একটা সময় ছিল বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক বই তেমন একটা হতো না। এখনও যে খুব ভালোভাবে হচ্ছে তা-ও বলা যাবে না। তবে খুব ভালোভাবে না হলেও বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেশ ভালো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশিত হচ্ছে। সেসব বইয়ের মাঝে কোনো কোনোটি বেশ ভালোও হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে সেসবের মাঝে কোনো কোনোটি বিশ্বমানেরও হচ্ছে।
বিজ্ঞান বিষয়ক বই যে আর উপেক্ষিত নয় তার নমুনা বইমেলাতেই দেখা যায়। সারা মাস জুড়ে এমনকি মাসের শেষ সপ্তাহেও প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানের বই। সেগুলো স্টলে অলস পড়েও থাকে না। পাঠকেরা সেসব বই কিনে সন্তুষ্টিমাখা অনুভূতিও প্রকাশ করেন। তার নমুনা পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। বইমেলার প্রথম ভাগে প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলোকে নিয়ে রোর বাংলায় পূর্বে আলোচনা করা হয়েছিল। এবার এবারের মেলার শেষ ভাগে প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো।
১. বিগ ব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স
লেখক: মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রকাশক: জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন আগাগোড়া বিজ্ঞানের মানুষ। শিক্ষকতা করছেন বিজ্ঞানের বিষয়ে, গবেষণা করছেন বিজ্ঞানের বিষয়ে, লেখালেখি করছেন বিজ্ঞানের বিষয়ে। বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির হাতও অত্যন্ত চমৎকার। কিন্তু লেখালেখির বেশিরভাগ সময়টা প্রদান করেন সায়েন্স ফিকশন কিংবা কিশোর উপন্যাসে। এ নিয়ে বিজ্ঞানপ্রেমী পাঠকদের মাঝে একটা স্থায়ী আক্ষেপ।
এবার জাফর ইকবালের বিজ্ঞান লেখার ভক্তদের সে আক্ষেপ সামান্য কমবে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর থেকে নানা ঘটনাবহুল ইতিহাস হয়ে আজকের আধুনিক মানুষ পর্যন্ত লম্বা টাইমলাইন নিয়ে লিখেছেন এবারের বইমেলায়।
তবে সামান্য একটু হতাশাও থাকতে পারে পাঠকদের। কারণ বইয়ের পরিসর খুবই স্বল্প এবং ভেতরের বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যাও বেশ সংক্ষিপ্ত। মূল বিষয়গুলোতে শুধুমাত্র একটুখানি করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিয়েই শেষ। তবে তারপরেও ঝকঝকে রঙিন এই বইটি নানা দিক থেকে অনন্য। বইটি সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন এখানে।
২. কৃষ্ণবিবর
লেখক: অভীক রায়
প্রকাশক: প্রকৃতি পরিচয়
কৃষ্ণবিবর (Black Hole) নিয়ে বাংলায় সর্বপ্রথম বই লিখেছেন নন্দিত বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। সেটি সেই ১৯৮৪ সালের কথা। কিন্তু কৃষ্ণবিবর বা মহাবিশ্ব সম্পর্কিত জ্ঞান আজকে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। তার বিপরীতে জামাল নজরুল ইসলামের বইতে আসেনি কোনো পরিবর্তন। সে হিসেবে কৃষ্ণবিবরের উপর আরো একটি আধুনিক বই থাকা সময়ের দাবী। মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু নিয়ে আগ্রহীদের সেই দাবীই পূরণ করেছেন অভীক রায়। বিজ্ঞান লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী অভীক রায় লিখিত এই বইটি সম্বন্ধে বলছেন–
“অমর একুশে বইমেলায় বিজ্ঞানের সবচেয়ে ‘গাঢ় সুন্দর’ বই কোনটি হতে পারে সেটা দেখার আমার খুব আগ্রহ থাকে। অবশ্য নিজের বইকেই প্রায়শ সুন্দরীতমা বোধ হয়, কিন্তু নিরপেক্ষতার চূড়ান্ত মানদণ্ডে নিজেকে দাঁড় করিয়ে যদি মেলায় প্রকাশিত বিজ্ঞানের বইগুলির দিকে তাকাই তাহলে বলা যায় এবারের বইমেলায় সবচাইতে ‘গাঢ়তমা’ বই হলো অভীক রায়ের ‘কৃষ্ণবিবর’।
