সম্প্রতি রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর ইউরোপীয় দুটি রাষ্ট্র সুইডেন ও ফিনল্যান্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউরো–আটলান্টিক সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইডেনের এই সিদ্ধান্ত সুইডেনের পররাষ্ট্রনীতিতে এক বড় মাত্রার পরিবর্তন এনেছে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় (international system) একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। ইতোপূর্বে সুইডেন একটি ‘নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিত ছিল, এবং সুইডিশ পররাষ্ট্রনীতিকে বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি আদর্শ পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের (Napoleonic Wars) পর থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে এই ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রেখেছিল। সুইডিশ নিরপেক্ষতার উৎপত্তি, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং বিলুপ্তি এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
নিরপেক্ষতা নীতি: সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘নিরপেক্ষতা’ (neutrality) একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। যদি কোনো রাষ্ট্র কোনো যুদ্ধ চলাকালে যুধ্যমান পক্ষগুলোর মধ্যে কাউকে সমর্থন বা কারোর বিরোধিতা না করে, কিংবা যদি কোনো রাষ্ট্র কোনো ধরনের সামরিক জোটে যোগদান থেকে বিরত থাকে, সেটিকে ‘নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ (neutral state) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, এবং উক্ত রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ধরনকে ‘নিরপেক্ষতা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্পেন মিত্রশক্তি বা কেন্দ্রীয় শক্তি কোনো পক্ষেই যোগদান করেনি, এবং কোনো পক্ষকেই প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেনি। সুতরাং, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে স্পেন ছিল একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। আবার, তুর্কমেনিস্তান মার্কিন–নিয়ন্ত্রণাধীন সামরিক জোট ন্যাটো বা রুশ–নিয়ন্ত্রণাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’ কোনোটিরই সদস্য নয়, এবং অন্য কোনো সামরিক জোটেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং তুর্কমেনিস্তান একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
একটি রাষ্ট্র নানাবিধ কারণে নিরপেক্ষতা নীতি (policy of neutrality) অবলম্বন করতে পারে। রাষ্ট্রটির সামরিক দুর্বলতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ, ভৌগোলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নৈতিক বিচারবোধ প্রভৃতি কারণ একটি রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে প্রণোদিত করতে পারে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, নিরপেক্ষতা কোনো এক ও অবিচ্ছেদ্য ধারণা নয়। বস্তুত, নিরপেক্ষতার নানা ধরনের প্রকারভেদ রয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেসব নিরপেক্ষতার উদাহরণ দেখা যায়, সেগুলোর কোনোটিই ১০০% নিরপেক্ষতা নয়।
প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী সুইডেন বহুলাংশে নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করেছে, এবং এর ফলে সুইডেনকে নিরপেক্ষতার একটি ‘আদর্শ’ উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করা হতো। সুইডেনের প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী নিরপেক্ষতার নীতি এবং সেটির বিলুপ্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অবশ্য বলাই বাহুল্য, সুইডেনের নিরপেক্ষতাও মোটেই ১০০% নিরপেক্ষতা নয়, বরং নানা পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত এবং সুইডিশ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ছাঁচে গড়া একধরনের নিরপেক্ষতা।
সুইডেনের নিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বনের ঐতিহাসিক পটভূমি
