Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টিনটিন আর হার্জ: চিরতরুণ অ্যাডভেঞ্চারার এবং তার স্রষ্টার গল্প

তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি। মায়ের সাথে ঢাকার নিউ মার্কেটের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে চোখ পড়ল রাস্তায় সাজিয়ে রাখা বইয়ের দিকে। বড় সাইজের চকচকে একটা কমিকস দৃষ্টি কেড়ে নিল। একটু এগিয়ে গিয়ে খেয়াল করে দেখলাম বইয়ের নাম “চাঁদে টিনটিন”, লেখক হার্জ।

হালকা চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ কমিকসের ব্যাপারে আমার দৌড় চাচা চৌধুরী আর নন্টে-ফন্টে পর্যন্তই। টিনটিন এর নাম শুনিনি তখনও। কিন্তু বইটা আমাকে টানছিল চুম্বকের মতো। তাই মায়ের পেছনে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান জুড়ে দিলাম। আমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি দোকানদারের সাথে দাম করে জানতে পারলেন টিনটিনের দাম পঁচাত্তর টাকা। তখন এটা আসলে অনেক টাকা। আমি যে বই কিনতাম সেগুলোর দাম এর অর্ধেকের থেকেও কম। তবে শেষ অবধি আমার জেদের জয় হলো। হাসিমুখে টিনটিনকে বগলদাবা করে বাসায় ফিরলাম। পাতা উল্টে ডুবে গেলাম রহস্য, কমেডি আর অ্যাডভেঞ্চারের এক আশ্চর্য জগতে। গোগ্রাসে শেষ করলাম পুরো বই। যদিও আগে থেকে টিনটিনের সাথে পরিচয় ছিল না, এবং চাঁদে অভিযান ছিল এর পূর্ববর্তী কাহিনীর দ্বিতীয় ও শেষ অংশ, তথাপিও বইয়ের মজা আহরণ করতে কষ্ট হয়নি।

সেই থেকে শুরু। টিনটিনের বই কেনা হত সুযোগ পেলেই। এর দাম অবশ্য একটা বড় বাধা ছিল। পঁচাত্তর থেকে আরম্ভ করে আমার যতদূর মনে পড়ে টিনটিনের দাম একশ তিরিশ-চল্লিশ টাকায় গিয়ে ঠেকেছিল। তবে এতগুলো টাকা খরচ করেও কখনও আফসোস হয়নি। ছোটবেলার সময়টা রঙিন করতে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি টিনটিনের অবদানও কম ছিল না।

এক শিল্পীর আবির্ভাব

কমিক স্ট্রিপ বা ধারাবাহিক আঁকার মাধ্যমে কাহিনী বলার মাধ্যমকে ফ্রেঞ্চরা বলত বন্ড ডেসিনে (bande dessinée)। এর একজন অগ্রদূত জর্জে রেমি। অনেক কমিক চরিত্রের স্রষ্টা হলেও তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত টিনটিনের লেখক হিসেবেই। হার্জ ছদ্মনামে লেখা তার টিনটিন সম্ভবত সর্বকালের বিখ্যাত কমিকসগুলোর অন্যতম।

টিনটিনের স্রষ্টা জর্জে রেমি © AFP

 

হার্জের জন্ম ২২ মে, ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাসেলসে। তার বাবা অ্যালেক্সিস আর মায়ের নাম এলিজাবেথ। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তিনি যা আঁকাআঁকি শিখেছিলেন তা নিজে নিজে, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা হার্জ সেভাবে গ্রহণ করেননি। ১৯২০ সালে তিনি সেন্ট বনিফেস কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই তিনি বেলজিয়ামের সেইন্ট বনিফেস বয় স্কাউট দলের সদস্যপদ নেন।

