আবু ইব্রাহীম। ছাপোষা এক সরকারি কর্মকর্তা, স্নেহময় এক পিতা, উদাসীন এক স্বামী, প্রেমিকপুরুষ এবং সর্বোপরি ভাবুক এক মানুষ। সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত আবু ইব্রাহীম। তার নীতির কাছে হার মানে অসততা। আবার সেই অসততা থেকেই মুক্তি পেতে চায় তার নিজের জীবন। সত্য আর মিথ্যা, ভালো আর মন্দ, এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে গোটা একটা জীবন পার করে দেয় গোবেচারা ধরনের লোকটা। সাধারণ গোছের আবু ইব্রাহীমকে দেখে তাই পাঠকের মনে হয়, লোকটা কত অসুখী!
উপন্যাসেও আবু ইব্রাহীম লোকটা ছিল একজন অসুখী মানুষ। আর তাই হয়তো অসুখীর প্রকট রূপ তুলে ধরতেই লেখক গল্পের শুরু করেছেন নিতান্ত সাধারণ এক মৃত্যু দিয়ে। যে মৃত্যু হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা; যে মৃত্যুতে হয় না শোকমাতম; হয় না কোনো আহাজারি; যে মৃত্যু অসম্মানিত হয়ে নীরবে প্রস্থান করে। অথচ সেই মৃত্যুই যেন পাঠকের মনের গহীন কোণে পাহাড়ের চেয়েও ভারি রূপে চেপে বসে। সে মৃত্যু মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয়, জীবনের অর্থ আর তাৎপর্য। সেরকমই এক মৃত্যু দিয়ে লেখক পাঠককে শোনান মৃত্যু পূর্ববর্তী একজন অসুখী মানুষের গল্প।
আবু ইব্রাহীমের অসুখী হবার পেছনে এতগুলো কারণ নিমজ্জিত যে, সুখটা কখনো টের পায়নি জীবিত মানুষটা। যৌবনে লালিত রাজনৈতিক আদর্শ অর্জনের পথ থেকে সরে আসার গ্লানি যেন আবু ইব্রাহীমের সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবু ইব্রাহীমের তরুণ বয়সের ব্যর্থ প্রণয়ের বিষণ্ণতা যেন তার পত্নীপ্রেমকে ছাপিয়ে সুখ নামক বস্তুটাকে খোঁচাতে থাকে সারাক্ষণ। কিন্তু একইসঙ্গে আবু ইব্রাহীমের এও মনে হয়, সে ব্যর্থ প্রেমের গ্লানিতে তার আদতে মৃত্যু হয়নি; বরং স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ গুছিয়ে ফেলেছে সে নিজেকে। আর তখন তার এই ব্যর্থ প্রেমের ভাবনাটা তাকে বিষণ্ণ করে ফেলে, পুনরায় সুখকে চুপসে দিয়ে।
সত্যের পথে হাঁটার ক্লান্তি যেন আবু ইব্রাহীমের প্রাপ্তবয়স্ক শরীরে জীর্ণতা নিয়ে আসে। মুক্তির উপায় খুঁজে বেড়ায় সে রাস্তায় ঘুরে কিংবা অফিসের ফাইলের ভিড়ে। অথচ মুক্তি যখন আবু ইব্রাহীমের জীবনটাকে প্রসন্ন করতে আসে, তখন লোকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে, আসল মুক্তির সন্ধানে। নীতির কাছে মাথা পেতে নিলে আদর্শ বাধা দেয় আবু ইব্রাহীমকে। আদর্শকে সঙ্গী বানালে সত্ত্বাটা করে বসে বিদ্রোহ। আর তাই, জীবিত আবু ইব্রাহীম কোনোদিনই সুখের সন্ধান পায় না।
অসুখী হয়েই পুরো জীবনটা পার করে দেওয়া এই মানুষটার মৃত্যুর গল্প পাঠকের কাছে অসুখকর লাগলেও নিজেকে শান্ত করতে পাঠক খুঁজে নেয় আবু ইব্রাহীমের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুখগুলোকে। এভাবেই লেখক পাঠকের মনে আবু ইব্রাহীমকে জায়গা করে দেন। এখান থেকেই আবু ইব্রাহীমের অসুখী জীবন কেমন যেন অতি সহজের তকমা পেয়ে যায় পাঠকের কাছে। যেন আবু ইব্রাহীম অতি সহজেই সকল কিছু জয় করে নিতে পারে।
