যুদ্ধে ধ্বংসের বিকল্প কিছু নেই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাবের মধ্য দিয়ে ফুটবলে শক্ত ও জনপ্রিয় অবস্থান তৈরি হয়ে যায় ব্রিটেনের মেয়েদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রবল ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের মধ্যেও ফুটবলে মাথা তুলে দাঁড়ানো মেয়েদের ফুটবল সমূলে বিনষ্ট করা হয় যুদ্ধ পরবর্তী শান্তিময় সময়ে, যা ছিল শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একরোখা ও একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তের বলি হয়েছিল সময়ের দারুণ জনপ্রিয় খেলা ফুটবল, যেখানে পুরুষদের পাশাপাশি ব্রিটেনের মেয়েদের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান ছিল।
নারী ফুটবলের অগ্রদূতদের মধ্যে অন্যতম একজন নেটি জে হানিবল, ১৮৯৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ লেডিস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। পুরুষদের ফুটবল যখন বাতাসের বেগে গোটা ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন পিছিয়ে ছিলো না নারীরাও। ১৯ শতকের শেষের দিকে নিজেদের সংগঠনের মাধ্যমে আয়োজিত ফুটবল ম্যাচ খেলে বেড়াতো নারীরা, যাদের বেশিরভাগ ছিলো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। ইংল্যান্ডের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের নারী দলগুলোর মধ্যে আয়োজিত ম্যাচগুলো বেশিরভাগই ছিলো দাতব্য সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডের জন্য। নারীদের এই খেলাগুলোতে হাজার হাজার দর্শক সমাগম হতো। জনপ্রিয়তার গ্রাফ যখন উর্ধ্বমুখী, তখনই শুরু হয়ে গেলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই ব্রিটেনের পুরুষদের বিশাল একটি অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চলে গিয়েছিল, ঘরে বসে ছিল না মেয়েরাও। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ। পর্যাপ্ত যোগান দিতে মেয়েরা কাজ করতো সমরাস্ত্র কারখানায়। তৎকালীন সময়ে ৭,০০,০০০ নারী যোগ দিয়েছিল বিভিন্ন সমরাস্ত্র কারখানায়, তৈরিকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হতো ব্রিটিশ বাহিনীকে। বিশ্বযুদ্ধের জন্য যুদ্ধ সামগ্রী যোগান দেওয়া সহজ কথা নয়, বিশাল কর্মযজ্ঞের চাপ থেকে নারী কর্মীদের দরকার ছিল একটু স্বস্তি ও শান্তি। বিশ্রামের মুহূর্তে নারীরা তাদের শান্তি খুঁজে নিয়েছিল ফুটবলে, দুপুরের বিরতিতে তারা কারখানার পাশের মাঠেই ফুটবল খেলতো। প্রথমদিকে সামান্য বাধা বিপত্তি আসলেও, পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠে আসতেন খেলা দেখতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো ও মানসিকতা চাঙ্গা রাখা, যা কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। এসব সমরাস্ত্র কারখানাগুলোতে নারী ফুটবল দল গঠিত হতে লাগলো, যারা অন্যান্য কারখানার দলগুলোর সাথে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতো। ভয়ংকর যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্য থেকে শুরু করা নারী ফুটবল এই সময়টাতেই পায় অন্য এক মাত্রা।
লোকোমোটিভ ও ট্রাম নির্মাণকারী ডিক, কার কোম্পানি (Dick, Kerr & Co) যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চাহিদার যোগান দিতে সমরাস্ত্র কারখানায় রূপান্তরিত হয়। এটি ছিলো প্রেস্টন ভিত্তিক কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের নারীরা দারুণ ফুটবল খেলতো। তাদের অসাধারণ প্রতিভা দেখে কারখানার কর্মচারী আলফ্রেড ফ্রাংকল্যান্ড খেলোয়াড়দের নিয়ে যুদ্ধের ভিতরেই নতুন করে দল গঠন করে ফেললেন, যারা ডিক, কার লেডিস নামে বিখ্যাত। কারখানাভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে, এমনকি নারী ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দল ছিল ডিক, কার