ডিসেম্বরের ১৮ পেরিয়ে ১৯ তারিখের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের অলি-গলিতে যখন আকাশি-সাদা পতাকার মিছিল আর মানুষের উল্লাসধ্বনি, ততক্ষণে কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে লেখা হয়ে গেছে এক নতুন রূপকথার গল্প। ফিরে আসা নিয়ে অসংখ্য কল্পকথা চালু আছে পৃথিবীতে, আছে বারবার ইকারাসের উড়তে না পারার আক্ষেপ। কিন্তু ফিনিক্স পাখির শেষ থেকে শুরু করার রূপকথাই বোধহয় সবচেয়ে সুন্দর; সবচেয়ে বেশি কাছের গল্প মনে হয় মানুষের কাছে। তেমন এক গল্পের পরশ দিয়ে গেল ১৮ ডিসেম্বর রাত।
আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দল বিশ্বকাপ জিতেছে ৩৬ বছরের অপেক্ষার পর। মেসির হাতে উঠল বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু খেয়ে মেসি তার অগণিত ভক্তের বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা পাথর সরালেন। কেউ কেউ বলছেন, ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসটাই যেন পূর্ণতা পেল মেসির জয়ে।
আর্জেন্টিনার ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হয় সৌদি আরবের কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। শর্তসাপেক্ষে, এই পরাজয়কে ফুটবল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বলেছেন অনেক ফুটবলবোদ্ধাই। তার আগে আর্জেন্টিনা সর্বশেষ হেরেছিল ২০১৯ সালে। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে লিওনেল স্কালোনির দল ভাগ বসায় ইতালির সর্বোচ্চ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ডে। কিন্তু বিধি বাম হয়ে আসে সৌদি আরবের মতো একটি দলের কাছে এমন লজ্জাজনক হার। সন্দেহ নেই, এই বিশ্বকাপের শুরুতে যদি পাঁচটি দলকে শিরোপার দাবিদার ভাবা হতো, তাহলে আর্জেন্টিনা ছিল তার ভেতর একটি। কোপা আমেরিকা এবং ফিনালিসিমা ট্রফি জয়ের পর ফেভারিট তকমা পাওয়া এই দলের এমন এক পরাজয় মেনে নিতে পারেননি খোদ আর্জেন্টিনা সমর্থকদের বড় অংশই। হঠাৎ করে সমন্বয়হীন, নড়বড়ে একটা রক্ষণভাগ ধরা পড়ে সে ম্যাচে। ডি পলরা যেন মুখ থুবড়ে পড়েন সৌদি আরবের শারীরিক সামর্থ্যের সুবিধাজনক অবস্থানের মুখে৷ সমালোচনার ঝড় উঠে গোলরক্ষক এমি মার্টিনেজকে নিয়ে। অনেকে যখন আর্জেন্টিনা গ্রুপে তৃতীয় নাকি চতুর্থ স্থান অধিকার করে বিদায় নেওয়ার তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করছিল, তখনই লিওনেল মেসি সংবাদ সম্মেলনে বললেন, তার দল সব নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছে।
বিশ্বকাপের পরের অংশ যেন নতুন করে হাজির হলো তাদের জন্য। মেক্সিকোর সাথে ম্যাচে নামার আগমুহুর্তে পুরো দুনিয়ার আর্জেন্টিনা ভক্তদের মনে কালোমেঘের ঘনঘটা৷ এ ম্যাচ হারলেই বিদায়। মেসি আগেই জানিয়ে দিয়েছেন এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। তার এমন বিদায় তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না! ৬৪ মিনিটে ডিবক্সের বাইরে থেকে শট নিয়ে মেসি যখন আর্জেন্টিনার সেই নতুন বিশ্বকাপের গোলের খাতা খুললেন, এক অপূর্ব প্রাপ্তির সুবাতাস যেন ছড়িয়ে গেল! লিওনেল মেসির জন্মস্থান আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে সেদিন নিশ্চয়ই কোনো ক্যাথলিক পাদ্রী গির্জায় বসে নীরবে ভাবছিলেন, এই শহর এই পৃথিবীকে দিয়েছে কতকিছু!
