শুরুর আগে
ডিসি কমিক্সের কল্যানে ‘ল্যাজারাস পিট’ কথাটা এখন বহুল প্রচলিত। ব্যাটম্যানের নেমেসিস বা সবচেয়ে বড় শত্রুদের একজন ‘রেইশ আল গুল‘ এই ল্যাজারাস পিট ব্যবহার করে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন। এই পিটে গোসল করলে মৃত বেঁচে ওঠে, বৃদ্ধ ফিরে পায় যৌবন। তবে ল্যাজারাস পিট আমাদের এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। এই পিটের নাম যার নামে রাখা হয়েছে, সেই ল্যাজারাসকে নিয়েই আমাদের আলোচনা।
ল্যাজারাস অব বেথানি
ল্যাজারাসের কিংবদন্তীর সূত্রপাত বাইবেল বা নিউ টেস্টামেন্টের ‘গসপেল অব জন’ থেকে। জন ১১, নিউ টেস্টামেন্টের গসপেল অব জনের এগারোতম অধ্যায়ে ল্যাজারাসের কিংবদন্তী উঠে এসেছে। কিংবদন্তী অনুসারে, ল্যাজারাসের পুরো নাম ল্যাজারাস অব বেথানি। অর্থাৎ, তিনি জেরুজালেমের বেথানি শহরের অধিবাসী ছিলেন। তাকে সেইন্ট ল্যাজারাসও বলা হয়।
ল্যাজারাস শব্দটা লাতিন। এটি আরামিক শব্দ אלעזר (Elʿāzār), যার হিব্রু এলিয়াজার (Eleazar) থেকে এসেছে। বাংলায় এর অর্থ, স্রষ্টাই আমার সহায় (God is my help)। ‘গসপেল অব লুক’-এও একজন ল্যাজারাসের কথা এসেছে। তবে দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।
ল্যাজারাসের দুই বোন, মার্থা ও ম্যারি অব বেথানি। এই ম্যারি অব বেথানিকে অনেকে বিখ্যাত ‘ম্যারি ম্যাগদালিন’ বলেও মনে করেন। ম্যারি ম্যাগদালিন যিশুর (ঈসা আঃ) অনুসারী ও অনেকের মতে তার স্ত্রী হিসেবে বিখ্যাত। ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত ‘ডা ভিঞ্চি কোড’ বই এই কিংবদন্তীকে আরো উসকে দিয়েছে।
ম্যারি অব বেথানি ও ম্যারি ম্যাগদালিনকে একই ব্যক্তি মনে করার পেছনে ‘পোপ গ্রেগোরি দ্য গ্রেট’-এর ভূমিকা আছে। তিনি তাদেরকে একই ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বর্তমান খৃষ্টান চার্চের মতে, তারা একই ব্যক্তি নন।
নিউ টেস্টামেন্ট
জন ১১ অনুসারে, ম্যারি ও মার্থা জিশুর কাছে খবর পাঠালেন, তাদের ভাই ল্যাজারাস প্রচণ্ড অসুস্থ। বর্ণনামতে, খবর শোনার পরেও জিশু দুদিন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি। যেখানে ছিলেন, সেখানেই রয়ে গেলেন।
দুদিন পর যিশু বেথানির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। যতক্ষণে তিনি এসে পৌঁছালেন, ততক্ষণে ল্যাজারাস মারা গেছেন। তাকে কবর দেয়া হয়েছে এবং এরপর আরো চারদিন পেরিয়ে গেছে। যিশু প্রথমে মার্থা ও ম্যারির সঙ্গে দেখা করেন। মার্থা আক্ষেপ নিয়ে তাকে বলেন, ‘আপনি এখানে থাকলে আমার ভাই মারা যেত না।’ যিশু উত্তরে তাকে জানান, ল্যাজারাস বেঁচে উঠবে এবং বলেন,
‘আমিই পুনর্জন্ম এবং জীবন। যারা আমাকে বিশ্বাস করবে, তারা মরলেও বেঁচে থাকবে। আর, জীবিতদের মধ্যে যারা আমাকে বিশ্বাস করবে, তারা কখনো মারা যাবে না। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?’
