ফিল্ম, টিভির মতো বিনোদনমাধ্যম আমাদের জীবনকেই প্রতিফলিত করে বড়/ছোট পর্দায়। এসব বিনোদন জীবনের প্রতিবিম্বকে যতটা অকৃত্রিমভাবে দেখাতে পারে, ততটাই আমাদের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে একটা আলাদা জায়গা দখল করে নেয়। বয়ঃসন্ধির অভিজ্ঞতা নিয়ে রয়েছে হাজারও ‘কামিং-অব-এইজ’ গল্প, যেখানে আমরা দেখতে পাই অগণিত অনুভূতির বিস্তর উপাখ্যান। ‘কামিং-অব-এইজ’ বলতে মূলত বয়ঃসন্ধির গল্পগুলোকে বোঝানো হলেও আরেক রূপ রয়েছে সিনেমার এই ধারার- বিশের ঘরে পারা দেয়ার ‘কামিং-অব-এইজ’। বয়ঃসন্ধি পার হলেই আমাদের বড় হওয়া থেমে যায় না, শুধুমাত্র একটু ভিন্ন রূপ নেয় বড় হওয়ার প্রক্রিয়া। বায়োলজিক্যাল ঘড়ি বলে দেয়- আপনি এখন একজন পরিণত, প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, কিন্তু এই বয়সপ্রাপ্তির সাথে জীবনের বাকি সব উপকরণ কেন যেন একই পথে হাঁটতে চায় না।
‘চা চা রিয়েল স্মুথ’ সিনেমাটি আবর্তিত হয়েছে অ্যান্ড্রু নামের এক তরুণের বিশোর্ধ বয়সের ভারসাম্যহীনতার গল্প নিয়ে। লেখক-পরিচালক কুপার রেইফের এই কমেডি ড্রামায় আমরা পরিচিত হই বাইশ বছর বয়স্ক ‘অ্যান্ড্রু’র সাথে। তার প্রেমিকা কলেজ শেষ করে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে বার্সেলোনা চলে গিয়েছে। অ্যান্ড্রুর পরিকল্পনা হচ্ছে কোনোভাবে অর্থ জমিয়ে বার্সেলোনায় তার প্রেমিকার সাথে একত্রিত হওয়া। এই কারণে সে স্থায়ী কোনো কাজ বা চাকরির খোঁজ করছে না। তবে এক পার্টিতে ড্যাকোটা জনসন অভিনীত ডমিনো আর তার অটিজমে আক্রান্ত মেয়ে লোলার সাথে পরিচয়ের পরে অ্যান্ড্রুর সকল পরিকল্পনায় গণ্ডগোল বেধে যায়। আস্তে আস্তে আমরা ঢুকে যাই তার অগোছালো, বিশৃঙ্খল আর দিশেহারা জীবনের মাঝে, যার সাথে বিশোর্ধ্ব বয়সের গলিতে হোঁচট খেতে থাকা সকল দর্শকই পরিপূর্ণভাবে নিজেকে দেখতে পাবেন।
অ্যাপল টিভির এই সিনেমা দেখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল একই ঘরানার আরো কিছু ফিল্মের কথা। সিনেমায় দেখা বয়ঃসন্ধির গল্পগুলোর এক অভিন্ন, সার্বজনীন প্রকৃতি থাকলেও বিশের ঘরের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো একটু ভিন্ন প্রকৃতির। কারণ এ সময়ের বিকাশ, বিবর্তন প্রত্যেক মানুষের জন্য ভিন্ন হয়। এই ভিন্নতার ছাপ পাওয়া যায় বিশের ঘরের অভিজ্ঞতা নিয়ে বানানো প্রতিটি সিনেমায়। আজ এরকম আরো তিনটি সিনেমার কথা তুলে ধরা হবে, যেখানে বিশোর্ধ্ব জীবনের অকৃত্রিম এবং খুবই ভিন্ন প্রকৃতির জটিলতা ফুটে উঠেছে।
প্রথমে আমরা দেখতে পারি ২০১২ সালের নোয়াহ বমব্যাক পরিচালিত ‘ফ্র্যান্সেস হা’! এই সিনেমায় উঠে এসেছে কলেজ শেষে নিউ ইয়র্কে ২৭ বছর বয়সী ফ্র্যান্সেসের নিজের স্বপ্ন পূরণের পেছনে ছোটার কাহিনী। পদে পদে ঝক্কি-ঝামেলা, হতাশা, উদ্বেগের সাথে লড়াই করা যেন ফ্র্যান্সেসের নিয়মিত সঙ্গী। বিশের শেষের দিকের বয়সে স্বপ্ন পূরণের সাথে জীবন গুছিয়ে নেয়ার তাগিদের টানাপোড়েনকে নোয়াহ বমব্যাক সম্পূর্ণ বাস্তবিক এক লেন্সে তুলে ধরেছেন। নামচরিত্রে গ্রেটা গারউইগের সাবলীল, সংবেদনশীল অভিনয়, গল্পের ড্রামা-কমেডিতে বাস্তবের প্রগাঢ় ছোঁয়া, সাদাকালো লেন্স ব্যবহার করে জাঁকজমকহীন বিশুদ্ধ এক পরিবেশ সৃষ্টি করা– এসবের মধ্য দিয়ে ‘ফ্র্যান্সেস হা’ সিনেমাটি বিশোর্ধ্ব জীবনের হতাশা, উদ্বেগের অতি মানবিক এক চিত্রায়ন।
