বার্সেলোনার হয়ে জেতা ট্রফির বিনিময়ে হলেও আর্জেন্টিনার হয়ে একটি বিশ্বকাপ চান মেসি। পর্তুগালের জন্য ভাঙা পা নিয়েও খেলতে রাজি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা একজন ফুটবলারের আজন্ম লালিত স্বপ্ন। আর সেটা বিশ্বকাপ হলে রোমাঞ্চ আরো বেশি। কিন্তু এমন অনেক খেলোয়াড় আছেন, যারা নিজের মাতৃভূমির ডাক উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছেন অন্য কোনো দেশ। বিশ্বকাপে নামবেন অচেনা দেশের জার্সি গায়েই। চলুন দেখে নেওয়া যাক, আসছে রাশিয়া বিশ্বকাপে কারা কারা নিজ দলের জার্সি উপেক্ষা করে খেলছেন অন্য দেশের পতাকাতলে।
ডিয়েগো কস্তা (স্পেন/ জন্মভূমি– ব্রাজিল)
ব্রাজিলের লাগার্তো নামে ছোট একটি প্রদেশে জন্মানো ডিয়েগো কস্তা রাশিয়া যাচ্ছেন স্পেনের জার্সি গায়ে। ক্লাব ব্রাগাতে ক্যারিয়ার শুরু করা কস্তা এটলেটিকো মাদ্রিদে এসে প্রতিভার ঝলক দেখান। সেই সুবাদে ব্রাজিল জাতীয় দলে ডাক পান ২০১৩ সালে। সেলেকাওদের হয়ে দুটি পর্যন্ত ম্যাচও খেলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কস্তা স্পেনের হয়ে খেলার ইচ্ছা পোষণ করে স্পেনের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। আবেদন মনজুরের ফলস্বরূপ ২০১৪ এর মার্চে স্পেনের জার্সি গায়ে অভিষেক হয়। কিন্তু ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয় সাবেক এই চেলসি ফরোয়ার্ডকে। বাজে ফর্মের পাশাপাশি ব্রাজিলের দর্শকদের অবিরাম দুয়োধ্বনিও শুনতে হয়। যাচ্ছেতা-ই পারফরম্যান্স করে স্পেন ও বাদ পড়ে গ্রুপ পর্ব থেকেই। তবে এবারও রাশিয়া বিশ্বকাপে স্পেন স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছেন ডিয়েগো কস্তা। ব্রাজিলে জন্মানো কস্তা স্পেনের হয়ে খেলতে যাচ্ছেন নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ।
গনজালো হিগুয়াইন (আর্জেন্টিনা/ জন্মভূমি– ফ্রান্স)
ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া গনজালো হিগুয়াইনের বাবা মিগুয়েল হিগুয়াইন আদতে একজন আর্জেন্টাইন। বাবার সুবাদে ২০০৭ সালে আর্জেন্টিনার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন হিগুয়াইন। আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভারপ্লেটের হয়ে ক্যারিয়ারও শুরু করেন। ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনা দুই জাতীয় দল থেকেই ডাক পাওয়া হিগুয়াইন দেশ হিসেবে বেছে নেন আর্জেন্টিনাকে। ২০০৯ সালে আলবিসেলেস্তেদের আকাশী-সাদা জার্সি গায়ে অভিষেক হয় সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ এই ফরোয়ার্ডের। ২০১০ বিশ্বকাপে হ্যাটট্ট্রিক করা এই খেলোয়াড় ছিলেন ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা দলেও। মেসি, আগুয়েরো, দিবালার সঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপেও।
পেপে (পর্তুগাল/ জন্মভূমি– ব্রাজিল)
