এতকিছু ঘটে গেল, অথচ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত একজন তেমন কিছুই জানতে পারেনি। কারণ সে তখন পূর্বে ছিল। সেখানকার সব দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিয়ে সে ফিরছিল সীমান্তের দিকে। প্রেমিকা রেনাটাকে দেখে ঠিক কেমন উচ্ছ্বসিত হবে, তা-ই ভাবছিল মনে মনে। যখন চেকপয়েন্টে এসে দাঁড়াল, তখন আচমকা দুপাশ থেকে দুজন লোক এসে তার কাঁধে হাত রাখল। বুঝতে আর বাকি রইল না, স্ট্যাসির লোকেদের কাছে ধরা পড়েছে সে। সেই ব্যক্তি ছিল ওল্ফডিটের।
প্রথমে তাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাকে স্ট্যাসির কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হোয়েনসেইনহাউজেন কারাগারে; পূর্বে যা সোভিয়েত ছিল। পরিত্যক্ত ছিল বলে এটাকে কাজে লাগিয়েছিল স্ট্যাসি।
তখন মধ্যরাত। আমাকে তন্নতন্ন করে তল্লাশি করলো ওরা। তারপর আমাকে কারাগারের পোশাক দেয়া হলো। এবং তারপর শুরু হলো প্রশ্ন, জিজ্ঞাসাবাদ এবং একের পর এক জেরা।
– ওল্ফডিটের স্টার্নহাইমার
পঞ্চাশের দশকে স্ট্যাসি কুখ্যাত ছিল তাদের শারীরিক নির্যাতনের জন্য। ষাটের দশকে তারা শারীরিক নির্যাতনের চাইতে মানসিক নির্যাতনের উপর বেশি জোর দিয়েছিল। নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করে কী করে বন্দীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হয়, সেই বিষয়ের উপর স্ট্যাসির নিজস্ব ছাপাখানা থেকে ছোট ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করা হতো। এছাড়াও স্ট্যাসির প্রাক্তন ও প্রবীণ অফিসাররা নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের একটা স্পেশাল কোর্সের মাধ্যমে এ বিষয়ে দক্ষ প্রশিক্ষণ দিতেন।
মানসিকভাবে যন্ত্রণা দেয়ার প্রথম ধাপটাই ছিল, তাদের এই বিশেষ কারাগার। কারাগারের কক্ষগুলোকে এমনভাবেই গড়ে তোলা হয়েছিল। অনেকটা বন্দীর আত্মাকে ধীরে ধীরে শুষে নেয়ার মতো যন্ত্রণা দেয়ার উদ্দেশ্যে। যেন বন্দী নিজের চোখেই নিজের মৃত্যু উপলব্ধি করতে পারে। কারাগারে কোনো কথা বলার কোনো অনুমতি ছিল না। কোনো গল্পগুজব নয়। কোনো ধরনের বিনোদন নয়।
এমনকি কারাগারের সেই সেলগুলোর ভেতরে, কোনোকিছুর উপরই বন্দীর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কক্ষের আলো জ্বালাবার সুইচটাও ছিল সেলের গরাদের বাইরে। এমনকি কমোডের ফ্ল্যাশের সুইচও ছিল বাইরেই। জানালার ফাঁক গলে দেখতে পাওয়া এক চিলতে আকাশ আর কারাগারের চার দেয়ালকে সঙ্গী করে নিতে বাধ্য হতো বন্দীরা। শূন্যতা, একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতার অভিশপ্ত আর বিকলাঙ্গ এক জীবন, বাধ্য হয়ে গ্রহণ করতে হতো তাদের।
আমার প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ একটানা ১২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। একটা দিনের অর্ধেকটা সময় জুড়ে আপনাকে কেবল প্রশ্নই করা হবে। এমনকি একটা সময় পরে, প্রশ্ন শুনতে শুনতে আপনার কান জ্বালা শুরু করবে। মাথাব্যথা শুরু হবে। আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন। তারা কিন্তু ভুলেও আপনার গায়ে হাত তুলবে না। আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? কোনো পানি নেই, কোনো খাবার নেই। কিচ্ছু নেই। কেবল ওরাই আছে প্রশ্ন নিয়ে, আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায়।
– ওল্ফডিটের স্টার্নহাইমার
ওল্ফডিটেরকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুলিপিটা ৫০ পৃষ্ঠা দীর্ঘ। জিজ্ঞাসাবাদকারী তাকে একাধিক প্রশ্ন করেছে এবং ঘুরেফিরে আবার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরই জানতে চেয়েছে বারবার। কয়েক ঘণ্টা এভাবেই কেটেছে। তারপর কিছুটা সময়ের বিরতি, তারপর আবার শুরু জিজ্ঞাসাবাদ। সেই একই প্রশ্ন, বারংবার। ধীরে ধীরে, ক্লান্তি, ক্ষুধা আর তৃষ্ণার কাছে মানসিকভাবে পরাজিত হয়ে সমস্ত কিছু বলে দেয় ওল্ফডিটের।