২-০ গোলে মেক্সিকোর সাথে জেতার পর আর্জেন্টিনা দলের মানসিক দৃঢ়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। যেন সেই চিরচেনা আর্জেন্টিনা, শৈল্পিক ফুটবলের অনন্য প্রতিনিধি। পোল্যান্ডের সাথে ২-০ গোলে সহজ জয় নিয়ে শেষপর্যন্ত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই শেষ ষোলোর টিকেট কাটে আলবিসেলেস্তেরা। শেষ ষোলোতে অস্ট্রেলিয়ার সাথেও ২-১ গোলে জয় তুলে নেয় আর্জেন্টিনা। মেসির নৈপূণ্য, নেতৃত্ব আর দৃঢ় মনোবল; টিম আর্জেন্টিনা জয়ের অনুপ্রেরণার তুঙ্গে থাকা আর ডি পল-ম্যাক অ্যালিস্টার-আলভারেজ-এমি-ওটামেন্ডিদের জয়ের ক্ষুধা অস্ট্রেলিয়ার সাথে সহজ জয় তুলে নিতে সাহায্য করে।
এই বিশ্বকাপের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ ও আলোচিত ম্যাচ ছিল কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডস বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচটি। কারণ, এর সাথে জড়িয়ে ছিল অনেক অনেক ইতিহাস। ডাচ কোচ লুই ফন গাল লাতিন আমেরিকানদের কখনোই সেভাবে পছন্দ করে উঠতে পারেননি। কেবল তার অপছন্দ বলেই রিকুয়েলমের মতো স্বতন্ত্র একজন ‘নাম্বার টেন’-এর বার্সেলোনার ক্যারিয়ার ছায়ায় ঢেকে গিয়েছিল। সেইসাথে ডি মারিয়ার সাথে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে হওয়া অসংখ্য অন্যায়ের ঘটনা তো ছিলই। এসব ছাড়াও নেদারল্যান্ডের সাথে ম্যাচের দুয়েকদিন আগ থেকেই ডাচ খেলোয়াড় আর কোচদের একের পর এক মেসি ও আর্জেন্টিনাকে নিয়ে টিটকারি, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ঘটনায় মাঠ ও মাঠের বাইরে এই ম্যাচকে ঘিরে একটা অন্যরকম উত্তাপ চোখে পড়ছিল। ম্যাচ শুরুর পর থেকেই একের পর এক দৈহিক আক্রমণ চলতে থাকে দু’পক্ষেই। তার ভেতর আর্জেন্টিনা দুই গোল করে বসে। দ্বিতীয় গোলের পর ফন গালের সামনে গিয়ে মেসির রিকুয়েলমের মতো সেই দুই কানের পাশে হাত দিয়ে আইকনিক উদযাপন আলোচনার জন্ম দেয়। মুহুর্মুহু ফাউল আর আক্রমণের সাথে যোগ হয় রেফারির হঠকারি সিদ্ধান্ত। গোটা খেলায় ১৫টি কার্ড দেখানো হয় উভয় পক্ষ মিলিয়ে। ম্যাচের শেষদিকে রক্ষণভাগ ফাঁকা পেয়ে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই গোল দিয়ে পরিস্থিতি পাল্টে দেয় নেদারল্যান্ডস।
স্কোর সমান হওয়ার পর তারা হয়তো আরো দুয়েকটি গোল ঠুকে দিতে পারতো আর্জেন্টিনার জালে। কিন্তু এমি মার্টিনেজ এত দারুণ সব আক্রমণ ঠেকিয়ে দেন যে, স্কোর আর বাড়তে পারেনি। শেষদিকে এসে দুর্দান্ত এক আক্রমণ রক্ষণভাগের লিসান্দ্রো মার্টিনেজ এমনভাবে ঠেকান, মনে হয়েছিল যেন সেই ২০১৪ সালের হাভিয়ের মাশ্চেরানো আবির্ভূত হলেন লুসাইল স্টেডিয়ামে। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময় পেরিয়ে টাইব্রেকারে। খেলার সময় রীতিমতো মারামারিতে জড়িয়ে যাওয়া দু’দলই টাইব্রেকারে গিয়ে সমানে স্লেজিংয়ে জড়ায়। মেসি প্রথম পেনাল্টি নিয়ে দলকে এগিয়ে দেন। ওদিকে আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম দুটো পেনাল্টিই ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক এমি মার্টিনেজ। আর্জেন্টিনা জয় পায় শেষপর্যন্ত ৪-৩ গোলে। সৌদি আরবের সাথে হেরে আসা দল জোগাড় করে ফেলে সেমিফাইনালের টিকেট!
