ক্যারিবিয়ান গণরাজ্যের ছোট একটি দ্বীপ সান্তা প্রিস্কা। পুরো দ্বীপ জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম কারাগার ‘পেনা দুরো’। পেনা দুরো শব্দটির অর্থ শক্ত পাথর। সম্পূর্ণ কারাগারটি পাথরের তৈরি হওয়ায় এটিকে এ নামে ডাকা হয়। মহাবিশ্বের বিপজ্জনক সব কয়েদীদের ধরে এনে বন্দী করে রাখা হতো সেখানে।
বিভিন্ন ধরনের কয়েদীদের সাথে সেখানে বাস করতো ‘কিং স্নেক’ বলে এক কুখ্যাত অপরাধী এডমান্ড ডুরান্স। সেখানে বন্দি অবস্থাতেই আরেক নারী কয়েদির সাথে তার প্রেম হয়। বিপজ্জনক সেই কারাগারের শত কষ্টের মাঝেও সুখেই কেটে যাচ্ছিল তাদের জীবন। কিন্তু তা-ও যেন মনে শান্তি আসেনা ডুরান্সের। জেল থেকে পালানোর জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। পালানোর জন্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা করতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখেই জেল থেকে পালিয়ে যায় ডুরান্স। নিষ্ঠুর জেল পরিচালকরা ডুরান্সের প্রাপ্য শাস্তি চাপিয়ে দেয় তার অনাগত সন্তানের উপর।
জন্মের পর থেকে সেই শিশুটি বেড়ে উঠে কারাগারের দুর্বিষহ পরিবেশে হিংস্র সব অপরাধীদের সাথে। তাকে দিন কাটাতে হয় প্রাণনাশের সংশয় নিয়ে। জীবনের এত প্রতিকূলতার প্রভাবে ধীরে ধীরে তার ভেতর টিকে থাকার এক শক্তিশালী মনোভাব আর হিংস্রতার জন্ম নেয়। এমনকি মাত্র আট বছর বয়সেই অন্য এক কয়েদিকে মোকাবেলা করার সময়, তার ছোট খেলনা ভালুক ‘অসিতো’র ভেতরে লুকিয়ে রাখা ছুরি দিয়ে সে সেই কয়েদিকে হত্যা করে। কিশোর অবস্থাতেই প্রথম খুন করার পর কারাগারের ওয়ার্ডেন তার নাম দেয় ‘বেইন’; যার অর্থ হচ্ছে মৃত্যু অথবা ধ্বংস।
খুনের দায়ে জেলের ওয়ার্ডেন তাকে মূল জেলখানা থেকে বিচ্ছিন্ন এক কক্ষে একঘরে করে রাখে। সেখানে বসেই বেইন উপলব্ধি করে যে, এই পরিবেশে বেঁচে থাকতে হলে তাকে সাহসী, শক্তিশালী এবং ধূর্ত হতে হবে। তাই কারাবন্দী অবস্থাতেই সে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করতে শুরু করে। প্রায়ই বৃষ্টি হলে তার এই কক্ষটি পানিতে ডুবে যেতো, এত প্রতিকূলতার মাঝেও সে নিজেকে টিকিয়ে রাখে।
বিচ্ছিন্ন সেই কক্ষ থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই প্রচুর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নানা ধরনের বই পড়তে শুরু করে বেইন। শারীরিক শক্তির সাথে মেধার বিকাশের লক্ষ্যে সে তার কারারুদ্ধ দিনগুলো কাটিয়েছে ব্যায়াম করে এবং প্রচুর বই পড়ে। হাতের কাছে যতোগুলো বই পেয়েছে, সবগুলোই সে পড়েছে। সমর বিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, গণিত, ব্যাকরণশাস্ত্র ছাড়াও আরও বিভিন্ন বিষয়ে সে জ্ঞানার্জন করে। তাছাড়া সান্তা প্রিস্কায় বিভিন্ন দেশের কয়েদী থাকার কারণে ইংরেজি ছাড়াও স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং লাতিন ভাষায়ও সে ধীরে ধীরে পারদর্শী হয়ে ওঠে।