ওল্ফডিটের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। সে একাই সাজা পায়নি। সেদিন গ্রেফতার হওয়া অনেকেই সাজা পেয়েছিল। সেখানে থাকা মায়েরাও তাদের সন্তানদের থেকে পৃথক হয়ে সাজা পেয়েছিল।
দ্বিতীয় প্রচেষ্টা
অভিযান ব্যর্থ হয়েছে, অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে, কারাবন্দী হয়েছে বেশ কয়েকজন, কারাদণ্ড হয়েছে তাদের, সবকিছু শেষ। সব আশা, জল্পনা-কল্পনা ধূলিস্যাৎ। এতকিছু ঘটে যাবার পর এমনটা ভাবা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তবে এতকিছুর পরে নতুন করে আবার অভিযান শুরু করাটাই অস্বাভাবিক ঠেকে। হ্যাঁ, অস্বাভাবিকই বটে; তবে বাস্তবে এমনটাই ঘটেছিল।
তারা হাল ছেড়ে দিতে নারাজ ছিল। তারা খুব ভালোভাবেই জানত, স্ট্যাসির কাছে আসল সুড়ঙ্গটার ব্যাপারে কোনো তথ্যই নেই। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল, আবার শুরু করবে সবকিছু। এবার আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে। খুঁটিনাটি তথ্যের ব্যাপারেও বেশ কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। এমনকি খননকারী দলের লোকসংখ্যাও অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ইতোমধ্যেই মূল সুড়ঙ্গের জল শুকিয়ে আবারও শুকনো অবস্থা ফিরে এসেছে। পুনরায় কাজ শুরু করার জন্য যথেষ্ট ভালো অবস্থানে রয়েছে সুড়ঙ্গটা। কিন্তু অনতিবিলম্বেই, আরেকটা পাইপ ফুটো হয়ে যায়। তবে এবার তারা পূর্ব দিকে এতটাই সরে এসেছে যে, পশ্চিম জার্মানির পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষের আওতায় নেই সেই পাইপ বা ভূমি। এখন তাদের সামনে কেবল দুটো পথ খোলা। হয় তাদেরকে সুড়ঙ্গটা ছাড়তে হবে, আর নয়তো ওপাশের যেকোনো বেজমেন্ট ফুঁড়ে বের হতে হবে।
মানচিত্র দেখে খননকারীরা বুঝতে পারল, তারা বর্তমানে আছে শ্যুয়েনহোজ্জার স্ট্রিটের নিচে। এই সড়কটি পূর্ব বার্লিনের এতটাই কাছে যে, এখান দিয়ে নিয়মিত সীমান্তরক্ষীরা গাড়িতে করে টহল দেয়। তাই এখানে সুড়ঙ্গের কাজ করাটা একদমই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু তারা এতটাই সাহসী আর সংকল্পবদ্ধ ছিল যে, হাল ছাড়তে চাইলো না কেউ।
নতুন তারিখ নির্ধারিত হলো, ১৪ সেপ্টেম্বর। কিছু শিক্ষার্থী স্বেচ্ছায় পূর্ব দিকে গেল। সেখানে তারা পলায়নরত লোকজনদের নতুন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাল। কিন্তু আগেরবারের মতোই, পালানোর দিনে সীমান্ত পেরোনোর জন্য তাদের গুরুত্বপূর্ণ একজনকে দরকার। যে কিনা আবার পূর্ব বার্লিনারদের সংকেত দেবে, কখন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে হবে। যে হবে একজন বার্তাবাহক।
ওল্ফডিটেরের সঙ্গে যা ঘটেছে, তারপর আর কেউই তার স্থলাভিষিক্ত হতে রাজি ছিল না। অনেক খুঁজে কিংবা অনেক বুঝিয়েও কাউকে এ কাজ দেয়া সম্ভব হয়নি। শেষমেশ খননকারীদের একজন, মিম্মো তার নাম; সে জানায় তার পরিচিত এমন একজন আছে, যে এ কাজের উপযুক্ত। মিম্মোর ২১ বছর বয়সী প্রেমিকা অ্যালেন শ্যাও; যার কিনা ওল্ফডিটেরের মতোই পশ্চিম জার্মানির পাসপোর্ট আছে। সে চাইলেই পূর্ব জার্মানিতে যাতায়াত করতে পারে। মিম্মো তাই ধারণা করেছিল, এ সুবিধার পাশাপাশি একজন নারী হওয়াতে সন্দেহপ্রবণতাও কম থাকবে অ্যালেনের উপর। আর অ্যালেনও দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করেই কাজটি করতে রাজি হয়ে যায়।
