৪৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রথমবারের মতো গ্রীসে আক্রমণ চালায় তৎকালীন প্রতাপশালী পারস্য সাম্রাজ্য। সম্রাট প্রথম দারিয়ুসের এই অভিযান ম্যারাথনের যুদ্ধের পর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দশ বছর পর তার ছেলে, প্রথম জার্সেস সেই কলঙ্ক মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হন। বৃহৎ এক সেনাদল নিয়ে রওনা হন গ্রীসের দিকে। পারস্যের অনুগত রাজ্যগুলোও শামিল হয় তার সাথে, যাদের অন্যতম হেলিকার্নেসাস।
হেলিকার্নেসাসের রানী
প্রাচীন কারিয়া অঞ্চলের রাজধানী গ্রীক নগর-রাষ্ট্র হেলিকার্নেসাস, বর্তমান তুরস্কের বোডরেম। জার্সেসের সময় তাদের রানী ছিলেন আর্টেমিসিয়া, যার শাসনাধীন কজ, ক্যালিমনোস আর নিসুরাস দ্বীপও। পারস্যের দ্বিতীয় গ্রীক অভিযানে তার ভূমিকা বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের গ্রন্থ দ্য হিস্টোরিজে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হেরোডোটাসের জন্মও হেলিকার্নেসাসে।
ঠিক কবে আর্টেমিসিয়ার জন্ম সেটা বিতর্কের বিষয়। মনে করা হয়, ৫২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে হেলিকার্নেসাসেই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তখন পারস্যের সিংহাসনে প্রথম দারিয়ুস, পুরো কারিয়া তার করদ রাজ্য। বলা হয়, তার পিতা হেলিকার্নেসাসের রাজবংশের সদস্য লাইগাডিমিস, মা ক্রিট দ্বীপের অধিবাসী।
৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হেলিকার্নেসাসের তৎকালীন রাজাকে বিয়ে করেন আর্টেমিসিয়া। এর ঠিক পর পরই আরম্ভ হয় আয়োনিয়ান বিদ্রোহ, যখন সেই অঞ্চলের গ্রীক রাজ্যগুলো বিদ্রোহ করে বসে পারস্যের বিরুদ্ধে। তাদের প্রতি সহায়তার অভিযোগে গ্রীসের সাথে টানাপোড়েন শুরু হয় তৎকালীন পরাশক্তি পারস্যের।
ওদিকে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় স্বামীর মৃত্যু হলে নাবালক সন্তান পিসিন্ডেলিসের (Pisindelis) পক্ষে রাজক্ষমতা চালাতে থাকেন আর্টেমিসিয়া। জার্সেস যখন গ্রীসের বিরুদ্ধে সেনা সমাবেশ করেন, অধিভুক্ত রাজ্যগুলোর শাসকদের নির্দেশ দেন লোক যোগান দিতে। আর্টেমিসিয়া নিজের ছয়টিসহ মোট ৭০টি জাহাজ সরবরাহ করেন। জার্সেসের বাহিনীর একমাত্র নারী সেনাপতি ছিলেন তিনিই। বলা হয়, হেলিকার্নেসাসের নৌবহর ফিনিশিয়ানদের পরই সবচেয়ে মজবুত আর দৃষ্টিনন্দন ছিল।
আর্টেমিসিয়াম
গ্রীসের ইউবোয়া অঞ্চলের (Euboea) উত্তর উপকূলে আর্টেমিসিয়ামে ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পারস্য আর গ্রীসের নৌবাহিনী প্রথম মুখোমুখি হয়। একই সময় স্থলপথে জার্সেসের সাথে সম্মিলিত গ্রীক বাহিনীর লড়াই চলছিল থার্মোপাইলির গিরিপথে। তিন দিন ধরে গ্রীক জাহাজ সংখ্যার স্বল্পতা সত্ত্বেও সমানে সমানে লড়ে যায় পারস্যের বিরুদ্ধে। তবে থার্মোপাইলির পরাজয়ের খবর এসে পৌঁছলে পিছিয়ে যায় তারা। আর্টেমিসিয়া নিজেও সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিলেন, এবং হেরোডোটাসের দাবি আর্টেমিশিয়ামের পর তার মাথার ওপর তৎকালীন মুদ্রায় প্রায় ১০,০০০ দ্রাখমা পুরষ্কার ঘোষণা করে এথেন্স।
