১৮৯২ সাল। টেনেসি রাজ্যের মেমফিস শহরে কৃষ্ণাঙ্গ-পরিচালিত সংবাদপত্র ‘মেমফিস ফ্রি স্পিচ’-এর প্রধান সম্পাদক এবং সহ-মালিক হয়েছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক আইডা বি. ওয়েলস। সংবাদপত্রের প্রমোশন করার সফর শেষে শহরে ফিরে আসার পর শুনতে পান একদল শ্বেতাঙ্গ তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির সাথে এক শ্বেতাঙ্গের দ্বন্দ্ব থেকে।
আইডা এরপর কৃষ্ণাঙ্গদের লিঞ্চিং (একদল লোক কোনো বিচার ছাড়াই কোনো অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে, সাধারণত ফাঁসির মাধ্যমে করা হয়) করার ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে থাকেন। তিনি এমন পদ্ধতিতে তার অনুসন্ধান চালাতে থাকেন, যেটি এখন পরিচিত ডেটা সাংবাদিকতা হিসেবে।
লিঞ্চিং হয়েছে এমন জায়গায় সশরীরে যান তিনি, সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার নেন, এছাড়াও অন্যান্য সংবাদপত্র থেকেও লিঞ্চিং সম্পর্কিত তথ্য বের করতে থাকেন তিনি। এরপর তার পত্রিকা ‘ফ্রি স্পিচ’-এ একাধারে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
তার গবেষণা থেকে বের হওয়া ডেটা থেকে বের হয়ে আসা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা বেশ কয়েকটি সম্পাদকীয় এবং প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর লিঞ্চিংয়ের সাথে জড়িতরা তাকে হুমকি দেয়- তিনি যদি শহরে ফিরে আসেন তাকেও লিঞ্চ করা হবে। এক শ্বেতাঙ্গ মব এরপর ফ্রি স্পিচের অফিস ধ্বংস করে দেয়, হারিয়ে যায় পত্রিকার সমস্ত রেকর্ড। আইডা তখন নিউ ইয়র্কে ছুটি কাটাচ্ছিলেন, হুমকির পর তিনি আর কখনো মেমফিসে ফিরে যাননি, চাকরি নেন নিউ ইয়র্ক এজে।
আইডা কখনো এক্সেল ব্যবহার করেননি, ব্যবহার করেননি আর্কজিআইএসের মতো ম্যাপিং সফটওয়্যার কিংবা অ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটরের মতো গ্রাফিক্স সফটওয়্যারও। তবে তিনি ডেটা সাংবাদিকতার মূল একটি জিনিস বুঝতে পেরেছিলেন: সংখ্যা গণনা। আইডার প্রতিবেদনে তার গ্রাউন্ড-রিপোর্টিংয়ের সাথে যোগ হওয়া ডেটা বিশ্লেষণ তার প্রতিবেদনকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়।
সেন্টার ফর ডকুমেন্টারি স্টাডিজের এক মিনি-ডকুমেন্টারিতে আইডা বি. ওয়েলসের জীবন তুলে ধরা হয়েছে, দেখানো হয়েছে তার কাজকে, যাকে আমরা এখন চিনি ডেটা সাংবাদিকতা হিসেবে। ডেটা সাংবাদিকতা হলো জটিল সব স্টোরিকে আরও স্পষ্টভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরা; শব্দ বা বক্তব্য ছাড়াই। ডেটা নিউজস্টোরিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে, নির্ভরযোগ্যতা বাড়ায়। বর্তমানে ডেটাবেজ, ছবি, ভিজ্যুয়ালাইজেশন, ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠকের কাছে আরও গভীরভাবে কোনো বিষয় তুলে ধরা সম্ভব।
ডেটা সাংবাদিকতার ধরন
কোন বিষয়টিকে ডেটা সাংবাদিকতা বলা হবে, আর কোনটিকে বলা হবে না তা নিয়ে বেশ মতভেদ রয়েছে। অনেকেই কেবল সারফেস অংশ থেকে পাওয়া ডেটা থেকেই পাওয়া স্টোরি আইডিয়াকেই ডেটা সাংবাদিকতা বলেন। অনেকে কেবল ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনকেও ডেটা সাংবাদিকতা বলে থাকেন। অনেকে আবার এক ধাপ এগিয়ে ভিআর বা ড্রোন ব্যবহার করে করা সাংবাদিকতাকেও ডেটা সাংবাদিকতা বলেন।
ওয়াল্টার ক্রংকাইট স্কুল অফ জার্নালিজমের নাইট চেয়ার সারাহ কোহেন তার ‘Ways of Doing Data Journalism’ আর্টিকেলে ডেটা সাংবাদিকতাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।
