কালে কালে বহুভাবে যুদ্ধবিরোধী প্রচার-প্রচারণার কথা আমরা জানি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরাও নানাভাবে এতে অংশ নিয়েছেন। কলমের ভাষায়, সুর ও সঙ্গীতে অনেক প্রকারেই মানুষে মানুষে হানাহানি আর রক্তপাতের নিন্দা জানানো হয়েছে। এই তালিকায় জার্মান ব্যান্ড ‘নিনা’র ‘৯৯টি বেলুন’ অসামান্য একটি কাজ বলে স্বীকৃত।
নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস (99 Luftballons) জার্মান পপ ঘরানার সঙ্গীত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যখন দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষমতার দাপট দেখাতে ব্যস্ত, বিশ্ব তখন কাঁপছে পারমাণবিক সংঘাতে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায়। সেই অনিশ্চিত সময়ে মুক্তি পায় জার্মান ভাষার এই গান। তৎকালীন বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করে শান্তির আহ্বান জানানো হয় শিল্পীর কথায়।
জার্মানি তখনও বার্লিন দেয়াল দিয়ে বিভক্ত। দুই পাশে সোভিয়েত আর মার্কিন বাহিনীর সমরসজ্জা জার্মানদের ফেলে দিয়েছিল এক মাইনফিল্ডের মধ্যে। নিনার গানের লক্ষ্য তাই ছিল জার্মানির লোকেরা, যারা বাস করছিল সদাবিরাজমান যুদ্ধের হুমকির ঠিক মাঝখানে। কিন্তু জার্মান ব্যান্ডকে অবাক করে ৯৯টি বেলুনের এই সঙ্গীত পৌঁছে যায় বিশ্বের দরবারে। বিদেশী ভাষায় গাওয়া হলেও এর যুদ্ধবিরোধী চিরন্তন বার্তা প্রায় সাথে সাথেই ঠাঁই করে নেয় অগণিত মানুষের হৃদয়ে।
নিনা
জার্মান এই ব্যান্ডের নাম হয়েছিল তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নিনার নামে। তৎকালীন পূর্ব জার্মানির ছোট শহর হ্যাগেনে ১৯৬০ সালে জন্ম নেন এই শিল্পী। তার নাম রাখা হয় গ্যাব্রিয়েলে সুসান কার্নার। বাবা হ্যান্স হ্যাগেন ছিলেন স্ক্রিপ্ট লেখক। মা ইভা মেরি হ্যাগেন অভিনেত্রী।
কিন্তু নিনা নামের উৎপত্তি হলো কীভাবে? তিন বছরের নিনাকে নিয়ে যাওয়া হলো স্পেনে ঘুরতে যান। স্প্যানিশ ভাষায় নিনা মানে ছোট্ট মেয়ে। সেখান থেকেই শিশু গ্যাব্রিয়েলে এই নাম পেয়ে যান। পরবর্তীতে নিনা নামেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
নিনার দুই বছর বয়সেই বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। তিনি মায়ের সাথে থেকে যান, শিল্প-সংস্কৃতিতে তার কাজ ছোট্ট নিনাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করে। মায়ের পথ অনুসরণের বাসনায় ১৭ বছর বয়সে তিনি বার্লিনে পূর্ব জার্মানির অভিনয়ের স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। এরপর তিনি মনোযোগ দেন গানে।
সঙ্গীতে নিনার আগ্রহ অনেকদিনের। নামকরা শিল্পী টিনা টার্নার আর জ্যানিস জপলিনের ক্যাসেট শুনে তাদের গান আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন তিনি। প্রায়ই নিজে সেসব গান গেয়ে প্র্যাকটিস করতেন তিনি। বার্লিনের স্কুল থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সেই বছরেই হ্যাগেনে ফিরে একটি গানের দল খুলে ফেলেন নিনা। নাম দেন ‘স্ট্রাইপস’ (The Stripes)।
