ভোট। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ভোটকে বলা যায় ব্যক্তিবিশেষের মতামত। অথবা বলা চলে, জনমত প্রতিফলনের গণতান্ত্রিক মাধ্যম। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় একটা ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কখনোই তা অর্থ দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। একটা ভোটের কারণেই যেমন কেউ নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে; আবার একটা ভোটের কারণে পরাজিতও হতে পারে।
ভোট নিয়ে জোচ্চুরিপনারও শেষ নেই। দূরদেশের কথা বলে কি লাভ? আমাদের দেশেই তো এমন অহরহ ঘটনা আছে। এমনকি অনেকেরই এমন মতামত যে- একটা ভোটে আর এমন কি আসে যায়? আসে যায়। অনেক কিছুই আসে যায়। ভুলে যাবেন না বিন্দু বিন্দু জল নিয়েই গড়ে সিন্ধু নদী। ঠিক একইভাবে প্রতি ব্যক্তির স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতেই গড়ে উঠে নগর, শহর এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা।
একটা ভোটের গুরুত্ব বা মহিমা খুব ভালোভাবে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ম্যাডোন অ্যাশউইন। কোলিউডের এই নির্মাতা হাস্যরসের মধ্যে দারুণ এক সত্যকে তুলে ধরেছেন তার নির্মিত নতুন সিনেমা ম্যান্ডেলার মাধ্যমে। মুভিটিকে নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার বলা চলে। একটা ভোটের আশায় মানুষ কতটা নীচে নামতে পারে; অথবা একটা ভোটের মূল্যবোধ মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে; উভয়ই উঠে এসেছে কমেডি ধাচের এই সিনেমাতে।
গল্পটা তামিলনাড়ুর এক প্রত্যন্ত গ্রামকে কেন্দ্র করে। ভারতের আরো কয়েকশো গ্রামের মতোই এই গ্রামেও স্বাস্থ্যসম্মত কোনো শৌচাগার নেই। তো পঞ্চায়েত নেতা বা এলাকার চেয়ারম্যান স্থানীয় রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে গ্রামে একটি শৌচাগার নির্মাণ করে। সবই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু ভেজাল বাঁধায় তার দুই ছেলে। নেতার আবার দুই স্ত্রী। একপক্ষ গ্রামের উত্তর দিকের আর অন্যপক্ষ দক্ষিণ দিকের। সেই সুবাদে দুই ছেলে দুই পক্ষের। উত্তরের লোকজন ভাবে তারাই উন্নত; আবার দক্ষিণের বাসিন্দারাও তাই ভাবে। এই জাতভেদের ব্যবধান নিয়ে ঝগড়া লেগে যায় শৌচাগার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ফলশ্রুতিতে, শৌচাগার ব্যবহারের আগেই যায় গুঁড়িয়ে। আর ছেলেদের এসব কাণ্ড দেখে নেতার হয় স্ট্রোক।