এম্পিরিকাল জার্নালিজম
১৯৬০-এর দশকে ফিলিপ মেয়ের ‘প্রিসিশন জার্নালিজম’ বলে একধরনের সাংবাদিকতা শুরু করেন যেখানে নিউজ স্টোরি তুলে ধরার জন্য সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হতো। ডেট্রয়েট শহরে দাঙ্গাকারীদের ওপর জরিপ থেকে শুরু করে ফিলাডেলফিয়ার আদালতের রায়ের ডেটা বিশ্লেষণ করে সেখানে বর্ণবাদজনিত পক্ষপাত আছে কিনা তা বের করেন তিনি। ১৯৯০ সালে এলিয়ট জ্যাসপিনের হাত ধরে আরেক ধরনের সাংবাদিকতার উদ্ভব হয়: কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড জার্নালিজম। এ ধরনের সাংবাদিকতায় কোনো নিউজ স্টোরির আইডিয়া বের করার জন্য কিংবা তদন্তের একেবারে প্রাথমিক তদন্ত করার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করা হতো, যেগুলোর মূল ডেটা থাকতো ইলেকট্রনিক ফর্মে।
রয়টার্সের সাংবাদিক মরিস টামান এই দুই ধরনের সাংবাদিকতাকে একত্র করে আরেক ধরনের সাংবাদিকতার সূত্রপাত ঘটান, যার নাম দেন ‘এম্পিরিকাল জার্নালিজম’। এম্পিরিকাল জার্নালিজমের ক্ষেত্রে সাংবাদিককে কম্পিউটার ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান, ডেটা এবং অন্যান্য প্রমাণ ব্যবহার করে কোনো নিউজ স্টোরির ভিত্তি সাজান। একেও একধরনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলা যায়, যেখানে সাংবাদিককে নিজেকে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে সংবাদ হতে পারে এমন তথ্য খুঁজে বের করতে হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০১৬ সালে ‘জনগণের স্বার্থে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকাশ’ করা পুলিৎজারজয়ী সংবাদ সংস্থা প্রোপাবলিকার একটি প্রতিবেদন: ‘Dollar For Docs’। ২০১০ সাল থেকে তদন্ত করার পর প্রোপাবলিকা একটি ডেটাবেজ তৈরি করে, যেখানে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সাথে ডাক্তার/হাসপাতালের আর্থিক লেনদেন তুলে ধরা হয়। তারা আবিষ্কার করে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারণাসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে ডাক্তার এবং অন্যান্য মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোকে গোপনে কয়েক বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যেগুলোর তথ্য জনসাধারণের কাছে উন্মুক্ত নয়।
ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি করা তাদের ডেটাবেজে বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার অর্থ নেওয়া ১০ লক্ষ ডাক্তারের হিসাব রয়েছে। এই ডেটার ওপর ভিত্তি করেই তারা যুক্তরাষ্ট্রে মেডিক্যাল গবেষণা ও চিকিৎসার ওপর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর প্রভাব সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই মার্কিন সরকার ‘ফিজিশিয়ান পেমেন্ট সানশাইন অ্যাক্ট’ জারি করে, যার ফলে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কোন কোন ডাক্তারকে অর্থ দিয়েছে তা প্রকাশ করতে আইনত বাধ্য।
ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন
ডেটা সাংবাদিকতার সবচেয়ে প্রচলিত রূপ হলো ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন। পাঠকের সামনে রো-কলাম ভর্তি তথ্যের টেবিল প্রকাশ করলে তা সহজে বোধগম্য হবে না। এ কারণেই সাহায্য নিতে হয় ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের। গ্রাফ-চার্ট, ম্যাপ, ডায়াগ্রাম, ছবি, আইকনসহ নানা ধরনের ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট ব্যবহার করে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করা হয়।
