১.
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যানের যেসব রেকর্ড গড়া সম্ভব, তার সিংহভাগ রেকর্ড ক্রিস গেইলের দখলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দৈত্যাকার ব্যাটসম্যান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন। বিশ্বের নানা-প্রান্তে অনুষ্ঠিত ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগে তিনি যেকোনো দলের প্রথম পছন্দ। তার ব্যাটও তার পক্ষে কথা বলেছে।
কিন্তু বয়স যে থেমে থাকেনা। বয়স প্রায় ৪০ ছুঁইছুঁই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে এসে বারবার বিদায় জানানোর চিন্তা করছেন। এমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো ২০১৮ সালে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ৫ম আসরে তিনি রংপুর রাইডার্সের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেখানে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে চেনা গেইলকে দেখা যায়নি। কিন্তু নকআউট পর্বে একাই রংপুরকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন অপরাজিত ১২৬ এবং ১৪৬ রানের ইনিংস খেলে, যার ফলে রংপুরের টিম ম্যানেজমেন্ট তার সাথে আগাম চুক্তি সেরে নেয়। বিপিএলে আগামী আসর খেলার নিশ্চয়তা পেয়ে গেলেও ২০১৮ সালে আইপিএলের নিলামে তাকে প্রথম কয়েক ডাকে কোনো দল দলে ভেড়ায়নি। শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব তাকে দলে নিলেও প্রথম কয়েক ম্যাচে একাদশে রাখেনি। এরপর সুযোগ পেয়েই নিজের স্বভাবসুলভ ব্যাটিং করে জানান দেন, তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি।
আইপিএল শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলেন। সেখানে এক শতক হাঁকানো ছাড়া খুব একটা ছন্দে ছিলেন না। বয়স যে থেমে থেকে নেই, সেটা বোঝানোর জন্যই লিস্ট-এ ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানিয়েছিলেন ২০১৮ সালের ৭ অক্টোবর। জ্যামাইকার হয়ে নিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচেও ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। বয়সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ১১৪ বলে দশটি চার এবং আটটি ছয়ের মারে খেলেছিলেন ১২২ রানের ইনিংস। বিদায়ের সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। লিস্ট-এ ক্রিকেটকে বিদায় জানানোটা অবশ্য একটা আনুষ্ঠানিকতা ছিল। কারণ, তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আসন্ন বিশ্বকাপ যে খেলবেন, আগেই জানান দিয়ে রেখেছিলেন। এত বছর খেলার পর নীরবে বিদায় জানানোর চেয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবেই লিস্ট-এ ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন।
২.
পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী, বিপিএলের সর্বশেষ আসরে রংপুরের সাথে শুরু থেকেই ছিলেন। এইবার আর রানের ফোয়ারা ছোটাতে পারেননি, পুরো আসর জুড়েই ছিলেন নিষ্প্রভ। টি-টোয়েন্টির রাজা বিপিএলের ৬ষ্ঠ আসরে ১২ ম্যাচ খেলে মাত্র একটি অর্ধশত রানের ইনিংস খেলেছেন। ১৮.৪৫ ব্যাটিং গড়ে এবং ১০৬.৮৪ স্ট্রাইক রেটে মোট রান মাত্র ২০৩। বিপিএলে ব্যাট হাতে রান না পেলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ানডে দলে ডাক পান গেইল। বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সময়টা কেমন কাটবে, তা নির্ভর করবে তার ফর্মের উপরও। তাই বিশ্বকাপের প্রস্তুতিটা সেরে নেওয়ার জন্য এই সিরিজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ তার জন্য।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, আসন্ন বিশ্বকাপশেষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন তিনি। ক্রিকেট বিশ্বকে যে এখনও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি আছে, সেটা বুঝানোর জন্যই হয়তো তার বিদায়ের দিনগুলোতে ব্যাট তরবারি হয়ে উঠে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে নিজের ইনিংসের শুরুতে বেশ নড়বড়ে ছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল, তাই নিজের উইকেট হারাননি। প্রতিপক্ষের অন্যতম সেরা ফিল্ডার জেসন রয়ও এদিন তার ক্যাচ তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হন। শুরুতে নড়বড়ে থাকলেও উইকেটে সেট হওয়ার পর ইংলিশ বোলারদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে তিনটি চার এবং ১২টি ছয়ের মারে ১২৯ বলে ১৩৫ রানের ইনিংস খেলেছেন।
৩.