স্ট্রাইপস কিছু শো করে বেশ নাম কামিয়ে ফেলে। তাদের সাথে পারফর্ম করতে পোল্যান্ডে অবধি ঘুরে আসেন নিনা। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে তারা মূলত ইংরেজিতেই গাইতেন। তাদের প্রথম গান ‘একস্ট্যাসি’ (Ecstasy) মুক্তি পায় ইংরেজিতেই, ১৯৭৯ সালে। পরের বছর নিজ নামে অ্যালবাম বের করে স্ট্রাইপস।
গানবাজনা থেকে কিছুদিনের বিরতি নিয়ে নিনা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পূর্ব বার্লিনের একটি স্টুডিওতে কোর্স করেন। কোর্স শেষে অন্য কিছু ব্যান্ডের সাথে সহশিল্পী হিসেবে কাজ করেন নিনা। এ সময় পূর্ব জার্মানির অনেক জায়গাতেই শো-তে তাকে দেখা যেতে থাকে।
নিনার মা ততদিনে বাসা বেধেছেন উলফ বিয়ারম্যান নামে এক খ্যাতনামা জার্মান সঙ্গীতশিল্পীর সাথে। নিনাকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন উলফ। তবে পূর্ব জার্মানির সরকারের সমালোচনা করে প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হন তিনি। তাকে দেশত্যাগের পরামর্শ দেয়া হয়। ফলে ১৯৭৬ সালের শেষদিকে উলফ, ইভা আর নিনা চলে যান পশ্চিম জার্মানিতে।
১৯৮১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে যায় নিনার প্রথম ব্যান্ড স্ট্রাইপস। এরপর নিনা পশ্চিম বার্লিনে চলে এলেন। তার সাথে ছিলেন স্ট্রাইপসের ড্রামার রলফ ব্রেন্ডেল। তাকে নিয়ে নিনা নিজ নামে নতুন ব্যান্ড গঠন করলেন। তাদের সাথে যোগ দিলেন উয়ে ফাহরেনক্রগ-পিটারসেন, কার্লো কার্গেস এবং ইয়ুর্গেন ডেহমেল। নিনা নতুন ব্যান্ডের সব গান মাতৃভাষা জার্মানে গাইতে মনস্থ করলেন, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যা বেশ চমকপ্রদ ছিল। কারণ বেশিরভাগ জার্মান শিল্পী তখন ইংরেজিতেই গাইতেন।
১৯৮২ সালের মে মাসে নিনা তাদের ব্যান্ডের প্রথম জার্মান গান (Nur geträumt/Just a Dream) প্রকাশ করেন। একদিনের মধ্যে ৪০,০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। রাতারাতি জার্মানির ঘরে ঘরে উচ্চারিত হতে থাকে নিনার নাম। তাদের দ্বিতীয় গান, “নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস” নিনার খ্যাতি ছড়িয়ে দেয় বিশ্বজোড়া।
নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস
জার্মান ভাষায় নিনার গানের নাম ছিল নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস (99 Luftballons), যা বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘৯৯টি বেলুন’ বা গ্যাস বেলুন। এই গানের রচয়িতা ছিলেন নিনা ব্যান্ডের সদস্য কার্লো কার্গেস। ১৯৮২ সালে রোলিং স্টোনের এক কনসার্টে গিয়ে তার মাথায় গানটির আইডিয়া এসেছিল।
রোলিং স্টোনের কনসার্টের শেষ দিকে তাদের অন্যতম সদস্য মিক জ্যাগার হাজারখানেক হিলিয়াম বেলুন উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাতাসের ঝাপটায় সেগুলো উড়ে যেতে থাকে পূর্ব বার্লিনের দিকে, যা কিনা সোভিয়েত বলয়ের অধীন পূর্ব জার্মানির অন্তর্ভুক্ত।
