। যোগ্য ভারতীয় কর্মকর্তার চেয়ে অনভিজ্ঞ ইংরেজ কর্মকর্তাই সবসময় পদোন্নতি পেত। আর ভারতীয় নাগরিক বছরের পর বছর সেই একই বেতনে চাকরি করে যেত। না হতো পদোন্নতি, না বাড়ত বেতন; এমনকি সামান্য ভুলে আবার কাটা হতো এই বেতন থেকে জরিমানার অংশ।
ধর্মীয় কারণে সিপাহী যুদ্ধ দানা বাঁধছিল বেশ আগে থেকেই। সতীদাহ প্রথা নিবারণ, বিধবা বিবাহ আইন ইত্যাদি কারণে হিন্দুরা বেশ ক্ষেপে ছিল ইংরেজিদের উপর। আবার, জোর করে খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তর খেপিয়ে তুলেছিল মুসলমানদের। এরপর এসেছিল চর্বিযুক্ত কার্তুজওয়ালা এনফিল্ড রাইফেল। ইংরেজদের সকল বৈষম্য আর অন্যায় মাথা পেতে নিয়েছিল ভারতবাসী। কিন্তু ধর্মের অবমাননা সহ্য করতে পারেনি হিন্দু-মুসলিম কোনো পক্ষই। তাই মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ।
সিপাহীরা বিভিন্ন ব্যারাক দখল করা শুরু করল। বাধা হিসেবে যারাই এলো, তারাই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। মুহূর্তেই দিল্লী দখল করে সিপাহীরা বাহাদুর শাহকে দিল্লীর সম্রাট ঘোষণা করলো। বাহাদুর শাহ সম্রাটের আসনে বসে নতুন করে সকল কিছু সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ঘোষণা দেন। দিল্লীর মতো এত বড় আর গুরুত্বপূর্ণ একটা রাজ্য ইংরেজদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে তারা। পাশাপাশি কানপুর এবং লখনৌও চলে যায় বিদ্রোহীদের দখলে।
কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। মূলত সিপাহী যুদ্ধের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দুটি ব্যাপারকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক, সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং দুই, শিখ সেনারা ভারতীয় হয়েও ব্রিটিশদের সহযোগিতা করা। বাহাদুর শাহ তেমন যোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। আর সিপাহীরাও জোটবদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু বিদ্রোহী মনোভাব হওয়ায় হতে পারেনি তারাও সামরিকভাবে সংঘবদ্ধ। উপরন্তু, শিখ সেনারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলাবার পর সিপাহীদের অধিকৃত অনেক অঞ্চলই ধীরে ধীরে হাতছাড়া হতে থাকে ও সিপাহীদের মনোবল ভেঙে পড়ে।
সিপাহীরা দিল্লী অধিকৃত করে রেখেছিল দীর্ঘ পাঁচ মাস। কিন্তু এতদিনেও তারা দিল্লীর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। তাই ব্রিটিশরা শিখদের নিয়ে আক্রমণ করামাত্রই দিল্লী দখল করে নেয়। আর দিল্লীর পতন হলে সামগ্রিকভাবেই সিপাহীরা মনোবল হারিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কেননা, ইতোমধ্যেই বিদ্রোহীদের ধরে নিয়ে বিচারের ধারেকাছেও না ঘেঁষে ব্রিটিশরা জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছিল বা নির্বিচারে গুলি করে মারছিল। তাই পালানো ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না বিদ্রোহীদের। তবে সিপাহী বিদ্রোহের কারণে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান হয়, এবং ভারতবর্ষ ব্রিটিশ রাজ্যের একটি অঙ্গরাজ্য বলে ঘোষিত হয়।
সুসাহিত্যিক আনিস সিদ্দিকী আদতে একজন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩৪ সালে সাতক্ষীরা জেলায় তার জন্ম। পেশাগত জীবনে বরিশাল জিলা স্কুল এবং খুলনা জিলা স্কুল থেকে বদলি হয়ে তিনি চলে আসেন ঢাকার গর্ভনমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে। এরপর পাশাপাশিই চলে তার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ইতিহাসের বই রচনা। প্রায় বিশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ঢাকার ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি, নির্বাসিত সম্রাট বাহাদুর শাহ, মহাযুদ্ধের নায়ক হিটলার, সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা ইত্যাদি।
আনিস সিদ্দিকীর লেখনশৈলী বেশ সাবলীল আর প্রাঞ্জল। পড়তে বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না পাঠকদের। তবে শব্দগত ভুল, বানানের তারতম্য খানিকটা হলেও চোখে লাগবে। বলা বাহুল্য, তখনকার বানানরীতি আর এ সময়ের বানানরীতি মোটেও এক নয়। লেখক বইয়ে যেসব তথ্যসূত্রের যোগাড় করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। ইতিহাসপ্রেমী হলে এমন বই গ্রোগ্রাসে যেকোনো পাঠকই গিলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বই: সিপাহী যুদ্ধের ট্র্যাজেডী
লেখক: আনিস সিদ্দিকী
ধরন: ইতিহাস
প্রকাশনী: নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
মলাট মূল্য: ১৭৫/- টাকা