ওয়াশিংটনের কোনো এক রাত। গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় পুলিশের নজরে পড়ে গেলেন ৪৬ বছরের এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন সন্দেহে তাকে থামানো হলো, তবে তিনি প্রতিজ্ঞা করে বললেন যে- মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন না তিনি।
তবে পুলিশের সন্দেহ গেল না। ভদ্রলোক ব্রেথালাইজার পরীক্ষা করতে (রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ পরীক্ষা করার জন্য বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি) অস্বীকৃতি জানান, ফলে গ্রেফতার করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে চিকিৎসকেরা রক্ত পরীক্ষা করে সাধারণ মাত্রার থেকে বহুগুণে বেশি অ্যালকোহল শনাক্ত করেন। তবে তিনি তারপরেও অনড়, তিনি নাকি গাড়ি চালানোর আগে সেসব কিছু ছুঁয়েও দেখেননি।
প্রৌঢ়কে পরে ছেড়ে দেয়া হলেও মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোর অভিযোগ থেকে যায়। তিনি নিজের নির্দোষিতা প্রত্যয়ন করতে উঠেপড়ে লাগলেন। বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে তার সমস্যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা খুঁজতে ছুটে যেতেন তিনি, এরকম করতে করতে খবর পেলেন ওহাইয়োতে থাকা এক চিকিৎসকের, যিনি এরকম কিছু রোগীর চিকিৎসা করেছেন বলে খবর ছিল।
চিকিৎসক লোকটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন যে ২০১১ সাল অবধি সুস্থই ছিলেন তিনি। এরপর থেকে অনেকটা আচমকাই স্মরণশক্তিতে ফাঁকফোঁকর দেখা দেয়, বিষণ্নতায়ও ভুগতে শুরু করেন তিনি। তার মেডিকেল হিস্ট্রি থেকে পাওয়া যায় যে এসব লক্ষণ দেখা দেবার সপ্তাহখানেক আগে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিকের একটি কোর্স শেষ করেন তিনি।
চিকিৎসকেরা সন্দেহ করলেন বিরল একটি অসুখের, যার ফলে তার পরিপাকতন্ত্র শর্করা জাতীয় খাদ্যকে ভেঙে ব্যাপক পরিমাণে অ্যালকোহল উৎপাদন করছে। নিশ্চিত হতে হাসপাতালে রেখে তাকে বিশেষায়িত শর্করা খাবার দেয়া হলো। নির্দিষ্ট সময় পর রক্তের নমুনা নিয়ে দেখা গেল সেখানে অ্যালকোহলের বিপুল উপস্থিতি। তাকে জানানো হলো- যে রোগে ভুগছেন তিনি তার নাম অটো ব্রিউয়ারি সিনড্রোম (Auto-Brewery Syndrome)।
অটো ব্রিউয়ারি সিনড্রোম
গাট ফার্মেন্টেশন সিনড্রোম নামেও পরিচিত এই রোগ। অ্যালকোহল সমৃদ্ধ পানীয় না খাওয়া সত্ত্বেও এই রোগে আক্রান্তদের রক্তে স্বাভাবিকের থেকে অধিক মাত্রার অ্যালকোহল পাওয়া যায়। ফলে মাতাল হলে যেসব উপসর্গ দেখা যায়, ঠিক তেমন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাদের, এমনকি আইনগত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও থাকে।
সর্বপ্রথম জাপানে ১৯৫০ সালের দিকে জাপানে অটো ব্রিউয়ারি সিনড্রোম বা এবিএস-এর কথা শোনা যায়। অন্যান্য দেশেও কালক্রমে আবিষ্কৃত হয় এই রোগ। এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৮ জন রোগীর কথা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে পাওয়া গেছে, তবে জাপানীদের মধ্যেই গবেষকেরা এবিএসের ঝুঁকি বেশি বলে মনে করেন। বৈজ্ঞানিকদের একটি দল মনে করেন যে তাদের মধ্যে জেনেটিক কারণে লিভারে অ্যালকোহলের বিপাক ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যে কারণে রক্তে এর মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কেবল নেশাজাতীয় পানীয় নয়, ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে আমাদের শরীরেও বিভিন্ন খাদ্য থেকে অ্যালকোহল তৈরি হয়। কিন্তু লিভার সেগুলো ভেঙে ফেলে বলে আমরা কিছু টের পাই না।
উপসর্গ
দুর্লভ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন পুরুষ-নারী উভয়েই। অনেক ক্ষেত্রেই এর সঠিক ডায়াগনোসিস হয় না। কারণ এরা এমন সব লক্ষণ প্রকাশ করেন, যা দেখে মনে হয় রোগবালাই না, বরং নেশাজাতীয় পানীয় পান করেছেন তারা। তাদের মুখে গন্ধ হয়, আচার আচরণে দেখা দেয় অসংলগ্নতা। ক্লান্তির কারণে কাজকর্মে দেখা দেয় নানা সমস্যা, ফলে চলে যেতে পারে চাকরি। পারিবারিক আর সামাজিকভাবে নানাভাবে অপদস্থ হতে পারেন এই রোগে আক্রান্তরা।
যদিও রোগীর সাথে কথা বললে জানা যায় তেমন কিছু করেননি তারা। এদের অনেকেই পূর্বে প্রচুর পরিমাণে চিনি আর শর্করাযুক্ত খাবার গ্রহণের কথা জানান। কেউ কেউ সুস্থ থাকতে খাওয়া-দাওয়াই বন্ধ করে দেন, ফলে উল্টো প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় শরীর।
কেন হয় এই রোগ?