‘সুইডেন রাজ্য’ (সুইডিশ: Konungariket Sverige) উত্তর ইউরোপে অবস্থিত একটি সাংবিধানিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ৪,৫০,২৯৫ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি আয়তনে ইউরোপের পঞ্চম বৃহত্তম রাষ্ট্র। প্রায় ১ কোটি ৪ লক্ষ জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাষ্ট্রটির উত্তরে ও পশ্চিমে নরওয়ে এবং পূর্বে ফিনল্যান্ড অবস্থিত, আর রাষ্ট্রটি দক্ষিণ–পশ্চিমে একটি সেতুর মাধ্যমে ডেনমার্কের সঙ্গে যুক্ত। রাষ্ট্রটির জনসংখ্যার ৭৪.১% জাতিগত সুইড এবং ২৫.৯% অন্যান্য জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত। সুইডরা জাতিগতভাবে উত্তর জার্মানিক/নর্ডিক মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং সুইডিশ ভাষা ইন্দো–ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সুইডেনের জনসংখ্যার ৬৬.৮% খ্রিস্টান, ২৭% কোনো ধর্মের অনুসারী নয়, ৫% মুসলিম এবং ১.২% অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। রাষ্ট্রটি শিল্পোন্নত, অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং রাষ্ট্রটিতে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত উন্নত।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশক পর্যন্ত সুইডেন ছিল ইউরোপের একটি অন্যতম বৃহৎ শক্তি (Great power), এবং সুইডেনের একটি সুবৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু উত্তরের মহাযুদ্ধে (১৭০০–২১) সুইডেন রাশিয়ার নিকট পরাজিত হয় এবং বিস্তৃত ভূখণ্ড হারায়। এরপর থেকে রাষ্ট্রটির শক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। ফ্রান্সে নেপোলিয়নের উত্থানের পর ফ্রান্স ইউরোপ জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইউরোপের অন্যান্য বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, এবং এ সময় সুইডেন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গঠিত জোটে যোগদান করে। কিন্তু ১৮০৮–০৯ সালের রুশ–সুইডিশ যুদ্ধে সুইডেন রাশিয়ার নিকট পরাজিত হয় এবং রাশিয়ার নিকট ফিনল্যান্ডকে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য, বহু শতাব্দী যাবৎ সুইডেন ও রাশিয়ার মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। লিভোনীয় যুদ্ধ (১৫৫৮–৮৩) ও ‘সমস্যাসঙ্কুল সময়’কালীন (Time of Troubles) রুশ–সুইডিশ যুদ্ধে (১৬১০–১৭) সুইডেন রাশিয়াকে পরাজিত করে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করে নেয়। বস্তুত সপ্তদশ শতাব্দীতে সুইডেন যে ইউরোপের একটি অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, এই শক্তির অন্যতম একটি উৎস ছিল রাশিয়ার কাছ থেকে অধিকৃত বিস্তৃত ভূখণ্ড। কিন্তু উত্তরের মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত সুইডিশ আক্রমণাভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয় এবং সুইডেন রাশিয়ার নিকট বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড হারায়।
উত্তরের মহাযুদ্ধের পর রুশ–সুইডিশ সম্পর্কে কার্যত সুইডেন ও রাশিয়ার স্থান পরিবর্তিত হয়। এ সময় রাশিয়া ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে, আর সুইডেন ক্রমশ রাশিয়ার তুলনায় দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সুইডেন তাদের হারানো ভূখণ্ড পুনর্দখলের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু তারা উক্ত ভূখণ্ড পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়নি। বরং রাশিয়ার সঙ্গে বার বার যুদ্ধের ফলে সুইডেনের শক্তিক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সর্বশেষ ১৮০৮–০৯ সালের যুদ্ধে সুইডেন রাশিয়ার নিকট ফিনল্যান্ড হারায়। প্রায় সাত শতাব্দী যাবৎ ফিনল্যান্ড সুইডেনের অংশ ছিল এবং প্রশাসনিকভাবে সুইডেনের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীভূত ছিল। ১৮০৯ সালে ফিনল্যান্ড ছিল সুইডেনের ভূখণ্ডের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ। সুতরাং রাশিয়ার নিকট ফিনল্যান্ড হারানো ছিল সুইডেনের জন্য একটি জাতিগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়।