মার্থা তার কথায় সম্মতি দেন এবং জানান যে তিনি যিশুকে বিশ্বাস করেন। বর্ণনাকারী ঘটনার এই পর্যায়ে এসে বিখ্যাত সেই পঙক্তিটি বলেছেন, ‘যিশু কাঁদছিলেন (Jesus Wept)।’ [জন ১১:৩৫]
এই বাক্যটি অসম্ভব বিখ্যাত। কারণ, খ্রিস্টানদের মতে, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যিশু কোনো রূপক সত্ত্বা ছিলেন না। তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন। এছাড়াও এটা প্রমাণ করে, যিশু তার অনুসারীদের দুঃখে দুঃখ পেয়েছেন, তাদের জন্য কেঁদেছেন। তার অনুসারীরাও এ সময় কাঁদছিল।
তিনি মার্থাকে নিয়ে ল্যাজারাসের কবরের কাছে গেলেন। অনুসারীদের বললেন পাথর সরিয়ে কবর উন্মুক্ত করতে। মার্থা এ সময় মৃদু বাধা দেয়ার চেষ্ট করেন। যিশু উত্তরে বলেন, ‘বলেছি না আমাকে বিশ্বাস করলে স্রষ্টার মহিমা দেখতে পাবে?’ তারপর আর মার্থা বাধা দেননি।
যিশু স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন এবং ল্যাজারাসকে কবর থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন (Lazarus, Come forth!)। তার হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজের মতো করে মোড়ানো লিনেন কাপড়ের টুকরো লেগেছিল। মুখও ঢাকা ছিল একখণ্ড কাপড়ে। যিশু তখন আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনুসারীদের বলেন, ‘কবরের কাপড় সরিয়ে ওকে মুক্ত করো।’
এ সময় ঘটনাস্থলে অনেক ইহুদীও এসেছিল। তারা এই ঘটনা দেখে যিশুর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে।
জন ১২ অনুসারে, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার ছয়দিন আগে তিনি আবারো বেথানিতে এসেছিলেন এবং মার্থা ও ল্যাজারাসের সঙ্গে খাবার খেয়েছিলেন। [জন ১২:০২] যিশু এবং ল্যাজারাস মিলে অনেক ইহুদীকে তার ধর্মের প্রতি আহ্বান করেন। এই বিষ্ময়কর ঘটনা ও ল্যাজারাসকে চলতে-ফিরতে দেখে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। এজন্য স্থানীয় ধর্মগুরু ল্যাজারাসকে হুমকি হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেন এবং তাকে মারার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
এরপর ল্যাজারাসের কী হয়েছে, তা অবশ্য পরিষ্কারভাবে কোথাও বলা হয়নি। বাইবেলে ল্যাজারাসের আর কোনো উল্লেখ নেই। তবে ইস্টার্ন অর্থোডক্স এবং রোমান ক্যাথলিকরা তার পরবর্তী জীবন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলে থাকেন। এদের কারো মতে তিনি সাইপ্রাস ও কারো মতে মার্সেলিতে এসে চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন ও বিশপ হিসেবে জীবন-যাপন করেন।
ইসলামি বর্ণনা
কোরআন শরীফে ঈসা (আঃ) এর মু’জেজা হিসেবে মৃতকে জীবিত করার কথা বলা হয়েছে। সুরা আল ইমরানের ৪৯ নাম্বার আয়াতে এসেছে–