এককথায় বলতে গেলে, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না! ফিলাডেলফিয়ার ফরেনসিক সায়েন্স রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক ব্যারি লোগান জানিয়েছেন- সাধারণ মানুষের পরিপাকতন্ত্রে স্বাভাবিক নিয়মেই সামান্য পরিমাণে অ্যালকোহল উৎপাদিত হয়। রক্তে পৌঁছানোর আগেই সেটা আবার বিপাকক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। ব্যারি লোগানের মতে, এবিএসে’র রোগীদের ক্ষেত্রে অ্যালকোহল অধিক পরিমাণে তৈরি হয় বলে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবার আগেই বেশ বড় একটা অংশ রক্তে ঢুকে যায়।
ঠিক কেন এত অ্যালকোহল তৈরি করে শরীর? সম্ভাব্য একটি কারণ পরিপাকতন্ত্রে বসে থাকা নানারকম অণুজীব। এরা আমাদের বিপাকক্রিয়ার জন্য দরকারি। তবে কখনো কখনো এই অণুজীবগুলোর সংখ্যা বেড়ে যায় অনেক, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক বা অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার খেলে। তখন এরা প্রস্তুত করতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ইথানল, যা একরকমের অ্যালকোহল।
কী কী কারণে ঝুঁকি বাড়তে পারে?
আগেই যেমন বলা হয়েছে, ঘন ঘন অথবা লম্বা সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের অণুজীবে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এবিএসের রোগীদের ইতিহাসের এমন ঘটনা দুর্লভ নয়। টেক্সাসের পানোলা কলেজের গবেষক বারবারা কর্ডেল প্রচুর পরিমাণে প্রসেসড ফুড গ্রহণের অভ্যাসকেও ঝুঁকির কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। এজন্য কিন্তু এসব রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে খাবারদাবারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের দরকার হয়।
রোগের প্রভাব
এবিএস নিজে থেকে প্রাণঘাতী নয়, তবে জীবনযাত্রার গুণগত মান চিন্তা করলে এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। শারীরিকভাবে রোগী নানা সমস্যার মুখোমুখি হন তো বটেই, পাশাপাশি মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। দেখা দেয় উদ্বেগ, বিষণ্নতার মতো বিভিন্ন সমস্যা। অ্যালকোহলের মাত্রা বেড়ে গেলে কাজকর্ম করতে গিয়েও শারীরিক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন তারা। আবার শরীরে অতিরিক্ত অ্যালকোহল উৎপাদিত হয় বলে পুলিশ কোনো কারণে পরীক্ষা করলে আইনগতভাবেও ফেঁসে যেতে পারেন এসব মানুষ, যেটা সামাজিকভাবে তাদের ছোট করে। পরিবারের সাথে সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জেনেটিক গঠনের কারণে কিছু মানুষের অন্য কিছু রোগ থাকলে এবিএসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এসব রোগের মধ্যে অন্যতম ডায়াবেটিস, ক্রোন’স ডিজিজ, লিভার ডিজিজ ইত্যাদি।
অটো ব্রিউয়ারি সিনড্রোমের কিছু উদাহরণ
