Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যান অভ স্টিল: মনে রাখার মতো যা যা উপহার দিয়েছে

ম্যান অভ স্টিল সিনেমা দিয়ে সুপারম্যান ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজি যখন সেলুলয়েডের পর্দায় প্রত্যাবর্তন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, দর্শকরা তখন জনপ্রিয় সেই কমিক বুক ক্যারেক্টারকে বড় পর্দায় দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল। ২০০৮ সালে প্রোডাকশন হাউজ ওয়ার্নার ব্রাদার্স (WB) বিভিন্ন কমিক বুক রাইটার, মুভি স্ক্রিন-রাইটার ও ডিরেক্টরের সাথে নিয়মিত ওঠা বসা শুরু করে সুপারম্যান রিবুট করার উদ্দেশ্যে।

দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস এর প্লট ডিসকাশনের সময় ডেভিড এস. গয়ের আধুনিক সুপারম্যানের ধারণা নিয়ে ক্রিস্টোফার নোলানের শরণাপন্ন হন। ডার্ক নাইট ট্রিলজির বাঁধভাঙা সফলতার পর সুপারম্যানের গল্প নতুন করে বুনতে, ডেভিড এস. গয়েরকে সাথে নিয়ে ক্রিস্টোফার নোলান সুঁই-সুতা নিয়ে বসলেন। বুনলেন আধুনিক যুগের সুপারম্যানের এক গল্প। তা প্রোডাকশন হাউজ ওয়ার্নার ব্রাদার্সের নিকট পেশ করলে, স্টুডিওর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেভ রবিনভের মনে ধরে যায়।

সিনেমার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় পরিচালক জ্যাক স্নাইডারের ঘাড়ে। এর আগে অবশ্য স্নাইডার 300, Watchmen এর মতো কমিক অ্যাকুরেট সিনেমা উপহার দিয়ে কলাকুশলীদের ভরসা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাই, ওয়ার্নার ব্রাদারস জ্যাক স্নাইডারের ‘ম্যান অভ স্টিল’ সিনেমার হাত ধরেই ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্স (ডিসিইউ) এর যাত্রা শুরু করে।

পোস্টার; Source: Devian Art

মুক্তির পর বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে, দর্শক এবং সমালোচকদের মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েও ২২৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভিটি ৬৬৮ মিলিয়ন ডলার আয় করে বক্স অফিসে হিট হয়ে যায়। সুপারম্যান অবতারে হেনরি ক্যাভিল, জ্যাক স্নাইডারের পরিচালনার মুনশিয়ানা, হ্যান্স জিমারের মনোমুগ্ধকর আবহ সঙ্গীত, ডেভিড গয়ের ও ক্রিস্টোফার নোলানের গল্পের মিশেলে ডিসি ইউনিভার্স এই মুভির মাধ্যমে যেন নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। যা সুপারম্যান ফ্র্যাঞ্চাইজি ও ডিসি ইউনিভার্স দুটোকেই চাঙ্গা করে তুলে। কালজয়ীর তালিকায় জায়গা করে নিতে না পারলেও, ডিসিইউ-এর প্রথম এই ইনস্টলমেন্ট হিসেবে এটা কিছু জিনিস উপহার দিয়েছে, যা সত্যিই মনে রাখার মতো। 

ক্রিপ্টন

সিনেমার শুরুতে ওপেনিং সিকুয়েন্সে প্রাধান্য পেয়েছে ক্রিপ্টন গ্রহ। এখানে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ক্রিপ্টন দেখানোর বদলে চিত্রায়িত করা হয়েছে ধ্বংসপ্রায় ক্রিপ্টনের আবহ। অতি চমৎকারভাবে জ্যাক স্নাইডার ক্রিপ্টনের প্রধান চরিত্রগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, আভাস দেন লেগে থাকা রাজদ্রোহের, আর গল্পে পাকিয়ে দেন সুপারম্যানের কোডেক্স রহস্যের জট।