প্রিয় পাঠক, ভাবছেন এ কেমন রূপকথার গল্প? প্রতিটি ম্যাচেই জয়-পরাজয়ের মাঝের এক পুলসিরাতে থাকা আর্জেন্টিনা দল বারবার বিশ্বকাপে কামব্যাক করছিল, বারবার ছিটকে পড়ার কাছাকাছি যাচ্ছিল। নেদারল্যান্ডসের সাথে জয়ের পর মেসি আর এমি মার্টিনেজের নেদারল্যান্ডসের দেওয়া সকল টিটকারির জবাব, সেসময় লুসাইল স্টেডিয়ামে এক বয়োবৃদ্ধ আর্জেন্টিনা ভক্তের তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কান্না- এসব দেখে যেকোনো রূপকথার গল্প লেখকই ভেবে বসবেন, ঢের হয়েছে। এর চেয়ে বেশি জয়ের স্বাদ কোনো গল্পের নায়ককে দেওয়া যায় না। কিন্তু অপেক্ষা যে করছিল তার চেয়ে দারুণ কোনো পৌরাণিক বীরত্বগাথা। কোচ স্কালোনি বোধহয় কোনো এক নির্বাণ লাভ করেছিলেন পরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সাথে সেমিফাইনাল জয়ের। ৪-৪-২ ফরমেশনে আর্জেন্টিনা দলকে তৈরি করলেন তিনি সেমিফাইনালের জন্য। ক্রোয়েশিয়ার শান্ত কিন্তু মজবুত আক্রমণভাগকে সামলানোর জন্য মাঠে নামালেন সবচেয়ে পরীক্ষিত রক্ষণভাগকে। অ্যাকুনা ছিলেন না সেই ম্যাচে। কিন্তু তার জন্য ভুগতে হয়নি একবারও। একবিংশ শতাব্দীতে আর্জেন্টিনার সবচেয় স্বয়ংসম্পূর্ণ খেলার সাক্ষী হন মানুষ সে রাতে। রীতিমতো বলে-কয়ে জয় তুলে নেয় তারা ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে। এই জয় আর্জেন্টিনার ফাইনাল নিয়ে মোমেন্টাম বদলে দেয়। আর্জেন্টিনাকে সুযোগ করে দেয় এক নতুন সত্যের সামনে দাঁড়ানোর।
২০১৪ সালে মারাকানা স্টেডিয়ামে জার্মানির সাথে ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে মারিও গৎজের গোলে আর্জেন্টিনার পরাজয়ের পর মেসির বিশ্বকাপ ট্রফির দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য কমবেশি আমরা সকলেই দেখেছি। মেসি নিজেই অসংখ্যবার বলেছেন, সেই দুঃসহ স্মৃতি তাকে ঘুমাতে দিত না। অনেকবারই বলেছেন, জীবনে আবার সুযোগ পেলে সে ম্যাচটাই খেলতে চান তিনি। প্রকৃতি সবাইকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয় না। মেসি সে সুযোগ পেয়েছেন। এবার প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স।
ফাইনাল খেলা; ভেন্যু লুসাইল স্টেডিয়াম। লুসাইল ইতোমধ্যেই এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জন্য হোম গ্রাউন্ডে রূপ নিয়েছিল। সে স্টেডিয়ামে ১৮ ডিসেম্বর চললো দুনিয়াসেরা হওয়ার লড়াই। একদিকে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে বারবার হাতছাড়া হওয়া এই কাপের জন্য ৩৬ বছরের আক্ষেপ মেটানোর সুযোগ আর্জেন্টিনার। একদিকে ফুটবল দুনিয়ার নতুন ত্রাস ১৯ বছরে বিশ্বকাপ জিতে নেওয়া এমবাপে, অন্যদিকে ৩৫ বছর বয়সেও পৃথিবীকে নান্দনিক খেলা উপহার দিয়ে চলা মেসি। একদিকে এমি মার্টিনেজের মেসিকে বিশ্বকাপ জেতানোর গুরুদায়িত্ব রক্ষা, অন্যদিকে উগো লরিসের সামনে গোল্ডেন গ্লাভসের হাতছানি। এদিকে এরই মধ্যে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন ডি মারিয়া। সুন্দর লাতিন ফুটবলের প্রতিনিধিত্বকারী আর্জেন্টিনা দলের এক নির্ভীক কমরেড ডি মারিয়া। এই ম্যাচ উত্তাপ ছড়াচ্ছিল; ছড়ানোর কথাই বটে!