কৃষ্ণবিবর বা ব্ল্যাকহোল রাতের আকাশের সবচাইতে এনিগম্যাটিক বস্তু। সে এক প্রচণ্ড জ্যোতিষ্ক যে কিনা আলোকেও শুষে নিতে পারে। ভাবতেই ভয়ানক এক জ্যোতিষ্কের কথা মনে হয়। তাকে তো দেখাও যায় না। কিন্তু আনন্দের বিষয় এই প্রায় ভৌতিক শোনায় এমন জ্যোতিষ্কও পদার্থবিদ্যার বাইরে নয়। পদার্থবিদ্যার নিয়মনীতি ব্যবহার করে এর সম্পর্কে আমরা বহু তত্ত্ব ও তথ্য পেতে পারি।
কী সেই তত্ত্বসমূহ, তারা কৃষ্ণবিবর সম্পর্কে কী কী বলতে পারে, আর কী কী বলতে পারে না, সেখানে পতিত তথ্যের কী হয়, এনট্রপি সেখানে কোন খেলা খেলে, হকিং বিকিরণ আর হকিং-বেকেনস্টাইন ফর্মুলার হালকা খোঁজখবর, এমনকি পর্যবেক্ষণের চ্যালেঞ্জসমূহ এই বইয়ে চমৎকার বর্ণিত হয়েছে।
অভীক রায়ের এ বইটিকে পড়তে হবে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কিংবদন্তীর বই ‘কৃষ্ণবিবর’ (১৯৮৫) এর পাশে রেখে। আমাদের প্রজন্মের জন্য ব্ল্যাকহোল বিষয়ে প্রথম জানার উৎস ছিল জামাল নজরুলের এই অনবদ্য বইখানি। সাথে ছিল অধ্যাপক হারুন অর রশিদের লেখালেখি। …জামাল নজরুল ইসলামের অনবদ্যতা সত্ত্বেও কৃষ্ণবিবর গবেষণায় অনেক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে গত তিন দশকে। সেসবের সালতামামি বাংলায় পরিবেশন করার প্রয়োজন ছিল। সেই শূন্যস্থান পূরণে এই বই।”
৩. দ্য থিওরি অব এভরিথিং
লেখক: স্টিফেন হকিং, অনুবাদক: আবুল বাসার
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের উপর বই A Brief History of Time লিখে স্টিফেন হকিং বিখ্যাত হয়ে আছেন। তারপর আবারো বড় পরিসরে আলোচনায় আসেন The Grand Design বইয়ের মাধ্যমে। এটিও কসমোলজি তথা বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বেরই বই। কসমোলজির উপর বই লেখা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি লেকচারও প্রদান করেন। সেগুলোও মানের দিক থেকে অনন্য। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদান করা এরকম নির্বাচিত ৭টি বক্তব্যের সংকলন হলো দ্য থিওরি অব এভরিথিং নামের বই। বাংলাভাষীদের জন্য এটি অনুবাদ করেছেন আবুল বাসার।
৪. শক্তি ও জ্বালানি
লেখক: ইমতিয়াজ আহমেদ
প্রকাশক: প্রকৃতি পরিচয়
জ্বালানি ছাড়া শক্তি মিলছে না. আবার জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে প্রাণের অস্তিত্ব গুরুতর হুমকির মুখে।
একুশ শতকের বৈশ্বিক রাজনীতিতে শক্তি ও জ্বালানির গুরুত্ব অনেক। আধুনিক মানুষের সাধারণ আলাপচারিতায়ও শক্তি ও জ্বালানি সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক জ্ঞান ও উপাত্ত প্রয়োজন। কোন ধরনের শক্তির উৎস আমাদের ব্যবহার করা উচিত, কোন বিষয়ে গবেষণা আরও বাড়ানো দরকার, কোন ধরনের জ্বালানি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর- এ সবই জানা দরকার সকলের। এসব বিষয় নিয়েই এই বই।
৫. অংক ভাইয়া
লেখক: চমক হাসান
প্রকাশক: আদর্শ প্রকাশন
এবারের বইমেলায় বিজ্ঞানের বই প্রচুর বের হলেও গণিতের তেমন বের হয়নি। খুব অল্প যা বেরিয়েছে তার মাঝে চমক হাসানের ‘অংক ভাইয়া‘, অনুপম পাল, দীপন কান্তি নাথ এবং দিপু সরকারের ‘জ্যামিতির যত কৌশল’ ও ‘বীজগণিতে আনন্দভ্রমণ’ উল্লেখযোগ্য।
এটি একটি গল্পের বই, গল্পের আড়ালে গণিত কিংবা গণিতের আড়ালে গল্প। গণিতের পথে চলতে চলতেই জীবনের কিছু ভাবনা। গল্পের খুব শক্তিশালী চরিত্র হলো প্রশ্ন। সেইসব প্রশ্ন, যাদের অনেককেই প্রথম দেখায় মনে হয় অর্থহীন! টেনশন টিনা, বিটলা বান্টি, তুখোড় তন্বী আর অবাক পৃথ্বী যখন নজিবুল্লাহ স্যারের কঠিন বাক্যবাণে জর্জরিত, তখন সহায় হয়ে আসে ‘অঙ্ক ভাইয়া’- উত্তর দেয় এমন সব প্রশ্নের যা সহজে করা যায় না ক্লাসের স্যারদের। তারপর একদিন মুখোমুখি হয় দুজন- অঙ্ক ভাইয়া আর নজিবুল্লাহ মাস্টার…