ব্রাজিলের মাসেইওতে জন্ম পর্তুগিজ ডিফেন্ডার পেপের। ফুটবলের হাতেখড়ি স্থানীয় এক করিন্থিয়ান্সের শাখাতে। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা ব্রাজিলেই। সেই সময় শৈশবের ওই ক্লাবের এক বন্ধুর সাথে পাড়ি জমান পর্তুগালে। মাদেইরার মারতিমো নামে এক বি টিমে নাম লেখান তিনি। সে থেকে পোর্তো হয়ে রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবেও খেলেন। ২০০৬ সালে দুঙ্গা তাকে ব্রাজিল দলে নেওয়ার কথা বললেও শেষপর্যন্ত ব্রাজিলের হয়ে খেলা হয়ে ওঠেনি বর্তমান এই বেসিকতাস ডিফেন্ডারের। পর্তুগালের হয়ে খেলেছেন ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপ। বয়স ৩৫ হয়ে গেলেও ফার্নান্দো সান্তোস ভরসা করেছেন এই বিশ্বকাপেও।
থিয়াগো আলকানতারা (স্পেন/ জন্মভূমি- ব্রাজিল)
ইতালিতে জন্ম নেওয়া থিয়াগোর বাবা-মা দুইজনই ব্রাজিলিয়ান। বাবা ম্যাজিনহো ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। ফুটবলের হাতেখড়ি ব্রাজিলের ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে। ২০০৫ এ ছোট ভাই রাফিনহা সহ যোগ দেন বার্সেলোনার বিখ্যাত একাডেমি লা মাসিয়ায়। সেখানে থাকতেই দুইজনই পান স্পেনের নাগরিকত্ব। নাগরিকত্ব পাওয়ার পরপরই থিয়াগো স্পেনের জার্সি পরার সিদ্ধান্ত নেন। ইউরো অনুর্ধ্ব ২১ দলের হয়ে লা রোজাদের জার্সি গায়ে জড়ান। ছোট ভাই রাফিনহা দেশ হিসেবে সেলেকাওদের বেছে নিলেও, বড় ভাই থিয়াগো বেছে নিয়েছেন স্পেনের জার্সি। স্পেনের হয়ে থিয়াগোর অভিষেক ঘটে ২০১১ সালে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা বর্তমান এই বায়ার্ন মিডফিল্ডার স্পেনের মাঝমাঠের ত্রাতা হয়ে উঠতে পারেন রাশিয়া বিশ্বকাপেও।
রাহিম স্টারলিং (ইংল্যান্ড/ জন্মভূমি– জ্যামাইকা)
জ্যামাইকার কিংস্টোন ওভালে জন্ম হলেও মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সাথে পাড়ি জমান লন্ডনে। ২০০৩ সালে কুইন্স পার্ক রেঞ্জার্সের হয়ে যুব ক্যারিয়ার শুরু করেন স্টারলিং। সেখান থেকে লিভারপুল হয়ে বর্তমানে ম্যানচেস্টার সিটি। তবে জ্যামাইকায় জন্ম নিলেও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন সব বয়স ভিত্তিক দলেই। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে হলে ইংল্যান্ডে কমপক্ষে পাঁচ বছরের পড়াশোনা করতে হবে। ছোটবেলায় লন্ডনে বেড়ে উঠায় রাহিম স্টারলিং এর এ ক্ষেত্রে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। ২০০৯ সালে অনুর্ধ্ব ১৬ দিয়ে শুরু করে ১৭, ১৯, ২১ বছরের বয়সভিত্তিক দলেও খেলেন এই উইঙ্গার। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের সিনিয়র দলে অভিষেক হওয়া স্টারলিং রাশিয়া বিশ্বকাপে থ্রি লায়ন্সের অন্যতম ভরসার প্রতীক।
ইভান রাকিটিচ (ক্রোয়েশিয়া/ জন্মভূমি– সুইজারল্যান্ড)
সুইজারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ইভান রাকিটিচ ক্যারিয়ারও শুরু করেন সুইস ক্লাব বাসেলের হয়ে। সুইজারল্যান্ডের হয়ে বয়সভিত্তিক দলগুলোতেও খেলেন। বাবা-মা ক্রোয়েশিয়ান, বিধায় ক্রোয়েশিয়ার নাগরিকত্ব জন্মসূত্রেই ছিলো ইভানের। ২০০৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার কোচ স্লাভেন বিলিচ তাকে টিমে ডাকলে ক্রোয়েশিয়ার হয়েই খেলার সিদ্ধান্ত নেন সাবেক সেভিয়া মিডফিল্ডার। ওই বছরেই ইউরো কোয়ালিফায়ারে ক্রোটদের হয়ে প্রথমবারের মত মাঠে নামেন তিনি। একে একে ২টি ইউরো এবং একটি বিশ্বকাপ খেলেন। আসছে রাশিয়া বিশ্বকাপে মড্রিচের সাথে ক্রোয়েশিয়ার মাঝ মাঠ সামলানোর গুরু দায়িত্ব বার্সেলোনা এই তারকার কাঁধেই।