নেতা তো বিছানায়। এদিকে নির্বাচনের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। কী করা যায়? যে-সে-কেই। মানে নেতার দুই অযোগ্য পুত্ররাই দাঁড়িয়ে যায় নির্বাচনে। একজন নেয় নারিকেল মার্কা আর অন্যজন ট্রাক্টর। কিন্তু নির্বাচন সম্পর্কিত তেমন কোনো ধারণাই নেই দুই ভাইয়ের। আদতে নেতা হবারও তেমন কোনো ইচ্ছে নেই দুই ভাইয়ের। কেবলই উত্তরপক্ষ চায় দক্ষিণকে নীচু করতে আর দক্ষিণ চায় উত্তরকে। উত্তরের লোকজন নিজেদের ভোটারদের একাট্টা করে। দক্ষিণেও তাই। লোকদেখানিতে দুই ভাই একে অপরের বিরুদ্ধে নামে এক লালসার যুদ্ধে। টাকা দিয়ে ভোট কেনা যাকে বলে। দেদারসে টাকা ঢালতে থাকে দুই ভাই ভোটের জন্য। দুই পক্ষই যখন তাদের ভোটার গুনে শেষ করে, তখন দুজনেরই ৪২০ জন ভোটার। ঠিক এমন সময় গ্রামের নতুন এক ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে প্রবেশ করে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা।
গ্রামের উত্তর আর দক্ষিণের সীমানার ঠিক মধ্যভাগে আছে এক বিশাল বড় বটগাছ। সেই গাছেই বসবাস নাপিত স্মাইল এবং তার এক সহকারী। স্মাইল নামকরণের সঠিক ইতিহাস নেই; আবার একইভাবে স্মাইলের আসল নামেরও কোনো হদিস নেই। যে যখন যা ইচ্ছা তাই ডাকে। তাতে কোনো আপত্তিও নেই স্মাইলের। তবে শুধু কি ক্ষৌরকর্ম করে পেট চলে? তাই, স্মাইল আর তার সহকারী সবার রেশন এনে দেয় ঘরের দুয়ারে। বিনিময়ে হয়তো কিছু টাকা বা কিছু চাল-ডাল দেয় লোকেরা। গ্রামের লোকেদের ঘরের কাজ থেকে শুরু করে সব কাজই করে দেয় স্মাইল। বিনিময়ে কিছু দিলেও হয় আবার না দিলেও তেমন আপত্তি করে না।
সারাদিনের উপার্জনের একটা নির্দিষ্ট অংশ সঞ্চয় করে স্মাইল, বটগাছের এক কোঠরে। কেননা, স্মাইলের বাবার স্বপ্ন ছিল একটা বিশাল বড় সেলুন দেয়া। গ্রামের এক মাতাল ইসাকি সেখান থেকে টাকা চুরি করে মদ খেয়ে ফেলে। তাই, স্মাইল নিজের গচ্ছিত বাকি টাকা নিয়ে চলে যায় গ্রামের একমাত্র পোস্ট অফিসে। পোস্ট অফিসের মহিলা অফিসার থেনমোঝি ওর আইডি কার্ড চায়। কিন্তু স্মাইলের তো কোনো আইডি কার্ড নাই। এমনকি স্মাইলের তো নেই কোনো নামই। পুরো গ্রাম ঘুরেও কারো কাছ থেকে নিজের নাম জানতে পারে না স্মাইল। কিন্তু থেনমোঝি বুঝায় স্মাইল নাম দিয়ে তো আর একাউন্ট খোলা যাবে না।
কথায় কথায় থেনমোঝিই ওর নতুন নাম দেয় নেলসন ম্যান্ডেলা। কেননা, ম্যান্ডেলা যেমন আফ্রিকায় নিজের লোকেদের জন্য সংগ্রাম করেছিল। ঠিক তেমনি স্মাইলও নিজের নামের জন্যই লড়াই করছে। থেনমোঝির বুদ্ধিতেই টাকা জমা রাখার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বানায় স্মাইল। আর এই কার্ড দিয়ে গ্রামের আসে অফিসার। কিন্তু ম্যান্ডেলা ভোট দেবে কাকে? উত্তর না দক্ষিণ? শুরু হয় ম্যান্ডেলার এক নতুন জীবন। এতদিন যাকে গ্রামের কেউ সম্মানও করতো না; তাকেই সবাই শ্রদ্ধা করা শুরু করে। না চাইতেই পূরণ হতে থাকে ম্যান্ডেলার সব স্বপ্ন। একটা ভোটের জন্য দুই ভাইই সর্বস্ব উজাড় করে দেয়। কিন্তু শেষমেশ জয় হয় কার? আর ম্যান্ডেলাই বা ভোট দেয় কাকে?
পরিচালক হিসেবে ম্যাডোন অ্যাশউইন একদম বাজিমাত করে দিলেন ম্যান্ডেলা দিয়ে। এত সুন্দর আর দক্ষ হাতের উপস্থাপন, যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। ম্যাডোন ছাড়াও এই সিনেমার কন্টেন্ট হেড হিসেবে ছিলেন সুমন কুমার। যিনি কিনা জনপ্রিয় সিরিজ দ্য ফ্যামিলি ম্যান এবং সিনেমা গেইম ওভার এর মতো মুভির লেখক। তাই ম্যাডোন বা সুমন, দুজনের কেউই চিত্রনাট্যে তেমন একটা ছাড় দেননি। একদম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিত্রনাট্যের প্রতিটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারও খুঁটিয়ে দেখেছেন। তা নাহলে এত নিখুঁত আর মসৃণ চিত্রনাট্য সম্ভব নয়।
সিনেমার প্রযোজনায় ছিল বালাজি মোহনের নাম। ধানুশের জনপ্রিয় সিনেমা মারি এবং মারি ২ এর নির্মাতা ছিলেন এই মোহন বাবু। তাই, ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসার হিসেবে তার নামটা যেন দর্শকদেরকে ম্যান্ডেলা দেখার ব্যাপারে আরো খানিকটা উৎসাহ দেবে। প্রযোজনায় আরো ছিল এস. শশীকান্তের নামে। যিনি কিনা ভিক্রাম ভেদা এবং গেইম ওভার-এর মতো সিনেমার প্রযোজক ছিলেন। সিনেমাটোগ্রাফিতে ছিলেন ভিডু আয়্যাইনা। যিনি বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছেন পুরো সিনেমা জুড়েই। সৃজনশীলতার জন্য ভিডু মোটেও জটিলতার আশ্রয় নেননি। বরং সাধারণভাবেই অসাধারণ কাজটা করে দেখিয়েছেন তিনি।
সিনেমার সম্পাদনা বা এডিটিং এবং আবহ সঙ্গীত বা ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিং দুটোই বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরিংয়ে যেমন স্যাটায়ার ভাইব ছিল; তেমনি ছিল কমেডি ভাইব; আবার যেমন সিরিয়াসনেস ছিল; তেমনি ছিল আবেগ বা রোমান্টিক ভাইব। এমনকি গানের লিরিকগুলোও লেখা হয়েছে বেশ যত্নে। সত্যিকার অর্থে, মুভির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কাজই প্রশংসার দাবিদার।
সাউথ ইন্ডিয়ান মুভিপ্রেমী না হলেও শাহরুখ খানের চেন্নাই এক্সপ্রেস মুভির কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। সেখানে একটা দৃশ্যে শাহরুখ খান শ্রীলংকার স্মাগলারদের খপ্পরে পড়ে যায়। সেই দৃশ্যের ঝাঁকড়া চুলের সেই পার্শ্ব-অভিনেতাকে হয়তো মনে আছে। অবশ্য আপনি যদি সাউথ ইন্ডিয়ান মুভিপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে যোগী বাবুকে অনেক সিমেনাতেই দেখেছেন কমেডি চরিত্রে অভিনয় করতে। ম্যান্ডেলা সিনেমার প্রধান চরিত্রে ছিলেন এই যোগী বাবু। ভাবতেই পারেন না, একজন কমেডি অভিনেতা বা পার্শ্ব অভিনেতা আর কতটুকুই বা ভালো অভিনয় করতে পারবে?
কিন্তু শুধু দর্শক নয় এমনকি বিচারকের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলেও বলতে হয় যে, ম্যান্ডেলা/স্মাইল চরিত্রে যে যোগী বাবু অভিনয় করছিলেন সেটা বুঝার কোনো উপায়ই ছিল না। গ্রামের মানুষের দয়ায় বেঁচে থাকা লোকটার চালচলন, নাপিতের হাব-ভাব, হঠাৎ করে জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়ার অভিব্যক্তি- পুরো সিনেমা জুড়ে প্রতিনিয়তই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন যোগী। আর তাতে যে ব্যাপক সফল হয়েছেন তা দর্শক সিনেমা শেষ করেই বুঝতে পারবে।