সিনেমায় ক্রিপ্টন গ্রহ; Source: denofgeek.com

কমিক-বুক পাঠকেরা ক্রিপ্টন সম্পর্কে ভালো-মন্দ জানলেও, কমিক না পড়া মানুষদের সে বিষয়ে তেমন ধারণা ছিল না। ম্যান অভ স্টিলে কম সময়ে যেভাবে সুপারম্যানের আদি-নিবাসকে প্রতিফলিত করা হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তাছাড়াও, সেখানে দর্শকদের কাছে পরিচয় করানো হয় সুপারম্যানের বাবা ‘জর-এল’ ও মা ‘লারা লর-ভ্যান’ এর সাথে। ক্রিপ্টনে সুপারম্যানের নাম ‘কাল-এল’ এবং পৃথিবীতে তার নাম ‘ক্লার্ক কেন্ট’, এই কথা কমবেশি সবাই জানে। সিনেমায় তাদের ভূমিকা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও স্ক্রিনে মা-বাবা দুজনকে বেশ ভালো সময়ই দেখানো হয়েছে।

সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য ‘জর-এল’ এর বিশেষ একটা ভূমিকা বিদ্যমান। ক্রিপ্টোনিয়ান ভাষা তৈরির জন্য প্রোডাকশন হাউজ একজন ভাষাতত্ত্ববিদকে নিযুক্ত করেন। জর এলের ক্রিপ্টোনিয়ান ভাষার একটা সিনও ছিল, যেটা পরে ডিলিট করে দেওয়া হয়।

হেনরি ক্যাভিল

সুপারম্যান চরিত্রে হেনরি ক্যাভিল এত দুর্দান্তভাবে সবকিছু ফুটিয়ে তুলেছেন যে, দেখে মনে হয় এ চরিত্রটি তারই জন্য যেন। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সুপারম্যান রিটার্ন্স’ সিনেমার জন্য অডিশন দিলেও সেখানে তিনি গ্রিন সিগন্যাল পাননি। কিন্তু মনে যিনি পৃথিবীর অন্যতম সেরা সুপারহিরোর রোল প্লে করার স্বপ্ন বুনে রেখেছেন, তিনি কি অত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র? কমিক-বুক সম্পর্কে বিশদ জ্ঞানী জ্যাক স্নাইডার, তাই পরের বার আর সেই প্রতিভাকে হাতছাড়া করতে চাননি। ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায়, পরবর্তী সুপারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হলো সুদর্শন ও সুঠাম দেহের অধিকারী হেনরি ক্যাভিলকেই। হারানো সুযোগ পুনরায় ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি হেনরি ক্যাভিল, ‘ম্যান অভ স্টিল’ সিনেমায় ঢেলে দিলেন নিজের সর্বোচ্চটা।

সুপারম্যান চরিত্রে অডিশন দেয়ার সময় হেনরি ক্যাভিল; Image: pinterest.com

হেনরি ক্যাভিলের মতে, শার্ট ছাড়া দুইটা দৃশ্যের জন্য যে ফিজিক্যাল ট্রেনিং করতে হয়েছে, তা ছিল মুভির সবচেয়ে কঠিন অংশ। কারণ, পেশী ফুলাতে তিনি কোনো গ্রাফিক্স বা স্টেরয়েড গ্রহণ করে স্ক্রিনে চালাকি দেখাতে রাজি ছিলেন না। ট্রেনিং রেজিমেন্টে ক্যাভিলকে প্রতিদিন ৫টা ১০০০ ক্যালোরির প্রোটিন শেক গ্রহণ করতে হতো। মজার ব্যাপার হলো, ‘সুপারম্যান রিটার্ন্স’ এর অডিশন দেয়ার আগে তিনি ‘ব্যাটম্যান বিগিন্স’ (২০০৫) সিনেমাতেও ব্যাটম্যান রোলের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন। 