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপের পূর্বপ্রস্তুতিটা ভালোভাবেই সেরে নেন ক্রিস গেইল। প্রথম ওয়ানডেতে ১৩৫ রানের ইনিংস খেলার পর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে একটি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ৫০ রানের ইনিংস খেলেছেন। সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও ক্রিস গেইলের ছন্দ বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি। সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের দেওয়া ৪১৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ক্রিস গেইলের ঝড়ো ব্যাটিংয়েই এক পর্যায়ে মনে হয়েছিলো, সহজেই জিতে যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩৪.১ ওভারে দলীয় ২৯৫ রানের মাথায় পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসাবে যখন সাজঘরে ফেরেন, তখন তার সংগ্রহ ছিল ৯৭ বলে ১৬২ রান। ১১টি চার এবং ১৪টি ছয়ের সাহায্যে তিনি এই ইনিংস খেলে দলকে জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আদিল রশিদের এক ওভারেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের সম্ভাবনা উড়ে যায়।
সিরিজ শুরুর আগে অবসরের ঘোষণা দিয়ে রাখা ক্রিস গেইল পুরো সিরিজ জুড়ে দুর্দান্ত ব্যাটিং করছেন। তিন ইনিংস ব্যাট করে ১১৫.৬৬ ব্যাটিং গড়ে ৩৪৭ রান সংগ্রহ করেছেন; এর মধ্যে চারের সংখ্যা ১৫টি হলেও ছয়ের সংখ্যা ঠিক এর দ্বিগুণ, ৩০টি।
ওয়ানডেতে শেষ চার ইনিংসে দু’টি অর্ধশতক এবং দু’টি শতক হাঁকানো গেইল চতুর্থ ম্যাচ শেষে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন, বিশ্বকাপের পর নিজের অবসরের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন। চল্লিশ ছুঁইছুঁই ক্রিস গেইলের শরীর আর কতদিন তার সঙ্গ দেয়, তার উপরই নির্ভর করছে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
৪.
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ইনিংসে ক্রিস গেইল অর্জন করেছেন বেশ কিছু রেকর্ড। প্রথম ওয়ানডেতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ছয় হাঁকানোর নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি। চতুর্থ ওয়ানডেতে এসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫০০ ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ড গড়েছেন। এছাড়া ওয়ানডেতে দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসাবে তিনশো’ ছয় হাঁকানোর কীর্তি গড়েছেন ছক্কার রাজা। এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ছয় হাঁকানোর রেকর্ডটিও নতুন করে গড়েছেন তিনি।
চতুর্থ ওয়ানডেতে ১৬২ রানের ইনিংস খেলার পথে দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওয়ানডেতে ব্রায়ান লারার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১৪তম ব্যাটসম্যান হিসাবে দশ হাজার রানের ক্লাবে যোগদান করেছেন ক্রিস গেইল।
সিরিজ শুরু হওয়ার আগে ক্রিস গেইল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৭৬টি ছয় হাঁকিয়ে সর্বোচ্চ ছয় হাঁকানো ব্যাটসম্যানদের তালিকায় শহীদ আফ্রিদির সাথে যৌথভাবে শীর্ষে ছিলেন। প্রথম ওয়ানডেতে নিজের ১২টি বিশাল ছয়ের মধ্যে প্রথম ছয় হাঁকিয়ে এককভাবে শীর্ষে উঠে আসেন। তিন ইনিংস শেষে নিজেকে নিয়ে যান সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ছয়ের সংখ্যা ৫০৬টি। এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন, এমন ক্রিকেটারদের মধ্যে ছয়ের দিক দিয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মহেন্দ্র সিং ধোনি। তার ছয়ের সংখ্যা ৩৫২টি। দুইজনেই ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে আছেন। তাই ধোনির পক্ষে তাকে টপকানো সম্ভব যে নয়, সেটা নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়। এক্ষেত্রে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ৩৪৯টি ছয় হাঁকানো রোহিত শর্মা।
ক্রিস গেইল টি-টোয়েন্টিতে ১০৩টি, টেস্টে ৯৮টি এবং ওয়ানডেতে ৩০৫টি ছয় হাঁকিয়েছেন। ওয়ানডেতে তার চেয়ে বেশি ছয় হাঁকিয়েছেন শুধুমাত্র আফ্রিদি, তার ছয়ের সংখ্যা ৩৫১টি। সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বল সীমানা ছাড়া করছেন, তাতে করে এই রেকর্ডটিও নিজের দখলে আনতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না ক্রিস গেইলের।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ছয় হাঁকানো পাঁচ ব্যাটসম্যান:
-
ক্রিস গেইল – ৫০৬টি
-
শহীদ আফ্রিদি – ৪৭৬টি
-
ব্রেন্ডন ম্যাককালাম – ৩৯৮টি
-
মহেন্দ্র সিং ধোনি – ৩৫২টি
-
সনাৎ জয়াসুরিয়া – ৩৫২টি
ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ছয় হাঁকানো পাঁচ ব্যাটসম্যান:
-
শহীদ আফ্রিদি – ৩৫১টি
-
ক্রিস গেইল- ৩০৫টি
-
সনাৎ জয়াসুরিয়া – ২৭০টি
-
মহেন্দ্র সিং ধোনি – ২২২টি
-
রোহিত শর্মা – ২১৫টি
৫.