দুই জার্মানির তিক্ত সম্পর্কের কথা ভাবতে গিয়ে কার্গেসের মাথায় অদ্ভুত এই চিন্তার উদয় হয়। কী হবে পূর্ব জার্মানি বা সোভিয়েত সামরিক বাহিনী যদি এই বেলুনগুলোকে অন্য কিছু মনে করে বসে? তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এই চিন্তায় গানের ভাষায় তুলে আনেন তিনি, সুর দেন ব্যান্ডের অন্য সদস্য কিবোর্ডিস্ট ফাহরেনক্রগ-পিটারসেন।
১৯৮৩ সালে নিজেদের দ্বিতীয় গান হিসেবে নিনা হ্যাগেনের কণ্ঠে মুক্তি পায় ‘৯৯টি বেলুন’। নিমেষে উঠে যায় জার্মানির সর্বাধিক বিক্রিত গানের তালিকায়। তবে আন্তর্জাতিকভাবেও যে এই গান সাড়া ফেলবে তা ভাবতে পারেনি নিনা ব্যান্ডের কেউই।
নিনার গান স্থান করে নেয় জাপান, মেক্সিকো, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, এবং ইউরোপের নানা দেশের চার্টে। যুদ্ধের ভয়াবহতার নিন্দা করে এই গান সারা বিশ্বেই মানুষের মন জয় করে নেয়। হঠাৎ করেই ছোট্ট একটি জার্মান ব্যান্ড থেকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে তারা, কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিপুল খ্যাতি পেয়ে যান নিনা নিজেও।
প্রাথমিকভাবে নিনার গান কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি দেয়া হয়নি। একদিন লস অ্যাঞ্জেলসের KROQ রেডিও স্টেশনের এক গানের অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ঘটনাচক্রে নিনার গানের একটি কপি খুঁজে পান। কী ভেবে জার্মান গানটি চালিয়েও দেন তিনি। কম সময়েই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গানটি। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু চার্টেও জায়গা করে নেয়।
নিনার রেকর্ড কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এবার আলাদা করে একটি ইংরেজি সংস্করণ বের করতে বলে। কেভিন ম্যাকঅ্যালিয়া মূল থিম ঠিক রেখে ইংরেজিতে গানটি লিখে দেন, যা ‘৯৯টি লাল বেলুন’ (99 Red Balloons) নামে প্রকাশ পায়।
ইংরেজি গানের কথা মূল জার্মান গানের থেকে আলাদা ছিল। শ্রোতাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায় মূল জার্মান গানটিই। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রেডিও স্টেশনগুলোও সেটিই বাজাতে থাকে বেশি। তাদের চার্টে ১৯৮৪ সালের ৩রা মার্চ এটি দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে। যুক্তরাজ্যে অবশ্য ইংরেজি সংস্করণটি বেশ ভালো চলেছিল। সেখানে ১৯৮৪ সালের মার্চে তিন সপ্তাহ এটি চার্টের প্রথমে অবস্থান করে।
তখন মিউজিক ভিডিওর চল শুরু হয়েছে। এই গানের সাথে মুক্তি দিতে একটি মিউজিক ভিডিও তাই বানানো হয়। ডাচ পরিচালক বার্ট ভ্যান ডার ভের পুরো ভিডিওর দেখভাল করেন। তখনকার এমটিভিতে বেশ জনপ্রিয়তা পায় তার কাজ। জার্মান আর ইংরেজি দুই ভাষাতেই বানানো হয় এই ভিডিও।
তবে নিনা ব্যান্ডের সদস্যরা পরবর্তীতে ইংরেজিতে গানটি করার জন্য আফসোস করেছিলেন। গানের সুরকার ফাহরেনক্রগ-পিটারসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ইংরেজিতে রূপান্তরের সময় গানটির যে আবেদন ছিল, তার অনেকখানি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ঠিক যে চিন্তা করে গানটি লেখা হয়েছিল, ইংরেজি গানের কথায় তা সঠিকভাবে প্রকাশিত হয়নি। এরপর থেকে তারা আর ইংরেজিতে গানটি কোথাও গাননি। আজও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিনাকে এই গান গাইতে অনুরোধ করা হলে তিনি জার্মান গানটিই গান।