থার্মোপাইলির পর জার্সেসের সেনারা স্রোতের মতো ঢুকে পড়ে গ্রীসে। এথেন্সের সেনা কমান্ডার থেমিস্টোক্লেস দ্রুত শহর খালি করে অধিবাসীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলেন। গ্রীক নৌবহর আশ্রয় নেয় সালামিস দ্বীপ আর পিরেউস বন্দর নগরীর মধ্যবর্তী সংকীর্ণ সালামিস প্রণালীতে। তিনি খোলা সাগরে জড়ো হওয়া পারস্যের ৮০০ জাহাজের মোকাবেলা করতে একেই উপযুক্ত মনে করলেন, কারণ অল্প জায়গায় একত্রে বেশি রণতরী জড়ো করা সম্ভব হতো না শত্রুর পক্ষে। তদুপরি, তাদের বিশালাকৃতি জাহাজের সালামিসের প্রণালীতে নড়াচড়ার সুযোগ সীমিত, যেদিক থেকে ছোট আকারের গ্রীক রণতরী এগিয়ে আছে।
সালামিস
জার্সেসের সেনারা এথেন্স পুড়িয়ে দেয়। সালামিসে গ্রীক নৌবহরের সাথে সংঘাতে না জড়ালেও চলে তার, তবে তাদের ধ্বংস করে দিলে একদিক থেকে নিশ্চিন্ত। তাই তিনি সেনানায়ক মার্ডোনিয়াসকে পাঠালেন এই ব্যাপারে নৌ-সেনাপতিদের মতামত নিতে। সকলেই জার্সেসের শৌর্যবীর্যের গুণগান গেয়ে সালামিসে গ্রীকদের চোখের পলকে পিষে ফেলা যাবে বলে মত দিলেন। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন আর্টেমিসিয়া। তিনি জার্সেসকে অনুরোধ করলেন এই ঝুঁকি না নিতে।
হেরোডোটাসের লেখায় জানা যায়, আর্টেমিসিয়া পারস্য সম্রাটকে জানান- জাহাজ কম হলেও নৌযুদ্ধের দক্ষতায় গ্রীকরা তার লোকদের থেকে অনেক এগিয়ে। তাছাড়া সালামিসে তাদের নৌবহর কৌশলগতভাবে প্রতিকূল অবস্থায় থাকবে। সেই মুহুর্তে নৌ-যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন, “আপনি এথেন্সকে পদানত করতে চেয়েছিলেন, করেছেন! সমগ্র গ্রীস আপনার সামনে উন্মুক্ত। এখন তাদের নৌবহরের সাথে অযথা শক্তিক্ষয়ের মানে হয় না।”
জার্সেসের অন্য কমান্ডাররা মনে করছিলেন আর্টেমিসিয়াকে তার স্পষ্টবাদিতার জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু জার্সেস উল্টো খুশি হলেন, কারণ আর্টেমিসিয়া স্রোতের বিপরীতে গিয়ে যুক্তিসঙ্গতভাবে নিজের মতামত তুলে ধরেছিলেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে তিনি যুদ্ধের আদেশ দেন।
সালামিসের লড়াই পারস্য নৌবহরের জন্য ছিলো মহা বিপর্যয়। তবে আর্টেমিসিয়া যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দেন বলে গ্রীক ঐতিহাসিক পসেনিয়াস বর্ণনা করেন। স্বয়ং সম্রাটের ভাই এবং নৌবহরের সর্বাধিনায়ক আরিয়ামেনেসের মৃতদেহ সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে তিনিই।
