রাত আড়াইটা। হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকাতেই ভয়ের শীতল স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে নেমে গেল। একই বিছানায় পাশাপাশি যে বন্ধুটির সাথে শুয়েছিলাম, তার জায়গা দখল করে নিয়েছে হুবহু একই রকম দেখতে অন্য কোনো মানুষ! আপাতদৃষ্টিতে পরিবর্তনটা ধরার জো নেই। কিন্তু আমি ঠিকই বুঝতে পারছি, আমার পাশে যে শুয়ে আছে সে আমার বন্ধু নয়, অন্য কেউ! দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো আমার। শরীরের সব শক্তি কন্ঠে নিয়ে এসে আর্তচিৎকারের চেষ্টা করলাম। কিন্তু এ কী! আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই যে বের হচ্ছে না!
না পাঠক, কোনো সস্তা হরর কাহিনীর সেট আপ নয় এটি। বরং আপনাদেরকে এখন বলা হবে এক বিশেষ ধরনের মানসিক রোগের ব্যাপারে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করে, তার খুব কাছের বন্ধু, সঙ্গী, ভাই-বোন, বাবা-মা, সন্তান, পোষ্য জীব বা পরিবারের কোনো সদস্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে হুবহু একই রকম দেখতে অন্য কোনো ব্যক্তি। এই মানসিক রোগের নাম ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম।
আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় যে কোনো জীবন্ত বস্তুর (মানুষ বা পোষা জন্তু) ব্যাপারেই মতিভ্রমে ভুগবে, তেমনটা না-ও হতে পারে। তার ভ্রমের লক্ষ্য হতে পারে কোনো জড় বস্তুও; এমনকি কোনো বিশাল গাড়ি কিংবা বাড়িও!
আট থেকে আশি, নারী কিংবা পুরুষ, শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত, সব বয়স-শ্রেণী-পেশার মানুষের মাঝেই এই মানসিক ব্যধির সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, নারীরাই সাধারণত এই ব্যধিতে বেশি আক্রান্ত হয়। তাই বলে কেউ যেন মনে করবেন না যে, এক্ষেত্রে কেবল নারীদের একচেটিয়া আধিপত্যই বিরাজ করে। আজকাল নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও প্রায়শই এই ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
ইতিহাস
ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমের নামকরণ করা হয়েছে ফরাসি সাইকিয়াট্রিস্ট জোসেফ ক্যাপগ্রাসের (১৮৭৩-১৯৫০) নামের উপর ভিত্তি করে। তিনিই প্রথম এই রোগটির ব্যাপারে উল্লেখ করেন। ১৯২৩ সালে তিনি জিন রেবৌল-লাচাওয়ের সাথে যৌথভাবে একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন। এক্ষেত্রে তারা কাজ করেন মাদাম ম্যাকাবের নামক এক ফরাসি মহিলার সাইকোলজিক্যাল কেসের উপর।
মাদাম ম্যাকাবের দাবি করতেন, তিনি তার স্বামীসহ পরিচিত প্রায় সব মানুষেরই দুটি করে অস্তিত্ব দেখতে পান। ক্যাপগ্রাস ও রিবৌল-ল্যাচাও প্রথম এই ভ্রমের নাম দেন “l’illusion des sosies”, যার আক্ষরিক বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “একই রকম দেখানোর ভ্রম”। প্রাথমিকভাবে তারা ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমকে একটি বিশুদ্ধ সাইকিয়াট্রিক ডিজঅর্ডার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যা স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা হিস্টিরিয়ার উপসর্গ হিসেবে দেখা যায়, এবং যেটি কেবল নারীদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে (যদিও এখন সেই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে)।
১৯৮০’র দশক পর্যন্ত ক্যাপগ্রাস ও রিবৌল-ল্যাচাওয়ের ধারণাই সর্বজনস্বীকৃত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম একটি নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার হিসেবে বিবেচিত হয়, যেখানে প্রাথমিকভাবে ভ্রমের কারণ হিসেবে মনে করা হয় মস্তিষ্কের ক্ষতকে।
যে কারণে দেখা দেয় ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম
ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম প্রধানত আলঝেইমার রোগ কিংবা ডিমেনশিয়ার সাথে সম্পর্কিত। এই দুই ধরনের রোগেই মানুষের স্মৃতিশক্তি আক্রান্ত হয়, এবং বাস্তবজ্ঞান প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া, প্রধানত প্যারানয়েড হ্যালুসিনেটরি স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমের কারণ হতে পারে। স্কিৎজোফ্রেনিয়াও মানুষের বাস্তবজ্ঞানকে প্রভাবিত করে এবং ভ্রম সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে।