ম্যাচ শুরুর আগে মেসির চোখের চাহনিতে বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে মাদকতা দেখল গোটা দুনিয়া। সেই মাদকতাকে ঘিরে লুসাইল স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপের বল গড়ালো শেষবারের মতো। স্কালোনি জানতেন, ফ্রান্সকে ঠেকানো মানে মূলত তাদের গতিকে রোধ করা। তা করার জন্য আবারো হাজির করলেন ৪-৪-২ ফরমেশনকেই। এই ফরমেশনের সুবিধা ছিল এই, ফ্রান্সের অ্যাটাক ঠিক জায়গা করে উঠতে পারছিল না এর মধ্যে। ম্যাক এলিস্টার, ডি পল মাঝমাঠ থেকে আবার রক্ষণভাগেও খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন। ফলস্বরূপ প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা শুরু থেকেই দাপটের সাথে খেলে যাচ্ছিল। ডি মারিয়ার বাম দিক থেকে একের পর এক ক্রস আর ডিবক্সে ঢুকে পড়া ধরাশায়ী করে দিচ্ছিল ফ্রান্সের রক্ষণভাগকে।
এদিকে আলভারেজ একটা দুশ্চিন্তার নাম হয়ে যাওয়াতে ওদিকে মেসিকেও একপেশে মার্ক করা যাচ্ছিল না। ফলস্বরূপ ডি মারিয়াকে আটকাতে গিয়ে ডিবক্সে ফাউল করে বসে ফ্রান্স। পেনাল্টিতে গোল দিয়ে নিজের গোল্ডেন বল পাওয়াটা আরো পাকাপোক্ত করে নেন মেসি। সাথে জোরদার হয় গোল্ডেন বুট পাওয়ার আশাও। তার কিছুক্ষণ পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন ডি মারিয়া। স্বপ্নের মতো এক ফাইনাল যেন ডি মারিয়ার জন্য। নিজের ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করলেন। তাও আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে। অবশ্য এ গোলে কোচ স্কালোনির ভূমিকাও কম ছিল না। ডাগআউট থেকে নিজেই পুরো আক্রমণটা সাজিয়ে দিচ্ছিলেন যেন তিনি। দর্শকমাত্রই মুগ্ধ হয়ে যাবেন এমন এক ম্যাচে আর্জেন্টিনার খেলা দেখে।
এদিকে নেটদুনিয়ায় ঝড় উঠল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত এমবাপের তেমন কোনো মুভমেন্ট চোখেই পড়েনি বলে। প্রথমার্ধ শেষ হলো। দ্বিতীয়ার্ধেও একপেশেভাবে আর্জেন্টিনার পক্ষেই যেন সবকিছু যাচ্ছিল। ম্যাচের যখন আর প্রায় ১০ মিনিটি বাকি, তখন ওটামেন্ডি ডিবক্সে ফাউল করে বসলে পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। দুর্দান্ত এক পেনাল্টি শটে গোলের দেখা পান এমবাপে। এক মিনিটের মধ্যে আরও এক চোখধাঁধানো গোলে এমবাপে ব্যবধান শূন্য করেন দু’দলের। তারপর থেকে ৯০ মিনিট শেষ হওয়া পর্যন্ত দাপট দেখায় ফ্রান্স। ২-২ এ ড্র হওয়ার ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। মেসির গোলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে গেলেও শেষদিকে পেনাল্টি থেকে আবার গোল পেয়ে অতিরিক্ত সময়ের স্কোরকে ৩-৩ এ নিয়ে আসেন এমবাপে। এই পর্বের একদম শেষ মিনিটে মুয়ানির নিশ্চিত গোলের শট ঠেকিয়ে এমি মার্টিনেজ যেন একা হাতে ধরে রাখেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