এরপরে আমরা আলোচনায় আনি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বিশের ঘরের এক অভিজ্ঞতার গল্প ‘গুড উইল হান্টিং’ কে! ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা আজ ক্লাসিকগুলোর মধ্যে অন্যতম নামধারী। এখানে আমরা দেখতে পাই গণিতে তুখোর প্রতিভাধর ২০ বছর বয়সী উইল হান্টিংকে। গণিতে তার প্রতিভা গগনচুম্বী হলেও জীবন নামের সমীকরণের আগাগোড়া বের করা মুশকিল তার পক্ষে। কম বয়সে অভাবনীয় প্রতিভার আশির্বাদও বোঝা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে যথাযথ দিকনির্দেশনা না থাকায়। বিশের ঘরে পা রাখার সাথে সাথে জীবন এমনিতেই জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। তার উপর উইল হান্টিংয়ের শৈশব-কৈশোর কেটেছে অবহেলা আর দুর্ব্যবহারে। দিশাহীন জীবনে উইল হঠাৎ আলোর দেখা পায় রবিন উইলিয়ামস অভিনীত সাইকোলজিস্ট শনের সান্নিধ্যে আসার পরে। ক্ষোভ, যন্ত্রণা আটকে রাখা উইলের জীবনে অর্থবহ পরিবর্তন নিয়ে আসেন এই সাইকোলজিস্ট। এখানে আমরা দেখতে পাই শৈশবের জমে থাকা ক্ষত, আঘাতের যন্ত্রণা কতটা ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে, এবং এই অন্ধকার জায়গা থেকে বের হয়ে আসার একটি স্বাস্থ্যকর উপায়। ৯টি অস্কার মনোনয়ন এবং ২টি ক্যাটাগরিতে অস্কার জেতাসহ ‘গুড উইল হান্টিং’ এর অবস্থান হলিউডের ইতিহাসে পাকাপোক্ত হয়ে রয়েছে মূল চরিত্রের মধ্য দিয়ে জীবনের এতটা জটিল এবং বাস্তবিক দিক তুলে ধরার জন্য।
শেষে তুলে ধরা হচ্ছে ২০১৫ সালের জন ক্রলি পরিচালিত ‘ব্রুকলিন’ মুভির কথা। নিজের দেশ আয়ারল্যান্ড ছেড়ে এইলিশ লেইসি সুদূর আমেরিকার ব্রুকলিন শহরে যায় বুককিপিং শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আশায়। বিশ বছর বয়সে নিজের দেশ, সমাজ, পরিবার ছেড়ে ভিনদেশে এসে খাপ খাওয়ানোর সমূহ জটিলতা যথার্থতার সাথে দেখানো হয়েছে এখানে। এসব জটিলতার মাঝে এইলিশ খুঁজে পায় ভালোবাসা। অপরিচিত মানুষ, অপরিচিত পরিবেশের মধ্যে মনের কাছের একজনকে পেয়ে কিছুটা হলেও যেন স্বস্তি পায় সে। ভিনদেশের নানা কঠিন পরিস্থিতি, অচেনা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ভালোবাসার অনুভূতিতে কিছুটা স্বস্তি উপভোগ করা, স্বদেশ আর প্রবাসের মাঝামাঝি একটা জীবন খুঁজে নেয়া- বিশের গন্ডিতে পা রেখে প্রবাসী হওয়ার যত রকম অভিজ্ঞতা আছে, সবকিছুই ফুটে উঠেছে সারশ্যা রোনান অভিনীত এইলিশের গল্পে।
চারটি সম্পূর্ণ ভিন্নরকম মানুষের, পরিস্থিতির গল্পের মধ্যেও একটা সরলরেখার খোঁজ পাওয়া যায়- বিশোর্ধ্ব জীবনের অভিজ্ঞতার সত্য ও আন্তরিক চিত্রায়ন। বিশ বছরের পরের সময়টা বড়ই টালমাটাল এক অধ্যায়। বয়ঃসন্ধির গন্ডি পেরিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার শুরুটা যেন আরেক সংকটকাল। বিশের কোঠায় অবস্থান করার আরেক দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মানুষজনের আচার-ব্যবহারে। একদিক থেকে প্রত্যাশা আসে পূর্ণবয়স্ক লোকের মতো দায়িত্ব বুঝে নেয়ার, আরেকদিক থেকে ফেলে আসা টিনেজ সময়ে আটকে ধরার একটা পাঁয়তারা চলতে থাকে। এর মাঝেই আবার জীবনে আসে ছোট/বড় অর্জনের আনন্দ, ভালোবাসার ছোঁয়ার মতো পরিবর্তন। এরকম হাজারো টানাপোড়েনে ভরপুর যেকোনো মানুষের বিশোর্ধ্ব সময়। চিরপরিচিত এসব অনুভূতিকে সিনেমার পর্দায় চিনতে পারলে যেন একাকিত্বের ভার কিছুটা হলেও নমনীয় লাগে।