‘R’-এর মতো প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার থেকে শুরু করে অ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটরের মতো ভেক্টর-বেজড গ্রাফিক্স সফটওয়্যার, এমনকি Tableau-এর মতো কেবল ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরির জন্য বিশেষায়িত সফটওয়্যারসহ নানা ধরনের কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করা হয়।
ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন স্ট্যাটিক বা স্থির হতে পারে, যেখানে কেবল ছবির মাধ্যমে ডেটাকে তুলে ধরা হয়। যেমন: ২০২৩ সালে তুরস্ক-সিরিয়ার বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান ‘ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট’ মার্কিন সরকারের ডেটাবেজে থাকা তথ্য ব্যবহার করে পাইথনম্যাপস সফটওয়্যারের মাধ্যমে ১৯৫৬ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে হওয়া ৪.৫ মাত্রার ওপরে হওয়া ভূমিকম্পগুলোকে বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরে। ভিজ্যুয়ালাইজেশনটি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, জাপানসহ অন্যান্য ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের ক্ষেত্রে অনেকসময় অ্যানিমেশনও ব্যবহার করা হয়। সাধারণত সময়ের সাথে সাথে কোনো পরিবর্তন বোঝানোর জন্য এই মাধ্যমের সহায়তা নেওয়া হয়। যেমন: হান্স রসলিং তার বিখ্যাত টেড টকে বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও ডেটা ব্যবহার করে তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন, দেখান কীভাবে বাংলাদেশসহ বেশ কিছু তৃতীয় বিশ্বের দেশে সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে গড় আয়ু বেড়েছে কিংবা ফার্টিলিটি রেট কমে গিয়েছে।
ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের আরেকটি ধরন ইন্টারঅ্যাকটিভ ভিজ্যুয়ালাইজেশন। এখানে পাঠক নিজের ইচ্ছানুযায়ী ডেটাকে আরও ভালোভাবে জানতে পারেন বা বিশ্লেষণ করতে পারেন। যেমন: ইনফরমেশন ইজ বিউটিফুল নামের একটি ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন প্রকাশকারী সংস্থা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডেটা চুরির ঘটনাগুলো নিয়ে একটি ইন্টারঅ্যাক্টিভ ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করেছে। এখানে সাল এবং ডেটা চুরির পরিমাণ হিসাব করে ঘটনাগুলো সাজানো হয়েছে। কোনো পাঠক যদি ২০২১ সালের ফেসবুক থেকে ডেটা চুরির ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান, তবে বাবলটিতে ক্লিক করলেই সে সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা সংবাদ প্রতিবেদনে পাঠককে নিয়ে যাওয়া হবে।
নিউজ অ্যাপ্লিকেশন