এছাড়াও কিছু বিরল ক্ষেত্রে, মস্তিষ্কের আঘাত, যা থেকে মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়, তা ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমের কারণ হতে পারে। এটি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে যদি আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটি হয় ডান হেমিস্ফেয়ারের পেছন দিকটা, কেননা ওখান থেকেই মানব মস্তিষ্কে মৌখিক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়ে থাকে।
আজকাল এই সিনড্রোমের সম্ভাব্য সেরা কারণ হিসেবে একাধিক তত্ত্বকে বিশ্বাস করা হয়। কিছু কিছু গবেষক মনে করেন, মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণেই এই সিনড্রোম দেখা দেয়। আবার গবেষকদের আরেক অংশের বিশ্বাস, শারীরিক পরিবর্তনও এখানে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার কারও কারও ধারণা, তথ্য পরিবহন বা উপলব্ধিগত ত্রুটির ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তির কিছুটা ধ্বংস হয়ে যায় বা সাময়িকভাবে লোপ পায়, যার ফলে মানুষ তার চেনা মানুষকেও অচেনা বলে ভুল করতে পারে।
কারা এ ব্যধির শিকার হয়?
সাধারণত ১৬-২৮% লিউয়ি বডি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়। ১৫% আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝেও এ রোগের উপসর্গ ধরা পড়ে। এছাড়া সাধারণ পারকিনসন্স রোগে আক্রান্তদের মাঝেও এ ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যদিও সে হার খুবই কম। উদ্বিগ্ন ও অবসন্ন ব্যক্তিদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা যেকোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের ব্যক্তির চেয়ে দশগুণ বেশি। যেহেতু এই ব্যধির সাথে মিথ্যা সন্দেহের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে, তাই ধরে নেয়া যায়, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত ব্যক্তিরা ভবিষ্যতে এ ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার সর্বাধিক ঝুঁকিতে রয়েছেন।
চিকিৎসা
এই মুহূর্তে ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম দূরীকরণের সরাসরি কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই, কেননা নির্দিষ্ট কোনো উপশমের রাস্তা বের করার আগে এই ব্যধি নিয়ে আরও বিশদ গবেষণা প্রয়োজন। তারপরও প্রচলিত কিছু উপায়ে এই রোগের উপসর্গগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তবে প্রথমত যেটি প্রয়োজন তা হলো ঠিক কী কারণে একজন মানুষের মধ্যে এ রোগের উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে তা চিহ্নিত করা।
এই ব্যধি দূর করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো আক্রান্ত ব্যক্তির চারপাশে একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে সে নিজেকে সবসময় নিরাপদ মনে করে, এবং তার মনে কোনো অকারণ ভীতি সঞ্চার না হয়।
কিছু কিছু মানসিক শুশ্রুষা কেন্দ্রে ভ্যালিডেশন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। ভ্যালিডেশন থেরাপিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মনে জন্মানো ভ্রমগুলোকে উড়িয়ে দেয়ার বদলে, সেগুলোকে সমর্থন করা হয়, এবং ব্যক্তির মনের উদ্বেগের প্রশমন ঘটানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে, প্রাকৃতিক উপায়ে তার মনের ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাসগুলোকে উপড়ে ফেলা হয়।
আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি হলো রিয়েলিটি ওরিয়েন্টেশন। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির সেবাদানকারী বা সঙ্গী ক্রমাগত তাকে বর্তমান সময়, অবস্থান প্রভৃতি স্মরণ করিয়ে দিতে থাকে। এছাড়াও তার সামনে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কর্মকান্ড ও পরিবর্তনসমূহের কথা বলতে থাকে, যাতে তার মস্তিষ্ক সেসব স্মৃতিকে হারিয়ে না ফেলে, বরং নতুন করে সেগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।
