সর্বজয়ার মৃত্যুর পর কিছুকাল অপু এক অদ্ভুত মনোভাবের সহিত পরিচিত হইল। প্রথম অংশটা আনন্দ মিশ্রিত- এমনকি মায়ের মৃত্যুসংবাদ প্রথম যখন সে তেলি বাড়ির তারের খবরে জানিল, তখন প্রথমটা তাহার মনে একটা আনন্দ, একটা যেন মুক্তির নিশ্বাস, একটা বাঁধন ছেড়ার উল্লাস…অতি অল্পক্ষণের জন্য- নিজের অজ্ঞাতসারে।
কী নিষ্ঠুর মনে হয়, না? মায়ের মৃত্যুতে অপুর মনের একটা অংশ সমস্ত বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়ার আনন্দে উল্লসিত। যে স্বাধীনতার স্বাদ সে দীর্ঘদিন যাবৎ পেতে চেয়েছিলো, সে স্বাধীনতার অবারিত দুয়ার তার সামনে খোলা অবস্থায় দাঁড়িয়ে। তাৎক্ষণিকভাবে অপুর চরিত্র এখান থেকে হয়তো খানিকটা অনুমান করা যায়; তবে পরমুহূর্তেই মায়ের জন্য অপুর আবেগ দেখে হতে হয় বিভ্রান্ত।
“উলা স্টেশনে নামিয়া হাঁটিতে শুরু করিল। এই প্রথম এই পথে সে যাইতেছে- যেদিন মা নাই! গ্রামে ঢুকিবার কিছু আগে আধমজা কোদলা নদী, এ সময় হাঁটিয়া পার হওয়া যায়-এরই তীরে কাল মাকে সবাই দাহ করিয়া গিয়াছে! এই সেদিন বাড়ি হইতে গিয়াছে, মা তখনও ছিলো। ঘরে তালা দেওয়া, চাবি কাহাদের কাছে? বোধ হয় তেলি-বাড়ি ওরা লইয়া গিয়াছে। ঘরের পৈঠায় অপু চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। উঠানের বাহিরে আগরের কাছে এক জায়গায় পোড়া খড় জড়ো করা। সেদিকে চোখ পড়িতেই অপু শিহরিয়া উঠিল-সে বুঝিয়াছে-মাকে যাহারা সৎকার করিতে গিয়াছিল, দাহ-অন্তে কাল তাহারা এখানে আগুন ছুঁইয়া নিমপাতা খাইয়া শুদ্ধ হইয়াছে – প্রথাটা অপু জানে। মা মারা গিয়াছে এখনও অপুর বিশ্বাস হয় নাই। একুশ বছরের বন্ধন মন এক মুহূর্তে টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিতে পারে নাই। কিন্তু পোড়া খড়গুলোতে নগ্ন-নিষ্ঠুর-রূঢ় সত্যটা, মা নাই! মা নাই! বৈকালের কী রূপটা! নির্জন, নিরালা, কোন দিকে কেহ নাই। উদাস পৃথিবী, নিস্তব্ধ বিবাগী রাঙা রোদভরা আকাশটা। অপু অর্থহীন দৃষ্টিতে পোড়া খড়গুলোর দিকে চাহিয়া রহিল।”
‘অপরাজিত’ বিভূতিভূষণের অনবদ্য এক সৃষ্টি। অনেক সময়ই একটি ব্যাপার লক্ষ করা যায়, উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব প্রথম পর্বকে মান বা জনপ্রিয়তার বিচারে ছাপিয়ে যেতে পারে না। তবে অপরাজিত এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। ‘পথের পাঁচালি’-এর পরের পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হওয়া এই উপন্যাসে বিভূতি তার পাঠকদের চোখে অপুর কৌতূহল, বিস্ময় ও বোধশক্তির মিথস্ক্রিয়া তার আশ্চর্য হবার যে বোধশক্তি, যা কিনা সাধারণকেও দীপ্তিমান করে তোলে, এছাড়া অজানার প্রতি তার যে দুর্বার আকর্ষণ, তা ফুটিয়ে তুলতে পুরোপুরি সফল হয়েছেন।
