১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসটি ছিল ফিলিস্তিনের ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ মাসগুলোর মধ্যে একটি। সে সময় ১০ দিনের যুদ্ধে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন পিএলওর অন্তত তিন সহস্রাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়, হাজার হাজার নেতাকর্মী বন্দী হয়, এবং কয়েক বছর ধরে তাদের প্রধান আশ্রয়স্থল জর্ডান থেকে তাদেরকে সদলবলে উচ্ছেদ হতে হয়।
কিন্তু ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া এ যুদ্ধ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং এটি ছিল জর্ডান এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ! ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামের পথকে বাঁকিয়ে দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এই ঘটনাটি ইতিহাসে আইলুল আল-আসওয়াদ তথা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে পরিচিত।
কী এই ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর? এর পটভূমিই বা কী? দুই পর্বের এই লেখায় সে ব্যাপারেই বিস্তারিত আলাপ করা হয়েছে। প্রথম পর্বে থাকছে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের পটভূমি, আর দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হবে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অপারেশনের বিবরণ এবং তার প্রভাব ও ফলাফল নিয়ে।
ফিলিস্তিনের সাথে জর্ডানের সম্পর্ক
পাশাপাশি অবস্থিত জর্ডান এবং ফিলিস্তিনের মধ্যবর্তী সীমারেখাটি প্রাকৃতিক। দুই দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে মৃত সাগর এবং গ্যালিলি সাগরকে সংযুক্ত করা জর্ডান রিভার নামের সরু একটি নদী। জর্ডান রাষ্ট্রটির অবস্থান এই নদীর পূর্ব পাশে, আর ফিলিস্তিনের অবস্থান এর পশ্চিম পাশে। নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত বলে ফিলিস্তিনের এই অংশটি ‘পশ্চিম তীর’ বা ওয়েস্ট ব্যাংক নামে পরিচিত। পবিত্র জেরুজালেম নগরী এবং মসজিদ আল-আকসা এই পশ্চিম তীরেই অবস্থিত।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনি ভূমিতে নিজেদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়, ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোতে আক্রমণ এবং এর অধিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করতে শুরু করে, তখন অন্যান্য আরব দেশগুলোর পাশাপাশি জর্ডানও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধে আরবদের পরাজয় ঘটে এবং ইসরায়েল জাতিসংঘের মানচিত্রে বরাদ্দকৃত নিজের অংশ তো বটেই, ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমিরও অর্ধেকের বেশি দখল করে নেয়।
জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানচিত্রে জেরুজালেমের আশেপাশের এলাকাগুলোসহ সমগ্র পশ্চিম তীর ছিল ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দকৃত। কিন্তু যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেমসহ বিশাল এলাকা দখল করে নেয়। পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরের বাকি এলাকাগুলোও হয়তো তারা দখল করে নিত, কিন্তু জর্ডানীয় সেনাবাহিনী তাদেরকে সেসব এলাকায় পরাজিত করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও তাই জর্ডানীয় সেনাবাহিনী সেখানে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রাখে। এবং দুই বছর পর, ১৯৫০ সালে জর্ডান এই পশ্চিম তীরের এলাকাগুলোকে ‘অ্যানেক্স’ করে নেয়, অর্থাৎ নিজের ভূমি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী জর্ডান নদী পেরিয়ে পূর্ব তীরের জর্ডানের মূল ভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৫০ সালে যখন পশ্চিম তীরকেও জর্ডানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন দেখা যায়, নতুন এই এলাকাসহ সমগ্র জর্ডানের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই ফিলিস্তিনি। মূল জর্ডানীয় নাগরিকরাই সেখানে সংখ্যালঘু। জর্ডানের তৎকালীন বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন হুসেইন অবশ্য ফিলিস্তিনিদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান, তাদের জন্য সংসদের অর্ধেক আসন বরাদ্দসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেন। কিন্তু জনমিতির এই পরিবর্তন জর্ডানের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়।
জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই জর্ডানের রাজতন্ত্র ছিল মূলত ব্রিটিশপন্থী। আধুনিক জর্ডান তথা ‘হাশেমাইট কিংডম অফ জর্ডান’-এর প্রতিষ্ঠাতা, বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন হুসেইন ছিলেন মক্কার গভর্নর শেরিফ হুসেইন বিন আলির পুত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এই হুসেইন বিন আলিই ছিলেন আরব উপদ্বীপে ব্রিটিশদের প্রধান মিত্র। ব্রিটিশদের জোগসাজশে, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’র সহায়তায় তিনি তুরস্কের নেতৃত্বাধীন অটোম্যান খিলাফতের পতন ঘটানোর জন্য আরব বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন এই আশায় যে, যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা তাকে সমগ্র আরবের বাদশাহী দেবে।
ব্রিটিশরা অবশ্য হুসেইনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তবে তারা হুসেইনের পুত্রদেরকে ইরাক, সিরিয়া এবং হেজাজে রাজত্ব করার সুযোগ করে দেয়। আব্দুল্লাহ যদিও অনেকটা নিজের চেষ্টাতেই জর্ডানে গিয়ে হাশেমী রাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন করেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনিও ব্রিটিশদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যখন ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন বাদশাহ আব্দুল্লাহ গোপনে জুইশ এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করছিলেন। অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলো যেখানে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল, সেখানে আব্দুল্লাহর তাতে খুব একটা আপত্তি ছিল না। বরং তিনি চাইছিলেন ইহুদীদের জন্য বরাদ্দকৃত অংশে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ফিলিস্তিনের জন্য বরাদ্দকৃত ভূমির পুরোটুকুই দখল করে তার অধীনে নিয়ে নেবেন এবং তার ভাইদের সাথে মিলে ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান এবং ফিলিস্তিনকে একত্রিত করে বৃহত্তর সিরিয়া প্রতিষ্ঠিত করবেন।
কিন্তু একদিকে জায়নিস্ট নেতাদের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলোর চাপে শেষ পর্যন্ত তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হন। তবে ইসরায়েলের প্রতি তার এই নমনীয় মনোভাব এবং গোপনে ইসরায়েলের সাথে যোগাযোগ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয়, যার মূল্য তাকে দিতে হয় নিজের প্রাণ দিয়ে।
১৯৫১ সালে আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার সময় এক ফিলিস্তিনি আততায়ীর গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। তার পাশে সে সময় অবস্থান করছিলেন তার দৌহিত্র, প্রিন্স হুসেইন বিন তালাল। কিশোর হুসেইনের বুকেও সেদিন গুলি লেগেছিল, কিন্তু তার জামার উপর ধাতব মেডেল থাকায় গুলি তার শরীরে প্রবেশ করতে পারেনি।
আব্দুল্লাহর মৃত্যুর পর প্রথমে তার পুত্র তালাল ক্ষমতায় বসেছিলেন, কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় পরের বছর তালালের পুত্র হুসেইনকে রাজা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ক্ষমতার সাথে সাথে হুসেইন তার দাদার কাছ থেকে ফিলিস্তিন সঙ্কটটিও উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই সঙ্কট আরও জটিল হয়ে উঠতে থাকে।
ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি: পিএলওর উত্থান
ষাটের দশক ছিল ফিলিস্তিনের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। সে সময় বিদেশের মাটিতে বড় হওয়া ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সন্তানরা সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করছিল। নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার, দেশকে স্বাধীন করার তীব্র বাসনা তাদেরকে সংগঠিত হওয়ার, অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা যুগিয়ে আসছিল।
জর্ডানসহ বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বড় হওয়া এসব ফিলিস্তিনি যুবকদের অধিকাংশেরই কোনো চাকরি-বাকরি ছিল না। তাদের সময় কাটত শরণার্থী শিবিরগুলোতে পত্রিকা পড়ে, রেডিওর সংবাদ শুনে আর মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের বিপ্লবী ভাষণ শুনে। ১৯৫৬ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আংশিক সাফল্য তখন নাসেরকে আরব জাতীয়তাবাদী মহানায়কে পরিণত করেছিল। তার ভাষণগুলো উদ্দীপ্ত করতে থাকে এই ফিলিস্তিনি তরুণদেরকেও।
