গল্পগুলো একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন। কোনো যোগসাজশ না থাকায় প্রথম প্রথম খাপছাড়াও মনে হতে পারে। কেননা কোন গল্পের শুরু কোত্থেকে তা ঠিক বোঝা যায় না। এমনকি শেষটা কোথায় তার উত্তরও চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক নূর ইমরান মিঠু তার চলচ্চিত্রে দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে কমলা রকেটকে অপরিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন গল্প বলে মনে হয় না। বরং মনে হয় সিনেমাটি পরিমিতিবোধ এবং সংবেদনে কোনো ঘাটতি না রেখেই ডালপালা মেলা সমষ্টিগত গল্পটিকে সেলুলয়েডে সার্থকতার সাথে গুছিয়ে বলতে পেরেছে।
কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ ও ‘সাইপ্রাস’ নামক দুইটি গল্প অবলম্বনে কমলা রকেট-এর চিত্রনাট্য করেছেন শাহাদুজ্জামান ও নির্মাতা নূর ইমরান মিঠু জুটি। চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষ অব্দি পুরোটাই ঢাকা থেকে খুলনাগামী একটা রকেটে। রকেট বস্তুটি হল ব্রিটিশ আমলের স্টীমার, যা কিনা শত বছরের ঐতিহ্য অটুট রেখে এখনো নদীপথে চলাচল করে যাচ্ছে। ছিয়ানব্বই মিনিটের যাত্রাপথে এমনই এক কমলা রঙের রকেটে চড়ে বসে সমাজের আপার ক্লাস, লোয়ার ক্লাস আর মৃত একটি লাশ।
গন্তব্য সবার একইপথে হলেও তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা একেকজনের এক এক রকম। এ যেন চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের ক্লাস সিস্টেমেকে দেখিয়েছেন নির্মাতা। তৌকির আহমেদের অজ্ঞাতনামা চলচ্চিত্রের মতো কমলা রকেটও মূল সংকট লাশ নিয়ে। তবে পাশাপাশি গল্পে ঠাঁঁই নিয়েছে বেকারত্ব সমস্যা, বিসিএস হাইপ, পরকীয়া সম্পর্ক, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শারীরিক প্রেম কিংবা সাম্প্রতিক হলি আর্টিজান হামলা, রানা প্লাজাসহ নানা চেনাপরিচিত ঘটনা অথবা এসব ঘটে যাওয়া ঘটনার নানা উদ্ধৃতি। কমলা রকেটে আরও আছে একটি ক্ষয়িষ্ণু সার্কাসের দল, যারা কিনা একরকম অস্তিত্ব সংকট নিয়েই টিকে আছে; আজ এই রকেটে কাল ঐ রকেটে।
সিনেমার শুরুটা সামান্য ধীর। তবে সময়ের সাথে সাথে মাঝ দরিয়ায় বেগ পেয়েছে কাহিনী। সরলরৈখিক এ গল্পে টুইস্ট না থাকলেও বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো এক সূত্রে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। উপস্থাপনায় মনে হয়েছে পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল গোষ্ঠীকে একটি রকেটে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। মানুষের যে শারীরিক জৈবিক চাহিদা, তাও উঠে এসেছে পৌনঃপুনিকভাবে। এমন একটি চরিত্রকে যাত্রী করা হয়েছে যে কেবল একটি শরীরী রাতের আশায় স্টিমারে চড়ে বসেছে। আর সে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে গল্পের অন্যতম প্রধান আতিক চরিত্রের জেগে উঠা যৌন ক্ষুধাকে যেভাবে অলংকরণ করা হয়েছে সেটিও নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। মফিজুরের দেয়া ভিজিটিং কার্ড গল্পের শুরুতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও পরবর্তীতে বিশেষ মুহূর্তে ফেলে দেয়া কার্ড কুড়িয়ে নিয়েছেন তিনি। যা সংলাপে না বলিয়েও অনেক কথা বলে দিয়েছে।
চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ নিয়ে কিছু না লিখলে নয়। ছবির ড্রোন ব্যবহৃত বেশ কিছু এরিয়েল শট মুগ্ধ করার মতো। এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো সিনেমার সবগুলো শটই হয় রকেটের ভিতর থেকে শুট করা, নাহয় বাইরে থেকে রকেটকে ফোকাস করে ফ্রেম নেয়া। গোলাম মাওলা নবিরের চিত্রগ্রহণে মিডক্লোজ এবং ক্লোজশটের প্রাচুর্য সাথে টাইট ফ্রেম ধরার যে দৃশ্যমান প্রবণতা, তা কেবল ইরানি নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামির ক্লোজআপ সিনেমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও ডেকের উপরে এবং সার্কাসের দলের সিনগুলোর কম্পোজিশন অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ মনে হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্পেসের সংকট হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে। সে সূত্রে ওয়াইড লেন্স ব্যবহার করেও পুরোপুরি সফলতা মেলেনি। এক্ষেত্রে অবশ্য চিত্রসম্পাদক সামির আহমেদের আন্তরিকতা এবং পারঙ্গমতা চোখে পড়েছে। এডিটিং টেবিলের কাটাছেঁড়ায় তিনি যে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তার সাক্ষ্য দেয় কমলা রকেট।
