তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল মিত্রবাহিনী এবং অক্ষশক্তির মধ্যে। মিত্রবাহিনীর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইংল্যান্ড এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এরই মধ্যে একতাবদ্ধ হয়ে জাতিসংঘ গঠনের জন্য মস্কো সম্মেলনে পারস্পরিক চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু জার্মানি এবং জাপানকে পরাজিত করতে হলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া আরও ভালোভাবে করার প্রয়োজনবোধ করেন মিত্রশক্তির প্রধান তিন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকের স্থান নির্ধারণ করে তিন দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর। ইরানের রাজধানী তেহরানকে বেছে নেয় তারা। ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর শুরু হয়ে ১ ডিসেম্বর অবধি চলে এই সম্মেলন। কোড নাম ‘ইউরেকা’ হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ‘তেহরান সম্মেলন’ নামেই বেশি পরিচিত।
তেহরান সম্মেলনে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পরস্পর সাক্ষাত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতা জোসেফ স্ট্যালিন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। এই সম্মেলনকে ঘিরে তিন পক্ষের আকাঙ্ক্ষা ছিল সর্বোচ্চ। শুধুমাত্র জার্মানি এবং জাপানকে পরাজিত করার বিষয়েই নয়, একইসাথে যুদ্ধত্তোর বিশ্ব কেমন হবে এবং সেখানে তাদের ভূমিকা কতটুক থাকবে এসব বিষয়কে আলোচনায় প্রাধান্য দেয়া হয়। তেহরান সম্মেলনে তিন পক্ষের চাওয়ার তালিকা যতটা দীর্ঘ ছিল, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ততটাই কম ছিল। কিন্তু মিত্রবাহিনীকে পরাজিত করতে হলে একে অপরকে ছাড় দেয়া ব্যতীত অন্য কোনো উপায় ছিল না তাদের হাতে।
আর তাই সকল জল্পনাকল্পনা উপেক্ষা করে ঠিক সময়েই অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সম্মেলনটি। এতে করে ফ্রান্স, জার্মানি সহ পূর্ব ইউরোপে মিত্রবাহিনী বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রিটেনের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত হয়। সেই সাথে এশিয়াতেও শক্তিশালী অবস্থান গড়ার বিষয়ে একমত হয় তিন পক্ষ। তেহরান সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় প্রত্যেক রাষ্ট্র নেতা ঐক্যের পরীক্ষা দেন। সেই সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি হন। তেহরান সম্মেলন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় পুরোপুরি পাল্টে দেয়। মিত্রবাহিনীর জয়ে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে এটি। আর এই তেহরান সম্মেলন নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
সম্মেলনের অনিশ্চয়তা
এমন একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন খুব সহজেই অনুষ্ঠিত হয়নি। এর পেছনে তিন দেশের কূটনীতিবিদ, রাজনৈতিক লোক এবং উপনিবেশিক সক্ষমতা বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। সে সময়ের কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক এটিকে বিশ্বাস এবং চুক্তির পরীক্ষা হিসেবেও দেখতেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে শুধু তেহরান সম্মেলনেই না, প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এর আগে বহুবছর যাবত জোসেফ স্ট্যালিনের সঙ্গে সরাসরি বসতে চেয়েছিলেন। কয়েকবার বৈঠকের স্থান নির্ধারণ হয়েও বাতিল করা হয়েছিল শুধুমাত্র সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়কের অনিচ্ছার কারণে। মার্কিন পত্রিকায় এর কারণ হিসেবে স্ট্যালিনের বিমান ভ্রমণে ভীতিকেই বার বার উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে বাস্তবিক প্রেক্ষাপট ছিল অনেকটাই ভিন্ন।
তেহরান সম্মেলনে তারা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে আলাপ করতে একমত হলেও এক মুহূর্তের জন্য কারো প্রতি কারো শতভাগ বিশ্বাস ছিল না। আরও একটি কারণে সম্মেলনটি প্রথমদিকে আলোর মুখ দেখেনি কারণ জোসেফ স্ট্যালিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কিংবা সমর্থিত কোনো দেশে ভ্রমণে যেতে রাজি ছিলেন না। তবে বৈঠকের মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তির মধ্যকার বোঝাপড়া এবং হিসেবনিকাশ ফয়সালা করার গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আর তাই নিজে থেকেই তেহরানে বৈঠকের প্রস্তাব দেন সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রনায়ক। এই প্রস্তাবের পর প্রথমেই বিপাকে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমতো ইরানের উপর তখন বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ ছিলো না দেশটির।
দ্বিতীয়ত মার্কিন কংগ্রেসে অধিবেশন চলাকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট টানা ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তবে তিনি তার ভেটো ক্ষমতা হারাবেন। এতে করে প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে যেকোনো আইন পাশ হবে। আর তাই প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের জন্য তেহরানের উদ্দেশ্যে বিমান ভ্রমণের বিষয়টি ছিল খুবই কঠিন। নিজের উপদেষ্টাবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর সবকিছুকে পেছনে ফেলে ইরানে পাড়ি জমান রুজভেল্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সবুজ সংকেত পেয়ে তেহরানে উপস্থিত হন জোসেফ স্ট্যালিন এবং উইনস্টন চার্চিল। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে গোটা বিশ্বকে চমকে দেয় তেহরান সম্মেলনের সংবাদটি।
রুজভেল্ট যা চেয়েছিলেন
চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিন প্রত্যেকেই নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে তেহরানে গিয়েছিলেন। যদিও তারা জার্মানিকে পরাজিত করার বিষয়ে একমত থেকে নতুন বিশ্ব কীভাবে গড়া যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তবে এটি কীভাবে পরিচালনা করা হবে সে ব্যাপারে প্রত্যেকের ছিল ভিন্ন মতামত। তেহরান সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের শীর্ষ বিষয়বস্তু ছিল ইংল্যান্ড থেকে উত্তর ফ্রান্স অভিমুখে ক্রস-চ্যানেল আক্রমণ সাজানো। একে অপারেশন ‘ওভারলর্ড’ নামকরণ করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডি-ডে নামেই বিখ্যাত। ১৯৪৩ সালের মে মাসে ওয়াশিংটনে এক দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে চার্চিল এবং রুজভেল্ট আক্রমণের জন্য ১৯৪৪ সালের ১লা মে তারিখটি অস্থায়ীভাবে নির্ধারণ করেন। কিন্তু তেহরান সম্মেলনে রুজভেল্ট এই অভিযানটি আরো এক বছর পেছানোর ব্যাপারে প্রস্তাব দেন।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সামরিক উপদেষ্টাগণ দীর্ঘদিন যাবত অপারেশন ওভারলর্ড বাস্তবায়নের জন্য তাকে চাপ দিচ্ছিলেন। তারা এটিও বুঝতে পারেন যে, জোসেফ স্ট্যালিন বহুবছর যাবত এই আক্রমণটির আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি দিন দিন ধৈর্যহারা হচ্ছেন। আর তাই সোভিয়েত ইউনিয়কে মিত্রশক্তি হিসেবে অপরিবর্তিত রাখতে চাইলে এই অভিযানের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। লেখক নাইজেল হ্যামিল্টন তার ওয়ার অ্যান্ড পিস বইতে লিখেন,
১৯৪৩ সালের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে নাৎসি জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠার গুঞ্জন রটেছিল। সে সময় অনেকেই মনে করেন জোসেফ স্ট্যালিন মিত্রবাহিনী ত্যাগ করবেন এবং কয়েকটি বড় চুক্তি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিবেন।
এই গুঞ্জন মার্কিনীদের কিছুটা হলেও ভীতসন্ত্রস্ত করেছিল। কারণ সে সময় মিত্রবাহিনীর জয়ের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রুজভেল্ট কখনোই চাননি সোভিয়েত ইউনিয়ন জোট ত্যাগ করুক। বরঞ্চ তিনি চেয়েছেন দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের বিপক্ষে হামলা চালিয়ে যাক। তেহরান সম্মেলনের পূর্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিলেও ১৯৪৫ সালে আবারও হামলা শুরু করে।
অপারেশন ওভারলর্ড ছাড়াও প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ গঠনের বিষয়ে ‘বিগ থ্রি’ এর অন্য দুই দেশের মতামত এবং ভূমিকা কেমন হবে সেটি উত্থাপন করেন তিনি। পাশাপাশি চার্চিল এবং স্ট্যালিনকে এই জোটে চীনের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হন। জোটের নেতাদের নিকট প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সর্বপ্রথম জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেছেন এমনটা দাবি করেন একজন মার্কিন সাংবাদিক। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মারা যাওয়ার পূর্বে ঐ সাংবাদিক তার সাক্ষাতকার নেন।