পলায়নরত লোকেদের বলা হলো, তিনটি ভিন্ন মদের দোকানে যেতে এবং সেখানে অপেক্ষা করতে। যখন খননকারীরা বেজমেন্টের মেঝেতে উঠতে সক্ষম হবে, তখন অ্যালেন এই মদের দোকানগুলোতে যাবে। আর সেখানে অপেক্ষারতদের গোপন সংকেত দেবে। পূর্ব দিকে যাবার জন্য ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যালেনের একটা ছবি তোলা হয়েছিল। দারুণ একটা জামা পরা, মাথায় স্কার্ফ, চোখে সানগ্লাস- ষাটের দশকের নায়িকাদের মতো একদম। তখন দুপুরের সময়। স্টেশনে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে অ্যালেন।
এরই মধ্যে, জোয়াকিম আর হাসো শ্যুয়েনহোজ্জার স্ট্রিটের একটা অ্যাপার্টমেন্টের বেজমেন্টে হানা দেয়া শুরু করে। অবশেষে জোয়াকিম বেজমেন্টের মেঝেতে উঠতে সক্ষম হলো। এবং সঙ্গে করে নিয়ে আসা অনেকগুলো চাবির একটা দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের লবির দরজাটা খুলে ফেলল।
তারা যে অ্যাপার্টমেন্ট দিয়ে বের হচ্ছে, সেটার নাম্বার কত, এটা জানা জরুরি ছিল। প্রথমেই সে হলঘরে গেল। সেখানে কোনো নাম্বার চোখে পড়ল না। শেষমেশ সে বুঝতে পারল, এটা জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনের সড়কে গিয়ে দাঁড়ানো, কারণ, সব অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশমুখেই একটি নাম্বারবোর্ড থাকে। কিন্তু সীমান্তরক্ষীর বাহিনী দিয়ে ভর্তি সড়ক। তাও- সাহস সঞ্চার করে মূল দরজাটা খানিকটা ফাঁক করল সে। এক চোখ দিয়ে দেখা যায়, এতটুকু ফাঁক।
অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই একটা চালাঘরের মধ্যে কয়েকজন সীমান্তরক্ষী আছে। কিন্তু তাদের মনোযোগ এই অ্যাপার্টমেন্টের দিকে নয়। জোয়াকিম ঠিক এই সুযোগটাই নিল। চোখের পলকে সে সড়কে নেমে এল এবং পলক পড়ারও আগেই সে দরজা গলে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে।
দরজার ঠিক উপরেই বড় করে সাত সংখ্যাটা লেখা ছিল।
– জোয়াকিম রুডলফ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত টেলিফোন দিয়ে তারা বাকি দলের কাছে একটা বার্তা পাঠিয়ে দিল। যারা পশ্চিম বার্লিনের একটা ফ্ল্যাট থেকে প্রাচীরের উপর নজর রাখছিল। জানালাতে একটা সাদা কাপড় টাঙিয়ে দেয়া হলো; অ্যালেনকে সংকেত দেয়া হলো যে, পালানো শুরু হয়েছে। পূর্ব দিক থেকে অ্যালেন সেই কাপড় দেখে সোজা প্রথম পাবে* চলে গেল সংকেত দিতে।
ওখানে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। যখন আমি ভেতরে ঢুকলাম, সবাই ঘুরে ঘুরে আমাকেই দেখছিল। কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার সংকেত দেয়ার জন্য এক প্যাকেট দেয়াশলাই কেনার কথা ছিল। আমি তাই সোজা হেঁটে বারের কাউন্টারে গেলাম; আর তখন লক্ষ্য করলাম যে, আসলে সেই লোকগুলো সব আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।
– অ্যালেন শাও
টেবিলে বসা তাদেরকে দেখে মনেই হয় যে, এক পরিবারের সদস্য সবাই। মা একটা আঁটোসাঁটো জামা আর হাই হিলের জুতো পরা। আর বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। অ্যালেন বেশি সময় নষ্ট না করে এক প্যাকেট দেশলাই কিনল এবং বের হয়ে চলে গেল। পরের পাবে গিয়ে সে এক গ্লাস পানি চাইল, এটা ছিল তার পরবর্তী সংকেত।
অবশেষে গেল শেষ পাবে। কিন্তু ভেজালটা বাধল ঠিক এখানে এসেই। এখানে তার সংকেত দেয়ার কথা ছিল এক কাপ কফি অর্ডার করার মাধ্যমে। কিন্তু ওয়েটার এসে জানিয়ে গেল; কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেদিন কফি তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেছে। অ্যালেন বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কেননা, কফি অর্ডার দেয়া ব্যতীত অন্যকিছুর কথা তাকে বলা হয়নি। ওদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে।
আমি ভালো রকমের ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছিলাম তখন। কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পাবে যদি কফিই না থাকে, তাহলে আমি কী করব আর সংকেতই বা দেব কীভাবে?