সুপারম্যান চরিত্রে হেনরি ক্যাভিল; Source: flipboard.com

বাস্তবতা

বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলাটা অনেক সিনেমার (বিশেষ করে সুপারহিরো সিনেমায়) মুখ্য উদ্দেশ্য না হলেও, এই সিনেমায় ভিন্ন কয়েকটা লেভেলে বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, সুপারম্যানের মূল উপাদানগুলোকে অবিকৃত রেখেই একে বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে মিশ খাওয়ানো হয়েছে। শুরুতেই সুপারম্যানকে আকাশে পাখির মতো উড়তে দেখা যায়নি। সে কীভাবে, কোত্থেকে এসেছে, কীভাবে এই শক্তি পেয়েছে, তা শুরু থেকে সিনেমার ফার্স্ট হাফ পর্যন্ত সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

‘ফার্স্ট ফ্লাইট’ সিনের মাধ্যমে সুপারম্যানের ব্যর্থতা ও সফলতা একই সূতায় বাধা হয়েছে। সে যে অলৌকিক কোনো প্রাণী বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী নয়, তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে হলুদ সূর্যের মাধ্যমে। ক্রিপ্টনের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হওয়া প্রাণী যে পৃথিবীর আবহাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, সেটাও সিনেমায় পরিষ্কার। তাই তো জেনারেল জড ও তার সাঙ্গু-পাঙ্গুদের আলাদা স্যুট ও মাস্ক পরে পৃথিবীতে নামতে দেখা যায়। 

জেনারেল জড ও তার দল; Source: comicbook.com

দ্বিতীয়ত, কী হবে, যদি এলিয়েনরা আমাদের পৃথিবীতে আক্রমণ চালায়? এ প্রশ্নের উত্তরটাও আশংকাজনক। সে জিনিসটা পৃথিবীতে ক্লার্ক কেন্টের বাবা জোনাথন কেন্ট ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই, তিনি যুবক ক্লার্ককে একদম সহজ-সরল জীবনযাপনের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। বানিয়ে রাখতে চেয়েছেন আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই। কারণ, তার মনে ভয় ছিল যে পুত্রের আসল ঠিকানা মানুষ জেনে গেলে, তা সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে যাবে এবং সবার জীবন পড়ে যাবে হুমকির মুখে।

শক্তিশালী ভিলেন

সিনেমায় জেনারেল জডকে ভিলেন দেখানো হলেও তাকে পুরোপুরি ভিলেন বলা যায় না। কারণ, ক্রিপ্টনের একজন জেনারেল হিসেবে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, যেকোনো মূল্যে ক্রিপ্টনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। ক্রিপ্টনে কে প্রকৌশলী হবে, কে চিকিৎসক হবে, কে যোদ্ধা হবে, তা জন্মের আগ থেকেই ঠিক করে ফেলা হয়, এবং সে অনুযায়ীই তাকে বড় করে গড়ে তোলা হয়। সে হিসেবে, জেনারেল জডেরও একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্রিপ্টনকে সকল প্রকার বিপদ থেকে রক্ষা করা।

গ্রাফিক নভেলে জেনারেল জড ও সুপারম্যান; Source: comicvine.com

স্পেসশিপ নিয়ে দলবলসহ জেনারেল জডের পৃথিবীতে অবতরণটা ফিল্মের সাসপেন্সফুল সিকুয়েন্সের মধ্যে অন্যতম সেরা একটি মূহুর্ত। পৃথিবীর আকাশে জডের শিপ প্রতীয়মান হবার সাথে সাথেই, সে স্যাটেলাইটের দখল নিয়ে সব টিভি চ্যানেলে তার আসার খবর জানান দেয়। জেনারেল জডের ভূমিকায় মাইকেল শ্যাননের অভিনয় চরিত্রটাকে পুরোপুরি জীবিত করে তুলেছিল। ঘৃণা, ক্রোধ, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ সবকিছুর অভিনয়েই মাইকেল শ্যানন যেন পূর্বের শ্যাননকে ছাড়িয়ে গেছেন।

সুপারম্যান আর জেনারেল জডের লড়াইয়ের সময় মেট্রোপলিস প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। শিপে করে ছোট্ট কাল-এল’কে পৃথিবীতে পাঠানোর সময়ই জেনারেল জড প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যেভাবেই হোক তিনি তাকে খুঁজে বের করবেন। পরবর্তীতে তিনি তার কথা রেখেছিলেন।