এই সময় স্কাউটদের যে আদর্শ ও মূল্যবোধ তার মধ্যে গেঁথে যায় তার প্রভাব পরে টিনটিনের মধ্যেও পড়েছিল। সতীর্থরা আঁকাআঁকির কথা জানতে পারলে তাদের চাপাচাপিতে তিনি দলের ম্যাগাজিন জ্যামেই অ্যাসেজ (Jamais assez /Never Enough) এ কিছু ড্রয়িং করেন। এখান থেকেই ব্রাসেলসের স্কাউটদের প্রধান রেনে ওয়েভারবার্গের তার প্রতিভা চোখে পড়ে। ১৯২৩ সাল থেকে তিনি স্কাউটদের জাতীয় ম্যাগাজিন ল্যু বয়-স্কাউট বেলজি’তে আঁকা শুরু করেন। ১৯২৪ সালে হার্জে এক মজার কাণ্ড করলেন। নিজের নাম উল্টে দিলেন তিনি। জর্জে রেমি হলো রেমি জর্জে। সেখান থেকে প্রতিটি অংশের প্রথম অক্ষর নিয়ে তার লেখায় স্বাক্ষর করলেন আর জে  নামে। ফরাসি ভাষায় এর উচ্চারণ হলো হার্জ। তার আসল নাম চাপা পড়ে যায় এই হার্জের তলে।

১৯২৬ সালে ল্যু বয়-স্কাউট বেলজি’তে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কমিক স্ট্রিপ-“দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ টোটর”। তখন তার বয়স উনিশ। ১৯২৯ সালের জুলাই পর্যন্ত টোটর সদর্পে ম্যাগাজিনের পাতায় বিচরণ করে। টোটরই এক অর্থে টিনটিনের আদিরূপ। অল্পবয়সী, খানিকটা স্থূলকায় টোটরকেই পরবর্তীতে হার্জ পরিমার্জিত করে রূপ দেন দুঃসাহসী টিনটিনে। টিনটিনের মতো টোটরের সঙ্গীও ছিল একটি কুকুর। হার্জ পরে নিজেই স্বীকার করেছেন টিনটিনকে তিনি টোটরের ছোট ভাই হিসেবে চিন্তা করেছিলেন। টিনটিনের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে ভাই বেলজিয়ান আর্মি অফিসার পল রেমির কথা তার মাথায় ছিল বলেও হার্জ বিভিন্ন সময় বলেছেন।

অ্যাডভেঞ্চারস অফ টোটর; Image Source:skynet.be

 

টিনটিনের উত্থান

১৯২৫ সালে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে হার্জ চাকরি নেন ক্যাথলিক ডানপন্থী মতবাদের ল্যু ভিঙশিয়েম সিক্ল (Le Vingtième Siècle) পত্রিকায়।সেখানে বিজ্ঞাপন বিভাগে তার দায়িত্ব ছিল। বেলজিয়ামের নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হত। ১৯২৬ সালে হার্জে তা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি আবার এই পত্রিকাতে যোগ দেন। এবার তার হাতে তুলে দেয়া হল ল্যু পেটি ভিঙশিয়েম (Le Petit Vingtième) এর ভার, যা শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত নিয়মিত একটি সংখ্যা। এখানে তিনি লিখতে থাকেন নতুন এক স্ট্রিপ “অ্যাডভেঞ্চার অফ ফ্লাপ, নেনেস, পসেট আর কচোনেট”।

কিন্তু হার্জ এই স্ট্রিপ লিখতে বিশেষ উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। সেই সময় ফরাসি কমিকসে ক্যাপশন দিয়ে সংলাপ ব্যবহার করা হত। বেলুনের আকৃতির ভেতর সংলাপ লিখে (স্পিচ ব্যালুন) চরিত্রের সাথে জুড়ে দেয়ার প্রথা তখন আমেরিকান কমিকসে চালু হয়েছে। এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ১৯২৯ সালে তিনি চালু করলেন অ্যাডভেঞ্চারস অফ টিনটিন। জানুয়ারির দশ তারিখ থেকে শুরু হয়ে পরের বছর মে মাসের আট তারিখ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ধারাবাহিকভাবে ল্যু পেটি ভিঙশিয়েমে প্রকাশিত হলো এই কমিকস।