– অ্যালেন শাও
কী করবে, তা বুঝতে না পেরে, কফি নেই কেন, তা নিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলতে লাগল অ্যালেন। বারংবার কফি শব্দটা উচ্চস্বরে বলল যেন তারা শুনতে পায়। এবং শেষমেশ একটা কনিয়াক* অর্ডার করল। সে বসেই কনিয়াকটা পান করল আর পেছন ঘুরে তাকাল। সেখানে দুটো পরিবার বসা ছিল। সে আশা করল, তারা হয়তো সংকেতটা বুঝতে পেরেছে। তার কাজ শেষ। সে বের হয়ে গেল।
পশ্চিম বার্লিনে ফিরে সে দেখতে পেল, শ্যুয়েনহোজ্জার স্ট্রিটে ছোট ছোট দলে বিভক্ত লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে। তারা এমনভাবে চলার চেষ্টা করছিল, যেন বোঝা না যায়। জোয়াকিম আর হাসো বন্দুক হাতে অ্যাপার্টমেন্টে অপেক্ষা করছিল। ছয়টা বাজার একটু পর তারা পায়ের শব্দ শুনতে পেল। দরজা খুলে গেল। প্রথম পাব থেকে আসা থাকা সেই মা, এভিলিন স্মিডট, নিজের স্বামীসমেত দুই বছরের কন্যাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে সুড়ঙ্গে নামিয়ে দেয়া হলো।
কুচকুচে কালো আর গাঢ় অন্ধকার। ঢোকার মুখে কেবল একটা বাতি জ্বালানো ছিল। টানেলারদের মধ্যে একজন আমার বাচ্চাটাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেল। আর তারপর শুরু হলো আমার হামাগুড়ি দেয়া।
– এভিলিন স্মিডট
একটা ভিডিও ফুটেজ, কোনোকিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটানা দীর্ঘ সময় ধরে ফুটেজের মধ্যে অন্ধকার দলা পাকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে যেন। সেই অন্ধকার থেকেই আচমকা একটা সাদা হ্যান্ডব্যাগ উঠে এলো। তারপর একটা হাত। আর সবশেষে সেই অন্ধকার গলে বেরিয়ে এলো এভিলিন। পশ্চিম প্রান্তে সুড়ঙ্গ খাদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এনবিসির চিত্রধারণের কর্মকর্তারা এমনটাই বিবরণ দিয়েছিলেন।
কাদায় পুরো শরীর মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল এভিলিনের, জামার কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে, আর পা জোড়া খালি। সুড়ঙ্গের কোথায়ও হয়তো তার জুতো জোড়া হারিয়ে গেছে। হামাগুড়ি দিয়ে আসতে সর্বমোট ১২ মিনিট সময় লেগেছিল। প্রথমেই মুখ তুলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়েছিল সে। আলোর ঝলকানি সহ্য করতে চোখ পিটপিট করছিল অনবরত। চোখটা সয়ে এলে মই বেয়ে বেজমেন্টে উঠে এলো এভিলিন। উপরে ওঠামাত্রই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল।
এনবিসির একজন ক্যামেরাম্যান তাকে ধরে ফেলল এবং একটা বেঞ্চে নিয়ে বসাল। এভিলিন বসল সেখানে, কিছুটা শান্ত হয়েছে; কিন্তু শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর। খানিক বাদেই একজন টানেলার তার বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে এলো। মেয়েটাকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে আগলে ধরল এভিলিন। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো এভিলিনের গহীন থেকে। যেন চাপা আতঙ্কটা বেরিয়ে এলো। আর একইসঙ্গে মুক্তির প্রশান্তিটাও তাকে শিহরিত করল যেন।