ম্যান অভ স্টিল-এ জেনারেল জড; Source: supermanhomepage.com

একক গল্প উপস্থাপন

ডিসি ইউনিভার্সে উপস্থিত মাল্টিভার্সের ভিড়ে, ক্রসওভার ঘটে যাচ্ছে হরহামেশাই। আর ডিসির কমিক, অ্যানিমেশনগুলো সুপারম্যান টাইটেল নিয়ে পাঠক-দর্শকদের কাছে হাজির হলেও সেখানে বিভিন্ন সময় অন্যান্য সুপারহিরোদের কাহিনীও উঠে এসেছে। এদের মধ্যে ব্যাটম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান, ফ্ল্যাশ, অ্যাকোয়াম্যান অন্যতম। সেদিক থেকে ম্যান অব স্টিল পুরোপুরি ১০০% সুপারম্যান ও তার সাথে সম্পৃক্ত সত্তাগুলোর গল্পই বলেছে। অতিরিক্ত কাউকে যোগ করা হয়নি। সুপারম্যান ফ্র্যাঞ্চাইজির রিবুটের মাধ্যমে ডিসিইউয়ের পথচলার জন্য সুপারম্যানের অরিজিন পরিষ্কার করা দরকার ছিল, এবং সিনেমাটি সে দিক থেকে সফল।

অল্প সময়ের মধ্যেও অরিজিন ডিটেলিং খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন জ্যাক স্নাইডার। এরপর ফোকাস করা হয়েছে মূল চরিত্র মার্থা কেন্ট ও জোনাথন কেন্ট, লোয়েস লেইন প্রমুখের উপরে। একদিকে পরিচয় গোপন করে বেড়ে উঠা ক্লার্ক কেন্ট, স্বজাতির অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারে বদ্ধপরিকর জেনারেল জড, স্বাধীনচেতা সাংবাদিক লোয়েস লেন, এ যেন শুধু সুপারম্যানের এক আলাদা জগৎ।

মা মার্থা কেন্টের সাথে ছেলে ক্লার্ক কেন্ট; Source: dailysuperheroes.com

হ্যান্স জিমার

হ্যান্স জিমারকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জিনিয়াস মিউজিশিয়ান বললে বোধহয় ভুল হবে না। সঙ্গীতের জীবন্ত এ কিংবদন্তি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন গ্ল্যাডিয়েটর, ইনসেপশন, ইন্টারস্টেলার, দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলজি, দ্য লায়ন কিং, পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান, ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান  ইত্যাদি জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সৃষ্টির মাধ্যমে। সেই সঙ্গীত স্রষ্টা আপন মহিমায় সুর বুনেছেন ম্যান অব স্টিল সিনেমাটিরও।

হ্যান্স জিমার; Source: hdslb.com

এর আগে সুপারম্যান সিনেমাগুলো সুরকার জন উইলিয়ামের আইকনিক সুপারম্যান থিম অনুসরণ করে গেলেও, স্নাইডার তাতে নতুনত্ব যোগ করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি সাত-পাঁচ না ভেবে হ্যান্স জিমারের দরজাতেই কড়া নাড়লেন। সিনেমার আবহ সঙ্গীত মূলত লেখা হয় চিত্রনাট্য, শুটিং লোকেশন, চরিত্রের অভিব্যক্তি, ইত্যাদিকে ভিত্তি ধরে। যা শ্যুট করা দৃশ্যে সুর ঢালার পর: দৃশ্যবস্তুর মূল ভাবাবেগ দর্শক মনে পৌঁছে দেয়। দর্শন-শ্রবণের ঐকতান যত সফল হবে, সিনেমাও দর্শকের হৃদয়ে তত স্পর্শ করবে। হ্যান্স জিমার সেটা খুব ভালো করেই বুঝেন, তাই তো ফলাফল আসে অতি-চমৎকার!