নিউজ অ্যাপ্লিকেশন ধরনের ডেটা সাংবাদিকতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় প্রোপাবলিকার প্রতিবেদনে। প্রোপাবলিকার বেশিরভাগ বড় বড় অনুসন্ধানী তদন্তকে প্রকাশ করা হয় এক বিশেষভাবে কাস্টমাইজড করা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে, যার মাধ্যমে পাঠক সহজেই অ্যানিমেশন/ইন্টারঅ্যাক্টিভসহ নানাভাবে পুরো অনুসন্ধানের আগাগোড়া জানতে পারে। প্রোপাবলিকা তাদের এই নিউজ অ্যাপগুলোর জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এ ধরনের প্রতিবেদন সাধারণত করে কোডাররা, যারা তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেছে কোডিংয়ের মাধ্যমে, এবং পরবর্তীতে সাংবাদিকে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা নিউজস্টোরি বলার জন্য মূলত কোডকে ব্যবহার করে, শব্দ নয়। তবে শব্দও যে একেবারে থাকে না, তা নয়। তবে সে কাজটি সাধারণত আরেকজন করে থাকেন।
যেমন: প্রোপাবলিকার ‘The Most Detailed Map of Cancer-Causing Industrial Air Pollution in the U.S.’ প্রতিবেদনটি এরকমই এক ডেটা সাংবাদিকতার উদাহরণ। সাংবাদিক-কোডাররা একত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে শিল্প-কারখানার ফলে বায়ু দূষণের হার কেমন, কোথায় কোথায় এই হার অত্যধিক তার একটি বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি করেছেন ম্যাপবক্স নামের একটি সফটওয়্যারের সাহায্যে। এর সাহায্যে পাঠক অনেকটা গুগল ম্যাপের মতো ‘জুম ইন-আউট’ করেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বায়ুদূষণের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবে।
ডেটা স্টোরি
অনেকেই কেবল এই ‘ডেটা স্টোরি’র ধরনকেই ডেটা সাংবাদিকতা বলে থাকেন, যেখানে ডেটা বিশ্লেষণ করে ডেটার ভেতর থেকে একটি পুরোদস্তুর নিউজ স্টোরি খুঁজে বের করেন, যা অন্য কোনোভাবে বের করা সম্ভব নয়। দ্য গার্ডিয়ানের ডেটাব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সাইমন রজার্স এ ধরনের সাংবাদিকতাকে মূলধারায় নিয়ে আসেন। এরপর ফাইভথার্টিএইট, ভক্স এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের আপশট এ ধরনের সাংবাদিকতাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো কাজ করলেও সবার কাজের ধরনের মূল বিষয় একটিই: পরিসংখ্যান আর ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠকের জন্য আকর্ষণীয় নিউজ স্টোরি খুঁজে বের করে আনা।
যেমন: দ্য গার্ডিয়ানের একটি নিউজ স্টোরি থেকে দেখা যায়, ২০২০ ইউরোর টুর্নামেন্ট চলাকালীন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়েরা শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের তুলনায় টুইটারে বেশি বর্ণবাদী হেট স্পিচের শিকার হয়েছেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের আপশট টিমের আরেকটি প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে, কীভাবে প্রতি পদে পদে বর্ণবাদের শিকার হওয়ার ফলে বাচ্চা জন্মদানের সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের মৃত্যুহার অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের পারিবারিক আয় বেশি থাকলেও হাসপাতালে বর্ণবাদের প্রভাব থাকায় তারা শ্বেতাঙ্গদের মতো ভালোভাবে যত্ন-চিকিৎসা পান না। দেখা যায়, কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ডাক্তারের অধীনেই কৃষ্ণাঙ্গ শিশু বেঁচে থাকার হার বেশি।
এগুলো ছাড়াও কৃষ্ণাঙ্গদের কমিউনিটিগুলোতে তুলনামূলক বেশি বায়ুদূষণ, কর্মক্ষেত্রে কম ছুটি পাওয়াসহ বিভিন্ন বর্ণবাদী কারণে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যার ফলে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গদের প্রায় দ্বিগুণ।
ইনভেস্টিগেটিং অ্যালগরিদম