এগুলোর পাশাপাশি স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা আলঝেইমারের সাধারণ ওষুধও চলতে থাকে। আর যদি সম্ভব হয়, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারও করা হয়ে থাকে, যাতে করে সে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। তবে যেহেতু মস্তিষ্ক খুবই স্পর্শকাতর এবং মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে, তাই শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে অধিকাংশ চিকিৎসকই মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করতে চান না।
কীভাবে ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির দেখভাল করা যায়
এই সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির দেখভাল করা খুবই দুরূহ একটি কাজ, বিশেষত আপনি নিজেই যদি সেই লোক হন, যাকে সে সন্দেহের চোখে দেখছে। ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিম্নলিখিতভাবে দেখভাল করা যেতে পারে:
- সহানুভূতিশীল হওয়া খুবই জরুরি একটি ধাপ। আক্রান্ত ব্যক্তির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে, তার চিন্তাধারার সাথে যথাসম্ভব নিজেকে সংযুক্ত করা গেলে তাকে অনুধাবন করা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। কিন্তু এটিও ভুলে গেলে চলবে না যে গড়পড়তা মানুষের পক্ষে এতখানি সহানুভূতিশীল হওয়া সম্ভব না। অনেক বেশি মনের জোর থাকলেই কেবল তা সম্ভব।
- এই সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অহেতুক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়, এবং তাদের চিন্তাধারণা গড়েই ওঠে ভুলের উপর ভিত্তি করে। তাই তাদের সাথে তর্ক করে, তাদের ভুল ধরিয়ে দেয়াটা খুব একটা প্রভাবজনক হবে না। বরং ধৈর্য ধরে তাদের কথা শোনা, এবং তারা যাতে একসময় নিজে থেকেই নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারে, সেজন্য অপেক্ষা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
- তারা যাতে আপনার কাছে নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রথমত আপনাকে তার বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠতে হবে। যদি আপনি নিশ্চিত না হন যে কীভাবে তার বিশ্বাস অর্জন করা যাবে, তাহলে সরাসরি তাকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করুন, এবং সে যা করতে বলে তা-ই করুন (যতক্ষণ পর্যন্ত সে কাজ তার বা আপনার ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়)।
- যাকে আক্রান্ত ব্যক্তি সন্দেহ করছে, তাকে দূরে রাখাই শ্রেয়। এবং যদি সেই দুর্ভাগা ব্যক্তি আপনিই হন, তাহলে মঙ্গলজনক হবে যদি আপনি তার ধারেকাছে না থাকেন। আপনার উপস্থিতি তার উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে, যা পরবর্তীতে আরও বেশি অকল্যাণকর হতে পারে। তাই যদি সম্ভব হয়, তাকে অন্য কোনো ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনি দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করুন।
- ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম দৃষ্টিশক্তির সাথে সম্পর্কিত। চোখের দেখায় একজন ব্যক্তি আপনাকে চিনতে ভুল করতে পারে বা আপনাকে সন্দেহ করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিরা শব্দ চিনতে সাধারণত ভুল করে না। তাই আক্রান্ত ব্যক্তি যদি হঠাৎ করে আপনাকে দেখে না চেনে বা সন্দেহ করে, তাহলে জোরে জোরে তার সাথে কথা বলতে পারেন, বা তাকে কোনো গান গেয়ে শোনাতে পারেন। কিংবা তার ও আপনার স্মৃতির সাথে জড়িত যেকোনো আওয়াজ করে দেখতে পারেন। এসব শব্দ দ্বারা সে আপনাকে চিনে ফেলতে পারে।
- সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, ক্যাপগ্রাস সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির দেখভাল করা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। যেহেতু এটি একটি মানসিক ব্যধি, তাই আক্রান্ত ব্যক্তি আকস্মিকভাবে সহিংস হয়ে আপনাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে বসতে পারে। তাই নিজের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিন।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/