সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট ফেলুদা সিরিজের প্রথমদিকের একটি গল্পের নাম ছিল ‘শিয়াল দেবতা রহস্য’। সেই গল্পে প্রাচীন মিশরীয় দেবতা ‘আনুবিস’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিখ্যাত লেখকদের গল্প, উপন্যাস বা মিশরীয় উপকথাই হোক, ইতিহাসের পাতায় আনুবিস সুপরিচিত ও জনপ্রিয় এক নাম। কিংবদন্তিতে বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি। শিয়ালের মুখাবয়ব ও মানুষের দেহ সম্বলিত দেবতা আনুবিস হচ্ছেন মমিকরণ প্রক্রিয়া ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের মিশরীয় দেবতা। এছাড়াও তিনি হারানো আত্মা ও অসহায়দের সাহায্য করে থাকেন। ধারণা করা হয়, তিনি সম্ভবত পূর্বের শিয়াল দেবতা ওয়েপওয়াটেট থেকে বিকশিত হয়েছেন, এবং ওয়েপওয়াটেটের সাথে তাকে প্রায়শই গুলিয়ে ফেলা হয়। মিশরে তখন শিয়ালেরা কবর খুঁড়ে মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। সেজন্য প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, শেয়াল দেবতা সেই শেয়ালদের হাত থেকে কবরের লাশগুলোকে রক্ষা করতে পারবেন। মিশরের প্রাক-রাজবংশীয় যুগের কোনো একসময় বন্য কুকুর এবং শিয়ালের হাত থেকে রাজকীয় কবরগুলোতে সর্বোত্তম সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দেবতা আনুবিসের ধারণার উদ্ভব ঘটে।
আবার অনেক মিশর-তত্ত্ববিদ বলেন, মিশরের অধিবাসীরা বিশ্বাস করত- কোনো ব্যক্তির মৃতদেহের সাথে কুকুর সমাহিত করা হলে ওই কুকুর তার হয়ে আনুবিসের কাছে সুপারিশ করবে। সেই কারণে ব্যক্তির মৃতদেহের সাথে কুকুরকেও সমাহিত করত তারা। খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ থেকে ৩০ অব্দ পর্যন্ত এই পশু-সমাধি প্রথায় বিশ্বাসী ছিল মিশরীয়রা। মিশরের প্রথম রাজবংশের রাজকীয় সমাধিতেও আনুবিসের মূর্তির সন্ধান মেলে। ওসাইরিস পুরাণ বিকশিত হবার আগপর্যন্ত আনুবিস ছিলেন মৃতদের দেবতা। কিন্তু ওসাইরিস পরবর্তীতে এই দায়িত্ব নেবার পর আনুবিস মমিকরণ দেবতার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।
মিশরীয় উপকথা অনুযায়ী, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মমি তৈরি করেছিলেন দেবতা আনুবিস। কাহিনিটি এমন- দেবতা গেব এবং তার বোন আকাশ ও স্বর্গদেবী নুট বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের গভীর প্রণয়ের ফলে জন্ম হয় আইসিস, ওসাইরিস, সেথ, ও নেপথিস নামক চার দেব-দেবীর। এদের মধ্যে নেপথিস সেথকে এবং আইসিস বিয়ে করেন ওসাইরিসকে। সূর্যদেবতা ‘রা’-কে যখন বার্ধক্য কিছুটা নুইয়ে ফেলে, তখন তিনি ওসাইরিসকে শাসনকার্যের ভার বুঝিয়ে দিয়ে সূর্যরথে চড়ে পাড়ি দেন স্বর্গে। ওসাইরিসের রাজত্বকালে মিশরের সবখানেই সুখ-শান্তি ছড়িয়ে ছিল। প্রচণ্ড ভ্রমণপিপাসু হওয়ায় ওসাইরিস প্রায়শই রানী আইসিসকে সাময়িকভাবে রাজ্যভার অর্পণ করে ভ্রমণে বের হতেন। এমনি এক ভ্রমণে ওসাইরিস তার সহোদর সেথের স্ত্রী নেপথিসের সঙ্গে গোপনে মিলিত হন। ফলে নেপথিসের গর্ভে আসেন আনুবিস। জানতে পেরে সেথ ক্ষিপ্ত হয়ে ওসাইরিসকে হত্যা করেন। হত্যার পর তার শরীর ৪২ টুকরা করে মিশরের ৪২টি অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে দেন। এরপর সেথ সিংহাসন দখল করে ফেলেন। শান্তিভূম মিশরে নেমে আসে ঘোর অশান্তির কালো ছায়া।