পরের কয়েক ঘণ্টায় আরো অনেক মানুষ এল সুড়ঙ্গ বেয়ে। হাসোর বোন অ্যানিটা থেকে শুরু করে আরো অনেকেই ৮ বছর বয়সী, ১৮ বছর বয়সী কিংবা ৮০ বছর বয়সী। ১১টা নাগাদ তাদের তালিকায় থাকা সকলেই একে একে চলে এলো।
ইতোমধ্যে সুড়ঙ্গটা জলে ভরে উঠতে শুরু করেছিল। অনেকটা জল ভরে যাবার পরও একজন খননকারী তখনও অপেক্ষায় ছিল। লোকটার নাম ছিল ক্লউজ। সে আশায় ছিল, যদি তার স্ত্রী ইঙ্গনা চলে আসে, আর তাকে না পায়। তার সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করাতে ইঙ্গনাকে কমিউনিস্ট কারাগার শিবিরে প্রেরণ করা হয়েছিল। তখন ইঙ্গনা গর্ভবতী ছিল এবং সেটাই ছিল ক্লউজের সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাত।
এনবিসির ফুটেজ চলছে। আগের মতোই দলা পাকানো অন্ধকারের দিকে ক্যামেরা ফোকাস করা। এবার আর কোনো হ্যান্ডব্যাগ কিংবা হাত নয়; বরং জলজ্যান্ত এক নারীকে দেখতে পাওয়া গেল। ক্লউজ নিজের হাত বাড়িয়ে দিল, কিন্তু সেই নারী সাহায্য নিল না। অন্ধকারে পুরুষটাকে ঠিক চিনে উঠতে পারেনি নারীটা। পুরুষটাও নিজের পরিচয় না দিয়েই অন্ধকারে নারীটাকে উপরে উঠতে সাহায্য করল। আর তারপরই সুড়ঙ্গ থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল।
কান্নার আওয়াজ। একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ। সাদা পোশাকে থাকা একটা বাচ্চা কাঁদছে। একজন সুড়ঙ্গ খননকারী বাচ্চাটাকে আগলে ধরে এগিয়ে আসছে। আবছা আলোতে বাচ্চাটাকে দেখা যায়। অনেক ছোট মাত্র পাঁচ মাস বয়সী; একটা ছেলে বাচ্চা। ক্লউজ ঝুঁকে গেল সামনের দিকে, আলতো করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল সে, খাদের কাছে থাকা কারো হাতে তুলে দিল সতর্কতায়। ক্লউজের চোখে অশ্রু। দুঃখের নয়, আনন্দের। এই পাঁচমাস বয়সী ছেলে শিশুটা তারই সন্তান। কমিউনিস্ট কারাগারে জন্ম নেয়া তার আর ইঙ্গনার সন্তান।
অপর প্রান্তে, পূর্ব দিকে, জোয়াকিম তখনও বেজমেন্টে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে ২৯ জন মানুষ এই সুড়ঙ্গ ধরে চলে গেছে। সুড়ঙ্গে এখন পানি হাঁটু সমান। যাওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়।
আমার মাথায় তখন অনেক চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই সুড়ঙ্গ খনন করতে গিয়ে আমরা যেসব কিছুর মধ্য দিয়ে গেছি; পাইপের ফুটো, বৈদ্যুতিক শক, কাদায় মাখামাখি, হাতে পরা ফোস্কা। সবকিছু তখন কেমন যেন ঘোরলাগা মনে হচ্ছিল আমার কাছে। এই যে এতগুলো মানুষ পার হতে পারল, তারা নতুন জীবন পেল, মুক্ত জীবন পেল; এই ব্যাপারটা তখন আমাকে যে কি পরিমাণ সুখী করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশের কোনো ভাষা আমার জানা নেই।
– জোয়াকিম রুডলফ
কয়েকমাস পরে এনবিসির ফুটেজটি সম্প্রচার করা হয়। কূটনৈতিক সাংঘর্ষিকতার আতঙ্কে রাষ্ট্রপতি কেনেডি কর্তৃক হোয়াইট হাউজ দ্বারা এর সম্প্রচার আটকে দেয়ার চেষ্টাও করা হলেও শেষমেশ এটি সম্প্রচার করা হয়। টেলিভিশন সাংবাদিকতার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। সুড়ঙ্গ খননকারীদের উদ্দেশ্য করে রাষ্ট্রপতি কেনেডি জানান, তিনি নিজে পুরো ফুটেজ দেখেছেন এবং কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একইসঙ্গে তাদেরকে তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। এনবিসির ফুটেজটি বর্তমানে আর্কাইভে রাখা। শুরুতে সম্প্রচারিত হলেও পরবর্তী সময়ে মিডিয়া থেকে তুলে নেয়া হয়েছিল ফুটেজটি। তবে অনেক তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে এই সুড়ঙ্গকে কেন্দ্র করে। তারই একটা পাঠকদের জন্য দেয়া হলো।
অতঃপর গল্পের সমাপ্তি
দুঃসাহসিক অভিযানের তো সমাপ্তি হলো। কিন্তু সেই দুর্ধর্ষ লোকগুলোর কী হলো শেষে? ওল্ফডিটের, যে কিনা স্ট্যাসির কাছে ধরা পড়ে কারাগারে গিয়েছিল, দু’বছর পর মুক্তি পেয়েছিল। উঝেকে স্ট্যাসির সম্মানজনক পদবী এবং মেডেল দেয়া হয়েছিল সুড়ঙ্গে অনুপ্রবেশ এবং সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য। ওল্ফ শ্রয়েডার এবং হাসো হার্শেল অন্য আরো কয়েকটা সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ করেছিল পরবর্তী সময়ে। মিম্মোর প্রেমিকা অ্যালেন, সাহসী সেই সংবাদবাহক, নিজের এই দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতাকে ছাপার অক্ষরে পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছিল।
কিন্তু মূল মানুষটার কী হলো? মূল উদ্ভাবক জোয়াকিম রুডলফের কী হয়েছিল? এখনও একটা গল্প বলা বাকি আছে। পালিয়ে যাবার কয়েক বছর পর, সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে আসা প্রথম নারী, এভিলিনের প্রেমে পড়ে যায় সে। এভিলিনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। পালিয়ে যাবার ১০ বছর পর এভিলিন আর জোয়াকিম বিয়ে করে।
বর্তমানে তারা যে অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করে, সেটার দেয়ালে এক জোড়া জুতো ঝুলানো আছে। যেটা পালিয়ে যাবার কয়েক দিন পরই তারা সংগ্রহ করেছিল। সুড়ঙ্গে খুঁজে পাওয়া সেই জুতো জোড়া যে এভিলিনের মেয়ে অ্যানেটের, সেই সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না জোয়াকিমের। যে সুড়ঙ্গ জোয়াকিম তৈরি করেছিল, যেটা ২৯ জন পূর্ব পাশের শরণার্থীদের নতুন জীবন দিয়েছে, সেই সুড়ঙ্গ জোয়াকিমকে একটা পরিবারও এনে দিয়েছিল।
আর প্রাচীরটার কী হয়েছিল অবশেষে? বার্লিন প্রাচীর! দুই আদর্শবাদীদের দম্ভের দেয়ালটা?
১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে বার্লিন প্রাচীর পতনের আগ অবধি কমপক্ষে ১৪০ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। পরের বছর ৩ অক্টোবর দুই আদর্শবাদীদের হাত থেকে রেহাই পায় বার্লিন, তথা পুরো জার্মান। দুই জার্মানি পুনরায় একত্র হয়। বর্তমানে আরো অনেক প্রাচীরই গড়া হয়েছে, অনেক শহরই দ্বিখণ্ডিত হয়েছে; এমনকি খণ্ডিত হয়েছে অনেক দেশও। কিন্তু জোয়াকিমের মতে, সেগুলোর সবক’টাতেই একটা নির্দিষ্ট সাধারণ বিষয় রয়েছে।
যেখানেই প্রাচীর গড়ে উঠুক না কেন, মানুষ সবসময়ই এটাকে টপকাতে চেয়েছে, চাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও চাইবে। কিংবা এটাও বলা উচিত, কেউ কেউ এর নিচ দিয়ে ওপারেও যেতে চাইবে, হয়তো।
টীকা:
*পাব – বার বা মদের দোকান, তবে নির্দিষ্ট কিছু খাবারেরও পাওয়া যায়।
*কনিয়াক – ফরাসী ব্র্যান্ডি।