এরপর পুরো কাহিনী একত্রিত করে বই প্রকাশিত হল সোভিয়েত রাজ্যে টিনটিন (Tintin au pays des Soviets/Tintin in the Land of the Soviets) নামে। অল্পবয়সী তরুণ রিপোর্টার টিনটিন, যার মাথার সামনের দিকে উঁচু হয়ে আছে একগুচ্ছ চুল, খুব দ্রুতই প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আন্তর্জাতিকভাবেই হার্জে পরিচিত হয়ে উঠলেন। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত দু’হাতে এঁকে গেলেন একের পর এক টিনটিন কমিকস। এর মধ্যে ১৯৩২ সালে তিনি বিয়েও করে ফেলেন। স্ত্রী কিকেন্স ছিলেন তার পত্রিকার পরিচালকের সেক্রেটারি।

সোভিয়েত রাজ্যে টিনটিন; Image Source:leazeltserman.com

 

প্রথমদিকে হার্জ টিনটিনের একেকটি কাহিনী লিখতে প্রায় এক বছর সময় নিতেন। এই সময় তার লক্ষ্য ছিল দ্রুত এঁকে যাওয়া। কাহিনীর খুঁটিনাটি আর বাস্তবতা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। প্রথমদিকের টিনটিনের কাহিনীর আঁকাও পরবর্তী সংখ্যাগুলোর মতো পরিচ্ছন্ন ছিল না। তবে পরবর্তীতে রঙিন আকারে পুরনো টিনটিন কাহিনীগুলো পুনরায় প্রকাশের আগে হার্জ বেশ পরিমার্জন করেন। এই সময় তার লেখায় ঔপনিবেশিক ভাবধারারও প্রতিফলন ঘটত। কঙ্গোতে টিনটিন গল্পের এক অংশে দেখা যায় টিনটিন স্থানীয় ছাত্রদের ভূগোলের ক্লাসে বলছে “আজ আমি তোমাদেরকে তোমাদের দেশ বেলজিয়াম সম্পর্কে বলব”। পুনর্মুদ্রণের সময় হার্জ এই অংশ পরিবর্তন করেন, যেখানে দেখা যায় টিনটিন ছাত্রদের অঙ্ক শেখাচ্ছে।

হার্জের লেখায় পরিবর্তন

ফারাওয়ের চুরুটে’র শেষাংশে উল্লেখ করা ছিল টিনটিনের পরের অভিযান চীনে। তখন পর্যন্ত স্থান-কালের বর্ণনাতে হার্জ সত্যাসত্য নিয়ে চিন্তা করতেন না। কিন্তু চীনের কথা দেখে ফাদার গসেট নামে এক পাদ্রি তাকে চিঠি লেখেন। তিনি ছিলেন লিউভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক। গসেট হার্জেকে তার গল্পে চীনের ব্যাপারে সঠিক চিত্র তুলে ধরবার আহ্বান জানান। তার পরামর্শে ১৯৩৪ এর বসন্তে চ্যাং চং-জেন নামে এক চীনা ছাত্রের সাথে হার্জ দেখা করেন। তাদের পরিচয় রূপ নেয় বন্ধুত্বে। ফলে পরবর্তী কাহিনীগুলো লেখার সময় হার্জ অনেক গবেষণা করে নিতেন যাতে টিনটিনকে তিনি যেসব জায়গাতে পাঠাচ্ছেন সেসব স্থান আর সংস্কৃতি ঠিকঠাক মতো ফুটিয়ে তোলা যায়। বন্ধুর সম্মানার্থে ‘দ্য ব্লু লোটাস’ (The Blue Lotus /নীলকমল) কমিকসে তিনি আমাদের সামনে হাজির করেন টিনটিনের চীনা বন্ধু, চ্যাং-চং চেনকে।

নীলকমলের প্রচ্ছদ; Image Source:deviantart.com

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ সালে হার্জে দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে রণাঙ্গনে চলে যান। কিন্তু জার্মানির দুর্বার আগ্রাসনে বেলজিয়াম দাঁড়াতেই পারেনি। ফ্রান্সের আত্মসমর্পণের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। জার্মানরা বেলজিয়াম দখল করে নেয়। সমস্ত পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে চালু রাখা হয় একমাত্র ল্যু সইর (Le Soir)। নাৎসি সরকারের মুখপাত্র হিসেবে ল্যু সইর কুখ্যাত হয়ে ওঠে।

