Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লিজ ইভান্স: যার ডাকে হাজির হলো ডাইনোসরেরা

১৯৯২ সালের গ্রীষ্মকাল। যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ ওয়েলসের ছোট্ট এক শহর কার্মারথেনের (Carmarthen) লিরিক থিয়েটার দর্শকে টইটুম্বুর। বিশ্ববিখ্যাত হলিউড পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের নতুন ছবি ‘জুরাসিক পার্ক’-এর উদ্বোধনী শো হচ্ছে এখানে।

১৯৯২ সালে ওয়েলসের ছোট্ট শহর কার্মারথেন সিনেমা ইতিহাসের অংশ হয়ে যায় © MJ Richardson

কিন্তু যুক্তরাজ্যের বড় বড় শহর থাকতে ওয়েলসের এই অখ্যাত কার্মারথেনকে বেছে নিলেন কেন স্পিলবার্গ? মাত্র ৬০০ দর্শকের লিরিক সিনেমা হলকেই বা কেন এজন্য উপযুক্ত মনে হলো তার? এর পেছনে আছে লিজ ইভান্স নামে এক অদম্য মহিলা আর শহরের মেয়ের রিচার্ড গুডরিজের গল্প। ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখতে এছাড়া অন্য কোনো উপায়ও ছিল না তাদের।

লিজ ইভান্স

ওয়েলসের কার্মারথেনেই জন্ম এলিজাবেথ মার্টল ইভান্সের। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কাজকর্মে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১০ বছর বয়সে নাম লেখান শহরের অপেরা দলে। পরে নাচের সাথেও জড়িয়ে পড়েন তিনি।

তরুণী লিজ পেশা হিসেবে বেছে নেন হেয়ারড্রেসারের কাজ। তবে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে যেতে দেননি। তিন সন্তানের এই জননী শখের বশে ছোটখাট অভিনয়ও করতেন।

লিজ বুঝতে পেরেছিলেন- স্থানীয় শিশু-কিশোর, যারা পারিবারিক সমস্যায় ভুগছে, তাদের ভ্রান্ত পথে যাওয়া ঠেকাতে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এই লক্ষ্যে কার্মারথেনের ইয়ুথ এডুকেশন সেন্টারের সাহায্যে ১৯৭৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ুথ অপেরা।

লিজ ইভান্স নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন ইয়ুথ অপেরা; Image Source: youthopera.co.uk

লিজের উৎসাহে তরতর করে চলতে থাকে অপেরার কার্যক্রম। কাজের ব্যাপ্তি প্রসারিত করে নাটকও নামিয়ে ফেলেন তারা। স্নো হোয়াইটসহ বেশ বড় বড় কিছু স্টেজ প্রোডাকশন করে শহরে নাম করে ফেলেন লিজ। তাই ১৯৮৬ সাল নাগাদ বড় কোনো ভেন্যুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন তিনি।এজন্য বেছে নেন শহরের একমাত্র সিনেমা হল লিরিক থিয়েটারের স্টেজ। ছোটবেলায় এই থিয়েটার ছিলো শহরের প্রাণকেন্দ্র। লিজ নিজেও বহু স্বর্ণালী সময় কাটিয়েছেন এখানে। 

লিরিক থিয়েটার

নিজের দোকানে কাজ করতে করতে একদিন লিজের কানে এলো দুঃসংবাদ। কালের পরিক্রমায় লিরিক থিয়েটার এখন আগের ছায়ামাত্র, চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ফলে মালিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লিরিক বিক্রি করে শপিং মল বানানোর।

লিজ জানতে পারলেন শহরের লিরিক থিয়েটার বন্ধ করে দেয়ার কথা চলছে; Image Source: walesonline.co.uk

