পৃথিবীর প্রতিটি দেশই মূলত বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ে গঠিত। এসব অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানীয় গল্প প্রচলিত রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ‘উপকথা’ বলে থাকি। একজন ব্যক্তি ছোটবেলায় পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এসব গল্প শোনেন। যেহেতু ছোটরা অনেক বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়, তাই তারা গল্প শুনতে শুনতে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায় অনেক সময়। বেশিরভাগ গল্পের ক্ষেত্রে একটি জীবনঘনিষ্ঠ বার্তা দেয়া হয়। আবার অনেক সময় উপকথায় এমন কিছু বলা হয়, যাতে ছোটরা আগ্রহ সহকারে শুনতে পারে। সেক্ষেত্রে উপকথায় বাড়তি উত্তেজনা তৈরির উপাদান থাকে। শিশুরা এসব উপকথা শোনে, পরবর্তীতে যখন তারা সময়ের ব্যবধানে পিতৃত্ব-মাতৃত্বের স্বাদ লাভ করে, তখন তাদের সন্তানদের সেসব গল্প শোনায়। এভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে গল্পগুলো প্রবাহিত হয়। অনেক সময় বিকৃতও হয়ে যায়।
মালদ্বীপ দক্ষিণ এশিয়ারই একটি দেশ। দেশটি মূলত অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে গঠিত, এবং প্রতিটি দ্বীপই প্রাকৃতির সৌন্দর্যের আধার হিসেবে পরিগণিত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিবছর অসংখ্য পর্যটক মালদ্বীপের বিভিন্ন দ্বীপে উপস্থিত হন, দুর্দান্ত সব সমুদ্রসৈকতে অবসর সময় কাটান, বিলাসবহুল রিসোর্টগুলোতে এসে নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন। দেশটির মোট জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসে পর্যটনশিল্প থেকে। শুধু তা-ই নয়, মালদ্বীপের চারপাশে যে সমুদ্র, তা থেকে বিশাল পরিমাণ সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয় প্রতিবছর। মাছের একটি বড় অংশ হচ্ছে বিখ্যাত টুনা মাছ। তবে পর্যটনের পাশাপাশি মালদ্বীপের বিভিন্ন দ্বীপে অনেক উপকথা প্রচলিত আছে স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে। দেশটিতে অঞ্চলভেদে অসংখ্য উপকথা প্রচলিত থাকলেও ‘রান্নামারি’ নামের এক দানবের কথা পুরো মালদ্বীপের সবখানেই শোনা যায়। আমাদের দেশের মায়েরা যেমন একসময় মারাঠা বর্গীদের ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন, তেমনই মালদ্বীপের মায়েরা রান্নামারি দানবের ভয় দেখিয়ে তাদের বাচ্চাদের ঘুম পাড়ান।
মালদ্বীপের উপকথা অনুযায়ী, রান্নামারি হচ্ছে এক সামুদ্রিক দানব। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই দানবের উৎপাত শুরু হয়। তখন প্রতিদিন রাতের বেলা এই দানব সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এসে মালদ্বীপের রাজধানী মালের লোকালয়ে পা রাখত, এরপর চলত তার ধ্বংসযজ্ঞ। বেশ কিছু উপকথা অনুযায়ী, এই দানব যখন সমুদ্রের তলদেশ থেকে লোকালয়ে পা রাখত, তখন বিকট আওয়াজের পাশাপাশি তার বিশালাকৃতির শরীর জ্বলজ্বল করত, যেন তার পুরো শরীরে রেডিয়াম দেয়া হয়েছে। এই দানবের মূল কাজ ছিল লোকালয়ের যত কুমারী নারী রয়েছে, তাদের হত্যা করা। মাসের পর মাস এই দানবের আক্রমণে মালদ্বীপের সমাজে নারীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। যেসব পরিবারে কুমারী নারী ছিল, সেসব পরিবার রাত হতেই চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সময় অতিবাহিত করত। মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা চিন্তায় পড়ে যান। এই দানবের হাত থেকে কীভাবে মালদ্বীপের সমাজকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে তার সভাসদদের নিয়ে আলোচনায় বসেন।