নারকীয় এই কারাগারে তার জীবনের প্রত্যেকটা দিন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আত্মরক্ষার খাতিরে সে নিজেও ধীরে ধীরে অন্যসব কয়েদির মতো হিংস্র আর বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এক সময় সে পরিণত হয় পেনা দুরোর ত্রাসে। নিজেকে সে প্রতিষ্ঠিত করে সেখানকার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যক্তি হিসেবে; কয়েদি থেকে শুরু করে কারাগারের প্রহরীরাও তার ভয়ে আতঙ্কিত থাকতো। জেলখানার কয়েদিরা মিলে তার নাম দেয় ‘কিং অফ পেনা দুরা’। কারাগারে জম্বি ও ট্রগ নামের দুই কয়েদি বেইনের সহকারি হিসেবে সবসময় তার সাথে থাকতো।
বিভিন্ন মারামারির ঘটনার পর কারাগার নিয়ন্ত্রণকারীদের নজরে পড়ে বেইন। তারা তখন আরেক সুপার ভিলেন ড. হুগো স্ট্রেইঞ্জের তৈরি স্টেরয়েড জাতীয় একধরনের রহস্যময় ড্রাগ ভেনোম দিয়ে সুপার সোলজার বানানোর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিল। গবেষণাটি পরিচালনা করছিল এক পাগল মনোবিজ্ঞানী।
জেল প্রশাসন বেইনকে বাধ্য করে সেই গবেষণার গিনিপিগ হতে। বেইনের শরীরে ভেনোম পুশ করার পরপরই আগের বহুসংখ্যক সাবজেক্টের মতো বেইনেরও মরণাপন্ন অবস্থা হয়। চেতনাহীন বেইনকে মৃত ভেবে তাকেও সাগরে ফেলে দেয়া হয়।
ভাসমান অবস্থায় এক পর্যায় তার জ্ঞান ফিরতে শুরু করে। পুরোপুরি জেগে উঠার পর সে লক্ষ্য করে যে, তার শারীরিক শক্তি আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধে অন্য জায়গায়, ভেনোমের ক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে তার শরীর আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়, এমনকি সে সাধারণ অবস্থা থেকে খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই প্রতি ১২ ঘণ্টায় তাকে একবার করে ড্রাগটি নিতে হতো, না হলে বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতো। বেইন পরবর্তীতে পুনরায় কারাগারে ফিরে আসে এবং জেলের ওয়ার্ডেনকে জিম্মি করে তার সহচারী এবং সেই পাগল বিজ্ঞানীকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসে।
বন্দীদশা থেকে পালানোর পরেও তার জীবনে শান্তি ছিলো না। কারাবন্দী থাকাকালীন সহকারী বার্ড তাকে গোথাম শহরের ‘ব্যাটম্যান’ নামের শক্তিশালী মানুষের কথা বলেছিল। এর পর থেকে মাঝেমধ্যেই সে বাদুড় নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতো। জেল পালানোর পর সে পুরনো সেই দুঃস্বপ্ন একটু ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করে। সে স্বপ্নে দেখে যে, ব্যাটম্যান পিশাচ হয়ে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে শেষমেশ সে গোথাম শহরে আঘাত হানার পরিকল্পনা করে। সেখানে পৌঁছানোর পর সে বুঝতে পারে, ব্যাটম্যানের উপর সরাসরি আঘাত হানাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই প্রথমেই সে যায় আরখাম অ্যাসাইলামে। জেলখানার দেয়াল ভেঙে দিয়ে সেখানকার মানসিক বিকারগ্রস্ত অপরাধীদের (দ্য জোকার, দ্য রিডলার, হার্ভে টু ফেইস, স্কেয়ার ক্রো, ম্যাড হ্যাঁটার, ভেন্ট্রিলোকুইস্ট, ফায়ার ফ্লাই, পয়জন আইভি, কর্নেলিয়াস স্টির্ক, ফিল্ম ফ্রিক এবং ভিক্টর স্যাজস) পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।
পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের ধরে আনার অভিযানে নামতে বাধ্য হয় ব্যাটম্যান আর গোথাম পুলিশ ফোর্স। তিন মাসব্যাপী অভিযান চালিয়ে সকল কয়েদিকে পুনরায় অ্যাসাইলামে ফেরত পাঠিয়ে ব্যাটম্যান যখন ফিরে আসছিল, তখন বেইনের সহকারীরা তার উপর হামলা চালায়। তিনমাস হাড়ভাঙা খাটুনীর পর ক্লান্ত ব্যাটম্যান কোনোমতে তাদের প্রতিহত করে ওয়েইন ম্যানরে ফিরে আসে।
কিন্তু সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করে বসেছিল বেইন। ভেনোম সেবনের ফলে দানবীয় আকার ধারণ করা বেইনের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি সেদিন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ব্যাটম্যান। একতরফা মারামারির একপর্যায়ে বেইন ব্যাটম্যানকে নিজের বিশাল হাঁটুর উপর প্রচণ্ড জোরে আছাড় মারে। শরীরের পাশাপাশি সেদিন পঙ্গু হয়ে যায় ব্যাটম্যানের সকল আত্মবিশ্বাস। ব্যাটম্যানকে সেই অবস্থায় ফেলে চলে যায় বেইন। এর পর থেকেই তাকে ডাকা হয় ‘The Man Who Broke the Bat’ হিসেবে।
ব্যাটম্যানকে পঙ্গু করে দেওয়া এই দানবকে কমিকবিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সে বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে ‘ব্যাটম্যান: ভেঞ্জেন্স অফ বেইন’ নামে যে কমিকস বই প্রকাশিত হয়, তাতে চাক ডিক্সন, ডাগ ময়েন্স এবং গ্রাহাম নোলান পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন বেইনকে। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসে শুরু হয় নাইটফল ট্রিলজি নামের এক নতুন সিরিজ, যার প্রথম কিস্তিতে বেইনের উৎপত্তির ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
এই পর্যন্ত ব্যাটম্যান নিয়ে তৈরি দুটি চলচ্চিত্রে বেইনকে নিয়ে আসা হয়ছে। যার প্রথমটি মুক্তি পেয়েছে ১৯৯৭ সালে। জুয়েল শুমাখারের নির্মিত ‘ব্যাটম্যান অ্যান্ড রবিন’ চলচ্চিত্রে বেইনকে দেখানো হয় মস্তিষ্কহীন এক মহাশক্তিধর দানব হিসেবে, যা ছিল বেইনের কমিকসের চরিত্রের উল্টো। ভেনোমক্রিয়ার ফলে তৈরি অতিকায় শরীর দেখালেও, বেইনের চতুরতার এক ফোঁটাও দেখানো হয়নি সেই চলচ্চিত্রে।
তবে ২০১২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান তার ডার্ক নাইট ট্রিলজির শেষ সিনেমা ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেসে’ পুনরায় বেইনকে নিয়ে আসেন। তিনি তার চলচ্চিত্রে বেইনের উৎপত্তি সম্পর্কে মূল কাহিনীর সাথে মিল রেখে কিছু কাহিনী তুলে ধরেছেন একটু ব্যতিক্রম রূপে। তবে ব্যাটম্যানকে হাঁটু দিয়ে আঘাত করার সেই দৃশ্য তিনি তার সিনেমায় তুলে ধরেন।
২০১২ সাল থেকে ওয়ার্নার ব্রস এবং ডিসি কমিকস নতুন একটি সিনেমাটিক ইউনিভার্স শুরু করেছে। সেই ইউনিভার্সের প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রেই কমিক বইয়ের চরিত্রগুলোকে তুলে ধরা হচ্ছে বইয়ের মূল গল্পের সাথে মিল রেখেই। হয়তো তাদের আগামী কোনো চলচ্চিত্রে আবার তারা বেইনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে কমিক বইয়ের মতো করেই।