স্ত্রীর কটুক্তি হজম করে নিয়ে নির্দ্বিধায় সে আকাশের চাঁদ দেখায় নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে পারে, অতি সহজেই। মেয়ের সঙ্গে সন্ধ্যার নির্জনে গল্প করার ছলে তার প্রাক্তন প্রেমিকার কথা মনে পড়ে, অতি সহজেই। ঘরে স্ত্রী রেখেও প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে একা নির্জন কক্ষে দেখা করার বাসনা প্রকাশ করে আবু ইব্রাহীম, অতি সহজেই। কমিউনিজমে বিশ্বাসী বিপ্লবী যুবক কেমন করে যেন প্রাপ্তবয়স্ক বুর্জোয়া আবু ইব্রাহীমে পরিণত হয়, অতি সহজেই। ঢাকায় এক মুঠো জমি কিনে বাড়ি করার আশায় অফিসের টেবিলের তলে আবু ইব্রাহীমের হাত চলে যায়, অতি সহজেই।
কিন্তু তার অতি সহজ জীবনযাপনটাই কঠিন হয়ে ওঠে, যখন সে ভাবনার জগতে ডুবে যায়। তাই, অফিসের টেবিলের নিচ দিয়ে নেওয়া কাজের বিনিময়ে টেবিলের উপরে থাকা ফাইলটিতে স্বাক্ষর করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে আবু ইব্রাহীম, অতি সহজেই। সরকারের অগোচরে ফলফলাদি গিলতে নিয়ে হজম করতে পারবে কি না, সেরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত হয় আবু ইব্রাহীম, অতি সহজেই। শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ি করবে, নাকি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে, তা নিয়ে সংশয়গ্রস্ত হয় আবু ইব্রাহীম, অতি সহজেই। প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে একান্ত কিছু সময় কাটাবে, নাকি নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাবে, তা নিয়ে দোনোমনা হয় আবু ইব্রাহীম, অতি সহজেই। এভাবেই অতি সহজেই পাঠক আবু ইব্রাহীমের গল্পে মজে যায়।
লেখক আবু ইব্রাহীমের গল্পের মাধ্যমে পাঠককে জানান, জীবন আনন্দ এবং বেদনার সর্বদাই একটি খেলা মাত্র। পাঠকের মনে বাসা বেঁধে নেয় এরকম সাধারণ গোছের অসাধারণ কথাগুলো। উপন্যাস শেষে পাঠক ভাবনায় পড়ে যায়। মানুষ কি আসলেই হঠাৎ করে একদিন মরে যায়? নাকি প্রতিদিন একটু একটু করে ধুঁকে ধুঁকে মানুষ শামুকের খোলসের মতো নিঃশেষিত হয়? কাঙ্ক্ষিত সুখ না পেলেও কি মানুষ একটু করে প্রতিদিন মরে যায় না?
খারাপ কাজের অনুশোচনা কি মানুষকে একটু করে মরে যেতে বাধ্য করে না? স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক এই নশ্বর জীবনযাত্রায় মানুষ এমন করেই একটু একটু করে প্রতিদিন মারা যায়। জীবিত অবস্থায়ই আত্মার মৃত্যু হয়ে যায় মানুষের। তারপর হঠাৎ কোনো তুচ্ছ ঘটনায় কিংবা মহৎ কোনো কর্মে মানুষটার নশ্বর দেহ মরে যায়। হয়তোবা সেটা হাঁসের পালকের মতো হালকা হয়; আর নয়তো তা পাহাড়ের চাইতেও অনেক ভারি।
এভাবেই পাঠকের মনে এতসব ভাবনার প্রতিফলন ঘটান লেখক শহীদুল জহির, ‘আবু ইব্রাহীমের’ মৃত্যু নামক এক উপন্যাসে। একদমই উপেক্ষা করা যায় এমন একটি গল্পকেও তিনি নিজের লেখনশৈলীর দক্ষতায় পাঠকের কাছে করে তুলেছেন অসাধারণ। একদমই স্বতন্ত্র আর অদ্ভুত এক বর্ণনাশৈলী নিয়ে পাঠকের কাছে গল্পের ডালা মেলে ধরেন শহীদুল জহির। পাঠক মুহূর্তেই ডুবে যায় সেই গল্পের গভীরে, হেঁটে বেড়ায় আবু ইব্রাহীমের পিছু পিছু। জাদুবাস্তব সে গল্পের অলিগলিতে ছুটে বেড়ায় পাঠক, আবু ইব্রাহীমের একটুখানি সুখের খোঁজে। কিন্তু লেখক যেন পূর্ব পরিকল্পনার মতোই অসুখী আবু ইব্রাহীমকে সাধারণ এক মৃত্যু দিয়ে পাঠককেও অসুখী করে তোলেন।
ক্ষণজন্মা মানুষেরাই পৃথিবীতে নিজেদেরকে অমর করে রেখে যান নিজেদেরই সৃষ্টিকর্মে। ঠিক তেমনি কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি; কিন্তু বাঁচিয়ে রেখেছেন তার চিন্তাভাবনার এক ক্ষুদ্র জগতকে, পাঠকদের উদ্দেশেযে। মাত্র চারটি উপন্যাস, তিনটি গল্প সংকলন আর কিছু প্রবন্ধই ছিল তার স্বল্প জীবনের একমাত্র অর্জন। মৃত্যু পরবর্তী একমাত্র উপন্যাস ‘আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু’, যা প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার জিতে নেয়। জীবদ্দশায় তিনি অর্জন করেছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং কাগজ সাহিত্য পুরস্কার।
‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮), ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫) এবং ‘মুখের দিকে দেখি’ (২০০৫) তার উপন্যাসগ্রন্থ। ‘পারাপার’ (১৯৮৫), ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ (২০০০), ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ (২০০৪) তার উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলন। সরকারি আমলা হয়েও বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যুক্ত করেছিলেন এক স্বতন্ত্র রীতি; যা জাদুবাস্তব বলে খ্যাত হলেও ‘শহীদুল জহিরীয়’ ধারা নামেই অধিক পরিচিত। তবে নিভৃতচারিতা শহীদুল জহিরকে আড়াল করে রেখেছে তার লেখক জীবনের শুরু থেকেই।
মাত্র ৬৪ পাতার একটি ক্ষুদ্র উপন্যাসে স্বল্প পরিসরে বর্ণিত একজন মানুষের গল্পটাকেই বৃহৎ এক চিন্তার জগতে পরিণত করেছেন লেখক। তিনি প্রতিটা শব্দ এত যত্নে বাছাই করে নিয়েছেন যে, সেসব শব্দ বা বাক্য যেন পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে। পুরো উপন্যাস জুড়েই লেখক প্রধান চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টাকে পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন।
লেখক কখনো মৃত্যু থেকে জীবিত জীবনের দিকে পাঠককে নিয়ে যায়; আবার কখনো জীবিত থেকে মৃত্যুর দিনে নিয়ে দাঁড় করায় পাঠককে; সঙ্গে প্রায়ই ছুঁড়ে দেয় প্রশ্নের উপর প্রশ্ন। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও, পাঠক বিভ্রান্ত হয় না। বরং নিজেকে হারিয়ে ফেলে লেখকের কল্পিত অথচ বাস্তবযোগ্য এক জগতের ভিড়ে। আর এখানেই যেন লেখক নিজের সার্থকতার প্রস্ফুটিত রূপ খুঁজে পায়।
তবুও এই গল্পের জগতে পরিভ্রমণে বের হয়ে পাঠক হোঁচট খায় বেশ কিছু কারণে। ভুল বানান, ছাপার ভুল, অতিরিক্ত দীর্ঘ বাক্য কিছু পাঠকের বিরক্তির উদ্রেকের কারণ হতে পারে। তবে এও ভুলে গেলে চলবে না যে, এ উপন্যাসের প্রকাশকালের বানানরীতির সঙ্গে বর্তমান বানানরীতিতে এক জগত পার্থক্য বিদ্যমান। তাছাড়া, পাঠক হয়তোবা লেখকের এই লেখনশৈলীর সঙ্গে কেবলই পরিচিত হয়েছে বিধায় এমন বিরূপ ভাব মনে হাজির হতে পারে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে হাসিমাখা মুখ নিয়ে হাজির হয় অসুখী আবু ইব্রাহীম। তার অতীত প্রেমিকার আগমন, চলমান সংসার ও সম্মুখ স্বপ্নের মধ্যে আকস্মিক মৃত্যু আসে, আর তখনই সত্য হয়ে ওঠে এই উপন্যাসের অমর সত্যদর্শন– জীবন, আনন্দ এবং বেদনা সর্বদাই একটি খেলামাত্র। সেই খেলায় হেরে যাওয়া শহীদুল জহিরের অপ্রকাশিত এক কবিতার দু’টি লাইন দিয়ে শেষ হচ্ছে আজকের এই গ্রন্থ পর্যালোচনা।
... তবুও আমরা আরও একবার সমবেত হলাম,
আর আমাদের সময়ের মাধ্যমে একটি কুঁড়ি ফুলে পরিণত হয়,
একটি রূপালি রূপচাঁদা নোনা পানিতে ভাসে …— শহীদুল জহির
বই: আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু
লেখক: শহীদুল জহির
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশনী: মাওলা ব্রাদার্স
মলাট মূল্য: ১০০/- টাকা