টাইব্রেকারের প্রথম শট নেন এমবাপে ও মেসি, দুজনের গোলে স্কোর ১-১ হওয়ার পর ব্যবধান গড়ে দেন এমি মার্টিনেজ, কোলম্যানের শট ঠেকিয়ে দিয়ে। ডিবালার গোলে আর্জেন্টিনা ২-১ এগিয়ে যাওয়ার পর গোল মিস করেন ফ্রান্সের চুয়ামেনি। এরপর পারাদেস ও মুয়ানি দুজনই গোল করলে ৩-২ হয় স্কোর। সবশেষে মন্টিয়েল গোল করলে আর্জেন্টিনা এগিয়ে যায় ৪-২ গোলে, জয়সূচক দৌড় আর আনন্দাশ্রুতে শেষ হয় এক মহাপ্রতীক্ষার। এ যেন এক স্বপ্নের মতো ফাইনাল! যেকোনো ফুটবলপ্রেমীর আরাধ্য এমন এক ফাইনাল ম্যাচ দেখা। সমানে সমানে লড়াই। কেউ কাউকে এক বিন্দু ছাড়ও দেয় না। খেলার শুরুতে সমান সমান শক্তি নিয়ে নামা এক দলের প্রায় পুরো ম্যাচ পিছিয়ে পড়েও শেষ মুহূর্তে এগিয়ে যাওয়া, এগিয়ে গিয়েও বারবার স্কোরকার্ডে পিছনে পড়ে যাওয়া, একের পর এক মুহুর্মুহু অ্যাটাক দুই পক্ষ থেকেই- সবকিছু মিলিয়ে এই ফাইনালটা এমন এক ফাইনাল, যার জন্য ফুটবল ভক্তরা অপেক্ষা করে বছরের পর বছর! এমনই এক ম্যাচ, আর এমনই এক ‘শো’, ফুটবল ধারাভাষ্যের কবি পিটার ড্রুরি এই ম্যাচ নিয়ে বলার সময় একই বাক্যে তিন বার লিওনেল মেসিকে ‘গ্রেটেস্ট’ বলতে যেন একরকম বাধ্যই হন, তিনি বলছিলেন,
The greatest player of his age finally has the greatest accolade football can afford him at the end of one of the greatest football matches ever played!
এই বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার হওয়ার পেছনে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন লিওনেল স্কালোনি। স্কালোনি ছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপে মেসির সতীর্থ। তার কাছে আর্জেন্টিনা ফুটবল চিরঋণী হয়ে থাকবে, হয়তো এই মুহূর্তে তার নামে গির্জায় প্রার্থনাও হচ্ছে৷ স্কালোনিই সেই ব্যক্তি, যিনি মেসিকে ২০১৮ সালে অবসর থেকে ফেরান। সেবার একাই আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপে তুলেছিলেন মেসি। টাকার অভাবে ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টাইন ফুটবল বোর্ড বেশি বেতন দিতে পারছিল না বলেই স্কালোনিকে কম বেতনে নিয়োগ দেয় প্রধান কোচ হিসেবে। ২০১৮তে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে বাদ পড়ার পর থেকে তিনি তার ট্যাকটিক্স, ঠান্ডা মাথায় একেকটি এক্সপেরিমেন্ট, নতুন আর অভিজ্ঞদের মধ্যকার রসায়ন গড়ে তোলা- এসব নিয়ে কাজ করে গেছেন। আর্জেন্টিনার গোটা দলটার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা এই ছিল যে, তারা মেসির জন্য জীবন দিতেও প্রস্তত। এমন ক্ষুধার্ত বাঘের দলের মতো করে কেউ একজনের বিশ্বকাপের ক্ষুধা মেটানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে, এধরনের ইতিহাস হয়তো ফুটবলে আর নেই। স্কালোনি সেই বীজমন্ত্র পুঁতে দিয়েছিলেন আলবিসেলেস্তেদের মাথায়। তাই হয়তো আপনি দেখবেন, এই খেলোয়াড়েরা নিজেদের সেরাটা খেলার পরেও নিজেদের প্রাপ্তির দিকে চিন্তা করেন না, চিন্তা করেন মেসিকে কী দিতে পেরেছেন তারা!