দীর্ঘদিনেও ফিলিস্তিন সংকটের কোনো সমাধান না হওয়ায় এই যুবকরা এ সময় আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর থেকে আস্থা হারিয়ে নিজেরাই ফিলিস্তিনের ভাগ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বিভিন্ন দেশে এসব যুবকরা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হতে শুরু করে। এবং ১৯৬৪ সালে এরকম কয়েকটি নতুন সংগঠন একত্রিত হয়ে গঠন করে পিএলও – প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, তথা ফিলিস্তিন মুক্তি সংগঠন।
পিএলওর ভেতরে বিভিন্ন সংগঠন ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি ছিল ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন সেক্যুলার, বাম ধারার, জাতীয়তাবাদী সংগঠন ফাতাহ। কিন্তু সেই সাথে ছিল আরও দুটি উগ্র বামপন্থী, মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট সংগঠন পিএফএলপি এবং ডিএফএলপি। এদের সবারই লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জন করা, কিন্তু তা করতে গিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে যে ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন ছিল, সে ব্যাপারে এদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল।
যা-ই হোক, পিএলও এবং এর অন্তর্ভুক্ত দলগুলো আরব রাষ্ট্রগুলোর ভেতর থেকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে। মিশর, সিরিয়া, ইরাকসহ আরব রাষ্ট্রগুলো তাদেরকে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে। কিন্তু এই দেশগুলোতে তখন ছিল শক্তিশালী সামরিক সরকার। ফলে ফিলিস্তিনি গেরিলা তথা ফেদাঈনদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা তাদের ছিল। তারা ফেদাঈনদেরকে সাহায্য করলেও এটা নিশ্চিত করতে পেরেছিল যে, তাদের অনুমতি ছাড়া বা তাদের সাথে যোগাযোগ করা ছাড়া ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে তাদের উপর বিপদ ডেকে আনবে না।
কিন্তু জর্ডানের অবস্থা ছিল ভিন্ন। জর্ডানের সেনাবাহিনী ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল, তাদের সক্ষমতাও ছিল তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়া জর্ডানে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের সংখ্যার অনুপাতও ছিল অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এত বিশাল সংখ্যক গেরিলার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা জর্ডানের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এই গেরিলারা জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ না করে নিজেরাই সীমান্ত দিয়ে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে। আর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে জর্ডানের সীমান্তের ভেতর, জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর উপর। সময় যত গড়াতে থাকে, ফেদাঈনদের অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রম জর্ডানের জন্য ততই উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে থাকে।
‘৬৭ সালের যুদ্ধ: নতুন বাস্তবতা
১৯৬৭ সালে যখন মিশর এবং ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন তাতে জর্ডানও জড়িয়ে পড়ে। বাদশাহ হুসেইনের অবশ্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তিনি ইসরায়েলের সাথে সমঝোতার রাজনীতিতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি গোপনে ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করছিলেন যে, ফিলিস্তিনি গেরিলাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
কিন্তু বাস্তবে হুসেইনের পক্ষে ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল না। এমনিতেই নাসেরের তুমুল জনপ্রিয়তার প্রভাবে হুসেইন তখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয়ে ছিলেন। তার উপর ফিলিস্তিনি বামপন্থী গেরিলারাও ক্রমেই তার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিল। এমতাবস্থায় তিনি যদি ফিলিস্তিনিদের কার্যক্রমে বাধা দিতে যেতেন, তাহলে তার ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হতো না।
এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য হুসেইন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নাসেরের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। তিনি মিশরের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি করেন। এবং এরপর যখন ‘৬৭ সালের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন চুক্তি অনুযায়ী জর্ডানে নিযুক্ত মিশরীয় জেনারেলদের নির্দেশে জর্ডানও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু এই যুদ্ধের ফলাফল ছিল আরবদের জন্য চরম বিপর্যয়মূলক। যুদ্ধে মিশর হারায় গাজা উপত্যকাসহ সমগ্র সিনাই উপদ্বীপ, সিরিয়া হারায় গোলান মালভূমি, আর জর্ডান হারায় জেরুজালেমসহ সমগ্র পশ্চিম উপকূল। প্রায় ৩ লাখ নতুন ফিলিস্তিনি শরণার্থী পশ্চিম তীর থেকে জর্ডানে প্রবেশ করে। জর্ডান মুখোমুখি হয় আগের চেয়ে আরও বড় সংকটের।
কারামার যুদ্ধ: নিয়ন্ত্রণহীন ফেদাঈন সংকট
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারে, আরবদের আশায় বসে থাকলে চলবে না। তারা নিজেরাই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। পিএলও পশ্চিম তীরের সীমান্ত সংলগ্ন শহর কারামাতে তাদের হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে এবং সেখান থেকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করতে শুরু করে। একইসাথে ফাতাহ ইসরায়েলের সীমান্তের ভেতরে গিয়েও গেরিলা আক্রমণ করতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালের মার্চে এরকম একটি আক্রমণের পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিশাল একটি দল জর্ডানের কারামা শহরে প্রবেশ করে।
ইসরায়েলের এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল পিএলওর ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং ইয়াসির আরাফাতকে আটক বা হত্যা করা। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবার ফিলিস্তিনিরা পিছিয়ে না গিয়ে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এমনিতে জর্ডান হয়তো এই অপারেশনে বাধা দিত না, কিন্তু ইসরায়েলের বিশাল বাহিনী দেখে তাদের ধারণা হয়, তারা হয়তো জর্ডানের আরো গভীরে প্রবেশ করবে। ফলে জর্ডানীয় সেনাবাহিনীও পিএলওর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়।
ব্যাটেল অফ কারামা নামে পরিচিতি ১৯৬৮ সালের ২১ মার্চের সেই যুদ্ধটি ১৫ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। দিন শেষে ফিলিস্তিন এবং জর্ডানের আহত-নিহতের সংখ্যা বেশি হলেও ইসরায়েলও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। ৩০ জন সৈন্যের মৃত্যুর পর শতাধিক আহত সৈন্য নিয়ে, বেশ কিছু ট্যাংক, সাঁজোয়া যান এবং অস্ত্রশস্ত্র ফেলে, ইয়াসির আরাফাতকে আটক করার আশা ছেড়ে দিয়ে তারা পিছু হটে। ফেদাঈনরা নিজেদেরকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করে।
‘৬৭ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের পর পিএলওর জন্য তো বটেই, মনোবল হারিয়ে ফেলা হতাশ আরবদের জন্যও এটা ছিল বিশাল অর্জন। ইয়াসির আরাফাতের এবং পিএলওর জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী হয়ে ওঠে। ফাতাহর দাবি অনুযায়ী, যুদ্ধের পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ৫,০০০ নতুন স্বেচ্ছাসেবী ফাতাহ-এ যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করে। অন্যান্য আরব দেশ থেকে পিএলওর প্রতি অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য আসতে থাকে। এবং দুর্বল জর্ডান রাষ্ট্রের ভেতর পিএলও হয়ে উঠতে থাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী।
রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র: হুসেইনের অসহায়ত্ব
১৯৬৮ সালের মার্চে ব্যাটেল অফ কারামায় বিজয়ের পর থেকেই জর্ডানে ফিলিস্তিনি ফেদাঈনদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথম দিকে তারা শুধু ট্রেনিং ক্যাম্পে এবং জনবহুল শহরগুলো থেকে দূরে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলোর ভেতরেই অবস্থান করত। কিন্তু সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তারা রাজধানী আম্মানসহ বিভিন্ন এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