লিজ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করলেন শহরের মেয়র রিচার্ড গুডরিজের কাছে। বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে বেশ ভাল ফল পাচ্ছেন তিনি, লিরিক থিয়েটার না থাকলে তার কাজ বাধাগ্রস্থ হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- শহরের ইতিহাসের অন্যতম একটি অংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। কী করা যায়? তাছাড়া বাচ্চাদের নিয়ে তার কাজের জন্যও এই থিয়েটারের দরকার আছে, এখানে শপিং মল হলে তো বন্ধ করে দিতে হতে পারে তার সংগঠন। ফলে আদতে ক্ষতি হবে সমাজেরই।

লিজের সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। মানুষকে প্রভাবিত করার সহজাত শক্তি ছিল তার। লিরিকের মালিককে তিনি রাজি করালেন শেষ একটা শো করার জন্য, বন্ধ করে দেয়ার আগে একটু জাঁকজমক করা আরকি। আশাতীত সফল হয় এই শো (Jesus Christ Superstar)। বহু বছর পর লোক গমগম করে ওঠে শহরের সিনেমা হল।

লিজ আশান্বিত হলেন। হয়তো এখনও সুযোগ আছে লিরিককে বাঁচিয়ে রাখার। তিনি বেশ কয়েকটি ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করলেন, মানুষও টিকেট কেটে দেখতে এলো। শহর কাউন্সিল এবার তার কথায় প্রভাবিত হয়ে থিয়েটার নিজেরাই কিনে নেয়, পরিচালনার দায়িত্ব দেয় লিজের ওপর। কাউন্সিলকে ভাড়া দিতে হবে বছরে এক পাউন্ড করে।

তবে কাউন্সিল একটা শর্ত দিয়ে দিয়েছিল। লিজ থিয়েটার চালানোর জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ পাবেন না, নিজেদের খরচ চালাতে হবে নিজেদেরই। লিজ নিজের ইয়ুথ অপেরার জন্য লিরিককে ভেন্যু হিসেবে ব্যবহার করে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন, আমন্ত্রণ জানান নামকরা শিল্পীদের। অনেক ধনী ব্যক্তি আর্থিক অনুদানও দেন। তবে থিয়েটারের আয়ের মূল উৎস ছিল সিনেমা প্রদর্শনী।

তবে তারপরেও লিরিকের অবস্থা ছিল ‘দিন আনি দিন খাই’-এর মতো। লিজ জানতেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কোনো সুপারহিট ছবি আনতে হবে, তাহলে একটা বড় অঙ্কের অর্থ আসবে। তাছাড়া, এর থেকে যা পাবলিসিটি হবে সেটাও উপকারে আসবে থিয়েটারের।

জুরাসিক পার্ক

স্টিভেন স্পিলবার্গ তখন বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক। ১৯৯৩ সালে তিনি জুরাসিক পার্ক নামে এক ছবি মুক্তি দেবেন বলে সব ঠিকঠাক। ডাইনোসর নিয়ে এই ছবি মুক্তির আগেই বিশাল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। অন্য অনেক সিনেমা হলের মতো লিরিকও তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে এই ছবির দিকে। লিজ জানেন, জুরাসিক পার্ক চালাতে পারলে তার আর্থিক অনটন অন্তত কয়েক বছরের জন্য দূরীভূত হবে, বেঁচে থাকবে প্রিয় এই সিনেমা হল।

জুরাসিক পার্ক তখন মুক্তির আগেই আলোড়ন তোলা এক সিনেমা; Image Source: imdb.com

প্রাথমিকভাবে যুক্তরাজ্যের অনেক সিনেমা হলের পাশাপাশি লিরিককেও ছবির প্রিন্ট দেবার কথা দিয়েছিল ডিস্ট্রিবিউটরেরা। লিজ এজন্য প্রচারণাও চালাতে শুরু করে দেন। শহরবাসীরা সোৎসাহে অপেক্ষা করতে থাকে কবে তাদের এই ছোট শহরে পা দেবে ডাইনোসরেরা। কিন্তু শেষপর্যন্ত ডিস্ট্রিবিউটর লিরিকে ছবি পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে। তাদের ভাবনা ছিল- বিগ বাজেটের এই ছবির জন্য অখ্যাত এক শহরের ছোট্ট এক সিনেমা হল পর্যাপ্ত মুনাফা আনতে পারবে না।

লিজ যখন খবর পেলেন তখন তার রাগে ফেটে পড়ার দশা। পরবর্তীতে তার ছেলে ওয়েন জানিয়েছিলেন, তার মা বাধা পেলেও হতোদ্যম হয়ে পড়েননি। তিনি শহরের কুইন্স পাবে মেয়র গুডরিজকে বিষয়টি জানান।  

সেই রাতে মেয়র স্পিলবার্গের কাছে একটা ফ্যাক্স করলেন। জানালেন প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যের ডিস্ট্রিবিউটররা তাদের জুরাসিক পার্ক ছবির প্রিন্ট দেয়নি। শহরের সমস্ত লোক অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষা করছিল এই ছবির জন্য, অনেকে ছুটিতে ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে কেবল জুরাসিক পার্ক দেখবে বলে। তারা সবাই বেশ হতাশ, এবং ক্রোধান্বিত। তিনি স্পিলবার্গকে অনুরোধ করলেন ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনা করে দেখতে। লিজ এরপর স্পিলবার্গের সেক্রেটারিকেও ফোন করেন।

স্পিলবার্গের কাছে মেয়র গুডরিজের ফ্যাক্স; Image Source: bbc.com

সত্যি বলতে কী, লিজ বা গুডরিজ কেউই উত্তর পাবার আশা করেননি। তাদের অবাক করে দিয়ে কয়েকদিন পর রাতের বেলা স্পিলবার্গের অফিস থেকে এক কর্মকর্তা মেয়রকে ফোন করলেন। তিনি জানালেন, স্পিলবার্গের কাছে তার ফ্যাক্সটি পাঠাচ্ছেন তারা।

স্টিভেন স্পিলবার্গ; Image Source: imdb.com

ছয়দিনের মাথায় জুরাসিক পার্কের মূল ডিস্ট্রিবিউটর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল পিকচার্সের প্রধান নিজে আনুষ্ঠানিক চিঠিতে জানালেন, স্পিলবার্গের অনুরোধে লিরিকের জন্য ছবির একটি প্রিন্ট বরাদ্দ করেছেন তারা। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাজ্যে জুরাসিক পার্কের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী যখন হবে, সেদিনই কার্মারথেনে দেখানো হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উদ্বোধনী বা প্রিমিয়ার শো হবার কথা লন্ডনে, যেখানে উপস্থিত থাকবেন প্রিন্সেস ডায়ানাসহ রাজপরিবারের সদস্যরা।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল পিকচার্সের পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠি; Image Source: bbc.com

লিজ এবার আয়োজনে লেগে পড়লেন। লিরিককে ধুয়েমুছে নতুনের মতো করে ফেলা হলো। ডাইনোসরের প্রতিকৃতি দিয়ে ছেয়ে ফেলা হয় থিয়েটারের আশপাশ। বিশেষ খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয় দর্শকদের জন্য। 

অবশেষে এলো সেই দিন। জুলাই ১৫, ১৯৯৩। লিজের ছেলে ওয়েন জানান, স্পিলবার্গ নাকি থাকতে চেয়েছিলেন সেখানে, তবে শেষ পর্যন্ত পারেননি। তবে ছবির শুরুতে তার পাঠানো একটি বার্তা পড়ে শোনানো হয়।

সন্ধ্যার সময় লন্ডনে প্রিমিয়ার শুরু হতে চলেছে, অভ্যাগতরা হাঁটছেন লাল গালিচায়। লিজ চালাকি করে এই সময়টাই বেছে নেন জুরাসিক পার্ক শুরুর জন্য। ফলে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যে সবার আগে লিরিক থিয়েটারেই প্রথম প্রদর্শনী হয় এই ছবির। সেই অর্থে প্রিমিয়ার কিন্তু হয়েছিল ওয়েলসের ছোট এই শহরে।

লিজের কৌশল এতটাই ফলপ্রসূ হয়েছিল যে অনেক সংবাদমাধ্যম তাদের ক্রুদের পাঠিয়ে দেয় কার্মারথেনে। সিএনএন লিরিকের বাইরে থেকে সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকে। আইটিএন নিউজের এক রিপোর্টার তো বলেই বসেন, “আপনি ৩০০ পাউন্ড খরচ করে রাজপরিবারের পাশে বসে জুরাসিক পার্ক দেখতে পারেন, অথবা আপনি চলে আসতে পারেন কার্মারথেনে। মাত্র আড়াই পাউন্ডে দেখতে পাবেন ছবি, ফ্রি হিসেবে পাবেন পপকর্ন।

জুরাসিক পার্ক দেখতে সেদিন লিরিক থিয়েটারে ছিল উপচে পড়া ভিড়; Image Source: inyourarea.co.uk

৬০০ আসনের লিরিক থিয়েটার সেদিন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। প্রদর্শনীর টিকেটের দাম লিজ রেখেছিলেন স্বাভাবিক সময়ের মতোই, আড়াই পাউন্ড। যতদিন লিরিকে জুরাসিক পার্ক চলেছিল, ততদিন এই দামেই টিকেট কেটেছেন দর্শকেরা।

জুরাসিক পার্ক লিরিক থিয়েটারকে নতুন জীবন দান করে। পত্রপত্রিকায় প্রচার পায় এর কথা। তৎকালীন ওয়েলশ পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড হান্ট লিজের সাথে দেখা করেন। তার লড়াকু মানসিকতা মুগ্ধ করে তাকে। তিনি লিরিকের মেরামতের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন। হান্ট এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকেও লিজের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন, যা দিয়ে ঢেলে সাজানো হয় পুরো থিয়েটার। এর নতুন নাম হয় কার্মারথেন ডিস্ট্রিক্ট ইয়ুথ অপেরা।

সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয় লিরিকে জুরাসিক পার্কার প্রিমিয়ারের কথা; Image Source: walesonline.co.uk

এখনও সমান তালে চলছে থিয়েটারের কাজকর্ম, প্রিন্স চার্লসের স্ত্রী ডাচেস অব কর্ণওয়াল ক্যামিলা এর পৃষ্ঠপোষক। সিনেমা প্রদর্শনী এখন আর করা হয় না। নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর অন্যান্য কাজ হয় এখানে। 

লিরিকের সাথে লিজের নাম এমনভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিল যে কার্মারথেনের লোকেরা তাকে ডাকত ‘লিজ দ্য লিরিক’ নামে। ডেভিড হান্টের সুপারিশে পরবর্তীতে তিনি মেরিট অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার (MBE) খেতাবও প্রাপ্ত হন। শিল্প-সংস্কৃতির কাজে প্রায় পুরো জীবনই উৎসর্গ করেন তিনি। ২০০৪ সালে স্বামীর ক্যান্সার ধরা পড়লে তার শুশ্রূষা করতে পেশাগত কাজ থেকে অবসর নেন। এর কয়েক মাস পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান লিজ, তার বয়স তখন ৬০। শহরের গির্জার পাশেই (Llangunnor Church) সমাহিত করা হয় তাকে।

সেইভ দ্য সিনেমা; Image Source: inews.co.uk

লিজ যেভাবে লিরিক থিয়েটারকে বাঁচিয়েছিলেন, তাকে চলচ্চিত্রের পর্দায় তুলে আনার যথেষ্ট রসদ ছিল। স্কাই স্টুডিও সেই সুযোগ নেয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তারা মুক্তি দেয় ‘Save the Cinema’, যেখানে সত্য আর কল্পনার মিশেলে পুরো ঘটনা তুলে ধরেন পরিচালক। ১৪ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যে প্রিমিয়ার হয় এই সিনেমার। কোথায় আন্দাজ করতে পারেন? কার্মারথেনের সেই লিরিক থিয়েটারে! কেবল এই ছবির প্রদর্শনীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়।

Related Articles