স্যামুয়েল উমতিতি (ফ্রান্স/ জন্মভূমি– ক্যামেরুন )
ক্যামেরুন ফেডারেশন আর কিংবদন্তি রজার মিলা অনেক চেষ্টা করেও ক্যামেরুন বয়স ভিত্তিক দলে টানতে পারেননি স্যামুয়েল উমতিতিকে। জন্মস্থান ক্যামেরুনে দু বছর কাটানোর পর উমতিতি চলে আসেন ফ্রান্সে। ফ্রান্সের হয়ে সব বয়স ভিত্তিক দলে খেলার পর অবশেষে ২০১৬ ইউরোতে ব্লুজদের হয়ে অভিষেক ঘটান এই বার্সেলোনা ডিফেন্ডার। দারুন ফর্মে থাকা উমতিতি এবারও আছেন দিদিয়ের দেশমের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। তাতে করে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার স্বাদ নিতে পারবেন উমতিতি। যদিও দেশ ক্যামেরুনের হয়ে নয়, ফ্রান্সের হয়ে।
উইলিয়াম কারভালহো (পর্তুগাল/ জন্মভূমি– অ্যাঙ্গোলা )
অ্যাঙ্গোলার লুয়ান্ডায় জন্ম নেওয়া এই ফুটবলার ২০০৫ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পাড়ি জমান স্পোর্টিং লিসবনের যুব দলে। সেই সুবাধে পর্তুগাল ও অ্যাঙ্গোলা- দুই দেশের হয়েও খেলার সুযোগ পান তিনি। অ্যাঙ্গোলান ফুটবল ফেডারেশনের ডাক উপেক্ষা করে তিনি পর্তুগীজদের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালে পর্তুগালের অনুর্ধ্ব ২১ দলে খেলার সুযোগ পান। আর ২০১৪ বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে সুইডেনের বিপক্ষে মহামূল্যবান দ্বিতীয় লেগে অভিষেক ঘটান কারভালহো। ফার্নান্দো সান্তোসের দলের অপরিহার্য অংশই হয়ে উঠেছেন এই অ্যাঙ্গোলান ফুটবলার।
মাতেও কোভাচিচ (ক্রোয়েশিয়া/ জন্মভূমি– অস্ট্রিয়া)
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ক্রোয়েশিয়ান ক্লাব ডায়নামো জাগরেবের হয়ে মাঠে নামেন বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদ এই মিডফিল্ডার। ডায়নামো জাগরেবে খেলার নিমিত্তে ক্রোয়েশিয়ায়ই থিতু হন। পেয়ে যান ক্রোয়েশিয়ার নাগরিকত্বও। ক্রোটদের হয়ে জার্সি জড়ান বয়স ভিত্তিক খেলাগুলোতে। অবশেষে সার্বিয়ার বিপক্ষে ২০১৩ সালে ডেব্যু ঘটান নিজের। মড্রিচ-রাকিটিচ পরবর্তী যুগে তিনিই হবেন ক্রোট মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো। প্রতিভাবান এই মিডফিল্ডার আছেন ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ দলেও।
রাফায়েল গুরেরো (পর্তুগাল/ জন্মভূমি–ফ্রান্স )
ফ্রান্সে জন্মানো এই লেফট ব্যাক ক্যারিয়ার শুরু করেন লিগ ওয়ানের দল সিয়েন দিয়ে। ক্লাবে খেলার সময় পর্তুগাল কোচ রুই জর্জের কোচিং স্টাফদের চোখে পড়েন তিনি। তাদের কথায় রাজি হয়ে পর্তুগালের নাগরিকত্ব নিয়ে ২০১৩ সালে পর্তুগাল অনুর্ধ্ব ২০ দলের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলেন। ২০১৬ সালে ফার্নান্দো সান্তোস তাকে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ করে দেন। তাই ফ্রান্সকে বাদ দিয়ে পর্তুগালের পক্ষেই খেলা শুরু করেন এই প্রতিভাবান লেফট ব্যাক। ২০১৬ ইউরো ফাইনালে নিজের দেশের বিরুদ্ধে জিতে শিরোপা উল্লাস মাতেন ডর্টমুন্ড ডিফেন্ডার রাফায়েল গুরেরো। রাশিয়া যাত্রায়ও রোনালদো, আন্দ্রে সিলভাদের সঙ্গী হচ্ছেন তিনি।