ওসাইরিসের স্ত্রী দেবী আইসিস জানতেন, শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান ছাড়া তার স্বামীর আত্মা স্বর্গে আরোহণ করতে পারবে না। তাই, আইসিস ও নেপথিস বাজপাখির রূপ নিয়ে, পুরো মিশর খুঁজে ওসাইরিসের শরীরের ৪২টি অংশ উদ্ধার করেন। এরপর জাদু দিয়ে ৪২টি টুকরা একত্র করা হয়। আইসিস তার স্বামী ওসাইরিসের মৃতদেহ উদ্ধার করার পর, সূর্যদেবতা আনুবিসকে মৃতদেহটি মমি করার নির্দেশ দেন। জ্ঞানের দেবতা থোথের সহায়তায় আনুবিস ওসাইরিসের শবদেহ কাপড়ে মুড়িয়ে দেন। তারপর আনুবিস তার পিতার লাশ সংরক্ষণের জন্য প্রথম মমি তৈরি করেন। এভাবেই মিশরের মাটিতে তৈরি হয় প্রথম মমি। যথারীতি ‘Opening of the mouth’ অনুষ্ঠানটি সম্পন্নের পর ওসাইরিসকে সমাহিত করা হয়। এই ঘটনার পর থেকেই আনুবিসকে মমিকরণের দেবতা বলা হয়।
এই মমিকরণ প্রক্রিয়ার সময় সেথের সাথে আনুবিসের প্রচণ্ড লড়াই বেধে গিয়েছিল। মমিকরণের সময় ওসাইরিসের মৃতদেহ মমি করার স্থানে রাখেন আনুবিস। যেহেতু মমিকরণ প্রক্রিয়া ছিল দীর্ঘ সময়ের এক কাজ, তাই প্রতি রাতেই আনুবিস কাজ শেষ করে ওই স্থান ত্যাগ করতেন। ব্যাপারটা সুচতুর দৃষ্টিতে পরখ করলেন দেবতা সেথ। তার উদ্দেশ্য ছিল ওসাইরিসের মৃতদেহ চুরি করা। তাই একরাতে তিনি আনুবিসের রূপ ধারণ করে সেখান থেকে ওসাইরিসের মৃতদেহ চুরি করেন। তবে সেথ মৃতদেহ নিয়ে বেশিদূর যেতে পারেননি। এর আগেই টের পেয়ে যান আনুবিস, এবং সেথকে ধাওয়া করেন। আনুবিসের হাত থেকে বাঁচতে ষাঁড়ের রূপ ধারণ করেন সেথ। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। আনুবিস তাকে ধরে নিয়ে নপুংসক বানিয়ে দেন। তারপর বন্দী করে রাখেন মিশরের সপ্তদশ নোমে সাকারাতে।
বন্দিত্বের দশা বরণ করে নেবার পর সেখান থেকে পালানোর ফন্দি আঁটতে থাকেন সেথ। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি বিশাল এক বিড়ালের রূপ ধারণ করলেন। কিন্তু এবারও তিনি আনুবিসকে ফাঁকি দিয়ে বের হতে পারলেন না। ধরা খাওয়ার পর আনুবিস তাকে টকটকে লাল লোহা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সেঁক দিলেন। চিতাবাঘের শরীরে কীভাবে ছোপ ছোপ দাগের জন্ম হয়েছে- প্রাচীন মিশরের এই কিংবদন্তি থেকেই সে কাহিনী বর্ণনা করা হতো।
এরপরেও ক্ষান্ত হননি সেথ। তিনি বিভিন্ন কায়দা ও কৌশলে ওসাইরিসের মৃতদেহ চুরির চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। এবারও তিনি ব্যর্থ হয়ে আনুবিসের হাতে ধরা পড়লেন। তবে, এবার আর আনুবিস ছোটখাট শাস্তির ধার ধারেননি। তিনি হত্যা করলেন সেথকে। তার শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। এরপর সেথের পুরো ফৌজকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে তিনি সেথের শিবিরে প্রবেশ করে তরবারির এক কোপে সেথের পুরো বাহিনীর শিরশ্ছেদ করলেন।