কী আছে গানের কথায়
নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস যুদ্ধের বিরোধিতা করে লেখা। মূল জার্মান গানে বর্ণনাকারী এমন এক ঘটনার কথা বলছেন যেখানে কেউ একজন ৯৯টি বেলুন ছেড়ে দিয়েছে বাতাসে। শত্রুদেশের কোনো এক জেনারেল রাডারে বেলুনগুলো দেখে সনাক্ত করতে পারলেন না। তার কাছে এগুলোকে ইউএফও মনে হয়। তিনি চাক্ষুষ দেখতে কয়েকটি বিমান পাঠান।
বিমানের পাইলটেরা উড়ে গিয়ে দেখতে পেল বাতাসে ভাসতে ভাসতে কয়েকটি বেলুন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। যুদ্ধের সুযোগ না পেয়ে যারপরনাই হতাশ হলো তারা। ফিরে গেলে সতীর্থদের টিটকারি শুনতে হবে ভেবে নিজেদের গোলাবারুদ নিরীহ বেলুনগুলোর উপরেই খরচ করতে লাগল তারা।
মনে রাখতে হবে, গানটি স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে লেখা। সামান্য উস্কানিতেই তখন যুদ্ধ বেধে যেতে পারত। সেই সময় আকাশে কিছু বিমান গোলাগুলি করছে দেখে সমস্ত দেশই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সবাই ধরে নেয়- অন্যরা তাদের উপর হামলা করছে। সুতরাং তারাও পাল্টা হামলা চালিয়ে বসে। তুচ্ছ বেলুনের কারণে বেধে যায় মহাযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ৯৯টি বেলুন যখন ভূপাতিত হলো, তার সাথে সাথে বিশ্বও পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। চারদিকে আগুন আর ধোঁয়ার মাঝে বর্ণনাকারী এরপর ১০০ তম বেলুনটি উড়িয়ে দিলেন।
ইংরেজি সংস্করণে একটু ভিন্নভাবে বিষয়টি লেখা হয়েছে। এখানে বর্ণনাকারীর ভাষ্যে বলা হয়েছে, তিনি এক বন্ধুর সাথে লাল রঙের ৯৯টি বেলুন ছেড়ে দিয়েছিলেন আকাশে। সামরিক বাহিনীর ওয়ার্নিং সিস্টেম ভুল করে একে চিহ্নিত করে শত্রুবিমান হিসেবে। পাল্টা আঘাত করলে শুরু হয়ে যায় পারমাণবিক যুদ্ধ। মানবসভ্যতা ধুলোয় মিশে যায়।
নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস-এর পর নিনা আরো অনেক গান গেয়েছেন, তবে কোনোটিই এর মতো বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারেনি। ১৯৮৭ সালের পর ব্যান্ডটি ভেঙে গেলেও আজও নিনা গান গেয়ে যাচ্ছেন। তবে বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, মানুষ তাকে মনে রেখেছে এই একটি গানের জন্যই।
শেষ করা যাক মজার এক তথ্য দিয়ে। ২০০৬ সালে হ্যারিকেন ক্যাটরিনার আঘাতে বিপর্যস্ত জনপদের জন্য সাহায্য চাওয়া হচ্ছিল। মার্কিন কেবল টেলিভিশন স্টেশন VH1 তখন অর্থ তোলার এক উদ্যোগ নেয়। স্টেশন জানায়- অর্থ প্রদানের বিনিময়ে অর্থদাতাদের পছন্দের মিউজিক ভিডিও তারা টেলিভিশনে দেখাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি ৩৫,০০০ মার্কিন ডলার দান করেন স্টেশনের তহবিলে। তার অনুরোধ- এক ঘণ্টা ধরে নিনার নাইন্টি নাইন লাফতবেলুনস মিউজিক ভিডিও চালাতে হবে। ২০০৬ সালের ২৬ মার্চ টিভি স্টেশনটি অর্থদাতার কথা মেনে দুপুর ২টা থেকে টানা এক ঘণ্টা এই ভিডিও চালিয়েছিল।