৭০ দশকের সেই সুপারম্যান থিম থেকে বেরিয়ে হ্যান্স জিমার সুর বাঁধলেন একদম নিজের মতো করে। পুরোটা সময়ই তার সৃষ্টি করা আবহ সঙ্গীত সিনেমার দিকে মনোযোগ বসিয়ে রেখেছে। তা শুরুর সেই ক্রিপ্টনের দৃশ্যেই হোক, জেনারেল জড আর সুপারম্যান ফাইটেই হোক বা ফার্স্ট ফ্লাইট, সবদিক থেকে দশে দশ!

হেনরি ক্যাভিল, হ্যান্স জিমার ও জ্যাক স্নাইডার; Source: cinemacure.wordpress.com

ফার্স্ট ফ্লাইট

নিঃসন্দেহে ম্যান অভ স্টিল সিনেমার সবচেয়ে আইকনিক ও প্রশংসা করার মতো একটা দৃশ্য হচ্ছে কাল-এল’ এর ফার্স্ট ফ্লাইট সিনটা। দেখলেই বুঝা যায়, জ্যাক স্নাইডার এই সিনটায় অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ কাল-এল থেকে সুপারম্যানে পরিণত হওয়ার দৃশ্যটাতে দর্শকের মনোযোগ হরণ হয়ে গেলে, সেই প্রাপ্তিটা ব্যর্থতার খাতাতেই যুক্ত হবে। এই সিনে অতিমানবীয় বা অতিদানবীয় কিছুরই দেখা মেলেনি। অন্য গ্রহ থেকে আসা কাল-এল হলুদ সূর্য, ও পৃথিবীর পরিষ্কার বায়ুমণ্ডলের সুবিধা নিয়ে হয়ে উঠে অধিক শক্তিশালী।

বাবার সব নির্দেশ অনুসরণ প্রথমবার উড়ার চেষ্টা করলেও, ভুল পদক্ষেপের কারণে তাকে অসফল হতে হয়। এরপর আবার উড়ার চেষ্টা করার পরেই সফল হয় সে। হ্যান্স জিমারের আবহ সঙ্গীত, জ্যাক স্নাইডার দক্ষ পরিচালনা, হেনরি ক্যাভিলের দুর্দান্ত অভিনয় ও অভিব্যক্তির মিশেলে পুরো মুভিতে সেই সিনের আউটপুট এসেছে আইকনিক সিন হিসেবেই, যার স্বাদ দর্শকরা আগে সুপারম্যানের কোনো মুভিতে পায়নি।

ফার্স্ট ফ্লাইট সিন; Image: Warner Bros.

গল্প এগিয়েছে চরিত্র দিয়ে, অ্যাকশন দিয়ে নয়

এই সিনেমায় সুপারম্যানকে যতটুকু না শক্তিশালী সুপারহিরো হিসেবে দেখানো হয়েছে, তার চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে। সুপারম্যান প্রসঙ্গে বারবার মানবিকতার প্রশ্নই উঠে আসে। এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সে কতটা মানবিক? সে কি তার শক্তির অপব্যবহার করছে? পৃথিবীতে মা-বাবা ও লোয়েস লেনের প্রতি ভালোবাসাই তার মানবিকতাকে পুরোদমে প্রতিফলিত করেছে।

ছেলের পরিচয় গোপন রাখার জন্য বাবা নিজের জীবন দান করে দিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা জেনারেল জড ও তার দলের বিরুদ্ধে অপরিণত সুপারম্যান ছিল বালির বাঁধের মতো। তবুও সে নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছে, শান্তির লক্ষ্যে শুরুতেই আত্মসমর্পণ করেছে সেনাবাহিনী ও জডের মিলিটারির কাছে। তাই সিনেমাতে অ্যাকশনের চেয়ে চরিত্র মূল্যায়ন, মানবিকতা ও ভাবাবেগ গুরুত্ব পেয়েছে বেশি।

আমেরিকান মিলিটারির কাছে সুপারম্যানের আত্মসমর্পন; Source: priormovie.com

ইস্টার এগ

ডিরেক্টর জ্যাক স্নাইডার মুভিটিতে ইস্টার এগের মাধ্যমে ডিসিইউ-এর আপকামিং সিনেমাগুলোর কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিল। নিচে এর কয়েকটি উল্লেখ করা হলো.

