২০১৩ সালে আমেরিকায় ডেভিড ফুং এবং অ্যান্ড্রু ফুং নামের দুই ভাই ‘বোবালাইফ’ (Bobalife) নামে একটি গান প্রকাশ করেন। এই গানের লাইনগুলো এমনভাবে লেখা হয়েছিল কিংবা সুর এমনভাবে দেয়া হয়েছিল যে, যেসব ব্যক্তি স্কুল কিংবা কলেজে থাকতে বন্ধুদের নিয়ে ‘বাবল চা’ খেতেন, তারা সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই গান শোনার পর। ‘আমরা যাপন করছি বোবার জীবন’ কিংবা ‘তরুণ এশিয়ানদের প্রধান পানীয়, বলো আমাদের বোবা জেনারেশন’– গানটির এই ধরনের লাইনগুলো অনেক এশীয়-আমেরিকান তরুণকে স্মৃতিকাতরতায় ভাসিয়েছিল। মূলত ‘বোবা টি’ (Boba Tea) কিংবা ‘বাবল টি’ (Bubble Tea) হচ্ছে একধরনের চা ঘরানার পানীয়, যেটি পূর্ব এশিয়া ও আমেরিকার তরুণদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ‘বোবালাইফ’ গানটি এই চা পানের স্মৃতিকে উপজীব্য করেই প্রকাশ করা হয়েছিল। যথারীতি আমেরিকায় বসবাসরত যেসব নাগরিকের শেকড় রয়েছে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, তাদেরকে বেশ নাড়া দিয়েছিল এই গানটি।
রাতের বেলা তাইওয়ানের বাজারগুলোতে যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, তা দেখার মতো একটি দৃশ্য। আপনি যদি কখনও তাইওয়ানে রাত কাটানোর সুযোগ পান, তাহলে দেখতে পাবেন- অসংখ্য মানুষ আলো ঝলমলে রাস্তাগুলোতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন স্ট্রিট ফুডের দোকানে মানুষজনের দলবেধে খাবার খাচ্ছে। অন্যান্য দোকানের চেয়ে যেসব দোকানে ‘বাবল টি’ বা ‘বোবা টি’ বিক্রি করা হয়, সেই দোকানগুলোতে ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। বাজার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়া নাগরিক কিংবা সারাদিন দোকানে কাজ করা মানুষেরা দিনশেষে শরীর থেকে ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে বাবল টি-র দ্বারস্থ হন। পৃথিবীর অনেক জায়গায় ক্লান্তি কিংবা অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে ধূমপান কিংবা অ্যালকোহল গ্রহণ করা হয়। কিন্তু তাইওয়ানে ‘রিফ্রেশমেন্ট ড্রিংক’ হিসেবে বাবল টি-র জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। আপনি তাইওয়ানের যেখানেই যান না কেন, বাবল টি কেনার জন্য দোকান খোলা পাবেন সবসময়। যেহেতু বিশাল চাহিদা রয়েছে, তাই মোড়ে মোড়ে বাবল টি-র দোকান থাকাও খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমরা সাধারণত যে চা পান করি, সেই চা বানানোর জন্য প্রথমে পানিতে চা-পাতা ঢেলে দেয়া হয়। এরপর যতক্ষণ না চা-পাতার কারণে পানির রং ‘চায়ের মতো’ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চুলোর উপরে বসিয়ে রাখা হয়। এরপর লিকার তৈরি হয়ে গেলে চুলো থেকে নামিয়ে ফেলা হয়। কখনও চিনি, আদা কিংবা লবঙ্গ যোগ করা হয়, কখনও আবার স্বাদ বাড়ানোর জন্য যোগ করা হয় দুধ। এটা হচ্ছে গতানুগতিক চা বানানোর পদ্ধতি। কিন্তু বাবল টি’ তৈরির পদ্ধতি আলাদা। এখানে শুরুতেই দুধে চা পাতা দিয়ে পাত্র চুলোয় চড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর চা হয়ে গেলে সেটিতে সাগু দানাজাতীয় খাবার ‘ট্যাপিওকা’ যোগ করা হয়। তবে চুলোয় দুধ এবং চা-পাতা চড়িয়ে দেয়ার আগেই সাগু দানাগুলো পানিতে সিদ্ধ করে নিয়ে ঠান্ডা করা হয়। এরপর চিনির সিরায় প্রায় আধা ঘন্টার মতো ডুবিয়ে রাখা হয় সেগুলো। সাধারণত দুধে আগে থেকেই চিনি দেয়া থাকে। এরপর কিছু বরফের টুকরো ঢেলে দেয়া হয়। তবে এটা হচ্ছে সাধারণ বাবল টি তৈরির পদ্ধতি। প্রায় সময়ই দুধের সাথে বিভিন্ন ফলের রস বা ‘ফ্লেভার’ যুক্ত করা হয়।