কিছু জনশ্রুতি অনুসারে, আনুবিস ছিলেন দেবতা রা-র পুত্র। প্রথমদিকে তিনি মৃতদের প্রাথমিক দেবতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। সময়ের সাথে সাথে ওসাইরিসের ধর্মীয় উপাসনার গুরুত্ব বাড়তে থাকলে, আনুবিসের কাহিনী ওসাইরিস পুরাণের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে নয়া ওসাইরিস পুরাণ (খ্রি.পূ. ২০০০ অব্দ নাগাদ) অনুসারে, আনুবিস হয়ে উঠেছিলেন ওসাইরিস এবং নেপথিসের জারজ সন্তান। নেপথিস তার স্বামী সেথের ভয়ে আনুবিসকে গোপনে পরিত্যাগ করেন। এতিম আনুবিসকে তখন পরিত্যক্ত অবস্থায় খুঁজে পান দেবতা আইসিস। তাকে দেখে মনের কোণে মায়া জাগে আইসিসের। পরবর্তীতে তিনি আনুবিসকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে, বেশ কিছু প্রাচীন মিশরীয় কিংবদন্তি অনুসারে, আনুবিস সত্যিকার অর্থেই সেথের ঔরসজাত সন্তান ছিল। সেসকল কিংবদন্তি অনুযায়ী, সেথের দ্বারা গর্ভবতী হবার পর নেপথিস সেথের কাছ থেকে সে খবর লুকিয়ে রাখে। কারণ, সন্তানসম্ভবা নেপথিস ভাবতেন, সেথের সংস্পর্শে এলে তার সন্তানও সেথের মতো রূঢ় ও বেপরোয়া স্বভাবের হয়ে উঠবে। তখন তিনি গোপনে আনুবিসকে আইসিসের কাছে দত্তক দেন।
আনুবিসকে নিয়ে ‘দুই ভাইয়ের গল্প’ নামে আরও একটি গল্প চালু আছে। সেই গল্পে আনুবিসের বাটা নামে এক অনুজ ছিল। বাটা ছিলেন প্রাচীন মিশরের একজন আঞ্চলিক দেবতা, যিনি সময়ের সাথে সাথে মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্তনের কারণে কালের গর্ভের হারিয়ে গেছেন। যেসব পুরাণে আনুবিসকে ওসাইরিসের সন্তান হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেসব পুরাণে, আনুবিসের ভাই হিসেবে হোরাস, সোপডেপ, বাবি, এবং ওয়েপওয়াওয়েটের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
মিশরীয় জনশ্রুতি অনুসারে, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির সামনে প্রথমেই যে দেবতা হাজির হন, তিনি হলেন মৃতের জগতের অধিকর্তা দেবতা আনুবিস। মারা যাওয়ার পর মৃত ব্যক্তি বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। আনুবিস তাকে সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন। মৃতের গ্রন্থের ১২৫ নং মন্ত্র অনুযায়ী, সেই মৃত ব্যক্তিকে অনন্তকালের পথ প্রদর্শনের কাজটা করে থাকেন দেবতা আনুবিস। মৃত ব্যক্তি আকাশের তারায় পরিণত হতে পারবেন কি না, তা বিচারের ভার আনুবিসের ওপরে। আনুবিসের হাতে থাকে পালকযুক্ত দণ্ড, যা দিয়ে মূলত মৃতের বিচার করা হয়।