অভিনয়ের পারদর্শিতায় কোনো চরিত্র কেউ কারো থেকে কম যাননি। তবে আতিক মূলত সিনেমার প্রানভোমরা হিসেবে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ উঁচুতে তুলেছেন। নার্সিসিস্ট গ্ল্যামারগার্ল দিশি চরিত্র সৌন্দর্যের দ্যুতির সাথে পারফর্মেন্সেও নিজেকে ভালো অভিনয়শিল্পী প্রমাণ করেছে। এদিকে আয়শা-মতিন দম্পতি মোটের ওপর ভালো করে গেছেন। ছবির প্রথমদিকে সংলাপে কিছু অপ্রাসঙ্গিকতা এবং অযত্নের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। যা গল্পের মূল সুরের সাথে যোগসূত্র তৈরিতে অসহায়ক লেগেছে। মফিজুর চরিত্রের বাচনভঙ্গি এবং সংলাপে কমিক রিলিফের পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্ব ছিল। প্যাথোসের মাঝেই হিউমারের বাস, তা বুদ্ধিদীপ্ততায় দেখিয়েছে চরিত্রটি। আবার তার বদৌলতেই শেষার্ধে আলাদা আলাদা গল্প একসূত্রে আবদ্ধ হতে পারে। অন্যদিকে মৃত লাশকে যাত্রাসঙ্গী করে মনসুর দেখিয়েছেন বিষাদের নীল দেখতে কেমন হয়। খুব সহজে প্রত্যক্ষ করা গেছে শোকে মূহ্যমান ভারী মনের জমে থাকা অভিমান, দুঃখকষ্ট।
মোহন শরীফের কণ্ঠ সুর সঙ্গীতে ‘মোমবাতি‘ ট্র্যাকটি ভিন্নরকম এক মাতাল আবহ উপহার দিয়েছে। এছাড়াও সিনেমার পারিপার্শ্বিক অন্যান্য ছোটোখাটো নানা ঘটনা গতানুগতিক ষ্টীমার যাত্রার সাথে মিল রেখে করা। এজন্য যে কাহিনীকারের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল তা দর্শক হিসেবে কারোর দৃষ্টি এড়াবার কথা নয়। পরিচালক দ্বিতীয় অংশের পর থেকে ক্রমান্বয়ে গল্পের গতিকে বাড়িয়ে ধীরে ধীরে মানবিক করে তুলেছেন তার সিনেমাকে। উদ্ভূত সংকটে ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জাররা নিচে নেমে এসে নিচের ডেকের যাত্রীদের সাথে এক লাইনে দাঁড়িয়েছে ২০০ টাকা দিয়ে শুধু একটু ডালভাত খাবে বলে। অনেকদিন চোখে লেগে থাকার মতো সে দৃশ্য!
আর ঐসময়েই কিনা মফিজুরকে লাইনের জটলায় এসে যিনি ভাত ডাল সরবরাহ করছেন তাকে সবার অগোচরে একটু কম কম করে খাবার দেয়ার পরামর্শ দিয়ে যেতে দেখা যায়। সংকটকে আরও তীব্রতর করার নিমিত্তে খাবারের লাইনের পাশে মানুষের লাশ পচে দুর্গন্ধ বের হওয়া শুরু করে। সে লাশের গন্ধে নাড়ি উল্টে বমি আসতে চায় যাত্রীদের! দৃশ্যচিত্রে সে পরিস্থিতি পুরোপুরি বাস্তবিক হয়ে উঠে লাশের কফিনকে ঘিরে মাছি ভনভন করার দৃশ্যে। পচন ধরতে শুরু করা লাশকে ইঁদুর ছিঁড়েফুরে খাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে কাঠের কফিনের উপর দিয়ে ছুটে বেড়ায়। সত্যিই তারিফ করার মতো একেকটি শট! বড্ড অদ্ভুত সুন্দর চোখ— দেখার, দেখানোর!
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সবথেকে তাৎপর্যময় হয়ে উঠল সিনেমার শেষ দৃশ্যটি। নিজের কর্মফলের উটকো বীভৎস গন্ধে শরীরের ভিতর থেকে গুলিয়ে আসছে আতিকের। তা দেখে মনসুর প্লেটের সামনে এগিয়ে দিচ্ছে দুটো মরিচ যেন আতিক একটু ভালকরে ডাল-ভাতটুকু খেতে পারে। আতিকের এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় তার নিজের উপলব্ধিকে, অনুশোচনাকে নির্মাতা যেভাবে কোনো সংলাপ ছাড়াই শুধু অভিব্যক্তির মাধ্যমে পর্দায় দেখিয়েছেন তা এক কথায় অনন্য। এরকম পরিস্থিতিতে আতিক আর সইতে না পেরে ডেকে বসেই সশব্দে বমি করতে শুরু করে। যেন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সকল পাপবোধকে শরীর থেকে বের করে দিয়ে শুদ্ধ হতে চাইছে সে! আতিকের ব্যাকগ্রাউন্ডে জুক্সটাপজিশনে মফিজুর আর মনসুরকে দেখতে পাওয়া যায় তাদের সাথে বহন করা লাশের গন্ধ চারপাশে না ছড়ানোর ফায়দা আঁটতে। এতসব যখন ঘটছে, কমলা রকেট কিন্তু তখনও অভীষ্ট গন্তব্যে যেয়ে পৌঁছায়নি।