পৃথিবীর অনেক খাবারের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থাকলেও ‘বাবল টি’ বলতে গেলে একেবারে নতুন একটি পানীয়। এর উৎপত্তির ঘটনাও বেশ মজার। ১৯৮৬ সালের দিকে টু সং নামের একজন তাইওয়ানীয় শিল্পী এবং উদ্যোক্তা তাইওয়ানে চা শিল্পের উৎকর্ষতা কাজে লাগিয়ে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার সব ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তার ব্যবসায় প্রায় চল্লিশ লক্ষ তাইওয়ানিজ ডলার লোকসান হয়। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি ভেবে দেখলেন, গতানুগতিক চা বিক্রয় করে লাভের মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তাই তাকে নতুন কোনো চা বানাতে হবে, যা সাধারণ চায়ের চেয়ে দেখতে এবং পান করতে বেশি সুস্বাদু হবে। এরপর তিনি দুধ চায়ে সাগু দানাজাতীয় ট্যাপিওকা বল ও বরফের টুকরা যোগ করলেন। তবে সেসময় এমন কোনো স্ট্র ছিল না, যা দিয়ে বাবল চা পানের ক্ষেত্রে মুখে বরফের টুকরা এবং ট্যাপিওকা বল পানকারীর মুখে পৌঁছাবে। ফলে ট্যাপিওকা বল মুখে নেয়ার জন্য পানকারীরা প্লাস্টিকের চামচের সাহায্য নিতেন। এটা ছিল বেশ দৃষ্টিকটু একটা ব্যাপার। এজন্য পরবর্তীতে টু সং নিজে স্ট্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কথা বলে মোটা স্ট্র ব্যবহার করতে শুরু করেন।
১৯৮৬ সালের অক্টোবরে ‘হানলিন’ নামে প্রথম বাবল টি প্রস্তুতকারী রেস্টুরেন্ট যাত্রা শুরু করে। এর চমৎকার স্বাদের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথমদিকে তাইওয়ানের অন্য শহরগুলোতে অসংখ্য বাবল টি শপ গড়ে ওঠে। এরপর অভিজাত রেস্টুরেন্ট ছেড়ে একেবারে সাধারণ স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলোতেও বাবল টি জায়গা করে নেয়। ১৯৯০ সালের দিকে তাইওয়ানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহির্বিশ্বের দিকে নজর দিতে শুরু করে, পৃথিবীর অনেক দেশে নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটায়। এর ফলে অনেক তাইওয়ানের নাগরিক বাইরের দেশগুলোতে যান। তাদের মাধ্যমে বাবল টি বাইরের দেশগুলোতেও পরিচিতি লাভ করে। ১৯৯০ সালের দিকেই আমেরিকাতেও বিভিন্ন জায়গায় বাবল টি শপ গড়ে উঠতে শুরু করে। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম বাবল টি শপ হানলিনের মোট শাখার পরিমাণ বর্তমানে আশিটি। আমেরিকা, কানাডা কিংবা চীনের মূল ভূখন্ডেও এই প্রতিষ্ঠানটির শাখা রয়েছে। তবে বেশ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাবল টি আরও বেশি পরিচিতি লাভে সমর্থ হয়।
বর্তমানে বাবল টির জনপ্রিয়তা পুরো বিশ্বজুড়ে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এই পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দিনে দিনে এই চমৎকার স্বাদের পানীয়ের চাহিদা বাড়ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০১৮ সালে শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই বাবল টির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১,৮০০ গুণ! বর্তমানে ধারণা করা হয়, পুরো বাবল টি ইন্ডাস্ট্রির মূল্য প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। পুরো পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ এই ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত আছেন। এছাড়া এটি বিভিন্ন বিখ্যাত খাবার তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের মেন্যুতেও স্থান করে নিয়েছে। যেমন বলা যায়, ২০১২ সালে জার্মানিতে ভোক্তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাকডোনাল্ডসের মেন্যুতে বাবল টি যোগ করা হয়। এছাড়া এটি অনেক মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে যখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, তখন সিঙ্গাপুরের অধিবাসীরা হন্য হয়ে শেষবারের মতো বাবল টি নিতে হাজির হয়েছিলেন নিকটস্থ বাবল টি শপগুলোতে, অনেকে আবেগাপ্লুতও হয়ে পড়েছিলেন।
চকলেটের জন্য যেমন বেলজিয়াম পুরো বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে, পাস্তা কিংবা পিজ্জার জন্য যেমন ইতালির আলাদা খ্যাতি রয়েছে, উচ্চমানের ওয়াইন প্রস্তুতের জন্য যেমন ফরাসিরা গর্ববোধ করে, তেমনই বর্তমানে তাইওয়ানের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয়েছে বাবল টি-র মাধ্যমে। বিশ্বায়নের এই যুগে শুধু প্রযুক্তি কিংবা সংস্কৃতি নয়, বিভিন্ন খাবারেরও আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটছে, যার অন্যতম উদাহরণ বাবল টি। ক্লান্তি বা অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে এর জুড়ি মেলা ভার। এর পাশাপাশি স্বাদের যে বৈচিত্র্য, এটি বিভিন্ন ধরনের মানুষকে আরও বেশি আকৃষ্ট করছে। সামনের দিনগুলোতে এই পানীয়র জনপ্রিয়তা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।