১৮০৮–০৯ সালের রুশ–সুইডিশ যুদ্ধ চলাকালেই ১৮০৯ সালের মার্চে সুইডিশ অভিজাতরা সুইডেনের তদানীন্তন রাজা চতুর্থ গুস্তাফকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তার স্থলে ত্রয়োদশ কার্লকে অধিষ্ঠিত করে। চতুর্থ গুস্তাফ শুরু থেকেই ফরাসিবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছিলেন এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গঠিত জোটে সুইডেনকে যুক্ত করেছিলেন। ১৮০৭–১২ সালের মধ্যে ফ্রান্স ও রাশিয়া পরস্পরের মিত্র ছিল এবং সুইডেন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় রাশিয়া সুইডেনের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। এই পর্যায়ে এসে সুইডিশ অভিজাতবৃন্দ এই উপসংহারে পৌঁছান যে, সুইডেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ (balance of power) পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে এবং এই পরিস্থিতিতে শতাব্দীপ্রাচীন রুশ–সুইডিশ দ্বন্দ্ব চালিয়ে যাওয়া সুইডেনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
১৮১২ সালের নীতি, সুইডেন–নরওয়ের সৃষ্টি এবং ১৮৩৪ সালের নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত ঘোষণা
ফিনল্যান্ড হারানোর পর সুইডেনের তদানীন্তন যুবরাজ চতুর্দশ কার্লের উদ্যোগে ১৮১২ সালে সুইডেনে একটি নতুন পররাষ্ট্রনীতি ধারণা (foreign policy concept) গৃহীত হয়। এটি সাধারণভাবে ‘১৮১২ সালের নীতি’ নামে পরিচিত। এটি অনুযায়ী সুইডেন রাশিয়ার সঙ্গে তাদের শতাব্দীপ্রাচীন দ্বন্দ্ব সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, সুইডেন যে চিরতরে ফিনল্যান্ড হারিয়েছে এটি স্বীকার করে নেয়, এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাশিয়া ও ব্রিটেনের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়। ১৮১৩–১৪ সালে সুইডেন ফ্রান্স ও ফ্রান্সের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ সময় সুইডেন ফ্রান্সের মিত্র ডেনমার্ক–নরওয়েকে যুদ্ধে পরাজিত করে এবং নরওয়ে দখল করে নেয়। নরওয়ে দখলের পর সুইডেন ‘সুইডেন ও নরওয়ে যুক্তরাজ্য’ বা ‘সুইডেন–নরওয়ে’ নাম ধারণ করে।
১৮১৫ সালে এলবা দ্বীপে নির্বাসিত প্রাক্তন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ফিরে আসেন এবং ফ্রান্সের সিংহাসন পুনর্দখল করেন। তাকে পরাজিত করার জন্য অন্য ইউরোপীয় শক্তিগুলো আরেকটি জোট গঠন করে এবং সুইডেন–নরওয়ে উক্ত জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সুইড–নরউইজীয় সৈন্যরা সরাসরি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। উক্ত যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হন এবং তাকে ব্রিটেনের সেইন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়।
উল্লেখ্য, ‘১৮১২ সালের নীতি’ গ্রহণের পর সুইডেন/সুইডেন–নরওয়ে যে যুদ্ধবিগ্রহ একেবারে পরিত্যাগ করেছিল, এমন কিন্তু নয়। এই নীতি গ্রহণের পরেও সুইডেন বিভিন্ন যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তদুপরি, এই নীতি গ্রহণের পর যে সুইডেন অন্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধে বরাবর নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে এসেছে, এমনটিও মোটেই নয়। কিন্তু এই নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে সুইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন কোনো যুদ্ধ শুরু না করার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ হয়, এবং এর ফলে সুইডেনের বৈদেশিক যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাত্রা বহুলাংশে হ্রাস পায়।