সহজে চেনার জন্য আনুবিসের মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও চিহ্ন বিদ্যমান ছিল। অধিকাংশ মিশরীয় দেবতাদের মতো তার একটি মানবদেহ ছিল, তার ঘাড়ের উপর বসানো ছিল শিয়ালের মাথা। পেছন দিক দিয়ে শেয়ালের মতো একটি লেজও ছিল তার। তার শরীরের রঙ ছিল কালো। তাঁকে প্রায়শই একটি আসনে বসা অবস্থায় চিত্রিত করা হয়। অধিকাংশ মিশরীয় দেবতাদের মতো তিনিও নিজ আকৃতি মুহূর্তেই পরিবর্তন করতে পারতেন। দেবতা ওসাইরিসের মৃতদেহ দেখে তিনি এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, তখন সাথে সাথে তিনি নিজেকে গিরগিটিতে রূপান্তর করে ফেলেন।
প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতি শেষদিকে এসে অনেকটা গ্রিক সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়েছিল। আজ মিশরীয় দেবতারা যেসকল নামে ইতিহাসের পাতায় পরিচিত, তার অধিকাংশই গ্রিকদের দেওয়া, এবং তা এসেছে গ্রিক অনুবাদ থেকে। গ্রিকরা মিশরীয় দেবতাদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও, দেব-দেবীদের নামকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দেয়নি। এর অন্যতম এক কারণ হতে পারে, প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে স্বরবর্ণহীন লিখনপদ্ধতি চালু ছিল। তাই গবেষকদের অনুমান অনুযায়ী, তৎকালীন প্রাচীন মিশরে আনুবিসকে ‘আনপু’ বা ‘ইনপু’ বলে ডাকা হতো। দেবতা আনুবিসের কন্যা কেবেচেতকে প্রাচীন মিশরীয়রা ক্বেবেহেত, কেবহুত, কেবেহুত, ক্বেবেহুত ও কাবেচেত নামেও ডাকত। তিনি ছিলেন সজীবতা ও বিশুদ্ধতার দেবী।
সম্ভবত আনুবিসের প্রার্থনার জন্য প্রাচীন মিশরে আলাদাভাবে কোনো মন্দির নির্মাণ করা হয়নি। কারণ, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই দেবতার প্রতি নিবেদিত কোনো মন্দির খুঁজে পাননি। তাই কবরস্থান ও সমাধিগুলোকেই তার মন্দির হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন মিশরের প্রথম রাজবংশের মাস্তাবাতে তার নামের সন্ধান মিলেছে। যেমন, সাক্কারার পূর্ব দিকে অবস্থিত আনুবিয়নের এক উপাসনালয়ে মমি-কৃত কুকুর ও শিয়ালের অস্তিত্ব মিলেছে। ধারণা অনুযায়ী, প্রথম রাজবংশের রাজত্বকালে তাকে ওসাইরিসের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পরবর্তী রাজবংশগুলোতে ধর্মীয় ভাবধারা বা দেবপূজার পরিবর্তন ঘটলেও, আনুবিস ছিলেন সর্বদা গুরুত্বপূর্ণ দেবতাদের মধ্যে অন্যতম।
মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্বে নয়জন আদি দেব-দেবীর কথা বলা হয়েছে। এদেরকে একত্রে এননিয়াড নামে অভিহিত করা হয়। আনুবিস ছিলেন এননিয়াডের মধ্যে অন্যতম। টলেমি শাসনামলে (৩০০ খ্রিস্টাব্দ – ৩০ খ্রি.পূ.), যখন মিশর গ্রিক ফারাওদের অধীনস্থ ছিল, তখন আনুবিসের নাম গ্রিক দেবতা হারমেসের সাথে মিশিয়ে ‘হারমানুবিস’ নামে এক দেবতার উৎপত্তি ঘটে। কারণ, দুজন দেবতার কাজের মাঝে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দুজনেই মৃত্যুর পর আত্মাকে পরকালের পথ দেখাতেন। দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত প্রাচীন রোমে এই দেবতার পূজা করা হতো, এমন তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে।