
হতাশায় সাগরে ডুবতে থাকা এক ব্যক্তি শেষমেশ মানসিক ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললেন, আমি খুব ডিপ্রেসড। জীবনটা খুব কষ্টের। মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতায় পুর্ণ এই সমাজে নিজেকে খুব একা মনে হয়।
ডাক্তার বললেন, সমাধান খুব সহজ। বিখ্যাত ক্লাউন পালিয়াচি এসেছেন আমাদের শহরে। তার একটি শো-ই যথেষ্ট। জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শুরু করবেন।
ডাক্তারের কথায় লোকটি ঢুকরে কেঁদে উঠে বললেন, কিন্তু ডাক্তার! আমিই পালিয়াচি।
– রোরশ্যাক জার্নাল
আমাদের কাছে সুপারহিরো মানে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান অথবা হালের আয়রন ম্যান বা ক্যাপ্টেন আমেরিকা। আর সুপারহিরো মুভি মানে সিনেমার খলনায়ক হিসেবে থাকবে এক অতি শক্তিশালী ভিলেন, যে ম্যাসাকার অথবা পৃথিবীর দখল করে নিতে চায়; কিংবা তার চিরশত্রু জনপ্রিয় সুপারহিরোদের কেউ একজন, যাকে হত্যা করে সে হতে চায় একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সেই দিক দিয়ে চিন্তা করলে, ওয়াচম্যান সিনেমাটি গতানুগতিক সুপারহিরো ধাঁচ থেকে একটু আলাদাই। সচরাচর আমরা যে ধরনের ভিলেন সুপারহিরো সিনেমায় দেখি, ওয়াচম্যানের ভিলেনকে সেই কাতারে ফেলা যাবে না। তাছাড়া ভিলেনকে বুঝতে হলে আপনাকে পর্দার সামনে বসে থাকতে হবে একদম শেষ অব্দি।
অ্যালান মুরের সৃষ্ট, ডেভ গিবসনের অঙ্কনে ‘ওয়াচম্যান’ কমিকসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এমন কয়েকজন সুপারহিরো, যাদের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ আর ওয়াটারগেট জয়ে সাহায্য করে, বলা যায় ত্বরান্বিত করে। বলা বাহুল্য, এই গল্পের প্লট আশির দশকের এক অল্টারনেট ইউনিভার্স, যেখানকার কারিগর এই সুপারহিরো দল। ১৯৮৫ সালে দেশ যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছিল, ততদিনে এই সুপারহিরোদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রণীত সুপারহিরো বিরোধী আইন ‘কীন এক্টের’ কারণে হয় অবসর নিয়েছেন আর নয়ত সরকারকে সাহায্য করছেন। আর এই গল্পটিকে ২০০৯ সালে সিনেমায় রূপ দেন থ্রি হান্ড্রেডখ্যাত জ্যাক স্নাইডার।

১২ অক্টোবর ১৯৮৫; নিউ ইয়র্ক শহরে একজন কমেডিয়ানের মৃত্যু হয়েছে। এডওয়ার্ড ব্লেক নামের সেই কমেডিয়ানের খুনের তদন্ত করছে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু কোনো তথ্যপ্রমাণ বা সাক্ষী না থাকায় তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় তদন্তের দায়িত্ব নেয় একসময়ের ওয়াচম্যান দলের সদস্য রোরশ্যাক। সে এখনো ‘কীন এক্টের’ বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাতের অন্ধকারে একাই শহর রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত করে একপর্যায়ে রোরশ্যাকের জানতে পারে ব্লেক নামের যে মারা গেছে, সে তারই সহকর্মী; যার ছদ্মনাম ছিল কমেডিয়ান।
কেউ একজন সাবেক মুখোশধারীদের ধরে ধরে হত্যা করছে। এই সন্দেহে সে তার অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মী ডেন ড্রেইবার্গ (নাইট আউল), সরকারের গবেষণায় সাহায্যকারী ডক্টর ম্যানহাটন এবং সফল ব্যবসায়ী অ্যাড্রিয়ান ভেইটকে (ওজিম্যানডিয়াস) সতর্ক করে দেয়। কিন্তু এদের কেউই এই হুমকিকে খুব একটা আমলে নেয় না। এদের মধ্যে কেবল অ্যাড্রিয়ান ভেইট আর ডক্টর ম্যানহাটনেরই পরিচয় জনগণের কাছে উন্মুক্ত ছিল। অন্যদিকে ডেন অবসর নিলেও তার পরিচয় সে জনগণের কাছে দেয়নি। একসময় অ্যাড্রিয়ানের উপর এক আততায়ী হামলা করে কিন্তু অ্যাড্রিয়ান বেঁচে যায়।