১৮৩০–এর দশকে সুইডেন–নরওয়ে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান তীব্র ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এবং সম্ভাব্য রুশ–ব্রিটিশ যুদ্ধে নিজস্ব অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত হয়। এমতাবস্থায় ১৮৩৪ সালে সুইডেন–নরওয়ের রাজা ত্রয়োদশ কার্ল ব্রিটেন ও রাশিয়ার কাছে স্মারকলিপি প্রেরণ করেন এবং সেগুলোতে ঘোষণা করেন যে, ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ে নিরপেক্ষ থাকবে। এই ঘটনাকে সুইডেনের নিরপেক্ষতা নীতির সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অবশ্য রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যকার সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে সুইডেন নিরপেক্ষতা ঘোষণা করলেও তাদের অবস্থান ছিল তুলনামূলকভাবে ব্রিটেনের প্রতি সহানুভূতিশীল। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া চেয়েছিল, রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সুইডেন যেন তাদের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ব্রিটেনের জন্য সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়, কিন্তু সুইডেন সেরকম কিছু করতে রাজি হয়নি। সুতরাং সুইডেনের নিরপেক্ষতা নীতি যে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ছিল, এরকম নয়।
প্রথম শ্লেসউইগ–হলস্টেইন যুদ্ধ এবং সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
১৮৪৮–১৮৫২ সালে প্রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন জার্মান কনফেডারেশন এবং ডেনমার্কের মধ্যে সংঘটিত প্রথম শ্লেসউইগ–হলস্টেইন যুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ে ডেনমার্ককে সমর্থন করে। ডেনমার্ককে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে সুইডেন–নরওয়ে ডেনমার্কের ভূখণ্ডে সৈন্য প্রেরণ করে, কিন্তু সুইড–নরউইজীয় সৈন্যরা এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। অবশ্য শত শত সুইড–নরউইজীয় স্বেচ্ছাসেবক এই যুদ্ধে ডেনমার্কের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। এই যুদ্ধে ডেনমার্ক বিজয়ী হয় এবং শ্লেসউইগ–হলস্টেইনের ওপর ড্যানিশ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। প্রথম শ্লেসউইগ–হলস্টেইন যুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ের ভূমিকা থেকে এটি স্পষ্ট যে, নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের পর সুইডেন সাধারণভাবে নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করলেও তাদের নিরপেক্ষতা মোটেই পরিপূর্ণ ছিল না।
ক্রিমিয়ান/পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ এবং সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
১৮৫৩–১৮৫৬ সালে ক্রিমিয়ান/পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এই যুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ওসমানীয় রাষ্ট্র ও সার্ডিনিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ক্রিমিয়ান যুদ্ধ শুরুর পরপরই সুইডেন–নরওয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোকে জানায় যে, এই যুদ্ধে তারা ‘কঠোর নিরপেক্ষতা’ (strict neutrality) অবলম্বন করবে এবং ১৮৫৩ সালের ২০ ডিসেম্বর সুইডেন–নরওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতার ঘোষণা প্রদান করে। একই সময়ে সুইডেন–নরওয়ে নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে, যাতে বহিঃশক্তিগুলোর চাপের মুখে সুইডেন–নরওয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারে। ১৮৫৪ সালের ৭ মার্চ রাশিয়া এবং ২৮ মার্চ ব্রিটেন সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতাকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
অবশ্য এক্ষেত্রে সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতা রাশিয়ার চেয়ে ব্রিটেন ও তার মিত্রদের জন্য বেশি লাভজনক ছিল। সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতা ঘোষণার আগে রাশিয়া সুইডেন–নরওয়েকে যুদ্ধের সময় তাদের সমুদ্রবন্দরগুলোকে বিদেশি শক্তিগুলোর জন্য বন্ধ করে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সুইডেন–নরওয়ে যুদ্ধ চলাকালে বিদেশি যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর জন্য তাদের সমুদ্রবন্দরগুলোকে উন্মুক্ত রাখে এবং এর ফলে রাশিয়ার চেয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স বেশি লাভবান হয়। ব্রিটিশ ও ফরাসি নৌবহর নির্বিঘ্নে সুইডেন–নরওয়ের বন্দরগুলোয় যাতায়াত করতে থাকে এবং রসদপত্র সরবরাহের জন্য উক্ত বন্দরগুলোকে ব্যবহার করে। এর ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের জন্য বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা সহজ হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই সুইডেন–নরওয়ের ‘নিরপেক্ষতা’ নীতি রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক ছিল না।