অতঃপর লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া প্রজাতন্ত্রের বিষয়ে স্ট্যালিনের সঙ্গে আলোচনা করেন রুজভেল্ট। ঐ তিন দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা না থাকার বিষয়ে গণভোট আয়োজনের দাবি জানান তিনি। এর উত্তরে স্ট্যালিন রাজি হন, তবে শর্ত হিসেবে গণভোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য যেকোনো দেশ যাতে কোনোপ্রকার হস্তক্ষেপ না করে সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা চান। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এই শর্তে রাজি হন।
চার্চিল যা চেয়েছেন
কাকতালীয় হলেও সত্য যে তেহরান সম্মেলন চলাকালে নিজের ৬৯তম জন্মদিন পালন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। ১৯৪৩ সালের ৩০ নভেম্বর রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিনয়ের উপস্থিতিতে তেহরানের ব্রিটিশ কনসুলেটে জন্মদিন উদযাপন করেন তিনি। যা-ই হোক, সম্মেলনে অপারেশন ওভারলর্ড নিয়ে তেমন আগ্রহী ছিলেন না চার্চিল। মূলত রুজভেল্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত অভিযান পরিচালনার সময় তার পছন্দ হয়নি। এরই মাঝে ইতালি আত্মসমর্পণ করলেও রোম ছিল জার্মানির দখলে। এই কারণে চার্চিল ধরে নিয়েছেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে সম্পদ সরিয়ে নিলে সেটি তাদের ক্ষতিসাধন করবে। তার মানসিক পরিবর্তন তাকে ঐতিহাসিক বিতর্কের মুখোমুখি করেছিল। যার ফলে তেহরান সম্মেলনে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিষয়ে বেশি জোর দেন।
বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক মার্কিন সাংবাদিক দাবি করেন চার্চিল অপারেশন ওভারলর্ড বানচাল করতে চেয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচারণের পঞ্চম খণ্ডে তিনি নিজেকে সমর্থন দেন। সেখানে তিনি নিজেকে আমেরিকার চোখে একজন কিংবদন্তি হিসেবে তুলে ধরেন। শেষমেশ চার্চিল তার বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে সমালোচকদের নিন্দা জানান। সেই সাথে যারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটেনের রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশগুলোর সঙ্গে একমত হয়নি তাদের কঠোর সমালোচনা করেন।
পরবর্তী সময়ে অনেক ইতিহাসবিদ চার্চিলের স্মৃতিচারণ সংস্করণে একমত প্রকাশ করেন, আবার অনেকেই বিরোধিতা করেন। সাম্প্রতিককালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ডেভিড রেইনোল্ডস ২০০৫ সালে তার বই ‘ইন কমান্ড অব হিস্টোরিতে’ চার্চিলের সমালোচনা করেন। অন্যদিকে, আরেক ইতিহাসবিদ হ্যামিল্টন সরাসরি অভিযানে চার্চিলের বিরোধিতার বিষয়ে লিখেছেন। তার মতে, সে সময় উইনস্টন চার্চিল ডি-ডে বা অপারেশন ওভারলর্ড বাতিল করতে যা যা করা দরকার সবই করেছিলেন।
চার্চিল কেন ডি-ডে’র বিরোধীতা করেছিলেন সে ব্যাপারে এখন অবধি নিশ্চিত হতে পারেননি ইতিহাসবিদগণ। তবে তারা বিশেষ কিছু কারণ বের করেছেন যা অনেক কিছুর ইঙ্গিত করে। হতে পারে তিনি এই পদক্ষেপে অনেক অনেক ব্রিটিশ নাগরিক হতাহতের আশঙ্কা করেছিলেন, আবার অভিযান ব্যর্থ হলে প্রত্যুত্তর হিসেবে হিটলার প্রথমেই ব্রিটেনে আক্রমণ করবে বলে ভয় পেয়েছিলেন। আবার তিনি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ উপনিবেশিক অঞ্চলগুলো রক্ষায় বেশি জোর দিচ্ছিলেন। যুদ্ধের পর নিজেদের সাম্রাজ্য বজায় থাকবে কি না সে বিষয়ে বেশ দুশ্চিন্তা ছিল ব্রিটিশদের মনে।
স্ট্যালিন যা চেয়েছেন
তৎকালে স্বৈরশাসক হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া জোসেফ স্ট্যালিন বড়সড় স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে তেহরানে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব ক’টি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিন উভয়ের এজেন্ডা ছিল সাজানো। ইরান সরাসরিভাবে সোভিয়েত এবং ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় দুই রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মতির ভিত্তিতে সবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বৈঠক ব্রিটিশ কনসুলেটে হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তার প্রতিনিধিদল সোভিয়েত দূতাবাসে অবস্থান করতেন। সোভিয়েত কর্মকর্তারা মার্কিনীদের কক্ষে গোপন মাইক্রোফোন লাগিয়ে নজরদারি চালায়। যদিও পরবর্তীতে তারা এই কৌশল বুঝতে পরে নিজেদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বন্ধ রাখেন।