ডেটা সাংবাদিকতার ফিল্ডে নতুন ধরনের আরেকটি ধরনের উৎপত্তি হয়েছে, যেটির লক্ষ্য কেবল প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয় সম্পর্কেই সাংবাদিকতা। নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকোয়ালস ডায়াকোপৌলোস এ ধরনকে নাম দিয়েছেন ‘অ্যালগরিদমিক অ্যাকাউন্টেবিলিটি।’ মূলত বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানির অ্যালগরিদমের ঝামেলা এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব খুঁজে বের করাই এর উদ্দেশ্য।
জুলিয়া অ্যাংউইন এবং জেফ লারসন নামের দুই সাংবাদিক প্রোপাবলিকা থেকে বের হয়ে ‘দ্য মার্কআপ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। অ্যাংউইনের দাবি অনুযায়ী, তারা এর মাধ্যমে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে তাদের মেশিন লার্নিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যালগরিদমের ফলে সমাজে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাকে চিহ্নিত করবেন এবং জবাবদিহিতা করতে বাধ্য করবেন।
যেমন: মার্কআপের একটি তদন্ত থেকে বেরিয়ে আসে কীভাবে গুগল, অ্যামাজন এবং অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলো তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত ডেটা থেকে তার পরিবারের অন্য তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যদের ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে।
এদিকে চার্লস বেরেট এবং শেরিল ফিলিপ্স তাদের ‘Teaching Data and Computational Journalism’ বইয়ে ডেটা সাংবাদিকতাকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন।
ডেটা রিপোর্টিং
ডেটা সংগ্রহ, ক্লিনিং এবং বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন নিউজ স্টোরি খুঁজে বের করাকে ডেটা রিপোর্টিং হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা। এক্ষেত্রে কম্পিউটার-অ্যাসিস্টেড রিপোর্টিং এবং প্রিসিশন জার্নালিজমের প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যবহার করে স্টোরি তৈরি করা হয়। ডেটাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করার জন্যও ম্যাপিং বা চার্টিং করা অথবা বিশ্লেষণের জন্য প্রোগ্রামিং করাকেও এর ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং ইন্টারঅ্যাক্টিভস
ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য কোডিং (এইচটিএমএল/সিএসএস/জাভাস্ক্রিপ্ট/জেকুয়েরি), প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ এবং ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট টুলস (মাইক্রোসফট অ্যাকসেস, মাইএসকিউএল) ব্যবহার করে ইন্টারঅ্যাক্টিভ নিউজ স্টোরি তৈরি করাকে এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ডেটা সাংবাদিকতার প্রথাগত সংজ্ঞার তুলনায় ভিন্ন হলেও ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং অ্যাপ ব্যবহার করেও নিউজস্টোরি পাঠকের সামনে তুলে ধরা যায়।
এমার্জিং জার্নালিস্টিক টেকনোলজি
ডেটা এবং প্রযুক্তিখাতের নতুন নতুন উদ্ভাবনকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো:
- ড্রোন সাংবাদিকতা
ড্রোন জার্নালিজম ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাট ওয়েইটের মতে, “ড্রোন সাংবাদিকতা হলো সংবাদের জন্য ড্রোন ব্যবহার করে ছবি, ভিডিও কিংবা ডেটা সংগ্রহ করা। সাধারণ ড্রোন ফটোগ্রাফি থেকে ড্রোন সাংবাদিকতাকে যেটি আলাদা করে সেটি হলো সাংবাদিকতার নৈতিক বিষয় এবং ড্রোন ব্যবহারের সময় এটি জনকল্যাণমূলক কী কাজে লাগবে তা মাথায় রাখা।” বিবিসি, সিএনএন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিবিএস নিউজসহ নানা প্রতিষ্ঠান সাংবাদিক্তয়ার কাজে ড্রোন ব্যবহার করে আসছে।