ল্যু সইর পত্রিকা; Image Source: toutdard.fr

 

ল্যু সইরে কাজ করার সুযোগ এলে হার্জ তা প্রত্যাখ্যান করেননি। তিনি পত্রিকার শিশু-কিশোর সংখ্যা ল্যু সইরে  জুনেজে (Le Soir jeunesse) টিনটিন আঁকা শুরু করেন। যুদ্ধে যাবার আগে তিনি কাজ করছিলেন ‘দ্য ল্যান্ড অফ দ্য ব্ল্যাক গোল্ড” (কালো সোনার দেশে) নিয়ে। কিন্তু এর ভেতর ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ থাকায় তিনি নাৎসি শাসনাধীন বেলজিয়ামে তা প্রকাশ করতে ভরসা পেলেন না। ফলে তিনি নতুন সিরিজ আরম্ভ করলেন “দ্য ক্র্যাব উইথ দ্য গোল্ডেন ক্ল’স” (কাঁকড়া রহস্য)। যুদ্ধ চলাকালে এরপর তিনি আরো পাঁচটি টিনটিন প্রকাশ করেন। টিনটিনের জন্যই পত্রিকার কাটতি হু হু করে বাড়তে থাকে।

এই সময় হার্জকে তার কমিকসের গল্প বলতে খুব সাবধান থাকতে হত। পাছে জার্মানদের চোখে কোনো কিছু পড়ে যায়। ফলে তার গল্পে সমসাময়িক ঘটনার কোনো প্রতিফলন থাকত না। এছাড়া চরিত্রের মধ্যেও এই সময় অনেক বৈচিত্র্য তিনি সন্নিবেশ করেন। এতদিন টিনটিনের সবসময়ের সঙ্গী ছিল তার সাদা ফক্স টেরিয়ার কুকুর মিলু (ফরাসি Milou, ইংরেজি অনুবাদে হয়ে যায় Snowy, যা বাংলাতে কুট্টুস)। কাঁকড়া রহস্যে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন টিনটিনের পর বোধকরি সবথেকে জনপ্রিয় চরিত্রের সাথে-ক্যাপ্টেন হ্যাডক

ক্যাপ্টেন হ্যাডক এরপর প্রায় সমস্ত অ্যাডভেঞ্চারেই টিনটিনের সাথে ছিল। “রেড র‍্যাকহ্যাম’স ট্রেজার” (লাল বোম্বেটের গুপ্তধন) কাহিনীতে আবির্ভূত হন আত্মভোলা বৈজ্ঞানিক প্রফেসর ট্রাইফুন টার্নসেল, যাকে আমরা চিনি কাথবার্ট ক্যালকুলাস নামে। কাছাকাছি সময় হার্জ আরো নিয়ে এলেন দুই পুলিশ অফিসার, ডুপন্দ আর ডুপন্টকে, ইংরেজি অনুবাদে যারা হয়ে গেল থমসন আর থম্পসন (বাংলাতে রনসন আর জনসন)। অবিকল এক চেহারার দুই অফিসারের ছিল শুধু এক জায়গাতে- ডুপন্দ বা থমসনের মোচ ছিল সামান্য বাঁকানো।টিনটিনের নানা অভিযানে এসব চরিত্র তার সঙ্গী ছিল।

তবে তাদের ভিড়ে আরেকজনের নাম উল্লেখ না করলে এই বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি নামকরা অপেরা গায়িকা, বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওর। তার সুতীক্ষ্ণ কণ্ঠের তোড়ে বয়ে যেত ঝড়ো বাতাস, ভেঙে পড়ত কাচ। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের নাম তিনি কখনোই মনে রাখতে পারতেন না এবং বিভিন্ন মজার নামে ক্যাপ্টেনকে ডাকতেন। ফলে ক্যাপ্টেন তাকে একদমই দেখতে পারতেন না। “দ্য কাস্তাফিওর এমারেল্ড” (পান্না কোথায়) গল্পে ক্যাপ্টেনের সাথে তার বাগদানের খবর পাপারাজ্জিরা ছাপিয়ে দিলে সৃষ্টি হয় মজার মজার কাণ্ডের। হার্জ প্রথম তাকে নিয়ে আসেন “কিং ওটোকারস সেপ্টার” (ওটোকারের রাজদণ্ড) গল্পে, যা প্রকাশিত হয়েছিল তিরিশের দশকে। হার্জ নিজমুখেই বলেছেন, অপেরা তার কাছে হাস্যকর লাগত বলে তিনি বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওরকে এভাবে চিত্রিত করেছেন, তাকে আঁকতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন নিজের দাদির অবয়বকে।    