যোগী বাবুর পরই আসে থেনমোঝির কথা। পুরো সিনেমা জুড়ে আলাদা এক স্বতন্ত্র চরিত্র নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন যিনি- শীলা রাজকুমার। গ্রামের এক পোস্ট অফিসার হওয়া সত্ত্বেও গল্পে বেশ দারুণ প্রভাব ছিল তার। ম্যান্ডেলা নামকরণটাও তারই দেয়া। যেজন্য কিছু রোমান্টিক ভাইব ছিল গল্পের মধ্যে, যেটা সত্যিই উপভোগ্য। আসলে, জটিল দেখতে দেখতে দর্শকরা হাফিয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। তাই এমন সহজ সাধারণ প্রেমের মোহটা নিঃসন্দেহে ভালো লাগবে দর্শকদের।
এছাড়াও নেতা এবং তার দুই ছেলের চরিত্রে অভিনয় যারা করেছেন তারাও কমবেশি পরিচিত চেহারাই ভারতের দক্ষিণের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। স্মাইলের সহকারি চরিত্রে অভিনয় করা ছেলেটাও বেশ ভালো অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছে। সবার অভিনয়ের মধ্যেই একটা বিষয়ের প্রাধান্য ছিল আর তা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা। যার জন্য চরিত্রগুলোকে জীবন্ত মনে হয়। মনে হয় যেন আস্ত এক গ্রামের বাস্তব গল্প দেখছে দর্শক।
গল্পটা আদতে বেশ সাদামাটাই বলা চলে। তবে গল্পে রূপকতার শেষ ছিল না। স্মাইল হচ্ছে গ্রামের এমন একজন মানুষ যাকে কিনা লোকেরা ঠকায়। কিন্তু স্মাইল তাতে রাগ করে না। যাই হোক, অন্তত বেঁচে তো আছে সে। স্মাইল কি সাধারণ জনগণের প্রতিচ্ছবি নয়? সাধারণ জনগণকেও তো এলিট শ্রেণি নানান ভাবে ঠকায়। কিন্তু তাও সাধারণ জনগণ সেই স্মাইলের মতোই ভাবে, বেঁচে তো আছি।
আবার, স্মাইলের একটা ভোটের জন্য তার প্রতি কদর বেড়ে যায় গ্রামের সকলের। তবে সেটা সীমিত সময়ের জন্য। নির্বাচনের পূর্বে নেতারা তো পারলে এসে জনগণকে হাতে তুলে খাইয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু নির্বাচন একবার হয়ে গেলে পরে, ভোটার কি জীবিত না মৃত সেটার খোঁজও রাখার দরকার পড়ে না নেতার। স্মাইলের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই হয়। সাময়িকভাবে স্মাইল হয়তো সবই পায়; এমনকি তার বাবার স্বপ্নের সেই সেলুনও তৈরি করে দেয় নেতারা। কিন্তু সেসব কি আসলেই স্থায়ী হয়? আর নেতা তো দুইজন। একজনকে ভোট দিলে কি আরেকজন বাঁচতে দেবে স্মাইলকে?
গল্পে কি তবে কোনো খুঁত নেই? অবশ্যই আছে। একজন মানুষকে চরম বোকাভাবে উপস্থাপন করার পর তার বুদ্ধির এমন ব্যবহার- কিছু দর্শককে ভাবাতে পারে। তবে বোকারাই আচমকা এমন কাজ করে বসে যে বুদ্ধিমানরা তা ভাবতেও পারে না। এখানে গল্পের অতিরঞ্জিত ভাবটাকে এইভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।
গল্পের শেষটা নিয়ে আরো বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সেসব বলতে গেলে স্পয়লারের ভয় থাকে। মূল বার্তাটাই অন্তর্নিহিত রয়েছে শুধু শেষের আধা ঘন্টায়। একজন ভোটারের একটা ভোট সমাজ তথা রাষ্ট্রের পরিবর্তনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তারই একটা নিদর্শন দেখিয়েছেন নির্মাতা। গল্পটাকে হাস্যরসের মধ্য নিয়ে চরম বাস্তবতার দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন পরিচালক।
সেই নির্বাক যুগের সিনেমাতে চার্লি চ্যাপলিনও এমনটাই দেখিয়ে গিয়েছিলেন। হাসতে হাসতে চরম বাস্তবতা আর দুঃখের কথাটাই বলে ফেলা যায়। ঠিক একইভাবে ম্যান্ডেলা সিনেমাটিও কমেডির মাধ্যমে দর্শকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে সমাজের চরম বাস্তবতাটাকে। ইতিমধ্যেই আইএমডিবিতে ১০ এর মধ্যে ৮.৭ রেটিং নিয়ে বেশ ভালো অবস্থানে আছে সিনেমাটি। পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের সুন্দর উদাহরণ হয়ে রয়ে যাবে সিনেমাটি, তা বলাইবাহুল্য।