“এবং বনী ইসরাইলদের কাছে তাঁকে (ঈসা আঃ) রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন। ঈসা (আঃ) তাদের বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমাদের জন্য নিদর্শন এনেছি। আমি কাদা দিয়ে একটা পাখির মূর্তি তৈরী করে, তাতে ফুঁ দেব। আর আল্লাহর ইচ্ছায় তা পাখি হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে মৃতকে জীবিত করব। তোমরা তোমাদের ঘরে যা খাও ও জমা কর, আমি তাও তোমাদের বলে দেব। তোমরা যদি বিশ্বাসী হও তবে সত্য মেনে নেয়ার ব্যাপারে এতে তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (৩:৪৯)
তবে, দেখাই যাচ্ছে, ল্যাজারাসের নাম এখানে উল্লেখ করা হয়নি। ইসলামি বর্ণনায় ঈসা (আঃ) এর মৃতকে জীবিত করার মু’জিজার কথা আসলেও, ল্যাজারাসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে খুবই অল্প কিছু জায়গায়। যেমন, ঐতিহাসিক আল তাবারি তার তা’রিখ গ্রন্থে এসব মু’জিজা নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন, কিন্তু কারো নাম সেভাবে উল্লেখ করেননি। কিন্তু আস-সা’লাবি (الثعلبي, ইংরেজিতে আল-থালাবি বলা হয়) আবার বলেছেন, আল-আজির (ল্যাজারাসের আরবি) মারা যাওয়ার পরে ঈসা (আঃ) এর কাছে খবর পাঠালে তিনি তিনদিন (নিউ টেস্টামেন্ট হিসেবে যদিও চারদিন) পরে এসে পৌঁছান এবং আল্লাহর নামে তাকে জীবিত হতে বলেন।
ল্যাজারাসের প্রথম কবর
জেরুজালেমের পশ্চিম তীরের (West Bank) আল-এইজারিয়া বা আল-আজারিয়া (অর্থ: ল্যাজারাসের স্থান, Place of Lazarus) নামের শহরকে কিংবদন্তীর বেথানি শহর বলে মনে করা হয়। এর অবস্থান মাউন্ট অব অলিভের দক্ষিণ-পূর্ব ঢালের দিকে। সেখানেই আছে ‘ল্যাজারাসের প্রথম কবর’। অর্থাৎ, এই কবর থেকেই নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী, যিশু ল্যাজারাসকে জীবিত করেন। যদিও পরবর্তীতে ল্যাজারাস কোথায় মারা গেছেন বা তার সত্যিকারের কবর কোথায় হয়েছে, তা জানা যায় না।
১৬ শতকের আগে এই জায়গাটি বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে একাধিক খৃষ্টান চার্চের অধীনে ছিল। ১৬ শতকে এই জায়গাটি আল-উজাইর মসজিদের আওতাভুক্ত হয়েছে। এটি অটোম্যান (উসমানিয়া) সাম্রাজ্যের শাসনামলে নির্মিত হয়। এর কাছেই আছে ক্যাথোলিক চার্চ অব সেইন্ট ল্যাজারাস। না, ল্যাজারাস নিজে এটি নির্মাণ করেননি। ১৯৫২-১৯৫৫ সালের দিকে এটি নির্মাণ করা হয়।
ল্যাজারাসের কবরস্থান হিসেবে অনেক দর্শনার্থী নিয়মিতই ওখানে ঘুরতে যান। তবে ক্যাথোলিক এনসাইক্লোপিডিয়ার হিসেবে, অনেক স্কলার মনে করেন, মাউন্ট অলিভের আশেপাশে কোথাও হলেও, বিখ্যাত এই জায়গাটি ল্যাজারাসের প্রথম কবর না।
তা হোক বা না হোক, মানুষ এখনো একে পবিত্র ও দর্শনীয় স্থান বলে মনে করে।
সত্য বনাম কিংবদন্তী
কতখানি সত্যি ল্যাজারাসের কিংবদন্তী? সেটা আসলে নিশ্চিতভাবে বলার কোনো উপায় নেই। চার গসপেলের বাকি তিনটি গসপেল- মার্ক, লুক কিংবা ম্যাথিউ-এর বর্ণনায় ল্যাজারাসের কথা আসেনি। আর, গসপেল অব জন লেখা হয়েছে বাকিগুলোর প্রায় ১০০ বছর পরে। তাছাড়া ল্যাজারাসের কথিত প্রথম কবর বলে চিহ্নিত জায়গাটি যে আসলেই ল্যাজারাসের প্রথম কবর, তারও কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই।
কারণ, মানুষ ল্যাজারাস হারিয়ে গেছেন সময়ের বাঁকে। কিন্তু কিংবদন্তীতে স্থায়ী হয়ে গেছে তার নাম।