টিনটিনের কমিকসের বিভিন্ন চরিত্র; Image Source: dreamstime.com

 

১৯৩৪ সালে ফারাওয়ের চুরুটে হার্জ টিনটিনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়ে আসেন রবার্টো রাস্তাপোপোলাসকে। এরপর বারে বারেই তাকে বিভিন্ন গল্পে দেখা গেছে। হোমসের প্রবল প্রতিপক্ষ যেমন মরিয়ার্টি, তেমনি টিনটিনের প্রধান শত্রু এই রাস্তাপোপোলাস।     

যুদ্ধ চলাকালে টিনটিনের বই প্রকাশক ছিলেন ক্যাস্টারম্যান। ছাপার মালামালের স্বল্পতা দেখা দিলে তিনি হার্জকে বলে দিলেন তার কমিকস ৬৪ পৃষ্ঠার মধ্যে রাখতে হবে। প্রচ্ছদ আর শেষ পৃষ্ঠা বাদ দিলে থাকে ৬২ পৃষ্ঠা, এর মধ্যেই হার্জ তার কাহিনী সঙ্কুচিত করলেন। পরবর্তীতে পুরনো টিনটিন নতুন করে মুদ্রণের সময়ও তিনি একই কাজ করেন।

যুদ্ধ শেষ হলে বেশ কিছু লোকের সাথে হার্জকে নাৎসি বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ থেকে তিনি মুক্তি পান বটে, তবে এর চিহ্ন তাকে অনেক বছর বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। তবে তিনি বেশি দিন বসে থাকলেন না। বন্ধু এবং নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করা রেমণ্ড লেব্ল্যাকে নিয়ে বের করে ফেলেলেন নিজেদের পত্রিকা “টিনটিন”।  ১৯৪৬ সালে থেকে প্রকাশিত এই টিনটিনে হার্জের আঁকা ছাড়াও আরো অনেকের লেখাই থাকত, তবে লোকে কিনে পড়ত টিনটিনের জন্যই। কয়েক বছরের মধ্যেই তাই এর গ্রাহকসংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যায়।

টিনটিন ম্যাগাজিন; Image Source: autographauctions.eu

 

গ্রাহকের চাপ অতিরিক্ত হয়ে উঠলে ১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে হার্জ স্টুডিয়ো প্রতিষ্ঠা করা হলো। এখানে হার্জের নির্দেশনায় অন্যান্য আঁকিয়েরা টিনটিন লিখতে সহায়তা করতেন। এদের মাঝে অন্যতম ছিলেন বব ডি ম্যুর। তিনি হার্জের সাথে কাজ শুরু করার পর থেকে প্রতিটি টিনটিন কমিকসের সাথেই জড়িত ছিলেন।

শেষ দিনগুলো

১৯৬০ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পঁচিশ বছর হার্জ লিখেছিলেন মাত্র পাঁচটি টিনটিন। তার পারিবারিক জীবন এক সংকটাপন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৬০ সালে স্ত্রী কিকেন্সের থেকে তিনি আলাদা বসবাস শুরু করলেন। এই সময় হার্জ ঝুঁকে পড়েন তার স্টুডিয়োর এক শিল্পী ফ্যানি ভ্লামিঙ্কের দিকে। এই সময় মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তিনি মনোবিদের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক তাকে টিনটিন লেখা স্থগিত রাখার পরামর্শ দিলেও তিনি প্রকাশ করেন “টিনটিন ইন টিবেট” (তিব্বতে টিনটিন)।  