স্ট্যালিনের প্রথম এবং প্রধান দাবি ছিল একটি সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি, যাতে করে মিত্রবাহিনী ফ্রান্সে দীর্ঘ প্রতিশ্রুত ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের দ্বার উন্মুক্ত করে এবং সোভিয়েত সেনারা সেখানে হিটলারের মুখোমুখি হতে পারে। এতে করে হিটলার তার সেনাদের দুই ভাগে বিভক্ত করে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। এছাড়াও তিনি অপারেশন ওভারলর্ড পরিচালনায় পহেলা মে তারিখ বেছে নিতে রুজভেল্ট এবং চার্চিলকে প্রস্তাব দেন। স্ট্যালিন নিজেও ভূমধ্যসাগরে সেনা বাড়ানোর ব্যাপারে রুজভেল্টের সঙ্গে একমত হয়ে চার্চিলের বিরোধীতা করেন। সেই সাথে ঐ অঞ্চলে কৌশলগত কোনো সুবিধা নেই ব্যাখ্যা করে সেনা বাড়ানোর পরিকল্পনাটিকে অপচয় হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
রুজভেল্টের সঙ্গে একমত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দরকষাকষির প্রতিদান হিসেবে অপারেশন ওভারলর্ড চলাকালীন মিলেমিশে আক্রমণ চালাতে সম্মত হন স্ট্যালিন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী হিটলার চাইলেই তার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নিতে পারবে না। তেহরান সম্মেলনে চার্চিল কয়েকবার প্রস্তাব পাল্টালেও স্ট্যালিনের সঙ্গে পেরে উঠেননি। শেষপর্যন্ত রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিন নিজেদের প্রায় সকল এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে, সম্মেলনে শেষে তিন দেশের কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন ব্রিটেনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশি সংখ্যক সেনা সদস্য আসন্ন অভিযানে সক্রিয় হতে যাচ্ছে।
শেষপর্যন্ত কে লাভবান হয়েছিলেন?
যেহেতু পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং স্বার্থ নিয়েই তিন রাষ্ট্রপ্রধান তেহরান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, সেহেতু প্রত্যেকে নিজের স্বার্থ পুরোপুরি আদায় করতে সক্ষম হবেন না এমনটাই স্বাভাবিক। রুজভেল্টের সমালোচকরা ভেবেছিল ধূর্ত স্ট্যালিন তার সাথে অভিনয় করে খালি হাতে ফেরত পাঠিয়েছে। বাস্তবিক অর্থে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তেহরান থেকে খালি হাতে ফেরেননি। আর যেহেতু সেখানে আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যুদ্ধপরবর্তী বিশ্বের নেতৃত্ব এবং সংগঠন প্রতিষ্ঠা, সেহেতু বলা যায় তিনি নিজের সমস্ত অর্জন দেখে যেতে পারেননি। অন্যদিকে, স্ট্যালিন নিজেও দারুণ সব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি প্রাক্তন পোলিশ সাম্রাজ্যে সোভিয়েত সীমান্ত প্রসারিত করার ব্যাপারে চুক্তি করেন যাতে করে জার্মানির সাথে একটি বাফার জোন তৈরি করা যায়। এটি ছিল পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসনের পূর্বাভাস।
অন্যদিকে, চার্চিল প্রাথমিকভাবে অপারেশন ওভারলর্ড স্থগিত করার চেষ্টা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। জোটের স্বার্থে তিনি অভিযানের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে গুটিয়ে না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেও ইস্তফা দেননি। অতঃপর ১৯৪৪ সালের ৬ জুন বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে যখন আক্রমণ শুরু হয় তখন উইনস্টন চার্চিল সরাসরি নিজের সমর্থন জানিয়েছিলেন। অতঃপর তেহরান সম্মেলনের শেষদিন তিন রাষ্ট্রনায়ক একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেন যাতে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তের ছিটেফোঁটাও উল্লেখ করা হয়নি। বরঞ্চ তিন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে আজীবন সম্প্রীতি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তারা।