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হওয়ার আগে ক্রিস গেইলের ওয়ানডেতে রান ছিল ৯,৭২৭। তিন ইনিংসে ৩৪৭ রান সংগ্রহ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১৪তম ক্রিকেটার হিসাবে দশ হাজার রানের ক্লাবে যোগ দিলেন ক্রিস গেইল। তিনি এখন পর্যন্ত ২৮৮ ম্যাচে ২৫টি শতক এবং ৫০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৮.০১ ব্যাটিং গড়ে ১০,০৭৪ রান করেছেন। সবচেয়ে বেশি বছর বয়সে তিনি দশ হাজার রান পূর্ণ করলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চতুর্থ ওয়ানডে খেলার সময় তার বয়স ছিল ৩৯ বছর ১৫৯ দিন।
শুধুমাত্র সবচেয়ে বেশি বয়সে নন, দশ হাজার রান তুলতেও সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে তার। ১৯৯৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটা এই ব্যাটসম্যান ১৯ বছর ১৬৯ দিন পর দশ হাজার রান পূর্ণ করলেন। এর আগে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে এই তালিকায় যোগ দিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার তিলকারত্নে দিলশানের। তিনি অভিষেকের ১৫ বছর ২২৭ দিন পর দশ হাজার রান করেছিলেন।
দশ হাজার রান করতে অন্যান্যদের চেয়ে বেশি সময় নিলেও ইনিংসের দিক দিয়ে ক্রিস গেইল ৮ম দ্রুততম ব্যাটসম্যান। তিনি ২৮২ ইনিংসে দশ হাজার রান করেছেন। সবচেয়ে কম ইনিংসে এই ক্লাবে যোগ দেওয়া ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি। ২০৫ ইনিংসেই তিনি মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি ৩৩৩ ইনিংসে এই মাইলফলক স্পর্শ করেছেন শ্রীলঙ্কার মাহেলা জয়াবর্ধনে।
ক্রিস গেইলের সময় বেশি লাগার কারণটা কারোরই অজানা নয়। চুক্তি নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সাথে অনেক সিনিয়র ক্রিকেটারেরই ঝামেলা ছিল। ২০০৯ সালে যখন একসাথে সব সিনিয়র ক্রিকেট চুক্তি নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো, তখন তাদের মধ্যে ছিলেন ক্রিস গেইল। তাই তার অভিষেকের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪১৬টি ওয়ানডে ম্যাচ খেললেও ক্রিস গেইল খেলেছেন মাত্র ২৮৮টি। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে আবারও ছন্দ ফিরে পাওয়া ক্রিস গেইলের ব্যাট হাসলে বিশ্বকাপে হাসবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখ। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় ধরে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে আসা গেইল বিশ্বকাপে ছন্দে থাকলে হয়তো নিজের অবসরের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে পারেন। পরিসংখ্যানও তাই বলে, শেষের শুরুতে আবারও নতুন করে শুরু করেন তিনি।
(সকল পরিসংখ্যান ২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল পর্যন্ত)