১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হার্জ ও কিকেন্সের দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি হয়। একই বছর তিনি এঁকে ফেলেন “টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারোস” (বিদ্রোহীদের দঙ্গলে)। এর মধ্যে টিনটিন অন্যান্য মাধ্যমেও জায়গা করে নিতে থাকে। ১৯৬১ সালেই “টিনটিন অ্যান্ড দ্য গোল্ডেন ফ্লিস” (টিনটিন আর স্বর্ণ পশমি মেষচর্ম) নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হলো। ফরাসি অভিনেতা জ্যা পিয়েরে ট্যালবট নাম ভূমিকায় অভিনয় এখানে করেন। ১৯৬৯ সাল থেকে বেশ কিছু টিনটিন কার্টুনও বানানো হলো, যার একটি ছিল “প্রিজনার্স অফ দ্য সান” (সূর্যদেবের বন্দি)।

সূর্যদেবের বন্দি কমিকসের প্রচ্ছদ; Image Source: goodreads.com

পঁচাত্তর বছর বয়সে ১৯৮৩ সালের ৩রা মার্চ হার্জের মৃত্যু হয়। ১৯৮৭ সালে তার স্ত্রী ফ্যানি হার্জ স্টুডিও বন্ধ করে গড়ে তোলেন হার্জ ফাউন্ডেশন। টিনটিনের কপিরাইট তাদের হাতে চলে যায়। হার্জের ইচ্ছা ছিল তার সাথে সাথেই টিনটিনের মৃত্যু হবে। ফাউন্ডেশন সেই ইচ্ছাকে সম্মান দেখায়। এরপর আর কোনো শিল্পীকেই নতুন করে টিনটিন লেখার অনুমতি দেয়া হয়নি। ১৯৮৮ সালে টিনটিন ম্যাগাজিনও বন্ধ হয়ে যায়।

সমালোচনা

১৯৯৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের পার্লামেন্টে টিনটিন ডান না বামপন্থী তা নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। বলা বাহুল্য, এই বিতর্ক ছিল অমীমাংসিত। আসলেই টিনটিনকে নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। হার্জের লেখায় স্পষ্টভাবেই ঔপনিবেশিক চিন্তা-চেতনার ভাব ছিল। অনেক সমালোচক তাকে সাম্প্রদায়িকতা আর অ্যান্টি সেমিটিসমের দোষে দুষ্ট বলে দাবী করেন।

হার্জের লেখায় ইউরোপিয়ানদের মহান দেখিয়ে অন্যান্য সভ্যতা সংস্কৃতিকে খাট করে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা ছিল। তবে মূলত প্রথমদিকের টিনটিন কমিকসে এই বিষয়গুলো বেশি। পরের দিকে হার্জ এই সমস্যা সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। সত্যিকার অর্থে হার্জের লেখা তার সময়ের প্রতিফলন । সময়ের পট পরিবর্তনের সাথে সাথে তার লেখনীতেও টিনটিনের পরিবর্তন হয়।

শেষ কথা

হার্জ মারা গেছেন প্রায় সাইত্রিশ বছর আগে। কিন্তু টিনটিনের জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকুও। আজও ছেলেবুড়ো সবার কাছে টিনটিন চিরতরুণ। সব বয়সের জন্যই তার অ্যাডভেঞ্চারে কিছু না কিছু আছে। নামজাদা ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্যু গল কি আর এমনি এমনি বলেছেন, “আমার সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষ হলো টিনটিন”।

টিনটিন সিরিজ-এর ২৪ টি কমিকস একসাথে পেতে ভিজিট করুন রকমারিতে। 

This is an article about Tintin and Herge. This article describes how Herge created Tintin and the impact it has on the world of comics. Necessary references are hyperlinked.

References

  1. Assouline, P., & Ruas, C. (2009). Hergé: The man who created Tintin. Oxford: Oxford University Press.
  2. Tintin
  3. Scouting: Tintin 
  4. Herge (1907 – 1983) 
  5. Shervin Moloudi (2008). A Brief History of Tintin Books
  6. Tintin  Essentials
  7. All you need to know about Tintin (2017)
  8. First publication dates of The Adventures of Tintin

Featured Image: wallur.com

Related Articles