১৯৫৯ সালে এক নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনায় অতি অমানবিক হয়ে ওঠা ডক্টর ম্যানহাটন তখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের গবেষণা দলের সদস্য। আরেক প্রাক্তন সুপারহিরো লরি জুস্পেজিকের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করছিল এবং একই সাথে আমেরিকার অস্ত্র উন্নয়ন গবেষণায় সাহায্য করে যাচ্ছিল। প্রতিরক্ষা দলে তার সংযুক্তি তার দেশকে বিরোধী শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে, যার কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করতে সাহস পাচ্ছিল না। এমন সময় মিডিয়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ইতোপূর্বে যারা ডক্টর ম্যানহাটনের সাথে কাজ করেছে তাদের অনেকেই ক্যান্সার আক্রান্ত এবং সেজন্য ম্যানহাটনকে দায়ী করা হয়। তার প্রাক্তন প্রেমিকাও ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে আঙুল তুলে ডক্টর ম্যানহাটনের দিকে। একই সাথে সম্পর্কের অবহেলার কারণে প্রেয়সী লরিও তাকে ছেড়ে নাইট অউল ডেনের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। রাগে ক্ষোভে নিজেকে মঙ্গল গ্রহে নির্বাসিত করে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনা গোপন রাখার চেষ্টা করলেও, একসময় সবাই জেনে যায় যে ম্যানহাটন আর পৃথিবীতে নেই। এতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের রাস্তা খুঁজে পায়।

অন্যদিকে কমেডিয়ান হত্যার তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল রোরশ্যাক। তদন্তের এক পর্যায়ে সে কমেডিয়ানের শত্রু মোলোখের ঘরে গিয়ে কমেডিয়ানের হত্যার দায় মোলোখের উপর চাপায়। কিন্তু মোলোখ কমেডিয়ান হত্যার দায় অস্বীকার করে। পরে রোরশ্যাক আবার মোলোখের সাথে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের পাতা ফাঁদে পা দেয়। মোলখের হত্যার অভিযোগে কারাগারে যেতে হয় তাকে।তার মুখোশ খুলে ফেলা হয় এবং মানুষ জেনে যায় তার আসল পরিচয় ।
এই পর্যন্ত আসার পর অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করবে মনে। কী হবে এখন বিশ্বে? ডক্টর ম্যানহাটনের অনুপস্থিত কি এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিবে? সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণ কি ঠেকাতে পারবে আমেরিকা? কে হত্যা করেছে কমেডিয়ানকে? কি তার উদ্দেশ্য? কেনইবা অবসর নেয়া সাবেক মুখোশধারী সুপারহিরোদের হত্যা করছে সে বা তারা?
R-রেটেড এই সিনেমাটিকে স্যাটায়ার বলা চলে। চরিত্রগুলোর চমৎকার সব সংলাপ আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে। হয়ত নিজের জীবনের মিলও খুঁজে পেতে পারেন। সিনেমাটির সবচেয়ে ভালো দিকগুলোর মধ্যে ছিল চরিত্র গুলোর গভীরতা। ডার্ক টোনের এই সিনেমাতে চরিত্রগুলোর ঠিক যতটুকু গভীরতা দরকার ততটুকুই ফুটে উঠেছে। গল্পের মাঝেমাঝেই ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের পেছনের গল্প তুলে ধরার ট্রাঞ্জিশনগুলো ছিল অসধারণ। আর ল্যারি ফংয়ের সিনেমাটোগ্রাফি আর স্লো মোশনের দৃশ্যগুলো সিনেমাটিকে তার সেরা কাজগুলোর মাঝে জায়গা করে দিয়েছে। অ্যাকশন লাভারদের জন্য এই অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো ভালোই উপভোগ্য হবে ।

এ বছর অক্টোবর মাসে মুক্তি পেয়েছে ‘ওয়াচম্যান’ টিভি সিরিজ। সিনেমা সম্পূর্ণ কমিকস অনুসারে হলেও সিরিজটি পুরোপুরি কমিকসের মত হবে না বলে জানিয়েছেন ডেমন লিন্ডেলফ। সিরিজের গল্পে অনেকটাই পরিবর্তন আনা হবে। অনেকগুলো নতুন চরিত্রকে নিয়ে আসা হবে সিরিজে। পুরাতন চরিত্রগুলোর মধ্যে থাকবে ডক্টর ম্যানহাটন, ওজিম্যানডিয়াস এবং সিল্ক স্পেক্ট্রে।