অন্যদিকে, ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুইডেন–নরওয়েকে তাদের নিরপেক্ষতা নীতি থেকে সরিয়ে এনে রুশবিরোধী জোটের অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক ছিল। ১৮৫৪ সালের জুনে ফ্রান্স সুইডেন–নরওয়ের মধ্য দিয়ে বাল্টিক অঞ্চলে সৈন্য প্রেরণের অনুমতি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রটিকে আহ্বান জানায়, কিন্তু সুইডেন–নরওয়ে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। সুইডেন–নরওয়েকে রুশবিরোধী জোটে যোগদানের আহ্বান জানানো হলে সুইডেন–নরওয়ের রাজা প্রথম অস্কার সেজন্য ৪টি পূর্বশর্ত প্রদান করেন:
(১) ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে সুইডেন–নরওয়ের ভূখণ্ডে ৬০,০০০ সৈন্য মোতায়েন করতে হবে;
(২) সুইডেন–নরওয়েকে প্রতি মাসে ৬০ লক্ষ ফ্রাঁ ভর্তুকি প্রদান করতে হবে;
(৩) অস্ট্রিয়াকে উক্ত জোটের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; এবং
(৪) রাশিয়ার কাছ থেকে ফিনল্যান্ড দখল করার আগ পর্যন্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া যুদ্ধ বন্ধ করবে না।
কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুইডেন–নরওয়ের এই শর্তগুলো পূরণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এর ফলে সুইডেন–নরওয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকে। ১৮৫৪ সালের আগস্টে ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাশিয়ার আলান্দ দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত বোমারসুন্দ দুর্গ দখল করে নেয়। এই দুর্গের ওপর আক্রমণ পরিচালনার আগে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুইডেন–নরওয়েকে উক্ত আক্রমণে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু সুইডেন–নরওয়ে ইতিপূর্বে উল্লিখিত শর্তাবলির পুনরাবৃত্তি করে এবং সেগুলো পূরণ হওয়ার আগ পর্যন্ত এই আক্রমণে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। দুর্গটি দখলে নেয়ার পর ব্রিটেন ও ফ্রান্স দুইবার সুইডেন–নরওয়েকে আলান্দ দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য আহ্বান জানায়, কিন্তু সুইডেন–নরওয়ে তাদের শর্তাবলি পূরণ ব্যতীত এই আহ্বানে সাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সুইডেন–নরওয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে আগ্রহী ছিল না। বস্তুত সুইডেন–নরওয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে এবং রাশিয়ার কাছ থেকে ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চল দখল করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সামরিক কার্যক্রমের ভরকেন্দ্র ছিল কৃষ্ণসাগরে এবং তাদের দৃষ্টিতে বাল্টিক সাগর ছিল একটি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন। এমতাবস্থায় বাল্টিক অঞ্চলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স কর্তৃক বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা ছাড়া সুইডেন–নরওয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াকে নিরাপদ মনে করছিল না। বস্তুত এই বিষয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে সুইডেন–নরওয়ের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