১. ম্যান অভ স্টিলে সরাসরি লেক্স লুথারের কথা উল্লেখ করা না হলেও কিছু দৃশ্যে লেক্স লুথারের কোম্পানি ‘লেক্সকর্প’কে দেখানো হয়েছে। এর মানে স্নাইডার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, লেক্স লুথার এই ইউনিভার্সেই বিদ্যমান।

লেক্সকর্পের ইস্টার এগ; Source: 3djuegos.com

২. সিনেমার ক্লাইম্যাটিক ব্যাটেলে জেনারেল জড যে স্যাটেলাইটটা পাকরাও করেছিল, সেটাতে ‘Wayne Enterprises’ এর লগো বিদ্যমান ছিল। ওয়েন এন্টারপ্রাইজের মালিক হলো ব্রুস ওয়েন তথা ব্যাটম্যান।

Source: screenrant.com

৩. ব্যাটেলের এক দৃশ্যে একটা পোস্টারে দেখা যায়, “Keep Calm and call Batman.”

Source: aminoapps.com

৪. ক্রিপ্টোনিয়ান বহরে ব্রিয়ানিকের চিহ্নও দেখা যায়, যে ডিসি ইউনিভার্সের অন্যতম সেরা এক ঘাতক।

ব্রিয়ানিকের লগো; Source: dccomicsextendeduniverse.fandom.com

৫. জেনারেল জডের বহরের নাম ছিল ব্ল্যাক জিরো। কমিকে ব্ল্যাক জিরো হলো সুপারবয়ের এক ইভিল অল্টারনেট ভার্সন।

৬. ফাইনাল ব্যাটের একটি সিনে WGBS এর লগো দেখা যায়, যে কোম্পানির মালিকের সাথে ডিসি ভিলেন ডার্কসেইডের সরাসরি যোগাযোগ আছে।

WGBS এর লগো; Source: whatculture.com

৭. মুভির শুরুতে কাল-এল এর জন্মের সময় একটা দৃশ্যে দেখা যায়, ক্রিপ্টনের চাঁদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই চাঁদটা ধ্বংস করেছিল মূলত প্রাচীন ক্রিপ্টোনিয়ান দানব ডুমসডে। ডিসিইউতে মোট দুইটা ডুমসডের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে একটাকে দেখা গেছে ব্যাটম্যান ভার্সাস সুপারম্যান মুভিতে।

ধ্বংস হয়ে যাওয়া ক্রিপ্টনের চাঁদ; Source: screenrush.com

৮. মুভির একটা সিনে দেখা যায়, মাঝ সমুদ্রে এক তেল কোম্পানির কিছু লোককে বিস্ফোরণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে পানিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। কমিক-বুক অনুযায়ী এই তেল কোম্পানির নাম হলো ‘মেরেভাল অয়েল’, যাদের সাথে অ্যাকোয়াম্যানের দ্বন্দ্ব ছিল। এছাড়াও ক্লার্ক কেন্ট ডুবে যাবার পর কিছু তিমি তাকে বাঁচাতে চলে আসে। যা থেকে অ্যাকোয়াম্যান ইস্টার এগের পরিপূর্ণ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

জ্যাক স্নাইডার

বলা-বাহুল্য, জ্যাক স্নাইডার বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ডিরেক্টরদের মধ্যে একজন। কমিক অ্যাকুরেট ও ডার্ক টোনের সিনেমা নির্মাণে সিনে-জগতে বিশেষ খ্যাতি আছে তার। কমিক অ্যাকুরেট সিনেমা বুননে তিনি কী পরিমাণ দক্ষ, তা 300 আর Watchmen সিনেমার মাধ্যমেই প্রমাণ করে দিয়েছেন। তার মতো কমিক-জ্ঞান খুব কম ডিরেক্টরই রাখেন। টাইটানিক, অ্যাভাটার মুভির নির্মাতা জেমস ক্যামেরন বলেছেন, জ্যাক স্নাইডারের মতো পরিচালকেরা তার নিকট অনুপ্রেরণা-স্বরূপ।