নিশ্চিন্দপুর থেকে চলে যাওয়ার পর অপুর কাছে তার গ্রাম্য জীবনকে সীমাবদ্ধ লাগতে থাকে। অপু স্কুলে পড়তে চায়। ভর্তি হয় গ্রাম্য এক বিদ্যালয়ে। রোজ দু’ ক্রোশ পথ হেঁটে পড়তে যেত সে। তার এই হাঁটা পথেরও ছিল অন্যরকম কিছু গল্প। এই পথের কথা অপু পরে আর কখনও ভুলতে পারেনি। গ্রাম্য বালক অপু সেখান থেকে বোর্ড পরীক্ষা দিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হয় মহকুমার হাইস্কুলে।
মহকুমার বোর্ডিং স্কুলে অপুর সামনে উন্মোচিত হয় নতুন এক জগত। সেখানে সে সারাদিন তার অজানা সব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে, খানিকটা বুভুক্ষুর মতো। অপুর দিগন্ত ক্রমেই বাড়তে থাকে। স্কুলের লাইব্রেরিতে বই দেখে সে দিশেহারা হয়ে যায়। সারা বিশ্বের সবকিছু সম্পর্কে সে জানতে চায়। যেতে চায় দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে।
তবে এখানেও মাঝেমধ্যে তার বাড়ির কথা মনে পড়ে। নির্জন বিকেলগুলোতে তার বাবার চেহারা, তার বোনের সাথে তার যত দুষ্টুমির কথা সে কল্পনায় দেখে। তার মার চেহারা না দেখে সে থাকতে পারে না।
কয়েক বছর সেখানে পড়ার পর অপুর হাইস্কুলের পাট চুকায়। তখন অপুর প্রথম যৌবনের শুরু। তার সবসময় মনে হয় কী যেন একটা ঘটবে, তাই সে আশায় আশায় থাকে। হয়তো তা অজানার ডাক, যার কাছে বাদবাকি সবকিছুই তুচ্ছ।
মহকুমার পরে অপু কলেজে পড়ার জন্য যায় কলকাতায়। রিপন কলেজে ভর্তি হয়ে সে শুরু করে কলেজের পড়াশোনা। এই কলকাতা থেকেই শুরু হয় অপুর আসল জীবনযুদ্ধ।
অপুর জীবনের দিগন্ত ক্রমাগতই বাড়তে থাকে। এ সময়ে তার অনেক নতুন নতুন বন্ধু হয়। জানকী, মন্মথ, বিশেষভাবে অনিল ও প্রণব। প্রণবের উৎসাহেই সে আবার নতুন করে বিভিন্ন বিষয়ে নতুনভাবে পড়াশোনা শুরু করে। আর অনিল ছিলো অনেকটা অপুর মতোই। প্রকৃতিকে তারা দুজনই ভালোবাসতো। কিন্তু শহরের গতিময়তাও ছিলো তাদের মাঝে। এ ছিলো এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এতদিন পর্যন্ত অপু তার নিজের সাথে মেলে, এমন কাউকে পায়নি। অনিলকে পেয়ে অপুর মনে হয়েছিল, সে একেবারে সৃষ্টিছাড়া কেউ নয়।
এ সময় অপুর ভীষণ অর্থকষ্ট শুরু। টিউশন পড়িয়ে নিজেকে চালাতে হতো তার। নিজেদের অবস্থান নিয়ে মাঝেমধ্যে দুঃখ হতো অপুর। শহরের প্রাণহীন মানুষগুলোকে পড়াতে গিয়ে তার মনে পড়তো দেওয়ানপুরের নির্মলার কথা। তার আফসোস হতো, নির্মলার মতো মমতাময়ীকে সে চিনতে গিয়েও চেনেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে, এখন আর নতুন করে চিনেই বা কী লাভ?