লড়াইয়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে, যখন পরাজয় সুস্পষ্ট, তখন আর্টেমিসিয়ার পশ্চাদপসরণ নিয়ে এক মুখরোচক গল্প বলে গেছেন হেরোডোটাস। গ্রীক একটি রণতরী তাকে তাড়া করেছিল। চারদিক থেকে বেষ্টিত হয়ে যাচ্ছেন দেখে আর্টেমিসিয়া সোজা জাহাজ চালিয়ে দেন তার মিত্র এক রণতরীর মাঝ বরাবর। জার্সেসের অধীনস্থ ক্যালিন্ডিয়ানদের রাজা ডামাসিথাইমোস (Damasithymos) পরিচালনা করছিলেন সেই জাহাজ। তার সাথে আর্টেমিসিয়ার বিবাদ ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন।
আর্টেমিসিয়ার আঘাতে দু’টুকরো হয়ে যায় ডামাসিথাইমোসের জাহাজ, সলিল সমাধি ঘটে রাজা ও তার সমস্ত নাবিকের।এদিকে আর্টেমিসিয়ার কাণ্ডে দ্বিধায় পড়ে যায় জাহাজ। তিনি শত্রুজাহাজ ডুবিয়ে দেয়ায় তারা একে মিত্রজাহাজ ধরে নেয়। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যার মাথার ওপর এথেন্স দাম ঘোষণা করেছেন, সেই আর্টেমিসিয়া স্বয়ং পরিচালনা করছেন এই রণতরী।
বহুদূর থেকে যুদ্ধ দেখছিলেন জার্সেস ও তার উপদেষ্টারা। আর্টেমিসিয়া যে নিজেদের জাহাজই ধ্বংস করে দিয়েছে, সেখান থেকে বোঝার উপায় ছিল না, তবে পতাকা দেখে তার জাহাজ চিনতে পারলেন তারা। তার এক উপদেষ্টা জার্সেসের দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করেন, তারা মনে করলেন আর্টেমিসিয়া বিপুল বিক্রমে শত্রুদের আঘাত করেছেন। জার্সেস নাকি আক্ষেপ করে উঠেছিলেন, “হায়, আমার অধীনস্থ পুরুষেরা লড়াই করছে নারীদের মতো, আর নারী পুরুষের মতো।” হেরোডোটাসের এই গল্প কতটুকু সত্য সেটা তর্কসাপেক্ষ। পসেনিয়াস দাবি করেন, আর্টেমিসিয়া গ্রীক আর পারস্য দুই দেশের পতাকাই জাহাজে রাখতেন। পরাজয় বুঝে তিনি নাকি গ্রীক পতাকা লাগিয়ে নিরাপদে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন।
গ্রীস ত্যাগ
সালামিসের পরাজয়ের পরেও কিন্তু গ্রীকদের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। পারস্যের নৌবহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে ব্যর্থ হয় গ্রীকরা। তদুপরি জার্সেসের সুবিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি তারা।
তবে জার্সেস শান্তিতে ছিলেন না। হেলেস্পন্ট (বর্তমান দার্দানেলি) প্রণালী দিয়ে এশিয়া মাইনর থেকে ইউরোপে পা রেখেছেন তিনি, সেজন্য সাগরের ওপর তৈরি করা হয়েছে ভাসমান সেতু। তিনি ভয় পেলেন সালামিসের বিজয়ের পর গ্রীক নৌবহর যদি সেতু ধ্বংস করে দেয় তাহলে বাড়ি ফিরবার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই তিনি মতামত চাইলেন মার্ডোনিয়াসের। জেনারেল তাকে পরামর্শ দিলেন সরাসরি পেলোপন্নেসের অঞ্চলে বড় আকারে হামলা করতে। অন্য উপদেষ্টারাও তাকে সমর্থন করলেন। মার্ডোনিয়াস রাজার দ্বিধা বুঝতে পেরে অনুরোধ করলেন সেক্ষেত্রে তাকে লাখখানেক সেনা দিয়ে যেতে, তিনি রাজার হয়ে গ্রীকদের বশীভূত করবেন।