বইটি সম্বন্ধে একজন পাঠক বলছেন–
“যাদের কাছে গণিত মানে হলো খাতা ভর্তি হিসেব নিকেশ, বইটি পড়ার পর তাদের চিন্তা ভাবনা বদলাবে। মানুষ গণিত শিখছে প্রকৃতি দেখে, তাই গণিতের পরতে পরতে শেখার অনেক কিছুই ছড়িয়ে আছে। কিভাবে সেটা খুঁজে পেতে হয় তার বর্ণনা আছে এই বইটিতে।”
৬. জ্যামিতির যত কৌশল
লেখক: অনুপম পাল ও দিপু সরকার
প্রকাশক: ল্যাব বাংলা
৭. বীজগণিতে আনন্দভ্রমণ
লেখক: দীপন কান্তি নাথ ও দিপু সরকার
প্রকাশক: ল্যাব বাংলা
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বা গণিত উপস্থাপনের আলাদা একটি স্টাইল দাঁড়িয়ে গেছে। গল্পের ছলে বিজ্ঞান ও গণিতের মজার মজার বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান ও গণিতে আগ্রহী করে তোলার জন্য এগুলো খুব কাজে দেয়।
কিন্তু যার জন্য এত কষ্ট করা হয়, দিন শেষে সে নিজেই যদি না থাকে তাহলে কেমন হয়? বাংলায় একটি দিক এখনো উপেক্ষিত। এ দিকটিতে এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণ বইয়ের বৈচিত্র্য তৈরি হয়নি। ভালো মানের একাডেমিক পড়াশোনার জন্য সিলেবাস উপযোগী ভালো মানের কিছু বই দরকার। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এ দিকটিতে বোর্ড বইয়ের পাশাপাশি বাইরের বই পড়ে না বললেই চলে। অথচ অনেক গণিতপ্রেমী আছে যারা বোর্ড বই শেষ করে মনে মনে আরো বৈচিত্র্যময় গাণিতিক চ্যালেঞ্জ নেবার জন্য মুখিয়ে থাকে। বোর্ড বইয়ের বাইরেও গণিতের খুঁটিনাটি জানতে চায় এবং আরো জটিল সব সমস্যা নিয়ে খেলা করতে চায়। সে অভাব পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন দিপু সরকার, অনুপম পাল, দীপন কান্তি নাথ প্রমুখ।
উপরে উল্লেখিত দুটি বই জ্যামিতির যত কৌশল এবং বীজগণিতে আনন্দভ্রমণ সেরকম বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে। গল্পের বইয়ের মতো একটানে হয়তো পড়ে ফেলার মতো না, কিন্তু বোর্ড বইয়ের পাশাপাশি সারা বছর ধরে কাছে রাখার মতো। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সকলেরই উচিত বইগুলো হাতের কাছে রাখা এবং সময়ে সময়ে নেড়েচেড়ে দেখা।
৮. মানুষের গল্প
লেখক: আশফাক আহমেদ
প্রকাশক: আদর্শ প্রকাশন
বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়া বই Sapiens: A Brief History of Humankind। এই বইটিকে ভিত্তি করে লিখিত হয়েছে মানুষের গল্প। তবে মানুষের গল্প হুবহু স্যাপিয়েন্সের ভাষান্তর নয়। এ প্রসঙ্গে লেখক আশফাক আহমেদ বলছেন–
বইটি কি ইউভাল হারারির বইয়ের অনুবাদ?
না। ইউভাল হারারি ছাড়াও আরো অন্তত দু’জন থেকে আমি বেশ ভালো পরিমাণে চিন্তা ও তথ্য নিয়েছি। একজন জ্যারেড ডায়মন্ড, আরেকজন নিয়াল ফার্গুসন।
বইটি কি হারারির বইয়ের পুরোটার অনুবাদ?
না। আমার যে অংশগুলো আগ্রহোদ্দীপক মনে হয়েছে, আমার চিন্তার সাথে তার চিন্তা মিলেছে, সেসব অংশের রূপান্তর করেছি শুধু। কেউ পুরো মজা পেতে চাইলে মূল বইটিই পড়তে বলবো। আমার বইটি গাইড হিসেবে পড়া যায় বা নিছক আনন্দের জন্য পড়া যেতে পারে।
৯. স্থাপত্য ভাবনা
লেখক: পিটার জুমথর
অনুবাদ: সুপ্রভা জুঁই
প্রকাশক: রোদেলা প্রকাশনী
বইটি প্রসঙ্গে অনুবাদক বলেন–
স্থপতি পিটার জুমথর ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝে নানা সময়ে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে, বেশ কিছু জায়গায় লেকচার দিয়েছেন। তাঁর পাঁচটি লেকচারের সমন্বয়ে এই বইটি। স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িত নন এমন পাঠকেরা বইটি পড়তে পারবেন না, তা একেবারেই বলা চলে না। কারণ স্থাপত্যের বাইরে আসলে আমরা কেউই নেই।
ফিচার ছবি- সংগৃহীত