হঠাৎ করে টিউশন চলে গেলে অপু পড়ে যায় অথৈ জলে। খাওয়া-খাদ্যের ঠিকঠিকানা নেই, কী করবে, তা বুঝতে পারতো না সে। প্রতিদিন গিয়ে বিজ্ঞাপন ঘাঁটত ছেলে পড়ানোর, যদি দুয়েকটা টিউশন পাওয়া যায়, এই আশায়। বাড়িওয়ালার নোটিশে মেস ছেড়ে গিয়ে ওঠে ভাড়াবাড়িতে। টাকার অভাবে ভাতের বদলে ছাতু খেয়ে দিনকাল চালাতে থাকে অপু। মাঝেমধ্যে চিন্তা করে, সে মনসাপোতার বাড়িতে ফিরে যাবে কিনা। কিন্তু তাও পারে না, আবার সেই সীমাবদ্ধ গণ্ডির ভেতরে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেই তার শরীরের প্রত্যেকটা রক্তবিন্দু বিদ্রোহ করে।
হঠাৎ অনিল এক অসুখে পড়ে মারা যায়। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে অপু মুষড়ে পড়ে।
কিছুদিন পর অপুর দেখা হয় তার বাল্যকালের বান্ধবী লীলার সাথে। কিছুটা অবাক হয় সে, বালিকা লীলার সাথে এখনকার লীলার কোনো মিল দেখতে না পেয়ে। হঠাৎ সে উপলব্ধি করে, লীলা তার মনের ভেতরের এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। সে জায়গায় অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই।
সময় গড়াতে থাকে। অপুর মা মারা যায়। অর্থাভাবে অপুকে একসময় তার পড়াশোনা ছাড়তে হয়। নানাভাবে নানাদিক দিয়ে অপু প্রতারিত হয়। মাঝেমধ্যে তার চোখে জল আসে। খবরের কাগজে চাকরি হয় অপুর। পুরনো বন্ধু প্রণবের সঙ্গে আবার যোগাযোগ ঘটে। ঘটনার পাকেচক্রে পড়ে প্রণবের মামাতো বোনের সঙ্গে অপুর বিয়ে হয়। অপু ভয় পায়। ভাবে সকল প্রকার বন্ধনকে সে ভয় করে, তার ওপরে বিয়ের মতো বন্ধন তো আরো প্রবল। এইতো সেদিন মা মুক্তি দিয়ে গেলেন তাকে, আবার এক বছর ঘুরতেই একী!
অপুর চোখে জল আসে, তার মাকে বাদ দিয়ে এখন জীবনের এ কোন উৎসবে সে?
সময় ক্রমেই আরও গড়িয়ে যেতে থাকে। সংসারজীবনে অনভ্যস্ত অপু অপর্ণার সঙ্গে সুখের সংসার গড়ে তোলে। তাদের দু’জনের ভালোবাসায় অভিমান থাকে, হাসিঠাট্টা থাকে। সেখানে থাকে ছেলেমানুষি। অপর্ণা যেন আসে অপুর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে। তবে সুখ বেশিদিন টেকেনি অপুর কপালে।
সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অপর্ণা মারা যায়। অপুর জীবন আবারও বাঁধনহারা হয়ে পড়ে। কী করবে অপু, তা সে বুঝতে পারে না। শহরের সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে গিয়ে ওঠে পাড়াগাঁয়ে। জীবন হয়ে পড়ে আবারো এলোমেলো।
অপু দ্রুতই নিজেকে খানিকটা হলেও গুছিয়ে ওঠে। অন্তরে অপু সবসময়েই ছিল একজন পর্যটক। সে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশে। ঘটনাচক্রে চাকরি পেয়ে যায় মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে। নানা জায়গায় প্রায় পাঁচ বছর ঘোরাঘুরি করে সে আবার ফিরে আসে কলকাতায়। তার ছেলে কাজলকে নিয়ে আবারও মগ্ন হয় সংসারজীবনে।
তবে সংসারজীবন অপুর ধাতে কখনই ছিলো না। তার আট বছরের ছেলে কাজলকে নিশ্চিন্দিপুরে তার ছোটবেলার সঙ্গী রাণুদির কাছে দিয়ে সে জাহাজে করে চলে যায় ফিজিতে। সেখান থেকে আবার নতুন কোনো গন্তব্যে যাওয়ার আশা নিয়ে।
জীবনের চক্র এভাবেই চলতে থাকে। একসময় অপু এই নিশ্চিন্দিপুরের বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো। এত এত সময় পর আরেকটি বালক এখন তার অবাক বিস্ময়ভরা চোখ দু’টি নিয়ে সেই একই জায়গা দাপিয়ে বেড়ায়।
অপরাজিত একই সঙ্গে ক্ষয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অগ্রগতির উপন্যাস। আমরা কী চাই, আর তার জায়গায় কী পাই- এ দুয়ের পার্থক্য এই উপন্যাস আমাদের দেখায়। অপরাজিত আমাদেরকে দেখায়, আগে থেকেই আন্দাজ করে বসে থাকা জীবনের চেয়ে জীবন কতটা ভিন্নরকম হতে পারে। এ উপন্যাস আমাদেরকে বার্তা দেয়, যে মানুষ অতীতকে গৌরবোজ্জ্বল বা ভবিষ্যতের ব্যাপারে বেশি না ভেবে বর্তমানে বাস করে সেই সুখে থাকতে পারে।
অপরাজিত অপুর উপন্যাস। অপুর অসাধারণ জীবনকে কলমে তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। জীবন তার দু’হাতে হাজার সমস্যা অপুর দিকে বাড়িয়ে দিলেও সে হার মানেনি। অপরাজিত হয়েই সে বিচরণ করে গেছে জীবনের অলিগলিতে।