এই পরিস্থিতিতে দরবারে হাজির হলেন আর্টেমিসিয়া। সালামিসের ব্যাপারে তার পূর্বানুমান স্মরণে রেখে জার্সেস তার মত জানতে চান। হেলিকার্নেসাসের রানী রাজাকে অনুরোধ করলেন মার্ডোনিয়াসের দ্বিতীয় প্রস্তাব মেনে নিতে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন যদি মার্ডোনিয়াস সফল হন, তবে প্রভু হিসেবে কৃতিত্ব তো পাবেন জার্সেসই। আর যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাতেও ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, কারণ গ্রীকরা জার্সেসের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। আর রাজার এক দাসানুদাসের বিরুদ্ধে জয় তেমন বড় করে দেখার কিছু নেইও। উল্টো জার্সেস আরো শক্তিশালী হয়ে পরে ফিরে আসবেন।
হেরোডোটাস উল্লেখ করেছেন, এবার জার্সেস আর্টেমিশিয়ার কথা মেনে নেন, কারণ তিনি নিজেও চাচ্ছিলেন বাড়ি ফিরে যেতে। তিনি আর্টেমিসিয়াকে দায়িত্ব দেন তার সঙ্গে আসা রাজপুত্র আর রাজকন্যাদের নিরাপদে এফেসাসে সরিয়ে নিতে। এক বছর পর প্লাটেয়ার লড়াইতে মার্ডোনিয়াস নিহত হন, বিধ্বস্ত হয় পারস্যের সেনাদল। সম্ভবত একই দিনে মাইকালির যুদ্ধে শেষ হয়ে যায় তার রেখে আসা নৌবহর। জার্সেসের গ্রীস দখলের স্বপ্নের সমাধি হয় সেখানেই।
অন্যান্য সূত্রে আর্টেমিসিয়া
হেরোডোটাস আর পসেনিয়াস ছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রাচীন ইতিহাসবিদের বর্ণনায় আর্টেমিসিয়ার উল্লেখ আছে। পঞ্চম শতকের গ্রীক চিকিৎসক থেসালাস তাকে কাপুরুষ এক জলদস্যু বলে গালমন্দ করলেও নাট্যকার অ্যারিস্টোফেনেস (Aristophanes) নাটকে যোদ্ধা রানী হিসেবে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পসেনিয়াস, পলিনিয়াস, প্লুটার্কের লেখায় এবং বাইজান্টিয়ান আমলে ভূমধ্যসাগরীয় বিষয়ক এনসাইক্লোপিডিয়া সুদা’তে (Suda) আর্টেমিসিয়াকে তুলে ধরা হয়েছে কুশলী সেনানায়ক হিসেবে।
আর্টেমিসিয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে প্রথম পিসিন্ডেলিস নামে রাজত্ব করেন। তবে ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পর আর্টেমিসিয়ার কী হয়েছিল, বা ঠিক কীভাবে তিনি মারা যান সেটা অজানাই থেকে গেছে। কন্সটান্টিনোপোলের এক ধর্মযাজক ফোটিয়াস এই ব্যাপারে একটি লোককথার প্রসঙ্গ টেনেছেন, যেখানে বলা হয়- পরবর্তীতে আবিদোসের এক তরুণের প্রেমে পড়েন আর্টেমিসিয়া। তবে সেই তরুণের থেকে সাড়া না পেয়ে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। এটা খুব সম্ভব কল্পকাহিনী।
পসেনিয়াসের লেখা থেকে জানা যায়- স্পার্টার বাজারের পার্সিয়ান হল নামে এক স্থানে তিনি আর্টেমিসিয়ার সম্মানে তৈরি মূর্তি দেখেছেন। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক চার্লস থমাস নিউটন ১৮৫৭ সালে হেলিকার্নেসাসের রাজকীয় সমাধি খননে গিয়ে সেখানে পেয়েছেন জার্সেসের সিল দেয়া পাত্র। মনে করা হয়, আর্টেমিসিয়াকে তা উপহার দেন স্বয়ং রাজা। কাজেই গ্রীক ও পারস্য দুই দেশের ইতিহাসের কিছুটা অংশ আর্টেমিসিয়ার জন্য বরাদ্দ আছে তা বলাই যায়।