আর এর পেছনের নায়ক তাদের অদ্ভুত সুদর্শন কোচ স্কালোনি। যখন ম্যাচ শেষে তিনি কাঁদছিলেন, ততক্ষণে তার ক্যারিয়ারে যোগ হয়ে গেছে কোপা আমেরিকা, ফিনালিসিমা আর বিশ্বকাপের মত বড় বড় প্রাপ্তি। অথচ দেখুন, এই ফাইনাল ম্যাচ পর্যন্ত কোনো ম্যাচের আগেই স্কালোনির ট্যাকটিক্স আর ফরমেশন প্ল্যান নিয়ে কেউ কিছুই আঁচ করতে পারেনি। প্রতি ম্যাচেই নতুন নতুন সব পরিকল্পনা হাজির করেছেন। একবারও ভেঙে পড়েননি সৌদি আরবের সাথে হেরে যাওয়ার পরে। সেদিন ফ্রান্স যখন প্রায় জিতেই যাচ্ছিল ধরনের অবস্থা, তখনো স্কালোনি বদলি করাননি সব খেলোয়াড়কে। স্কালোনি যেন জানতেন, এই খেলা টাইব্রেকারে যাবে। খেলোয়াড় বদলি করালেন অতিরিক্ত সময়ে। গোটা টুর্নামেন্টে উপেক্ষিত রাখা ডিবালাকে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টায় পেনাল্টি শ্যুট নিতে নামালেন। এ যেন ‘দ্য কুলেস্ট ম্যানেজার’! আবার দেখুন, স্কালোনি কিন্তু কোনো ম্যাচ নিয়ে আগে থেকে হাঁকডাকও রাখেননি। কেবলই খেলিয়ে গেছেন, ম্যাচের আগে পরে বড় বড় কথার বুলিতে নয়, শুধু মাঠের খেলা দিয়েই জয়টা বের করে এনেছেন। ডুবু ডুবু তরী নিয়েও শেষমেশ পাড়ি দিয়ে দিয়েছেন মহাসমুদ্র। এই বিশ্বকাপ তাই স্কালোনির বিশ্বকাপ।
একটু পুরানো এক স্মৃতিতে ফিরি। ব্রাইটন আর আর্সেনালের ২০২০ সালের প্রিমিয়ার লীগের ম্যাচে আর্সেনালের জার্মান গোলকিপার বের্ন্ড লেনো আহত হন। লেনো ইনজুরড হওয়াতে কপাল খুলে এমিলিয়ানো ‘দিবু’ মার্টিনেজের। বেঞ্চ থেকে এসে এমি সেবার পারফর্ম করার সুযোগ পেলেন। আর সে সুযোগ তাকে জায়গা করে দিল কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা দলে। কোপায় তিনি স্বপ্নের মতো খেলেছিলেন। বিশ্বকাপের আগে এমি বলে-কয়েই এসেছিলেন, তিনি মেসিকে বিশ্বকাপ জেতাতে চান। সেই এমি মার্টিনেজ যখন অতিরিক্ত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত গোলের শট ঠেকিয়ে দিলেন, তখন তার নাম আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। এমি হয়তোবা এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ১০ জন গোলরক্ষকের তালিকায়ও নেই। কিন্তু তিনি জানতেন, কখন তাকে কী করতে হবে। তিনি জানতেন, কখন বুক পেতে দিতে হবে। একারণেই দিবু অনন্য। একারণেই বলতে দ্বিধা নেই, দিবুই আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে জিতিয়েছেন। পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেন। নিজের মতো পাগলাটে সেলিব্রেশন করা দিবুকে তাই ফুটবল বিশ্ব মনে রাখবে অনেকদিন।