জ্যাক স্নাইডার; Source: cheatsheet.com

২০১০ এর অক্টোবরে স্টুডিও ম্যান অভ স্টিল মুভিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয় জ্যাক স্নাইডারকে। নিরাশ করলেন না স্নাইডার, নতুন সুপারম্যান বক্স অফিসে হিট উপহার দিল। স্নাইডারও মুভিতে বেশ কিছু ইস্টার এগ ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝিয়েছিলেন, ওয়ার্নার ব্রাদারসকে নিয়ে একটি বড় সুপারহিরো ইউনিভার্সের দিকে এগোচ্ছেন তিনি।

শত ভাংচুরের মধ্যেও স্নাইডারের স্টোরিটেলিং ক্ষমতা দুর্দান্ত। কম সময়ের মধ্যেই তিনি সুপারম্যানের অরিজিন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়াও কিছু সিন স্লো-মোশন ও ফাস্ট করেছেন, যা সত্যিই চিত্রনাট্যর প্রতি বিশেষ মুগ্ধতা যুক্ত করেছে। স্টুডিও চেয়েছিল বোটের একটা দৃশ্য গ্রিন স্ক্রিনে শ্যুট করে ফেলতে। কিন্তু দৃশ্যটাকে অধিকতর জীবন্ত করার জন্য তিনি দলবল নিয়ে ছুটলেন একেবারে মাঝ সমুদ্রে! এভাবেই ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সকে এগিয়ে তিনি বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। ফ্যানেরা তার সাজানো ইউনিভার্সের নাম দিয়েছে ‘স্নাইডারভার্স’, যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া restorethesnyderverse হ্যাশট্যাগে আন্দোলনও করেছিল।

নিজের ইউনিক ডিরেক্টিং স্টাইল ও সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝার কারণে, স্নাইডারের আলাদা একটা ফ্যান-বেজ তৈরি হয়ে গিয়েছে। যারা কয়েকদিন আগেই এক অসাধ্য সাধন করে বসেছে। ডিসির সুপারহিরো কম্বিনেশন ‘জাস্টিস লিগ’ মুভি কোনোমতেই দর্শকের আশা পূরণ করতে পারেনি। শুরুতে এর ডিরেক্টর জ্যাক স্নাইডার থাকলেও, মেয়ের মৃত্যুতে তিনি পরিচালনা থেকে সরে আসেন। স্টুডিও তখন তার দায়িত্ব অর্পণ করেন ডিরেক্টর জোশ হোয়েডনের কাছে। তিনি সবকিছু একদম নিজের মতো করে গুছিয়ে নেন। স্নাইডারের ডার্ক টোন নীতি থেকে বের হয়ে সিনেমাকে বানান কালারফুল।

ফলাফল, সিনেমা রিলিজের কয়েকদিনের মধ্যেই সন্দেহ শুরু হয় ভক্তদের। স্নাইডারের ডার্ক টোনের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই মুভিতে। জাস্টিস লিগের আসল স্নাইডার কাট ভার্সন রিলিজ করার পিটিশন খোলা হয়, ৫ দিনের মধ্যে সেটার পক্ষে প্রায় ১ লাখ স্বাক্ষর পড়ে। ধীরে ধীরে আন্দোলনে যুক্ত হয় আরও অনেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘Release the SnyderCut’ হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিংয়ে পরিণত হয়। এদিকে ভক্তকুলের উৎসাহ পেয়ে স্নাইডারও কেটে ফেলা অংশের বিভিন্ন সিন, ফটো আপলোড দিতে থাকেন।

এরপর আর যায় কোথায়? আন্দোলন ফুলে-ফেঁপে একাকার। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর কমেন্ট, ইনবক্স ভেসে যায় স্নাইডারকাট রিলিজের দাবিতে। টাইমস স্কয়ারের বিলবোর্ড, স্যান ডিয়েগো কমিকন, ইংলিশ এফএ কাপ অধিকাংশ জায়গায়ই ছেয়ে যায় এই হ্যাশট্যাগে। অবশেষে স্টুডিও তাদের মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। HBOmax স্ট্রিমিং সার্ভিসে ‘জাস্টিস লীগ স্নাইডার কাট’ মুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

Related Articles