১৯৬৪ সালের একটি সুন্দর শীতের সকাল। কুয়াশা কেটে গিয়ে মিষ্টি রোদ্দুরের দেখা মেলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দক্ষিণ ভারতের তিরুচিরাপল্লীবাসী। এমনি এক সকালে চিন্নাস্বামী নামের এক তামিল ব্যক্তি হাতে একটি পাত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। পেছনে রেখে গেলেন তার বৃদ্ধা মা, প্রিয়তমা স্ত্রী আর আদরের শিশুকন্যাকে। হাঁটতে হাঁটতে শহরের রেল ষ্টেশনটির কাছে গিয়ে পৌঁছালেন তিনি। সেখানে পৌঁছেই হাতের পাত্রটি থেকে পেট্রোল ঢেলে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন। শেষ মুহূর্তে তার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে যা বললেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, “তামিল জিন্দাবাদ, হিন্দি নিপাত যাক”।
চিন্নাস্বামীর পরপর এমন আরো কয়েকটি আত্মহুতির ঘটনা ঘটে তামিলে, যারা কেবলমাত্র নিজেদের মাতৃভাষার জন্য আত্মহুতি দিয়েছিলেন। ইতিহাসে ভাষার দাবীতে আন্দোলনের দৃষ্টান্ত থাকলেও এমন আত্মহুতি দেয়ার মতো ঘটনা আর দ্বিতীয়টি নেই। হিন্দি আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানাতে যে দৃষ্টান্ত তামিলরা স্থাপন করেছিল, তা সত্যিকার অর্থেই অবিস্মরণীয়।
আসলে ভাষা স্রেফ মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমই নয়। একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতির মর্মবেগ লীন হয়ে থাকে তাদের মাতৃভাষার পরতে পরতে। তাই যখনই কোনো গোষ্ঠী সেই জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভুত্ব করতে চায়, তাদের প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপরে। একটি জাতির স্পিরিটকে নষ্ট করে দিয়ে আগে তাদের মানসিকভাবে গোলাম বানানোর উদ্দেশ্যে শুরু হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আর এই আগ্রাসনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে ভাষা।
এই ভাষাগত আগ্রাসনের স্বরূপ বাংলাদেশীদের চেয়ে কারও ভালো জানার কথা নয়। বায়ান্নতে আমরা দেখেছি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কীভাবে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল আমাদের ওপর। সেদিন বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে মেনে নেয়া হতো আমাদের জাতিগত আত্মহত্যার শামিল। ভাষা হারানোর সাথে আমাদের বিসর্জন দিতে হতো আমাদের আত্মপরিচয়।
মূলত শোষকগোষ্ঠীর চরিত্র সব জায়গায় একইরকম। এই ভাষাগত আগ্রাসনের দেখা মেলে নানা জাতির সম্মিলনে গঠিত ভারতেও। ভারতের শাসনকেন্দ্র দিল্লীভিত্তিক হওয়ায়, তাদের ভাষা হিন্দির আগ্রাসনের শিকার হতে হয়েছে অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষাগুলোকে। কিন্তু সব জাতি এটি সহজে মেনে নেয়নি। হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিলনাড়ু বা দক্ষিণ ভারতীয়দের প্রতিরোধ আন্দোলন একসময় ইন্ডিয়ান ইউনিয়নকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলো। সে আন্দোলনের ইতিহাসই বলা হবে আজকের লেখায়।
সমস্যাটা শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতারও পূর্বে। ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের শেষ দশকে এসে বৃটিশরা স্থানীয় প্রদেশিক সরকার গঠনের অনুমতি দেয়। তখন তামিলনাড়ু ছিল মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত। ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে রাজাগোপালচারীর অধীনে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। সেসময় স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান করার জন্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ চিন্তা করেন যে, সমগ্র ভারতে একটি ভাষা প্রচলিত হলে ভারতবাসীর মধ্যে একতা বাড়বে। তারা সমগ্র ভারতে হিন্দি ভাষা প্রচলন করার পরিকল্পনা করেন।