লিওনেল মেসির বয়স এখন ৩৫। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলা। এই বয়সে কোনো খেলোয়াড়ের দলের মূল ভরসা হিসেবে থাকাটা দুর্লভ ঘটনা। লিওনেল মেসি ফুটবলের সেই তারকা, যাকে ঘিরেই বর্তমান ফুটবল বিশ্ব তাদের রক্ষণ কৌশল সাজায়। আজকের দুনিয়ায় এখনও আক্রমণের যোগ্যতার মানদণ্ড হলেন মেসি; মেসিকে কতটুকু আটকানো যায় সেটাই কোনো দলের রক্ষণভাগের মূল যোগ্যতা। তাই তো ঠাট্টাচ্ছলে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আসলেই কি লিওনেল মেসি এ গ্রহের কোনো ফুটবলার? দিনকে দিন নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। বয়সের সাথে যেন বাড়ছে বাঁ পায়ের ধার। অনেকের কাছে এই বিশ্বকাপের পর মেসি তাই সন্দেহাতীতভাবে ‘সর্বকালের সেরা’। তার ক্যারিয়ারে ছিল কয়েকটি অপূর্ণতা, কিন্তু ভাগ্যে যেন ভাগ্যবিধাতা লিখে রেখেছিলেন এই বিশ্বকাপটাই, যাতে ‘ভুলগুলো সব ফুল হয়ে যায়’।
মেসির অবসরে যাওয়ার চেয়ে ফিরে আসার বেশি সমালোচনা ছিল। তিনি তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। মেসির বিশ্বকাপ ছিল না বলে ফুটবল বোদ্ধাদের বড় অংশ তাকে সবার সেরা মানতে নারাজ ছিলেন। মেসি সে জবাব দিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বকাপে মেসির কোনো নকআউট পর্বে গোল ছিল না। মেসি সে গোলটাও দিয়ে দিয়েছেন। মেসির কোনো বিশ্বকাপ জয়ী দলের সাথে বিশ্বকাপে গোল ছিল না। মেসি সে জবাবটাও দিয়ে দিয়েছেন। মেসির সবচেয়ে বেশি ব্যালন ডি’অর, একমাত্র ফুটবলার হিসেবে দুটো বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল, একমাত্র ফুটবলার যিনি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ফিনালিসিমা, কোপা আমেরিকা, বিশ্বকাপ, অলিম্পিকে স্বর্ণ- সবকিছুই জয় করেছেন। মেসিকে আর কোনোদিক থেকে আটকানোর নেই। মেসি যেন তাকে ঘিরে দীর্ঘ ১৬ বছরের সকল সমালোচনার সলিল সমাধি টেনে দিয়েছেন এবার এই ফাইনালে।
এই বিশ্বকাপ জয়ে খুশি গোটা ফুটবল বিশ্ব। অথচ একটা বড় সত্য হলো, এই জয়ের পরও আর্জেন্টিনায় অর্থনৈতিক মন্দা আর দুর্নীতি আরো বাড়তে পারে, আর্জেন্টিনার মানুষের দুঃখের সময় দীর্ঘতর হতে পারে। কিন্তু তাতে তো মেসিদের দোষ দেওয়া চলে না। মেসি তো আর আর্জেন্টিনার নন কেবল। মেসি সকল দেশের, সকল মানুষের। মেসি আর তার আর্জেন্টিনা দল ভালোবাসা পেতে জানে, তারা গোটা পৃথিবীর ভক্তদের এক ছায়ায় এনে বসাতে পারে। সে ভালোবাসার এমনই শক্তি, যে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা বাংলাদেশের নামই শুনেননি সেই আর্জেন্টিনায় এখন বাংলাদেশের ফুটবল ভক্তদের পাগলামোর খবর প্রচার হয়। আর্জেন্টিনার মানুষ বাংলাদেশিদের এখন আমন্ত্রণ জানায়। এমনকি শোনা যাচ্ছে, বুয়েন্স আয়ার্স ঢাকার সাথে নতুন করে কূটনীতিক সম্পর্ক তৈরিতেও আগ্রহী।
ফুটবল একটি রাজনৈতিক খেলা অবশ্যই। তবে একটি বিশ্বকাপ নিয়ে সারা দুনিয়ায় এতটা আনন্দ আর উন্মাদনা দেখে মনে হয়, আমরা যেন দাঁড়িয়ে আছি ফুটবল খেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নির্মাণের শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তগুলোর একটির সামনে। যে মুহূর্ত জন্ম দিয়েছে এক রূপকথার রাতের। যে রাতের পর আকাশি-সাদা পতাকায় ছেয়ে যাওয়া বাংলাদেশ আর আর্জেন্টিনার আকাশ ঠিক একইরকম মনে হয়, মনে হয়, এ আকাশের দিকে তাকালেই মনে পড়বে সেই রূপকথার রাতের স্মৃতি।