সবার সাথে পরামর্শের পর রাজা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, রাজধানী মালে থেকে কাছে সমুদ্রতীরে একটি মন্দির তৈরি করা হবে, যে মন্দিরের ভেতরে প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর একজন কুমারী নারীকে রেখে আসা হবে। এরকম করার কারণ ছিল, রান্নামারি দানব অন্যান্য সময় অসংখ্য কুমারী নারী হত্যা করত, কিন্তু এবার যদি মাত্র একজন নারীতেই সে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে সেটাই ভালো। তার এই পরিকল্পনা কাজে দিয়েছিল, রান্নামারি দানব প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর সেই মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে আগে থেকেই রেখে আসা সেই নারীকে হত্যা করতে, লোকালয়ের দিকে আর নজর দিত না। সাধারণত যে কুমারী নারীকে মন্দিরে রেখে আসা হবে, তাকে রাতের বেলা একেবারে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো মন্দিরের কাছে, এরপর মন্দিরের ভেতরে তাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে আসা হতো। পরদিন ভোরবেলা গিয়ে সেই কুমারী নারীর পরিবারের সদস্যরা গিয়ে তার প্রাণহীন দেহ বহন করে নিয়ে আসত, এবং সৎকারের আয়োজন করত। মালদ্বীপের সমাজে যেসব পরিবারের কুমারীদের রান্নামারি দানবের উদ্দেশ্য উৎসর্গ করা হতো, সেই পরিবারগুলো সমাজে বিশেষ মর্যাদা লাভ করত।
এভাবেই চলছিল দিনকাল। কিন্তু ১২০০ সালের দিকে এক মরক্কান পর্যটক, যিনি মালদ্বীপে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, তিনি এই ঘটনা শুনে দারুণ বিস্মিত হন। তিনি এরপর প্রস্তাব করেন, কুমারী নারীর পরিবর্তে তিনি নিজে একরাত সেখানে কাটাবেন। মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা তাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরবর্তীতে তার জেদি মনোভাবের জন্য তার প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন। নিয়ম অনুযায়ী, তাকে রাতের বেলা মন্দিরের ভেতর রেখে আসা হয়। পর দিন যখন রাজার প্রতিনিধি সেই মরক্কান পর্যটকের মৃতদেহ আনার জন্য মন্দিরে প্রবেশ করে, তখন তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে সেই মরক্কান পর্যটক কুরআন শরীফ থেকে বিভিন্ন আয়াত তেলাওয়াত করছেন। তাকে মালদ্বীপের রাজার দরবারে নিয়ে আসা তিনি। রাজদরবারে সেই মরক্কান পর্যটক বলেছিলেন, যখন রান্নামারি দানব এসেছিল, তখন তিনি কুরআন শরীফের কিছু আয়াত পাঠ করেন। এরপর রান্নামারি দানব তাকে আক্রমণ না করে সমু্দ্রে ফিরে যায়। তিনি মালদ্বীপের তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা ও তার জনগণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। তারা তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়। সকলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। উপকথা অনুযায়ী, এভাবেই মালদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে।
অনেকে আবার এই রান্নামারি দানব সম্পর্কে প্রচলিত আরেকটি উপকথার ভিন্ন সংস্করণ প্রচার করেন। তাদের প্রচার করা উপকথা অনুযায়ী, রান্নামারি বলতে কিছুই ছিল না, বরং মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা ছিলেন একজন বিকৃত মস্তিষ্ক, ও চরম নারীলিপ্সু ব্যক্তি। রান্নামারি দানবের অন্তরালে তিনিই সেই মন্দিরে গিয়ে সারারাত ধরে কুমারী নারীদের ভোগ করতেন। এরপর তার ভোগকর্ম শেষ হলে গেলে অসহায় নারীটিকে হত্যা করতেন, যাতে পরবর্তীতে সে মুক্ত হয়ে কোনো ঝামেলা করতে না পারে। অর্থাৎ, ‘রান্নামারি’ দানব ছিল তার একটি বানানো গল্প, যার আড়ালে তিনি নিজে তার ব্যক্তিগত নারীলিপ্সা মেটাতেন। পরবর্তীতে যখন সেই মরক্কান পর্যটক ইসলামের বার্তা নিয়ে হাজির হন, তখন তিনি নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন। তবে রান্নামারি দানব সম্পর্কে প্রচলিত এই ভিন্ন সংস্করণের গল্পের প্রচারকেরা হলেন মালদ্বীপের শিক্ষিত সমাজের লোকজন।
বেশিরভাগ উপকথার ক্ষেত্রেও যা হয়, রান্নামারি দানবের উপকথা সম্পর্কেও তা-ই হয়েছিল। মূলত উপকথাগুলোর নির্ভরযোগ্য সূত্র পাওয়া যায় না, অর্থাৎ উপকথায় যেসব গল্পের অবতারণা করা হয়, সেগুলো যে সত্যি, এরকমটা দাবি করা হয় না কখনোই। কিন্তু উপকথাগুলো প্রায় সময়ই যে একটি নিগুঢ় বার্তা নিয়ে হাজির হয়, সেটার গুরুত্ব আছে। এটি ছোটদের ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষা হিসেবে কাজ করে। মালদ্বীপের ক্ষেত্রে রান্নামারি দানবের উপকথার সত্যতা নিয়ে কারও মাথাব্যথা না থাকলেও সেই মরক্কান পর্যটকের মাধ্যমে যে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল, এর পক্ষে ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।