রাজাগোপালচারী সর্বপ্রথম তামিলদের ওপর হিন্দি আরোপ করার প্রচেষ্টা চালান। তার সরকার তামিল স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে হিন্দি অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করে। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে তামিলরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কেননা হিন্দি তাদের ভাষা নয়। তামিল ভাষার মতো হিন্দি স্রেফ অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষা। দক্ষিণ ভারতে হিন্দির অনুপ্রবেশ ঘটতে দেয়ার অর্থ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে উত্তর ভারতের আধিপত্যের কাছে মাথা নত করা।
৩ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে রাজাজির বাসভবনের সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা জড়ো হয়ে এ পরিকল্পনা বাতিল করার দাবী জানায়। সেখান থেকে প্রায় ১,২৭০ জন আন্দোলনকারী গ্রেফতার হয়। এর মাধ্যমেই মূলত শুরু হয় দশকের পর দশকব্যাপী চলমান তামিলদের হিন্দি আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলনের।
কিন্তু তামিলদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার হিন্দিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে তামিলদের হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয়। তামিল দেশপ্রেমিকদের নিয়ে গঠিত হয় ‘এন্টি-হিন্দি কমান্ড’। মিছিল, মিটিং জনসভা ইত্যাদি কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রতিবাদমুখর তামিলরা তাদের দাবি জানাতে থাকে। এমনকি এক সভায় তামিল নেতা ই. ভি. রামাস্বামীতো বলেছিলেন তামিলদের স্বাধীনতা দাবী করা উচিৎ। লাখো মানুষের করতালির মাঝে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “তামিলনাড়ু ফর তামিলস”।
১৯৩৯ সালে এসে দুই আন্দোলনকারী পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুবরণ করলে তামিলদের এ আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে তুমুল আন্দোলনের মুখে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী সরকার হিন্দিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানোর সিদ্ধান্ত রদ করে। কিন্তু কংগ্রেস সরকার সাময়িকভাবে পিছু হটলেও ক্ষান্ত হয়নি। এরপর ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালে আরো দু’বার তারা দক্ষিণ ভারতের স্কুল পাঠ্যক্রমে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করে। এবং দু’বারই তামিলদের তীব্র আন্দোলনের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তবে তামিলদের আসল সংগ্রাম শুরু হয় স্বাধীনতার পর। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর কংগ্রেস সমগ্র ভারতের ক্ষমতায় আসে। কেন্দ্রীয় এবং সকল প্রাদেশিক পর্যায়ে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। আবার শুরু হয় হিন্দি আগ্রাসন। অন্য ভাষাভাষী প্রদেশগুলোতে তারা হিন্দি আরোপ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। আবারো হিন্দিকে বাধ্যতামূলক হিসেবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তামিলদের প্রতিবাদের মুখে এবার প্রশাসন তাদের অবস্থানে অনড় থাকে।
সবচেয়ে বড় ঝামেলা বাধে ভারতের সংবিধান গঠন করার সময়। অন্য ভাষাভাষী নেতৃবৃন্দের তুমুল বিরোধীতা সত্ত্বেও কংগ্রেস সরকার ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দিকে গোটা দেশের প্রধান দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করে। এছাড়াও সিদ্ধান্ত হয় পনের বছর পর ইংরেজি বাদ দিয়ে একমাত্র হিন্দিকেই দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে। ভারতের এ সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি। সে হিসেবে ১৯৬৫ সালের একই দিন থেকে হিন্দি হয়ে উঠবে গোটা ভারতের রাষ্ট্রভাষা।
হিন্দি ছিল কেবলমাত্র একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা। দক্ষিণ ভারতীয়রা এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছিলো তা তাদের নেতা আন্নাদুরাই এর কথা থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেছিলেন,
“একটি অঞ্চলের ভাষাকে গোটা দেশের উপর চাপিয়ে দেয়া সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী আচরণ। আমি বিশ্বাস করি যে, এটি একটি অঞ্চলের মানুষের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে। এর ফলে হিন্দি ভাষাভাষীরা আমাদের উপর কর্তৃত্ব করবে। নিজ দেশে আমাদের অবস্থা হবে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো।”
গোটা পঞ্চাশের দশক জুড়ে ভাষা নিয়ে সরকার ও তামিলদের মধ্যে এ দ্বন্ধ বেধেই ছিল। একের পর এক ছোটখাটো বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে একটি ফুঁসতে থাকা আগ্নেয়াগিরির অস্তিত্ব বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। ষাটের দশকের শুরু থেকেই সরকার হিন্দিকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তখন তামিলদের আন্দোলন আবার তীব্রতর হয়ে উঠে।
১৯৬০ সালে তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক সংগঠন Dravida Munnetra Kazhagam (DMK) এর অধীনে এক হিন্দি বিরোধী সমাবেশে প্রায় এক লাখ লোক জমায়েত হয়। এমন পরিস্থিতি দেখে নেহেরু দ্রুত তামিল নেতৃবৃন্দের কাছে বার্তা পাঠান যে, হিন্দি আগ্রাসন বন্ধ হবে। অন্য ভাষাভাষীরা যতদিন না চাইবে ততদিন হিন্দি একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে না।
কিন্তু নেহেরুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হলে পরিস্থিতি আবার আগের মতো হয়ে যায়। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নিজেই কট্টরভাবে হিন্দি আরোপের পক্ষে ছিলেন। যার ফলে ২৬ জানুয়ারী ১৯৬৫ তে হিন্দিকে একমাত্র সরকারী ভাষা করার তোড়জোড় ভালোভাবেই চলতে থাকে। বলা যায় এ পর্যায়ে এসেই তামিলদের ভেতর ফুঁসতে থাকা আগ্নেয়াগিরির চরম বিস্ফোরণ ঘটে, যা হতচকিত করে দেয় গোটা বিশ্বকে।
প্রথমে বর্ণিত চিন্নাস্বামী ও আরো ছয়জনের আত্মত্যাগের ঘটনা এ পর্যায়েই সংঘটিত হয়। পত্রপত্রিকায় এ ঘটনাগুলো প্রচারিত হলে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়। তামিলনাড়ুতে আন্দোলনের তীব্রতা দিনদিন বেড়েই চলছিল। ১৯৬৫ সালের ২৬শে জানুয়ারী ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসকে তামিলরা শোক দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৫শে জানুয়ারী এ উপলক্ষ্যে আয়োজন করা তামিল ছাত্রদের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরকারী দলের ইন্ধনে ট্রেড ইউনিয়নের কর্মীরা অস্ত্রসস্ত্র সহ আক্রমণ করে। এতে অনেক সাধারণ ছাত্র হতাহত হয়।
এমন সংঘর্ষ দ্রুতই গোটা শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ অ্যাকশনে গেলে তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় রাজেন্দ্র নামের এক ছাত্র। একের পর এক এমন ঘটনার জের ধরে বিশৃঙ্খলা চরমে উঠে, উত্তেজিত জনতা পোস্ট অফিস, রেলস্টেশন, টেলিগ্রাফ অফিস ভাঙচুর শুরু করে। একসময় পুলিশের ওপরও আক্রমণ শুরু হয়। এমনকি একদল জনতা দুজন পুলিশকে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির এমন চরম অবনতি ঘটলে সরকার তামিলনাড়ুতে আধাসামরিক বাহিনী নামিয়ে দেয়।
এভাবে জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় রূপ নেয়। ২৭ জানুয়ারী থেকে শুরু করে এ দাঙ্গা ১৩ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত চলমান থাকে। চলতে থাকে সামরিক বাহিনীর সাথে তামিল দেশপ্রেমিক জনতার সংঘর্ষ। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর হিসেবে এ দাঙ্গায় নিহত হয় ৬৩ জন তামিল নাগরিক। তবে অনেকের মতে মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেছে। অবশেষে জোরপূর্বক এ আন্দোলন দমন না করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কথা দেন তারা হিন্দি আগ্রাসন বন্ধ করবেন এবং নতুন করে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে তামিল জনতা তাদের আন্দোলন বন্ধ করেন। ১ আগস্ট ১৯৬৮ সালে ভারত সংসদ ‘লুকওয়ার্ম ল্যাঙ্গুয়েজ এক্ট’ পাশ করে। তবে এটি তামিলদের প্রত্যাশা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে পারেনি। অহিন্দি প্রদেশগুলোতে হিন্দি আগ্রাসন এখনও চলছে নানা রূপে। বস্তুত হিন্দি আগ্রাসন নয়, বলা উচিৎ উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কারো কারো মতে যা, দ্রাবিড়দের প্রতি আর্যদের আধিপত্যবাদীতার প্রকাশ।