১৮৫৫ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন ও ফ্রান্স রুশ কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহরের মূল ঘাঁটি সেভাস্তোপোল দখল করে নেয়। রুশদের এই পরাজয়ের ফলে সুইডেন–নরওয়ে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠে। ৬ নভেম্বর ফরাসি প্রতিনিধি দল সুইডেনে পৌঁছায় এবং বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিষয়ে বিশদ আলোচনা করে। ২১ নভেম্বর সুইডেন–নরওয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে একটি আত্মরক্ষামূলক মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করে, এবং এই চুক্তিটিকে যেকোনো সময় আক্রমণাত্মক মৈত্রীচুক্তিতে রূপ দেয়া সম্ভব ছিল। এদিকে ২৮ ডিসেম্বর অস্ট্রিয়া রাশিয়াকে একটি চরমপত্র প্রেরণ করে এবং জানায় যে, রাশিয়া ব্রিটেন ও ফ্রান্সের শর্তাবলি না মানলে সেক্ষেত্রে অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবেশ করবে। সুইডেন–নরওয়ে ও অস্ট্রিয়ার যুদ্ধে প্রবেশের সম্ভাবনা রাশিয়ার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে অসম্ভব করে তোলে এবং রাশিয়া অস্ট্রিয়ার চরমপত্র মেনে শান্তি আলোচনায় বসতে সম্মত হয়। এর ফলে সুইডেন–নরওয়ের রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের এবং ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চল পুনর্দখলের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়।
সামগ্রিকভাবে, ক্রিমিয়ান/পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ ছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ব্রিটিশ–নেতৃত্বাধীন জোটকে সমর্থন করে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রস্তুতিও গ্রহণ করে। সুতরাং প্রকৃত অর্থে সুইডেন–নরওয়ে এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ ছিল না। বস্তুত সুইডেন–নরওয়ের যুদ্ধে যোগদানের আগেই যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রটির রাজা প্রথম অস্কার অসন্তুষ্ট ছিলেন। এই যুদ্ধের পর সুইডেন–নরওয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, কঠোর নিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বনই তাদের জন্য লাভজনক এবং তারা অন্য কোনো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে এই নীতি পরিত্যাগ করে লাভবান হতে পারবে না।
দ্বিতীয় শ্লেসউইগ–হলস্টেইন যুদ্ধ এবং সুইডেন–নরওয়ের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
১৮৬৪ সালে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া এবং ডেনমার্কের মধ্যে সংঘটিত দ্বিতীয় শ্লেসউইগ–হলস্টেইন যুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ে কঠোর নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করে। যুদ্ধের প্রাক্কালে সুইডেন–নরওয়ের রাজা পঞ্চদশ কার্ল ডেনমার্ককে সামরিক সহায়তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যত সুইডেন–নরওয়ের সেসময় প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য ছিল না এবং সুইডেন–নরওয়ের আইনসভা এই যুদ্ধে ডেনমার্কের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে সুইডেন–নরওয়ে বাধ্য হয়ে এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করে। যুদ্ধে ডেনমার্ক পরাজিত হয় এবং প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার নিকট শ্লেসউইগ ও হলস্টেইন হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।
বস্তুত ক্রিমিয়ান/পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাকি সময় জুড়ে সুইডেন–নরওয়ে সামগ্রিকভাবে নিরপেক্ষতা নীতি অনুসরণ করে। ১৮৬৬ সালের অস্ট্রো–প্রাশীয় যুদ্ধ, ১৮৭০–১৮৭১ সালের ফ্রাঙ্কো–জার্মান যুদ্ধ, ১৮৭৭–১৮৭৮ সালে রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধ প্রভৃতি বৃহৎ মহাদেশীয় যুদ্ধে সুইডেন–নরওয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এবং নিজে থেকে কোনো যুদ্ধ শুরু করা থেকেও বিরত থাকে। তদুপরি, ১৮৮০–এর দশক থেকে ইউরোপে যেসব সামরিক জোট গঠিত হয়, সেগুলোতে যোগদান থেকে সুইডেন–নরওয়ে বিরত থাকে। ১৯০৫ সালে নরওয়ে ‘সুইডেন ও নরওয়ে যুক্তরাজ্য’ থেকে বের হয়ে যায় এবং সুইডেন ও নরওয়ে আবার দুইটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯০৫ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ইউরোপে সংঘটিত যুদ্ধগুলোর ক্ষেত্রে সুইডেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এবং কোনো জোটে যোগদান থেকে বিরত থাকে, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সুইডেনের নিরপেক্ষতাকে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করায়।