লেডিদের। যুদ্ধের সময়েও তাদের জনপ্রিয়তা আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো, প্রচুর দর্শক সমাগম হতো নারী দলগুলোর ম্যাচগুলোতে। আরুনডেল কোল্টহার্ড ছিল ডিক কারদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯১৭ সালের বড়দিনে অনুষ্ঠিত খেলায় কোল্টহার্ডকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে ডিক, কার লেডিস। প্রেস্টনের স্টেডিয়ামে এই ম্যাচে প্রায় ১০,০০০ দর্শক উপস্থিত হয়। যুদ্ধকালীন অবস্থা ও সময়ের বিবেচনায় এমন উপস্থিতি প্রমাণ করে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল নারীদের ফুটবল।
ডিক, কার লেডিস ফুটবল দলটি ক্রমেই ব্রিটেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী নারী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে দলটি প্রচুর ম্যাচ খেলে বেড়ায়, যেগুলোর বেশিরভাগ ম্যাচের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাহত সৈনিকদের সহযোগিতার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। প্রায় সব ম্যাচেই জয় পেত শক্তিশালী ডিক, কার লেডিস। ১৯২০ সালে ফ্রান্সের একটি নারী ফুটবল দলের বিপক্ষে ডিক, কার লেডিস দল মুখোমুখি হয়। এই ম্যাচটিকেই বলা হয় নারীদের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও নারী ফুটবলের অগ্রযাত্রা থেমে যায়নি। তখন পুরুষ দলের পাশাপাশি নারীদের ফুটবলের জনপ্রিয়তা কোনো অংশে কম ছিলো না। বলতে গেলে, অনেক ক্ষেত্রে নারীদের ম্যাচেই বেশি দর্শক উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ঠিক এই ব্যাপারটিই হয়তো ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বা এফএ।
১৯২০ সাল নাগাদ, ইংল্যান্ডে প্রায় ১৫০টি নারী ফুটবল দল ছিলো এবং স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসেও নারীদের অনেকগুলো দল ছিলো। এই বছরেই এভারটনের গুডিসন পার্কে ডিক, কার লেডিদের একটি ম্যাচে স্টেডিয়ামের ভিতরে দর্শক সংখ্যা ছিলো প্রায় ৫৩,০০০ এবং ধারণা করা হয় প্রায় ১৪,০০০ মানুষ স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। নারী ফুটবল ইতিহাসের কিংবদন্তি লিলি পারের অভাবনীয় পার্ফরম্যান্সের দরুন দলটি ১৯২১ সালের দিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে। সেই সাথে ইংল্যান্ডে নারী ফুটবলের অবস্থানও দারুণ এবং অপার সম্ভাবনাময় ছিলো। ঠিক এই মুহূর্তেই পরিষ্কার নীল আকাশে নেমে এলো ঘোর অন্ধকার।
অন্ধকার সময়ের কথা শুরু করার পূর্বে, ঐ সময়ে বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধান ও নির্বাচনের অন্যরকম একটি প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কিছু সূত্র মতে, নারীদের ফুটবল ম্যাচের দিনে অনেক অবিবাহিত পুরুষেরা ভিড় করতো শুধুমাত্র তাদের ভবিষ্যৎ স্ত্রী সন্ধানের জন্য। ম্যাচে অংশগ্রহণ করা অবিবাহিত মেয়েদের মধ্য থেকে পছন্দের একজনকে বেছে নিত, এক্ষেত্রে তারা বিবেচনা করতো পাত্রীর ফুটবল খেলার দক্ষতা কতখানি ভালো।
যা-ই হোক, মূল আলোচনায় আসা যাক। নারীদের ফুটবলের জনপ্রিয়তা দেখে ভয় পেয়ে গেলো ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ)। তারা মনে করলো, নারীদের এই জনপ্রিয়তা ফুটবল লিগে দর্শক উপস্থিতি কমিয়ে দিবে। অযৌক্তিক ভয়ের কারণেই তৎকালীন নির্বোধ সংস্থাটি যে সিদ্ধান্তটি নিলো সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিলো সুদূরপ্রসারী এবং বলতে গেলে তা আজও বিদ্যমান। ৫ ডিসেম্বর, ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডের নারী ফুটবলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এফএ। নিষেধাজ্ঞার ফলে এফএ’র অধীনে থাকা কোনো মাঠেই ফুটবল ম্যাচ খেলতে পারতো না নারীদের দলগুলো। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও একমুহূর্তে ধ্বংস হয়ে গেলো নারীদের ফুটবল। আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সংস্থাটি যা জানায় তা নিয়ে ছিলো চূড়ান্ত রকমের লিঙ্গ বৈষম্য ও অযৌক্তিক পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের সবচেয়ে নোংরা বহিঃপ্রকাশ। সংস্থাটি বিবৃতিতে জানিয়েছিল যে, ফুটবল “নারীদের জন্য বেশ অনুপযুক্ত এবং উৎসাহিত করা উচিত নয়”। কিছু অতি উৎসাহী ডাক্তারও সম্মতি দেয় যে, খেলাটি নারীদের শারীরিক দিক বিবেচনায় বিপদজনক। এফএ’র সিদ্ধান্তকে প্লাইমাউথ লেডিস দলের অধিনায়ক অবহিত করেন “সম্পূর্ণ লিঙ্গ বিদ্বেষ” এবং “সময়ের চেয়ে একশো বছর পিছিয়ে থাকা” সংস্থা হিসেবে।
তবুও থেমে থাকতে চায়নি নারীরা, খেলা চালিয়ে গেছে নিজেদের মতো করে। কমপক্ষে চেষ্টা করে গেছে, নারী ফুটবল যেন একেবারে হারিয়ে না যায়। কিন্তু এফএ নিষেধাজ্ঞায় আরও যোগ করেছিলো যে, সংস্থাটির সাথে জড়িত সদস্যরা নারীদের ম্যাচে রেফারি, লাইন্সম্যান বা কোনো রকমের সহযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। অবশেষে এফএ যা চেয়েছিলো, ঠিক তা-ই হলো। ইংল্যান্ড থেকে একরকম হারিয়ে গেলো নারীদের ফুটবল।
এফএ-কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে টিকে থাকার মতো শক্তিশালী একটি দলই ছিলো, তারা হলো ডিক, কার লেডিস। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতির সুবাদে ১৯২২ সালে উত্তর আমেরিকায় পাড়ি জমায় ডিক, কার লেডিরা। এখানেও বাধ সাধে এফএ, তাদের নির্দেশনায় কানাডার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তাদের দলের সাথে নির্ধারিত খেলা বাতিল করে দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যেন নিজেদের চিরচেনা সময় ফিরে পায় দলটি, যেখানে নয়টি পুরুষ দলের মুখোমুখি হয় নারী দলটি। পুরুষ দলগুলোর সাথে ডিক, কার লেডিস দলটির কিছু ফলাফল ছিলো অকল্পনীয়। ৪-৪, ২-২ গোলে দুটি ম্যাচ ড্র হয়, ৫-৪, ৮-৪, ৪-৩ গোলে জয়ী হয় ডিক, কার লেডিস দল এবং একটি ম্যাচে তারা ৫-৭ গোলে পরাজিত হয়। ডিক, কার লেডিস দলটির খেলা দেখতে যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০,০০০ দর্শক সমাগম হয়। তখনও যুক্তরাষ্ট্রের নারী ফুটবল আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যসব নারী দলগুলো অবশ্য ডিক, কার লেডিস দলটির মতো টিকে থাকতে পারেনি, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী দলই হারিয়ে যায়। ডিক, কার লেডিস দলটি ১৯২৬ সালে নাম বদলে হয়ে যায় প্রেস্টন লেডিস ফুটবল ক্লাব এবং তারা টিকে থাকা দলগুলোর সাথে এফএ’র অধীনে না থাকা মাঠে খেলা চালিয়ে যায়। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিষেধাজ্ঞার প্রায় ৫০ বছর বছর পর, ১৯৬৯ সালে ৪৪টি ক্লাব নিয়ে ইংল্যান্ডে গঠিত হয় উইমেন্স ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (WFA)। পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় একসময়ের অসামান্য জনপ্রিয় নারী ফুটবল।
১৯২১ সালের আরোপকৃত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ২০০৮ সালে এফএ দুঃখ প্রকাশ করে। তবে নিষেধাজ্ঞার ৫০ বছরে যতটা ক্ষতি হওয়ার, তা হয়ে গেছে ইংল্যান্ডের নারী ফুটবলে। তাই, তর্ক সাপেক্ষে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। ১৯২১ সালের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কি আজও ভোগাচ্ছে না ইংল্যান্ডের নারী ফুটবল দলকে? ইংল্যান্ডের নারীদের পরে ফুটবল খেলা শুরু করলেও, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার দরুন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্জন করেছে অসামান্য সাফল্য। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নারী ফুটবল জিতেছে ৩টি বিশ্বকাপ ও ৪টি অলিম্পিক স্বর্ণ পদক, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজও ইংল্যান্ডের নারীদের বলার মতো বড় কোনো অর্জন নেই।
ফিচার ইমেজ- donmouth.co.uk