অস্ত্র হাতে থাকা নিয়ন্ত্রণহীন এসব মিলিশিয়ারা জর্ডানের আইন অমান্য করে, আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীর পরোয়া না করে রাজধানী আম্মানসহ বিভিন্ন শহরে স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শন করতে থাকে। তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করে, নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো রাস্তাঘাটে চেকপয়েন্ট বসিয়ে জর্ডানীয় নাগরিকদেরকে হয়রানি করতে শুরু করে, এমনকি নিজস্ব ইউনিফর্ম এবং বিচারব্যবস্থাও চালু করে। আক্ষরিক অর্থেই তারা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র।
এ সময় তাদের দ্বারা লুটপাট, ছিনতাই, অপহরণ এবং হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এমনকি বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে, যা আরব বিশ্বে সাধারণত বিরল। পিএলওর ভেতরে থাকা উগ্র বামপন্থী আদর্শে প্রভাবিত দলগুলো এ সময় ধনী জর্ডানীয়দের ব্যক্তিগত সম্পত্তিরও নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে। জর্ডানীয়দের মধ্যে, বিশেষ করে জর্ডানীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে ফেদাঈনদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে ছোটখাট সংঘর্ষ নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অভিযোগ আছে, ফিলিস্তিনিদেরকে দেশছাড়া করার অজুহাত তৈরি করার জন্য এ সময় জর্ডানীয় ডিপ স্টেট ফেদাঈনদের ভেতর নিজেদের অনুচর প্রবেশ করিয়েও বিভিন্ন নাশকতা চালিয়েছিল।
পিএলওর প্রধান হিসেবে ইয়াসির আরাফাত ফেদাঈনদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু বাস্তবে ফাতাহর বাইরে পিএফএলপি বা ডিএফএলপির উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তারা প্রকাশ্যেই বাদশাহ হুসেইনকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিতে শুরু করে। তাদের দৃষ্টিতে জর্ডানের অধিকাংশ জনগণই যেহেতু ছিল ফিলিস্তিনি, তাই দেশটির উপর তাদের অধিকারই বেশি ছিল। বরং সৌদি আরব থেকে আসা হাশেমী রাজপরিবারের বাদশাহ হুসেইনই ছিল তাদের দৃষ্টিতে বহিরাগত, যাকে ইসরায়েলের স্বার্থে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে।
ফেদাঈনদের দৌরাত্ম্যে বাদশাহ হুসেইন উভয় সংকটে পড়ে যান। একদিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, বিদেশী পত্রপত্রিকায় তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছিল, এমনকি সেনাবাহিনীর ভেতরেও তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। সেনাবাহিনীর ক্ষোভ হুসেইন টের পেয়েছিলেন অত্যন্ত অপমানজনকভাবে। সেনাবাহিনীর এক বেদুইন ইউনিট পরিদর্শনকালে হুসেইন দেখতে পান, কমান্ডারের ট্যাঙ্কের উপর একটি অ্যান্টেনা থেকে মহিলাদের ব্রেসিয়ার ঝুলছে। হুসেইন যখন কারণ জিজ্ঞেস করেন, তখন কমান্ডার উত্তর দেন, “আমরা যদি কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে মহিলাদের মতো বসে থাকি, তাহলে আমাদের জন্য মহিলাদের জামা পরাই উত্তম।” হুসেইন বুঝতে পারেন, তিনি যদি শীঘ্রই কিছু না করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান ঘটাও অসম্ভব কিছু না।
কিন্তু অপরদিকে আরব বিশ্বে সাধারণ জনগণের মধ্যে তখনও ফেদাঈনদের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশ ছোঁয়া। জর্ডানের সাধারণ জনগণের বিশাল অংশটিও তখনও ফেদাঈনদের প্রতিই সহানুভূতিশীল ছিল। এছাড়া সরকারের অনেক মন্ত্রীও ছিল ফিলিস্তিনি, বা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালাতে গেলে একদিকে আরব বিশ্বে হুসেইনের একঘরে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, অন্যদিকে জনরোষ বৃদ্ধি পেয়ে তা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ারও সম্ভাবনা ছিল।
অসহায় বাদশাহ হুসেইন অপেক্ষা করতে থাকেন। এবং এমন সময় ১৯৭০ সালে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা হুসেইনের সামনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর উপযুক্ত অজুহাত এনে দেয়। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সুযোগ পেয়ে যান ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে জর্ডান থেকে উচ্ছেদ করার। আর এ ঘটনাই পরবর্তীতে পরিচিত হয় ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে, যা আলোচনা করা হয়েছে পরবর্তী পর্বে। পড়তে ক্লিক করুন এখানে।