যুক্তরাজ্যের সাফোকের এক বাসিন্দা ৬৪ বছরের নিক কার্সন। তার অভিযোগ মাঝে মাঝে কোনো কারণ ছাড়াই জড়িয়ে যায় তার কথা, হাঁটতে গিয়ে মাতালের মতো দুলতে লাগলেন তিনি। কখনো কখনো এমন করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেন তিনি, তরতাজা হয়ে জেগে উঠতেন ছয়-আট ঘণ্টা পরেই। তবে ঘুমোতে যাবার আগে কী হয়েছিল সেটা কেবল ভাসা ভাসা মনে থাকত তার।
কার্সনের স্ত্রী ক্যারেন তো অবাক! তার স্বামীর কাণ্ডকারখানা দেখে যে কেউ বলবে অ্যালকোহল পান করেছেন তিনি। অথচ কার্সনের সে অভ্যাস নেই, এমনকি সংসার জীবনে তাকে কখনো মাতাল হতে দেখেননি তিনি।
অবশ্য কার্সনের পেট ফাঁপা, ব্যথা, ক্লান্তির মতো অন্যান্য লক্ষণও ছিল। প্রায় দুই দশকের মতো এই সমস্যা তার। অবশেষে চিকিৎসকেরা তাকে এবিএসের রোগী বলে শনাক্ত করেন।
ওহাইয়োর ৩৯ বছরের নিক হেস। এবিএসের কারণে জীবন নরকতুল্য হয়ে ওঠে তার। উপসর্গ এতটাই প্রকট হয়ে পড়ে যে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিতে বাধ্য হন নিক। তার সমস্যা যে রোগ, অ্যালকোহল পান নয়- সেটা স্ত্রীকেও বোঝাতে ব্যর্থ হন তিনি, ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় দাম্পত্য সমস্যার। নিক দাবি করেন- একপর্যায়ে স্ত্রী নাকি তার ওপর নজরদারি করতে সিসি ক্যামেরা পর্যন্ত লাগিয়েছিলেন!
টেক্সাসের এক ৬১ বছরের বৃদ্ধ একরাতে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে টলতে টলতে প্রবেশ করেন। সন্দেহ হওয়ায় অ্যালকোহল পরীক্ষা করা হলো, যার পরিমাণ পাওয়া গেলো স্বাভাবিক মাত্রার প্রায় পাঁচগুণ। তবে বৃদ্ধের এককথা, অ্যালকোহল তিনি ছুঁয়েও দেখেননি।
কর্ডেল আর ম্যাককার্থি নামে দুই চিকিৎসক ঘটনা বুঝতে চাইলেন। তারা লোকটিকে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখেন। এই সময়ে তাকে দেয়া হয় শর্করা জাতীয় খাবার। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা হয় অ্যালকোহলের মাত্রা দেখতে। প্রমাণিত হয় যে তিনি আসলে এবিএসে ভুগছেন।
চিকিৎসা
আগেই বলা হয়েছে খুব দুর্লভ এই রোগ। ফলে চিকিৎসকদের সন্দেহের তালিকায় সাধারণত স্থান পায় না এটি। এজন্য অনেক সময়েই রোগীরা চিহ্নিত হন না। রোগীর ইতিহাসে যদি ঝুঁকি বাড়ানোর মতো কিছু থাকে সেটা একটা সতর্ক সংকেত হতে পারে। রক্তে অতিরিক্ত অ্যালকোহল অবশ্যই সন্দেহ বাড়ায়। অনেক সময় চিকিৎসকেরা পরিপাকতন্ত্রে কিছু বিশেষ অণুজীবের অস্তিত্ব সন্ধান করেন, যা পাওয়া গেলে রোগের কার্যকারণ নিয়ে একটা ধারণা পান তারা।
ঠিক কীভাবে করা যায় চিকিৎসা? এজন্য দরকার জীবনপ্রণালীর পরিবর্তন, বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে। শর্করা জাতীয় খাবার বাদ দেয়ার দরকার নেই, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অতিরিক্ত শর্করা পরিহার করতে হবে এবং বিশেষ বিশেষ খাবার হয়তো একেবারেই বাদ দিতে হবে। ওষুধ ব্যবহার করে তেমন কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
অটো ব্রিউয়ারি সিনড্রোম সারা জীবনের রোগ। তবে আশার কথা হলো নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব। এজন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব আর সমাজের পক্ষ থেকেও সহায়তা জরুরি।