ড্রোন সাংবাদিকতার একটি চমৎকার উদাহরণ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের চেরনোবিল দুর্ঘটনা সম্পর্কিত প্রতিবেদন। তেজস্ক্রিয়তার কারণে পরিত্যক্ত চেরনোবিল ও প্রিপিয়াত শহরের বর্তমান অবস্থা ড্রোনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
- সেন্সর সাংবাদিকতা
বায়ুদূষণ, নড়াচড়া কিংবা শব্দের মাত্রাসহ নানা ধরনের অবস্থা পরিমাপ করার জন্য নানা ধরনের সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যারের সমন্বয়ে তৈরি সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কোনো পোর্টেবল কম্পিউটার কিংবা মাইক্রোকন্ট্রোলার ব্যবহার করে এগুলোর ডেটা সংগ্রহ করা হয়। ক্রেডিট কার্ডের আকারের র্যাসপবেরি পাই এমনি একধরনের কম্পিউটার, যাতে বিভিন্ন ছোট ছোট সেন্সর যুক্ত করা যায়। বর্তমানে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্সর সাংবাদিকতা পড়ানো হচ্ছে, যেখানে বাতাস কিংবা পানির গুণমান পরিমাপ করার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ দূষণ বিষয়ক নিউজস্টোরি তৈরি করা হয়।
যেমন: রেডিওল্যাব নামের একটি প্রতিষ্ঠান সেন্সর ব্যবহার করে শব্দ এবং তাপমাত্রা পরিমাপ করে পঙ্গপালের অস্তিত্ব বোঝার চেষ্টা করেছেন। তারা দেখতে পেয়েছেন পঙ্গপালের মিলনের সময় ৭ কিলোহার্জ শব্দ উৎপন্ন হয়। বাসায় তৈরি করা সাধারণ সেন্সর দিয়ে সাধারণ জনগণদের কাছ থেকে পাওয়া ডেটা থেকে তারা পঙ্গপালের বিচরণ কোথায় কোথায় বেড়েছে তার একটি ম্যাপ তৈরি করেছেন।
- ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সাংবাদিকতা
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) দীর্ঘদিন ধরেই প্রযুক্তি জগতে আলোড়ন তৈরি করবে বলে মনে হচ্ছিলো। অবশেষে স্যামসাং, ওকুলাস, গুগলের মতো কোম্পানিগুলো সাধারণ ভোক্তাদের জন্য ভিআর হেডসেট ও অন্যান্য কন্ট্রোলার নিয়ে এসেছে, যার মাধ্যমে শরীর ব্যবহার করে ভিন্ন অনুভূতি পাওয়া সম্ভব।
নিউ ইয়র্ক টাইমস, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস কিংবা পিবিএস পরীক্ষামূলকভাবে ভিআর ব্যবহার করে ৩৬০ ডিগ্রি ছবি/ভিডিও করা, অডিও যোগ করা, শ্রোতাদেরকে ঘটনার জায়গায় সশরীরে থাকার মতো অনুভূতি দেওয়ার চেষ্টা করলেও কীভাবে পুরো নিউজস্টোরি সাজানো হবে, শ্রোতারা কীভাবে ভিআর সংবাদের সাথে নিজেদেরকে সংযোগ ঘটাবেন, তা নিয়ে এখনো কাজ করছেন।
যেমন: নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘We Who Remain’ নামের একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রতিবেদন তৈরি করে, যার মাধ্যমে দর্শক ভিআর হেডসেট ব্যবহার করে সুদানের নুবা পর্বতমালায় চলা সুদান সরকার ও বিদ্রোহীদের চলমান সংঘর্ষকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার অনুভূতি লাভ করবে।
কম্পিউটেশনাল জার্নালিজম
অ্যালগরিদম, মেশিন লার্নিং এবং অন্যান্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাংবাদিকতা করাকেই কম্পিউটেশনাল জার্নালিজম হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা। ডেটা রিপোর্টিং এবং এমার্জিং টেকনোলজির বেশ কিছু বিষয়ের সাথেও এ ধরনের ডেটা সাংবাদিকতা ওভারল্যাপ করে।